রাতে ডিনারের পর সামান্য পড়াশোনা করেন সত্যব্রত। এ-তাঁর অনেককালের অভ্যাস। এর আগে যে-ব্লকে ছিলেন, সেখানে পেশেন্টের চাপ খুব বেশি ছিল। দিনরাত বলে আলাদা কিছু ছিল না। লেবার রুমের বেড খালি থাকত না কখনই। তার উপর রাতবিরেতে কেউ মদ খেয়ে মাথা ফাটিয়ে এসে হাজির হতো, কেউ আবার সন্দেহজনক আগুনে পোড়া শরীর নিয়ে হাজির হতো। পেশেন্টপার্টির ছিল মাথা গরম। ডাক্তার যেন ভগবান। চাইলেই সকলকে বাঁচিয়ে দিতে পারে, চাইলেই সকলকে মেরে ফেলতে পারে। এ-দেশে মানুষ এখন বুঝলো না যে, ডাক্তারি একটা বিজ্ঞান। ডাক্তারও কোনও গুনিন বা তন্ত্রসাধক নয় যে, মন্ত্র-তন্ত্র-তুক্তাক্-জলপড়া-তাবিজ-মাদুলি—এসব দিয়ে পেশেন্টকে সারিয়ে দিতে পারবে! লোকে কেন যে বোঝে না যদি, ওই সমস্ত বুজরুকেরা ওই তন্ত্র-মন্ত্র-মাদুলি-তাবিজ দিয়েই সব ভালো করে দিতে পারত, তাহলে সারা পৃথিবীতে আর হাসপাতাল, ডাক্তার, মেডিসিন ইত্যাদি কিছুরই দরকার হত না। অথচ লোকে সেটা বোঝে না। লোকাল ট্রেনে, সংবাদপত্রের পাতায়, এমনকি ইদানিং তো ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিতেও ওইসমস্ত ট্র্যাশ লেখায় তন্ত্রমন্ত্রের রমরমা। এ সবই সাধারণ মানুষের মনে অন্ধ বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। তারা ভাবে, মাত্র এক ঘন্টায় কালা জাদু দিয়েই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব, অতএব কেউ-কেউ পেশেন্টদের নিয়ে আগে সেখানে ছোটে। দক্ষিণা মাত্র তিনশো এক টাকা শুনে তাদের লোভও হয় যে, ও-টুকু টাকা খরচ করে যদি রোগী সুস্থ হয়ে যায়, তাহল কেনই বা হেলথ্ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া, কেনই বা মেডিসিন কিনতে গুচ্ছের টাকা খারচ করা! তারপর গিয়ে যখন ভণ্ড বাবাজি স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়, তখন তারা আবার এসে ভিড় করে ডাক্তারের কাছে। তখন তাদের দাবি কিন্তু বদলায় না। তারা ভাবে, ডাক্তার যখন হয়েছ, তখন রোগীকে ভালো করে তোমায় দিতেই হবে! নাহলে ভাঙচুর, মারধোর—যেন মগের মুলুক! সেদিক দিয়ে পিশাচপাহাড় হেলথ্ সেন্টার অবশ্য একেবারে যাকে বলে মিয়ানো! এর জন্য অবশ্য এলাকার লোকজনের চেয়েও বেশি কৃতিত্ব চার্চের হাসপাতালের। এই হেলথ্ সেন্টারিটি তৈরি হওয়ার অনেক আগে থেকেই চার্চ তাঁদের হাসপাতাল স্থাপন করে এলাকার মানুষের জীবনে অনেক বদল এনে দিয়েছিল। আগে সদরে পেশেন্টকে নিয়ে যেতে-যেতেই পথে অনেকে এক্সপায়ার করত। চার্চের হাসপাতালটি গড়ে ওঠার পর সেই হার অনেক কমেছে। সেই জন্যই এখানে এসে লেখাপড়া করার যে সুযোগটা সত্যব্রত পান, তা অন্য কোন হেলথ্সেন্টারে থাকলে যে পেতেন না, সে-ব্যাপারে তাঁর কোন সন্দেহ নেই।
এখানে তো সারাদিন হাতে গোনা পেশেন্ট আসে। তাও খুব সাধারণ কেস নিয়ে, ফলে সত্যব্রতর বিশেষ কিছুই করার থাকে না। তাও যারা আসে, তারা মূলত ফ্রি-মেডিসিনের লোভেই আসে। চার্চের মেডিক্যাল স্টোরে অনেকটা কম মূল্যে ওষুধ পাওয়া যায়, তবে সেক্ষেত্রে গাঁটের কড়ি কিছুটা হলেও খরচ করতে হয়, সেখানে হেলথসেন্টারে এলে সাধারণ ওষুধ, যেগুলি সরকার ফ্রিতে দেন, সেগুলির জন্য তাদের পয়সা খরচ করতে হয় না আর। সত্যব্রত অনেক লেখালেখি করছেন ওপরে যে, এখানে স্বল্পমূল্যের একটা মেডিসিন স্টোর যদি খোলা যায়, যেখানে চার্চের চেয়েও কম দামে জীবনদায়ী ঔষধ পাওয়া যাবে, তাহলে হয়তো হেলথ্ সেন্টারের রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু স্বাস্থ্যভবনও সম্ভবত চান না যে, হেলথ্সেন্টারগুলিতে ভির বাড়ুক এবং মানুষ স্বল্প কিংবা নামমাত্র মূল্যে জীবনদায়ী ঔষধ পাক, সে-কারণেই কোন মেইলের কোন প্রাপ্তিস্বীকার অবধি পান নি সত্যব্রত। কেবল তাঁর এই সব বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্যই সিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে দিনের পর দিন সদর হাসপাতালে না ট্রান্সফার করে, হেলথ্ সেন্টারগুলিতে পাঠানো হচ্ছে। অথচ তাঁর চেয়ে হদ্দ জুনিয়ার বহাল তবিয়তে কোনরকমে দু-তিন বছর হেলথ্সেন্টারে বুড়িছোঁয়া করে সদরে পাকাপাকি থানা গেড়েছে। সর্বত্র ঘুণ ধরা থাকলে কী আর করবেন তিনি একা? তুচ্ছ কিছু অসুবিধা ছাড়া হেলথ্সেন্টারে থাকার জন্য তিনি আক্ষেপ করেন না। প্রাইভেট প্র্যাকটিস তিনি করেন না কোনদিন, সদরে থাকলেও করতেন না। তবে নানা বিচিত্র কেস পেলে তাঁর মেডিক্যাল অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পেত, হয়তো রিসার্চটা শুরু করতে পারতেন, এই এক আক্ষেপ। না হলে তিনি এখানে মন্দ নেই। সহজ-সরল কিছু মানুষজনের সান্নিধ্যে-ভালোবাসায় কাটিয়ে যাচ্ছেন দিব্যি। যদিও তাঁর নিজের স্ত্রী-সন্তানদের সান্নিধ্য তিনি হারিয়েছেন। কেন যে মনোরমা বুঝল না! কেন যে সন্তানদের নিয়ে চলে গেল শহরে—কলকাতায়! কলকাতা যদি সব দিতে পারত, তাহলে তো সারা পশ্চিমবঙ্গ খালি করে সব লোক কলকাতায় গিয়ে বসে থাকত!
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৭: ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে মহর্ষি পেলেন চরম দুঃসংবাদ
খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছে আগেই। মনোরমা চলে যাওয়ার পরে এখনও ললিতা আসে। ঘরের কাজকর্ম করে দিয়ে যায় আর রান্নাটুকু। রাত্রের রান্না শেষ বিকেলে করে সে ঢাকা দিয়ে চলে যায়। রান্না তো ভারি। দুটি রুটি আর সামান্য সবজি দেওয়া ডাল, একটা কোন ভাজি, কখনো ডিমের ডালনা—যখন যেমন। রাতে খুব বেশি খাবার খাওয়ার অভ্যাস বহুকাল ছেড়েছেন সত্যব্রত। তারপরেও মাঝেমধ্যে খাওয়া হয়ে যায় অতিরিক্ত। তাঁর কোয়াটার্সে রেফ্রিজারেটর নেই। ফলে রান্না পড়ে থাকা মানে নষ্ট হয়ে যাওয়া। দিনের বেলার রান্না ললিতা দুজনের জন্য করে। তাতেও বেশি হয়ে যায়। সে-সব সে যাওয়ার সময় টিফিনক্যারিয়ারে নিয়ে যায়। রাতের রান্না যদি কোনসময় বেশি হয়, তখন সকালে এসে তা দিয়ে সে টিফিন করে। তবে সত্যব্রত বারণ করেন। বাসি রান্না আগে ঠিক আছে কি-না তা ভালো করে না দেখে খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু শুনলে তো? এই অঞ্চলের মানুষের কিছু নিজস্ব বিশ্বাস, নিজস্ব সিদ্ধান্ত আছে, হাজার মানা করলেও, এমনকি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও সেগুলির থেকে তারা বেরিয়ে আসতে নারাজ। বড় নার্সদিদি অর্থাৎ শেফালিকা বিশ্বাস একটা শব্দ ব্যবহার করেন, “গেঁতোমি”। অর্থাৎ জিদ ধরে বসে থাকা, ভুল জেনেও তাকেই আঁকড়ে ধরে থাকা এখানকার মানুষজনের স্বভাব। তা না হলে, কালাদেও নিয়ে এখনও এত অন্ধ বিশ্বাস পোষণ করে তারা?
কালাদেও-সংক্রান্ত মিথ এখানে এসে আগে শোনেননি। গতবছর দু-তিনটি ডেথ কেসে কালাদেওর নাম জড়িয়ে যায় এবং সেইসময়েই তিনি বিষয়টি জানতে পারেন। এই হেলথ্সেন্টারে মর্গ নেই কোন। কোন আনন্যাচারাল ডেথ হলে সদরেই পাঠাতে হয় ভিকটিমের বডি। তার রিপোর্ট সত্যব্রতর কাছে এসে পৌঁছায় না। সদরে যিনি মর্গের ডাক্তার, তাঁর সঙ্গে সত্যব্রতর তেমন পরিচয় নেই। তবে ফরেন্সিকের একজনকে চেনেন। কিন্তু তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। ফলে আজও জানতে পারেননি বুধনের ফরেন্সিক রিপোর্টে কী ছিল! অথচ জানাটা খুব জরুরি ছিল, কারণ, তা-হলে তাঁর অবর্জারভেশন কতটা সঠিক, তা বুঝতে পারতেন তিনি। একইভাবে সবক’টা আনন্যাচারাল ডেথকেসের ফরেন্সিক রিপোর্ট যদি পাওয়া যেত! তাহলে সত্যব্রত কোন একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন। একজন ডাক্তার হিসেবে তাঁর গতিবিধি নির্দিষ্ট, অধিকারের সীমানাও। পুলিশ যা পারে, তা তিনি চাইলেই তো আর পারবেন না! একবার ভাবলেন, শাক্যকে এ-ব্যাপারে অনুরোধ করবেন কি-না। অফিসারটিকে দেখে তাঁর বেশ ভালোই লেগেছে। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। ধীর-স্থির। এদিকে আবার ম্যাচোম্যানের মতো চেহারা। চাইলেই যিনি হতে পারতেন বলিউড হিরো, তিনি হয়েছেন কি-না লালবাজারের গোয়েন্দা! শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার নাম মনে এল—“কোথাকার ফুল কোথায় রেখেছ?”
কালাদেও-সংক্রান্ত মিথ এখানে এসে আগে শোনেননি। গতবছর দু-তিনটি ডেথ কেসে কালাদেওর নাম জড়িয়ে যায় এবং সেইসময়েই তিনি বিষয়টি জানতে পারেন। এই হেলথ্সেন্টারে মর্গ নেই কোন। কোন আনন্যাচারাল ডেথ হলে সদরেই পাঠাতে হয় ভিকটিমের বডি। তার রিপোর্ট সত্যব্রতর কাছে এসে পৌঁছায় না। সদরে যিনি মর্গের ডাক্তার, তাঁর সঙ্গে সত্যব্রতর তেমন পরিচয় নেই। তবে ফরেন্সিকের একজনকে চেনেন। কিন্তু তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। ফলে আজও জানতে পারেননি বুধনের ফরেন্সিক রিপোর্টে কী ছিল! অথচ জানাটা খুব জরুরি ছিল, কারণ, তা-হলে তাঁর অবর্জারভেশন কতটা সঠিক, তা বুঝতে পারতেন তিনি। একইভাবে সবক’টা আনন্যাচারাল ডেথকেসের ফরেন্সিক রিপোর্ট যদি পাওয়া যেত! তাহলে সত্যব্রত কোন একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন। একজন ডাক্তার হিসেবে তাঁর গতিবিধি নির্দিষ্ট, অধিকারের সীমানাও। পুলিশ যা পারে, তা তিনি চাইলেই তো আর পারবেন না! একবার ভাবলেন, শাক্যকে এ-ব্যাপারে অনুরোধ করবেন কি-না। অফিসারটিকে দেখে তাঁর বেশ ভালোই লেগেছে। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। ধীর-স্থির। এদিকে আবার ম্যাচোম্যানের মতো চেহারা। চাইলেই যিনি হতে পারতেন বলিউড হিরো, তিনি হয়েছেন কি-না লালবাজারের গোয়েন্দা! শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার নাম মনে এল—“কোথাকার ফুল কোথায় রেখেছ?”
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৮: রামানুজ ভরত ও লক্ষ্মণ, আনুগত্যের প্রকাশে দু’জনেই অনন্য
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক
বাইরে ঘুরঘুট্টি রাত থমথম করছে। কোথাও আজ অদ্ভুতভাবে ঝিঁঝি ডাকছে না কোন। সত্যব্রতর কোয়াটার্স একতলা বাড়ি একটা। জানালায় নেট লাগানো। নাহলে ভাম, বেড়াল এসব ঢুকে পড়ে। এদিকে মশার অত্যাচার তুলনায় কম। সম্ভবত ওয়াটারবডি কম থাকায় এটা হয়েছে। তবে একেবারেই নেই তা নয়। তাদের অবশ্য ওই নেটের ভিতর দিয়ে ঢুকতে অসুবিধা নেই। সত্যব্রতর নিজের নেট-লাগানো জানালা ভালো লাগে না। কিন্তু উপায় নেই। এই নেট তিনি লাগাননি। আগের কোন ডাক্তার লাগিয়েছিলেন। সেই থেকে রয়ে গিয়েছে। জানালায় মোটা লোহার শিক লাগানো। নেট লাগানো জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে অসুবিধা হয়, কেমন যেন জেলে বসে আছি, জেলে বসে আছি বলে মনে হয়—এজন্যই সত্যব্রতর ভালো লাগে না একেবারেই। মাঝেমধ্যে জানালার শিক ধরে তিনি অন্ধকার রাতের পিশাচপাহাড়ের রূপ দেখার চেষ্টা করেন। কোয়াটার্সের পিছন দিকে কিছুটা বাদ দিয়ে কলার ঝাড়, পেয়ারা, আম, কাঁঠাল ইত্যাদির গাছ। পিছনে কুঁয়ো আছে একটা, তার পাড় শানবাঁধানো। সেখান থেকেই পাম্পে করে জল তোলা হয় কোয়াটার্সের ছাদের ওপরের জলের ট্যাঙ্কে। অনেক সময় বালতিতে জল তুলেও ললিতা বাসন মাজে কুঁয়োপাড়ে বসে। তার পরেই গাছপালা। তাদের মাথার উপরে তারার ঝিকিমিকি ভরা একখানা চাঁদোয়া ঝোলে। তার ওপারে বাউণ্ডারি ওয়াল। তার ওপাশে কিছুটা ক্ষেতখামার, তারপরেই জঙ্গলের শুরু। জঙ্গলের গা-ঘেঁষে আদিবাসীদের একখানা ছোট মহল্লা। গোবিন্দরা ওই মহল্লাতেই থাকে। কখন কখন তাদের মহল্লা থেকে নাচ-গানের আওয়াজ ভেসে আসে। অন্যদিন কখন মধ্যেরাতে পেঁচার ডাক, কখন নাম-না-জানা আওয়াজ ভেসে আসে। যেদিন গরমের পর হাওয়া দেয়, অরণ্য থেকে হাওয়ার জড়িয়ে ভেসে আসে বুনো ফুলের গন্ধ। কেমন মনে হয় সত্যব্রতর, যেন তিনি পৃথিবীতে নয়, অন্য কোথাও অন্য কোনও এক ভুবনে রয়েছেন। সেখানে সবকিছুই অপার্থিব, অথচ সুন্দর!
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮১: ইষ্টদেবীরূপে মা সারদা
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৬: ‘রাজর্ষি’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘বিসর্জন’ নাটক
আজ অবশ্য হাওয়া বইছে না তেমন। মাঝেমধ্যে যেটুকু হাওয়া আসছে জানালা দিয়ে তাতে অবশ্য হালকা গা শিরশির করে। পড়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে জানালায় দাঁড়ালেন। অনেক রাত এখন। দেড়টা বাজে প্রায়। মাঝেমধ্যে এক-এক রাত ঘুম আসে না। অনেক কথা মনে হয়। কখন কখন একাকিত্বও গ্রাস করে। কখন আবার কোন বিষয় মাথার মধ্যে ঢুকে ঘুরঘুর করতে থাকে, কিছুতেই বেরোতে চায় না। আজও তেমন একটা দিন। শাক্য আর থানার সেকেন্ড অফিসার সুদীপ্ত এসে বুধনকে নিয়ে কথাবার্তা বলার পর থেকেই বুধন, কালাদেও আরও নানা কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজস্ব কৌতূহল থেকেই তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন বুধনের কেসে। তাঁকে কেউ জড়িয়ে পড়তে বলেননি। এই সূত্রেই চার্চে গিয়েছিলেন ফাদারের সঙ্গে কথা বলতে। সেইখানে দেখা হয়ে যায় সাইকেল মাহাত আর নুনিয়ার সঙ্গে। নুনিয়াকে তিনি চিনেছেন অল্প কিছুদিন হল। ললিতাই বলেছিল, তার দুর্ভাগ্যজনক জীবনের কথা। মনোরমার সঙ্গে নুনিয়ার প্রথম সাক্ষাৎ সুখকর ছিল না। পরে অবশ্য মেয়েটি কোন বিশ্বাসে তাকে একটা কুড়ানো মোবাইল রাখতে দিয়েছিল তা জানেন না তিনি। শাক্যকে বলবেন বলবেন ভেবেও বলতে পারেন নি। সুদীপ্তর সামনে মোবাইলের কথা বলা ঠিক হবে কি-না সেই ধন্দেই কথাটা তোলেন নি তিনি। কিন্তু মোবাইলটা হস্তান্তর করতেই হবে তাঁকে। কারণ, তাঁর পক্ষে ওই মোবাইলে কী আছে তা বার করা অসম্ভব। চার্চ থেকে ফেরার সময়ের অভিজ্ঞতা তাঁর মনে আছে এখন। ফেরার পথে যা বিপদে পড়েছিলেন! আচ্ছা, নুনিয়া বহুদিন হল আসেনি এখানে। তবে সে না থাকলে লালবাজারের ওই গোয়েন্দা ভদ্রলোক শাক্য এবং তাঁর বন্ধু আর-এক গোয়েন্দা পাভেল হয়তো সেদিন বেঁচে ফিরতেন না। পাভেলকে যে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে তা নুনিয়ারই প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে। না হলে হয়ত রক্তক্ষরণেই মারা যেতেন পাভেল। আর শাক্যর পক্ষেও সারারাত জঙ্গলে কাটানো অসম্ভব ছিল। জঙ্গল যেমন বাইরে থেকে সুন্দর, তেমনই তার গর্ভে থাকে অনেক আপাত অসুন্দর, বিপদ-আপদ। অনভিজ্ঞের পক্ষে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া খুব সহজ নয়। শাক্যের মতো জঙ্গল বিষয়ে আনাড়ির পক্ষেও উদ্ধার পাওয়া কতখানি সম্ভব ছিল, তা বলা অসম্ভব। তাছাড়া যারা জঙ্গলে তাদের ঘাঁটি তৈরি করেছিল, তারা যখন টের পেত যে শাক্য জঙ্গলের মধ্যেই আটকে আছেন, তাহলে তারা আর শাক্যকে জীবিত ফিরতে দিত না। হয়তো বুধনের মতোই মাথা কেটে ফেলে রেখে যেত, ধড়টা হাওয়া করে দিয়ে। তারপর রটত আবার কালাদেওর কবলে নামক মিথ!
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া
হঠাৎ অন্ধকারে ‘ঝুপ্’ করে শব্দ হল। তারপরেই দূরে কলাগাছের ঝাড়টা হঠাৎ যেন দুলে উঠল। কিছু একটা যেন কলাগাছের ঝাড়ের পিছন থেকে দৌড়ে গিয়ে আত্মগোপন করল পেয়ারাগাছের গুঁড়ির পিছনে। পেয়ারাগাছের গুঁড়ি আর কত মোটা হবে। যে লুকিয়ে আছে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে! কোন আততায়ী কি? সত্যব্রত চেঁচাতে গিয়েও চেঁচাতে পারলেন না। যদি গুলিটুলি চালিয়ে দেয়। ওরা হয়ত লক্ষ্য করেছিল যে আজ শাক্য ও সুদীপ্ত দুজনেই এসেছিলেন তাঁর কাছে। অতএব ওরা ভয় পাচ্ছে। তারাই কি কাউকে পাঠিয়েছে তাঁকে নিকেশ করে দেওয়ার জন্য? সন্দেহ নেই, নিজের কৃতকর্মের জন্যই অনেক শত্রু তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। চেয়েছিলেন নির্বিরোধী জীবন কাটাতে, কিন্তু অনন্ত কৌতূহল তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি। অতএব তারাই হয়ত কালান্তক মৃত্যুর রূপে দুয়ারে হাজির! কিংবা এ-কি সেই মিথের মৃত্যুদূত কালাদেও? তাকে উপহাস-অস্বীকার করেছেন বলেই হয়তো সে এসেছে বদলা নিতে? তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে-কি আর উত্তর দেবে? কালাদেওর কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয়, তার উত্তর মানেই হল মৃত্যু। তাহলে? জিজ্ঞাসা করবেন, না-কি করবেন না ভেবে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লেন সত্যব্রত। তারপর নিজেকে নিজেই বোঝালেন, শক্ত করলেন। ভয়কে সঙ্গে নিয়ে বাঁচার চেয়ে মৃত্যুই ভালো। অতএব যতখানি সাহস বুকে জড়ো করা যায়, ততখানি সাহস বুকে ভরে তিনি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে? কে ওখানে?” ? —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।