
ছবি: প্রতীকী।
ঠিক এখন চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে ছিপছিপে তন্বী মেয়েটিকে দেখে আচমকা কেমন যেন একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করলো অমলেন্দু! লেভেল ক্রসিংটা এসে যাচ্ছে! লেভেল ক্রসিং টপকালেই প্রতিমা হারিয়ে যাবে! অমলেন্দু কি প্রতিমাকে হারিয়ে ফেলবে চিরকালের মতো! নাকি মিথ্যে দিয়ে অতীতের অস্বস্তিকর অধ্যায়কে চাপা না দিয়ে যে মেয়ে সহজভাবে স্বীকার করতে পারে— ‘সেটা দূর্ঘটনা! একসময়ের ভুল ছিল’। তাকে বিশ্বাস করা যায়? সে স্বীকার করেছে যে সেই অন্যায় সম্পর্ক থেকে সরে আসতে চেষ্টা করছে সে। তাই অমলেন্দুর সঙ্গে বিয়েতে মত দিয়েছে! অমলেন্দু তো জিজ্ঞেস করেনি তার কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল কিনা? তাই বিয়েতে মত আছে কিনা সেটা জানাতে গিয়ে অতীতের সম্পর্কের উল্লেখ করাটা কোন কাজের কথা নয়!
এ সব ভাবতে ভাবতেই লেভেল ক্রসিং-এর কাছাকাছি এসে যাওয়া প্রতিমা দূরে মিলিয়ে গেল! ট্রেনের জানলা দিয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে ফিরে শেষবারের মতো দেখার চেষ্টা করল অমলেন্দু! দেখা গেল না! কিন্তু এই মেয়েটিকে সকালসন্ধ্যা আজীবন নিজের সঙ্গে পেতে সে পারে! ইচ্ছে করলেই পারে! ইচ্ছে করাটা সম্পূর্ণ তার নিজের সিদ্ধান্ত। দোষ আমরা সকলেই করি! ছোটবড় মাঝারিমাপের আঁকাবাঁকা চোরানজরের অসংখ্য অগণিত দোষ। তার অধিকাংশটাই গভীরগোপনে চাপা থাকে! একা একা আয়নার সামনে দাঁড়ালে প্রতিফলন দেখতে গিয়ে সেই সব দোষের কথা মনে পড়ে যায়। সেসব প্রকাশ না হওয়া ভ্যাপসা ভেপনো-ফুটে যাওয়া ছোটখাটো দোষেরা আজীবন চাপা থেকে যায় – নিজে প্রকাশ না করলে সময়-সম্পর্ক-ব্যক্তিত্বের চামড়া-মাংস খুঁড়ে কারও পক্ষেই সে সব ছুটকো-ছাটকা টুকরো দোষ দিনের আলোর সামনে এনে ফেলা সম্ভব নয়।একটা মানুষের করা অসংখ্য দোষ তার মৃত্যুর পরে, হয় আগুনে জ্বলে যায়, নয় সর্বংসহা মাটিতে মিলিয়ে যায়…
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৯: সারদা মায়ের রোগ নিরাময়ের প্রচেষ্টা

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, হ্যালো বাবু! পর্ব-৮৩: অনুসরণ/৪
গৃহী সন্ন্যাসী সকলেরই একটা নিজস্ব গোপনীয়তা থাকে। সেটাকে অপরের সামনে প্রকাশ করবার ক্ষমতা যার থাকবে তাকে শ্রদ্ধা করা উচিত। হতে পারে এই চিঠিটা অমলেন্দুর হাতে না পড়লে প্রতিমা কিছুই স্বীকার করতো না। এখন স্বীকার না করে তার উপায় নেই। পরিস্থিতিটা সামলাতে প্রতিমা একটা ঝুঁকি নিয়েছে। সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে সে এই সম্পর্কটাকে জীবনের প্রথমদিকে করা একটা ভুলের মতোই মনে করে। সে মনে করে এই সম্পর্কটা ন্যায়সঙ্গত ছিল না, এটা অন্যায়, অবৈধ। তাই সে এই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে জীবনটাকে গড়তে চাইছে। এবার বল অমলেন্দুর কোর্টে। প্রতিমা নিখুঁত দক্ষতায় অমলেন্দুর চাবুকের মতো সার্ভিসটা ফিরিয়ে দিয়েছে। প্রতিমা কি লনটেনিস দেখে? দশটা-পাঁচটা টিফিনবক্স সঙ্গে নিয়ে বিবাদীবাগে অফিস করতে যাওয়া অমলেন্দু সাধারণ হলেও টেনিস দেখতে খুব পছন্দ করে! না, অন্য অনেক পুরুষের মত সানিয়া মির্জাকে দেখতে টেনিসপ্রেমী হয়ে ওঠেনি অমলেন্দু!
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৭: রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টার হতে চেয়েছিলেন

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৮: হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে চূড়ার কাছাকাছি গিয়ে পাহাড় দেখার রোমাঞ্চটাই আলাদা
এ বার অমলেন্দু কি করবে? প্রতিমার পাঠানো রিটার্ন শটটা ভয়ংকরভাবে বাঁক নিয়ে সাইডলাইনের বাইরের দিকে আসছে। অমলেন্দু যদি র্যাকেট সরিয়ে নিয়ে বলটা ছেড়ে দেয় তাহলে পয়েন্ট পাবে! আবার যদি তার জাজমেন্টে ভুল হয়ে যায় বলটা যদি লাইনের ওপরে এসে ড্রপ পড়ে তাহলে অমলেন্দুর হার। অমলেন্দুর বিবেচনার হার। এতসবকিছুর পরেও যদি সে প্রতিমাকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে হতে পারে অমলেন্দু আজীবন একটা সুখী দাম্পত্য পাবে! আবার সেজো মামার মত সিদ্ধান্তটা যদি ভুল হয়ে যায়! তাহলে তো নিজের জীবনটা নষ্ট হবে নিজের সম্মানটা ধুলোয় মিশে যাবে লোকজনের কাছে ঠাট্টার পাত্র হয়ে পড়বে অমলেন্দু পাল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৯: সময় বুঝে প্রত্যাঘাতের জন্য রাজনীতিতে অনেক সময় পিছিয়েও দাঁড়াতে হয়

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১৫: অগ্নির কি শুধুই দহনজ্বলা? মহর্ষি মন্দপালের অগ্নিস্তুতিতে অগ্নির কোন সদর্থকতার ইঙ্গিত?
ট্রেনের হর্ন শুনে নিজস্ব চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এল অমলেন্দু। হাওড়ায় ঢোকার খানিক আগে সিগন্যালে আটকে গেছে ট্রেন! হয়তো নির্ধারিত প্ল্যাটফর্ম খালি নেই! ট্রেন আসার প্ল্যাটফর্মের মতো মানুষের জীবনে নতুনমানুষ আসাও কি পূর্বনির্ধারিত? বিয়ে নিয়ে একটা কথা চালু “Marriage makes in heaven”। যদিও অনেক জ্ঞানীগুণী লোক বলেন বাইবেলে এই কথার ব্যাখা অন্যরকম। সেখানে যীশুখ্রীষ্টের সঙ্গে তাঁর চার্চের ওতপ্রোত সংযোগকেই বিবাহের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২৩: বন্ধু হে আমার…

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১০১: ছিট ঘুঘু
জ্ঞানীমানুষরা যাই বলুন আমজনতা এটাই মনে করেন যে বিয়ের সঙ্গে একটা স্বর্গীয় যোগাযোগ আছে। তাই অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর পাশের পাড়াতেই মেয়ের সম্বন্ধ পাওয়া যায়। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে প্রতিমার সঙ্গে অমলেন্দুর যোগাযোগটাও হয়তো পূর্বনির্ধারিত। না হলে হয়ত এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটতই না। আর অমলেন্দু প্রতিমার সহজভাবে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতাটাও জানতে পারত না। মেয়েটাকে যে তার ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছে সে কথা নিজের কাছে সে লুকোয় কি করে? এই দ্বিতীয়বার শ্রীরামপুরে এসে চলন্তট্রেনের জানলা থেকে প্রতিমাকে দেখে আর অমলেন্দু নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারছে না। পকেট থেকে সেই চিঠিটা বের করে প্রথমে কুঁচিকুঁচি করে ছিঁড়ল। তারপর একটু একটু করে মুঠোর থেকে হাওয়ায় ছেড়ে দিলো কাগজের টুকরোগুলো সামনে-বসা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে অমলেন্দুর দিকে তাকাতে অমলেন্দু হাসিমুখে উত্তর দিল—
—বাজে কাগজ! জঞ্জাল!
নির্দিষ্ট দিনে লগ্ন দেখে অমলেন্দু পাল-এর ঘরণী হলো প্রতিমা!
—বাজে কাগজ! জঞ্জাল!
নির্দিষ্ট দিনে লগ্ন দেখে অমলেন্দু পাল-এর ঘরণী হলো প্রতিমা!
অমলেন্দু পাল মৃত্যুরহস্য। পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।