রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

শাক্য অন্ধের মতো নুনিয়াকে অনুসরণ করছিল। কিছু করারও নেই। এই জঙ্গল তার কাছে নেহাতই অপরিচিত। এ ভাবে তার চলে আসা উচিত হয়নি, আবার না এসেও তো পারত না সে। কিন্তু আফসোস একটাই, অল্পের জন্য ধরতে চেয়েও ধরতে পারল না। তবে সে মনে করে, পৃথিবীতে কোনও ঘটনাই সম্পূর্ণ নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ নিয়ে আসে না। প্রতিটি ঘটনার ভালো-খারাপ দু’টি দিক আছে। কোনও একটি দিককেই আমরা হাইলাইট করি বলেই সমস্যা তৈরি হয়।

আজকের ঘটনাও তেমন। রহস্যজনক সন্দেহভাজনের পিছন-পিছন দৌড়ে তাকে ধরতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু অন্য লাভ হয়েছে। সে লাভ আর কিছু নয়, নুনিয়ার মতো একজন রহস্যময়ীর সঙ্গে দেখা হওয়া। অনেক ছোটবেলায় বাবার বইপত্রের মধ্যে থেকে এক সেট বঙ্কিম-রচনাবলী নিয়ে ‘কপালকুণ্ডলা’ পড়ে ফেলেছিল সে। কতই বা বয়স তখন। কিন্তু এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায় এমন উপন্যাস। সেই ভালো লাগার রেশ এখনও আছে। আজ জঙ্গলে পথ হারিয়ে যখন সে বিভ্রান্ত-বিপর্যস্ত, ঠিক তখনই কপালকুণ্ডলার মতোই নুনিয়া হাজির হয়ে এসে যেন তাকে বলল, “আইস, আমি পথ দেখাইয়া দিতেছি!” এ-এক অদ্ভুত সমাপতন!
পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে দেখল সে। নাহ্, টাওয়ার নেই। এই ঘন জঙ্গলের ভিতর তাওয়ার থাকলেই অবাক হত সে। আসার পথে কাছেপিঠে কোনও টাওয়ার-পয়েন্ট দেখেনি সে। লোকালয় নেই বললেই চলে এই দিকে, সেই কারণেই হয়তো কোম্পানিগুলি টাওয়ার-পয়েন্ট বসানো নিয়ে মাথাও ঘামায়নি। সে আসলে ফোন করতে চাইছিল পাভেলকে। তার পিছন পিছনই তো দৌড়ে আসছিল সে। কিন্তু মাঝপথে নিশ্চয়ই আর অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। আজকাল শরীরচর্চা করে না বলে পাভেলের ফিটনেস কমে গিয়েছে। পেটের কাছে মেদ জমেছে, যেটা এদেশের অধিকাংশ পুলিশের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। অনেকবার পাভেলকে বলেছে সে, তার সঙ্গে অন্তত কিছু ফ্রিহ্যাণ্ড করতে। কিন্তু পাভেল ফ্রিহ্যান্ডও করবে, আবার তার পরেই এগ-চিকেন রোল কিংবা চকোলেট-বার খাবে। ফলে শাক্য ক্ষান্ত দিয়েছে এই মহৎ কর্মের থেকে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৪: লোকশিক্ষক মা সারদা

আজকাল পাভেল সে-কারণেই অল্পতেই হাঁফিয়ে যায়। কিন্তু সে জঙ্গল থেকে বেরুতে পেরেছে কি? সামনের দিকে লক্ষ্য রেখে ছুটছিল বলে একটা সময়ের পর আর তার পক্ষে দেখে নেওয়া সম্ভব হয়নি যে, পাভেল তার পিছন-পিছন আসছে কি-না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পাভেলও যদি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলে? তখনও কি এই নুনিয়া বাঁচাবে?
“নুনিয়া!” শাক্য ডাকল হঠাৎ।
নুনিয়া শুনে ঘাড় ঘোরালো কেবল, সাড়া দিল না।
“নুনিয়া, তুমি কী আমার পিছন-পিছন কাউকে আসতে দেখেছ?”
আবারও ঘাড় ঘোরাল সে, কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
“কী হল নুনিয়া, তুমি কোন কথা বলছ না কেন?”
এতক্ষণে নুনিয়া জবাব দিল, “কী বলব?”
“ওই যে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কী আমার পিছন-পিছন কাউকে দৌড়াতে দেখেছ?”
“হ্যাঁ, একজন দৌড়াচ্ছিল তো! সে কোথায়?”
“আমি তো সেই কথাই তোমাকে বলতে চাইছি, সে কোথায়?”
“আমি তাকে আগে দেখেছিলাম এক-ঝলক। কিন্তু তারপর তো দেখিনি! সে কে?”
একটু থতমতো খেল শাক্য। তারপর কোনরকমে বললা, “সে আমার বন্ধু হয়। আমরা একই পুলিশবিভাগে চাকরি করি।”
“ওহ্! তোমরা তবে পুলিশ?”
“হ্যাঁ। কেন সন্দেহ আছে?”
“না না, এমনি জানতে চাইছিলাম। যে-আসছিল তোমার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও কি পুলিশ?”
“হ্যাঁ।”
“তোমরা এই জঙ্গলে এসেছিলে কেন? ইনভেস্টিগেট করতে?” জিজ্ঞাসু মুখে নুনিয়া তাকাল শাক্যর দিকে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৩: জোর কা ঝটকা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী

নুনিয়ার মুখে নিখুঁত উচ্চারণে ‘ইনভেস্টিগেট’ শব্দটা শুনে অবাক হয়ে গেল শাক্য। তার মানে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো এই মেয়েটি লেখাপড়াও করে! তা-না-হলে ইনভেস্টিগেট না-বলে তদন্ত বা ওই-জাতীয় কিছু বলত। শাক্য বলল, ওই বলতে পারো আর কী!”
“কীসের তদন্ত?”
“ও তুমি বুঝবে না। কালাদেওর অভিশাপ সকলে বলছে!”
“তাতে না-বোঝার কী আছে? কালাদেওর হাতে বেশ কয়েকজন মারা পড়েছে বলে চারদিকে সকলে বলছে। এ-অঞ্চলের সব্বাই জানে। এভরিওয়ান ইজ টকিং অ্যাবাউট ইট দিজ ডেজ্!”
বিস্ময়ে শাক্যর মুখ হাঁ হয়ে গেল। এই নুনিয়াকে কাল্টিভেট করতে হবে তো? মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমান, সপ্রতিভ এবং শিক্ষিত। কিন্তু সে এখানে এই জঙ্গলের মধ্যে কী করছিল?
“নুনিয়া, তুমি এই জঙ্গলের মধ্যে কী করছিলে?”
“আমি জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি। সেটাই করছিলাম। কেন ? জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো অপরাধ না-কি?”
“না, তা নয়। প্রোটেকটেড জঙ্গলে উইদাউট পারমিশন ঘুরে বেড়ানো ইল্লিগাল হলেও এই জঙ্গলে তা নয়। কিন্তু জঙ্গলে অনেক বিপদ-আপদ থাকে। সাপ-বিছে-ভাল্লুক-বুনো হাতি… এই সব আর-কী!”
“এই জঙ্গলে সাপ-কাঁকড়া-বিছে আছে। কিন্তু বিয়ার বা ওয়াইল্ড অ্যানিমেল নেই। আগে ছিল শুনেছি। তখন জঙ্গলটাই কত বড় আর ঘন ছিল। মানুষ সব শেষ করে দিয়েছে। মানুষ সবচেয়ে ডেঞ্জারাস এনিমেল!”
কথাটা শাক্যও বিশ্বাস করে। সে বলল, “ঠিক বলেছ!”
“আচ্ছা, তোমরা পুলিশরাও কি ভাবো, এ-সব কালাদেও করেছে?”
“সকলে তো তেমনই বলছে!”
“সকলের কথা বাদ দাও। তোমরাও কি তেমনটাই ভাবো?”
“আমাদের ভাবনায় কী-যায়-আসে? আমরা কেবল কালাদেও যে লম্বা-চওড়ায় বিশাল, সে কথা শুনেছি।’’
“তোমার মতো?”
“আমার চেয়েও হাজার গুণ বেশি লম্বা ও চওড়া অনেকেই আছে নুনিয়া!”
“দেখ, অন্য কেউও তো কাজতা করতে পারে! করে কালাদেওর নামে চালিয়ে দিতে পারে। কারুর নামে মিথ্যে ব্লেম দেওয়াটা কিন্তু খুব কঠিন নয়।”
“হ্যাঁ, সেটা ঠিক। সবকিছুই তদন্তসাপেক্ষ!”
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না

জঙ্গলে জায়গায়-জায়গায় আলো কম। বড়-বড় গাছের আস্তরণ ভেদ করে সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছয়নি। তার মধ্যেই যেখানে যেখানে আলো পড়েছে, ঝোপেঝাড়ে এই শেষ বসন্তে নানা রঙের ফুল ফুটে আলো হয়ে আছে। অন্য জায়গায় ফার্ণ, অনন্তমূল এবং আরও নাম-না-জানা নানা গাছের সমারোহ। পাখপাখালির আওয়াজ ভেসে আসছে মাঝেমধ্যে। রঙিন প্রজাপতিদের ব্যস্তসমস্ত ওড়াউড়িও দেখল সে। এত সুন্দর পবিত্র একটা পৃথিবীকে মানুষ সত্যিই কী নিদারুণ রক্তপাত, হিংস্রতায় আবিল করে তুলেছে, ভাবলে কষ্ট হয় তার। যদি মানুষ ষড়রিপুর দাস না-হতো তাহলে এই পুলিশ-বিভাগের প্রয়োজন হত না। নুনিয়া ঠিক বলেছে। সত্যিই মানুষের চেয়ে নিষ্ঠুর, অমানবিক আর হিংস্র পশু আর নেই!
নুনিয়া তাকে চুপ করে যেতে দেখে একটু থমকেছিল। শাক্য সামান্য থেমে এদিক-ওদিক দেখছিল তখন। নুনিয়া তাকে জিজ্ঞাসা করল, “কী হল? থামলে কেন? এখনও বাকি আছে। তাড়াতাড়ি চল!”
“হ্যাঁ। চল!”
নুনিয়া হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, তুমি ভালো পুলিশ না-কি খারাপ পুলিশ?”
“ভালো পুলিশ-খারাপ পুলিশ ?” অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল শাক্য, “মানে?”
“এই ধর যে-পুলিশেরা কেউ অপরাধ করেছে দেখেও তার সঙ্গে হেসে-হেসে কথা বলে, খাতির করে, তাকে ছেড়ে দেয়, তারা পুলিশ হলেও ভালো নয়। আবার যারা কারুর কথা মানে না, অপরাধীকে ধরে নিজেদের জিম্মায় নেয়, কাউকে ভয় পায় না, সবসময় যারা অত্যাচারিত, তাদের পাশে থাকে, তারা তো ভালো পুলিশ তাই না?”
“বেশ বলেছ তো? তা এখানে কি তেমন কেউ আছে ? ভালো পুলিশ কিংবা খারাপ পুলিশ?”
নুনিয়া বলল, “সেটা তুমি খুঁজে বার করতে না-পারলে আমি বলে দেব তখন!”
“আচ্ছা। তাড়াতাড়ি বল। আমার জানা দরকার !”
‘আগে বুঝি তুমি ভালো পুলিশ, খারাপ পুলিশদের মতো নয়, তারপর বলব!”
“বেশ!”
“আচ্ছা, আমার যদি কখনও কিছু হয়, তুমি অপরাধীদের গ্রেপ্তার করবে?” নুনিয়া হঠাৎ অদ্ভুত প্রশ্নটা করল।
“মানে? তোমার আবার কী হবে?”
“কেউ মেরে ফেলতে পারে আমায়। কিংবা ধর অন্য কোথাও পাচার করে দিল চিরকালের মতো। আমাকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না। এখানে কেউ আর কোনদিন দেখতেই পেল না! তখন?”
“নুনিয়া! কারা মেরে ফেলবে তোমায়?”
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

নুনিয়া সে-কথার জবাব দিল না। আচমকা ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে তাকে কথা বলতে নিষেধ করল। তারপর তরতর করে একটা লম্বা গাছে এমন অবলীলায় উঠে গেল, যেন সেটা কিছুই না। উপরে উঠে সে যেন কী দেখছিল।

শাক্য অবাক হয়ে গেল। মেয়েটির কি মাথা খারাপ না কি? তাহলে তো তাকে বিশ্বাস করে তার পিছু পিছু এতদূর আসাটা উচিত হয়নি একদমই! সে নুনিয়াকে ডাকতে যাবে, এমন সময় নুনিয়া নিজেই নেমে এল। তারপর তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “চুপচাপ আমার পিছন-পিছন এসো। মনে হচ্ছে কোন বিপদ হয়েছে। তোমার বন্ধুর পোশাকের মতো দেখলাম যেন ওইদিকে। রাজার টিলা আছে যেখানে!” বলে এগিয়ে গেল।

শাক্য প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে একরাশ কৌতূহল নিয়ে তাকে অনুসরণ করল।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content