সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

অঞ্জনকে রাগতে দেখে অরণ্য একটু থমকে গেল। কথাটা খুব কটু ভাবে বলা হয়ে গেল না কি? ভাবল সে। তারপরেই মজা পেল। কথাটা সে কেন বলেছে নিজেই জানে না। নেহাত বলে ফেলা একটা কথা। এতে এত প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠার কী আছে, তা সে বুঝল না। হাসিই পেল তার। এখানে এসে গত দু’ দিন ধরে এমন সব অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার ঘটে চলেছে যে, সকলেই স্বাভাবিকভাবে ভাবতে ভুলে গিয়েছে। সে অঞ্জনকে বলল, “আরে তুমি রাগ করছ কেন? আমি কোন কিছু ভেবে কথাটা বলিনি। এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম।”
“না, রাগের কথা না। তুমি এমন করে হঠাৎ কথাটা বললে যে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। বুঝতেই পারছ, যা ঘটে চলেছে ক’দিন ধরে, তাতে আমরা যে এখনও পাগল হয়ে যাইনি, সেটাই অনেক! যাই হোক্‌, স্যরি। আমার ওভাবে রিঅ্যাক্ট করা উচিৎ হয়নি।” অঞ্জন বলল। তার চোখে-মুখে যদিও দুঃখিত হওয়ার মতো কিছু লক্ষণ দেখতে পেল না অরণ্য। বরং ক্রোধের গনগনে একটা আগুন তখনও তার মুখে-চোখে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল।
“ঠিক আছে। বুঝতেই পারছি। গত কয়েকদিন ধরে যা চলছে, আমরা সকলেই বিভ্রান্ত। কেবলই একে অন্যকে সন্দেহ করছি। এটা আমাদের সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলছে!”
“হ্যাঁ, সত্যিই তা-ই। এই পরিস্থিতির চাপে পড়ে উন্মেষাও যেন কেমন একটা বিহেভ করছে! ও কিছুতেই আর এখানে থাকতে রাজি নয়। কিন্তু আমরা কী করতে পারি? আমি হয়তো ক’দিন দেখে কলকাতায় আমার উপরমহলে যে চেনাজানা আছে, সেখানে ফোনটোন করতে পারি। কিন্তু তাতে কতটা লাভ হবে তা তো জানি না। যেহেতু আনইউজুয়াল মার্ডার কেস, ফলে সকলের হাত-পা বাঁধা। যদিও আমি কলকাতায় আমার ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলেছি। এরা যদি আর কয়েকদিন আটকে রাখে, যেতে না দেয়, তাহলে কোর্টের কাছে প্লি করবো যে, যেন আমাদের কলকাতায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন তাঁরা। তোমরাও প্রেয়ার করতে পারো একইসঙ্গে। আই হোপ অল অফ ইউ আর এগ্রি উইথ মি!”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৭: মুখোমুখি প্রথমবার /২

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল

“দেখ, আমাদের কারুরই যে আর এই ট্রিপটা ভালো লাগছে না, এটা আলাদা করে বলার দরকার নেই। তার উপর এলাকাটাও যেন অসহ্য হয়ে উঠেছে। এখনও তো মর্গে যাওয়া বাকি। সেখানে গিয়ে যদি দেখা যায়, লাশটা আমরা যার কথা ভাবছি, তারই, তাহলে আমাদের মানসিক অবস্থা কেমন হবে বুঝতে পারছ?”
“কিন্তু কিছু করার নেই। আজকেই যেতে হবে। আমরা তো ভেবেছি, আড়াইটের দিকে যাব। ওই যে লোকাল পুলিশ অফিসারটি এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি বলেছেন ব্যবস্থা করবেন। আমরা যেন রেডি থাকি। কেবল সনাক্ত করা। তারপর অনেক প্রসিডিওর আছে। তাছাড়া বাড়ির আত্মীয়স্বজন কেউ না হলে বডি দেবেন না ওনারা। সেক্ষেত্রে আর্যর মা যদি আসতে পারেন ভালো, না হলে তাঁকেও তো পারমিশন লেটার দিতে হবে যে, বডি আমরা নিজেদের দায়িত্বে এখানে দাহ করতে পারি!”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

“তোমার মনে হয় আর্যের মা এই অনুমতি দেবেন? একমাত্র ছেলে, তার বডি শেষবারের মতো না দেখে তিনি দাহ করে ফেলতে বলবেন, সেটা হতেই পারে না। ছেলের ব্যাপারে উনি খুব পজিসিভ। আমার মনে হয় সেক্ষেত্রে উনি নিজে আসবেন তা সে যেভাবেই হোক না কেন ব্যবস্থা করে। আর উনি আসবার পর আমাদের যে কী কী শুনতে হবে, সে-ব্যাপারে আমি কোন গ্যারান্টি দিতে পারব না!” অরণ্য শ্রাগ করল।
অঞ্জন অস্থিরভাবে বলল, “সত্যি অরণ্য, আমার আর ভালো লাগছে না। কেমন যেন একটা ধাঁধার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েই চলেছি। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। পুলিশ যা পারে করুক, যাকে অপরাধী হিসেবে পাকড়াও করে করুক, সে যদি আমিই হই, আমাকেই ধরুক। কিন্তু ধরুক। প্রতিমুহূর্তের মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে অন্তত মুক্তি পাব!”
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৫: অরু দত্ত— এক অভিশপ্ত গান্ধর্বী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

অরণ্য খুব মনোযোগ দিয়ে তার উরুর ওপর গজিয়ে ওঠা ছোট লাল তিলটাকে দেখছিল। সেই অবস্থায় সে বলল, “আসলে কী জান, ধরা যে কেউ পড়তেই পারে। কিন্তু তারপরেও সে কি আর নিরুদ্বিগ্ন হবে? তখন অন্য উদ্বেগ কাজ করবে।”
“তাতে কী? বাকিরা তো মুক্তি পাবে! তুমি কি চাও, দিনের পর দিন এই উদ্বেগের মধ্যে আমরা সকলে দিন কাটাই?” অঞ্জন অসহিষ্ণু হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
“অঞ্জন, আমার কী মনে হয় জানো, আমাদের সকলের জীবনেই তো কোন না কোন অন্ধ-অতীত থাকে, তেমন কোন অন্ধ-অতীত তার প্রতিশোধ নিচ্ছে না তো?”
“অন্ধ-অতীত? সেটা আবার কী?” অঞ্জন অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল।
“মানে ধরো, আমাদের ফেলে আসা জীবনে ঘটে যাওয়া কিংবা ঘটিয়ে ফেলা এমন কোন কোন ঘটনা বা সময়, যার সঙ্গে তুমি-আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে। যে-সব ঘটনা আমরা মনে করতে চাই না আর, মনে পড়লে অপরাধবোধ হয় ভীষণরকম, কিংবা ক্রোধ-প্রতিহিংসা এসবও হতে পারে। আসলে সব সময় তো অন্ধ অতীতে একজনের ভূমিকা কেবল অপরাধীর হয় না, যার প্রতি অপরাধ করছি, তার কাছেও তো সেই সময় বা ঘটনা অন্ধ অতীত। সে-ও তো মনে করতে চায় না সেই সময়, কিংবা হয়তো মনে থেকেই যায় তার। ভুলতে পারে না। তোমার জীবনে তেমন কিছু কি আছে, যা তুমি ভুলতে চাও কিন্তু পারো না?”
“মাই গড! কী অদ্ভুত সব কথা বল তুমি ? আমার জীবনে কোন অন্ধ অতীত-টতীত নেই। কোন অপরাধবোধও নেই তাই। আমি এমন কিছু করি নি যে কখনও নিজের করা কাজের জন্য অনুশোচনা বা অপরাধবোধে ভুগবো,” বলল অঞ্জন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৫: রাজা যযাতির উপাখ্যান—পৌরবদের বর্ণ বিপর্যয় না উত্তরণের কাহিনি?

“বাঃ! তুমি তো দেখছি ধোওয়া তুলসীপাতা! কোনও অপরাধ করেনি এমন মানুষ এই প্রথম দেখলাম!” অবাক গলায় বলল বটে অরণ্য, কিন্তু তার বলা কথায় কোথাও যেন প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের সুর।
“সে তুমি যা খুশি ভাবতে পারো অরণ্য! তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তুমি নিশ্চয়ই আমার জীবনে আসা মেয়েরা এবং তাদের সঙ্গে কাটানো কোয়ালিটি টাইম এবং পরবর্তীকালের ব্রেক-আপকে অন্ধ-অতীত বলবে না? কারণ, তোমার-আমার অনেকের জীবনেই তাহলে অন্ধ-অতীত গুণে শেষ করা যাবে না !”
“নাহ্‌, সে-সব ঘটনাকে অন্ধ-অতীত বলা যায় না। সম্পর্ক তৈরি হওয়া, ব্রেক-আপ হওয়া যদি অন্ধ-অতীত হত, সত্যিই আমাদের বেশিরভাগের আর মুখ লুকানোর জায়গা থাকত না। এই আমি, ক্লাস এইটে নিজেরই কোচিং-এর আন্টির সঙ্গে ফিজিক্যাল হয়েছিলাম। ফার্স্ট ইনসিডেন্ট ইন মাই লাইফ, অ্যান্ড আই কুডন্ট রেজিস্ট মাইসেলফ! বাট ইউ ক্যান নট কল দিস ইভেন্ট ব্লাইণ্ড-পাস্ট, অ্যাট লিস্ট আই হ্যাভ নো গিল্ট অ্যাবাউট দ্যাট ম্যাটার!”
“হ্যাঁ, আমি বলতেও চাইছি না। এরকম আমাদের সবার জীবনেই আছে। আমি নিজেও আজ পর্যন্ত যে কত জন মেয়ের সঙ্গে পিজিক্যালি অ্যাটাচড হয়েছি, নিজেই হিসেব দিতে পারব না। যদিও উন্মেষা আমার জীবনের সবকিছুকে বদলে দিয়েছে। ওকে পাওয়ার পর থেকে আমি বুঝেছি, অ্যাকচুয়াল রিলেশনশিপ বলতে কী বোঝায়!”
“ইউ আর লাকি এনাফ!” বলল অরণ্য। তার গলায় কোন ব্যঙ্গ ছিল না, হাহাকার ছিল কি?
“কেন, তুমি নিজে নও? তৃষার মতো মেয়ে হয় না। আর আমি যা দেখেছি, তোমরা দুজনেই হ্যাপি কাপল! অন্য কিছু আছে না কি এর মধ্যে?”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৫: রাজনীতি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বারে বারে টেনে আনে ধর্মকে, আর এতেই প্রাণ যায় ধর্মভীরু সাধারণদের

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৮: বিয়ের পর রাধুর প্রত্যাবর্তন

“না না! কী আর অন্য কিছু থাকবে? আসলে একটা সময়ের পর সম্পর্কগুলি হয় শিথিল হয়ে পড়ে, নয় আরও শক্ত-পোক্ত হয়। আমাদের দুজন সেই ব্যাপারে একটু কনফিউজড। ঘেঁটে আছি বলতে পারো!”
“দুজনে মিলে আলাদা করে কোনও ট্রিপে যাও। কথা বল। আমি এসব আগে ফিল করতাম না, এখন করি। দেখবে দু’ জনের মনের মধ্যে জমে থাকা ময়লা সাফ হয়ে যাবে!” অঞ্জন ভরসা জোগায়।
“এই একটা ট্রিপে এসেই তো দেখছ কী হচ্ছে সব? আগামী এক-দু’ বছর কোন ট্রিপে যাওয়ার কথা উঠলেই আর মনের মধ্যে থেকে সাড়া পাব না!”
“হুস। আমার মনে হয় আমরা যখন কালপ্রিট নয়, তখন আমাদের ভয়ের কিছু নেই। সে যারা বা যে অপরাধ করছে, তাকে চমকাতে দাও। আমাদের কী?”
অরণ্য বলল, “তুমি এত শিওর হচ্ছ কী ভাবে যে, আমাদের মধ্যে কেউ কালপ্রিট নয়?”
“কী বলছ তুমি?” অঞ্জন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “আমাদের মধ্যে কাউকে কালপ্রিট ভাবছ কী করে? হাউ ডেয়ার ইউ আর?”
“ভাবছি না, পসিবিলিটির কথা বলছি। আমরা যতটুকু দেখি, বাইরে থেকে দেখি। ভিতরে কোন অন্ধ-অতীত লুকিয়ে আছে, কোন চেহারা লুকিয়ে আছে তা কি আমরা কেউ জানি?”
“আবার সেই অন্ধ-অতীত? তুমি এইসব পসিবিলিটিজের কথা পুলিশকে বলনি তো? তাহলে তোমার এই মনগড়া কল্পনায় আমাদের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে! কী করে পারলে তুমি?”
অরণ্য বলল, “রাগ করো না। ওই ভাবে আমি বলতে চাইনি। কিন্তু ধরো…” তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ডোরবেল বাজল। দরজায় নক না করে ডোরবেল বাজানোয় অরণ্য একটু অবাক হল। তৃষা কি ফিরে এল? কিন্তু সে তো ডোরবেল বাজাবে না, নক করবে। তাহলে? তবে কী রুম-সার্ভিস দিয়ে গিয়েছিল যে ছেলেটি সে ফিরে এসেছে এঁটো বাসনপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য? সে উঠতে যাচ্ছিল। অঞ্জন বলল, “দাঁড়াও, আমি দেখছি। তুমি টাওয়েল সামলাও!” বলে কাষ্ঠহাসি হাসল। তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content