ছবি: প্রতীকী।
আধ্যাত্মিক জীবনে নির্জনতার প্রয়োজনীয়তা আছে। অনেকে নির্জন স্থানে গিয়ে হাঁপিয়ে যান একাকিত্বের জন্য। আবার কারও জন্য একাকিত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনে কখনও কখনও একাকিত্ব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকের কাজ করে। নিজের মানসিক বিশ্লেষণের জন্য নির্জনতা আশীর্বাদ স্বরূপ। শরীরকে যেমন সুস্থ সতেজ রাখার জন্য খাদ্যের দরকার, তেমনি মনকে সুস্থ রাখার জন্য নির্জনতার দরকার। নির্জন স্থানে মনকে বিশ্লেষণ এবং তাকে অর্ন্তমুখ করা, তিতিক্ষা অভ্যাস করা যেমন দরকার, তেমন ঈশ্বর প্রেমে ভরপুর এবং নির্ভরতা বাড়ানোর প্রয়োজন।
আপন, পর পরিচয় বিশ্লেষণ করে, দেহ কেন্দ্রিক জীবন থেকে আত্নকেন্দ্রিক জীবনের দিকে এগোনে যায়। ন্যায়-অন্যায় বিশ্লেষণ করে, অন্যায় আপসহীন জীবন তৈরি করে সঠিক পথে এগোনে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “ঈশ্বরের নামগুণ গান সর্বদা করতে হয়। আর সৎসঙ্গ, ঈশ্বরের ভক্ত বা সাধু, এদের কাছে মাঝে মাঝে যেতে হয়। সংসারের ভিতর এবং বিষয় কাজের ভিতর রাত দিন থাকলে ঈশ্বরের মন হয় না। মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তার চিন্তা করা বড় দরকার। প্রথম অবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জন না হলে ঈশ্বরের মন রাখা বড়ই কঠিন।” (কথামৃত পৃঃ ১৯)
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭৬: ঈশ্বর যেমন জীব ছাড়া থাকেন না, তেমনই ভক্তও প্রভুকে ছাড়া থাকতে পারেন না
মন শান্ত করতে বিষয়ের থেকে মনকে মুক্ত করতে হবে। আচরণের শুদ্ধতা দরকার। অন্য কারও সাহায্য না আসলে, ঈশ্বরের উপর নির্ভরতা বাড়ে। “কিন্তু এই ভক্তি লাভ করতে হলে নির্জন হওয়া চাই। মাখন তুলতে গেলে নির্জনে দই পাততে হয়। দইকে নাড়ানাড়ি করলে দই বসে না। তারপর নির্জনে বসে, সব কাজ ফেলে দই মন্থন করতে হয়। তবে মাখন তোলা যায়।” (কথামৃত পৃঃ ২০)
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
“আবার দেখ, এই মনে নির্জনে ঈশ্বরচিন্তা করলে জ্ঞান বৈরাগ্য ভক্তি লাভ হয়। কিন্তু সংসারে ফেলে রাখলে ওই মন নীচ হয়ে যায়।” (কথামৃত পৃঃ২১) মন বিষয়াসক্ত বেশিক্ষণ থাকলে তাতেই সম্পৃক্ত হয়ে যায় তখন আর ঈশ্বর চিন্তা আসে না। বিচার বোধ চলে যায়। ঈশ্বর ভাবনা ছাড়া আর সবকিছু ভাল লাগে। সুখ তখন দুঃখের মুকুট পরে সামনে উপস্থিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ঈশ্বর লাভ কি করে করা যায়।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ
মাঝে মাঝে নির্জন বাস, তাঁর নাম গুনগান আর বস্তু বিচার। এইসব উপায় অবলম্বন করতে হয়। উপনিষদে যে সাধন চতুঃষ্টয়ের কথা আছে, শ্রীশ্রীঠাকুর সংক্ষেপে বলে দিলেন। অধিকারীর জন্য এগুলির সাধন প্রয়োজন। সংসারে থেকেও কি প্রকারে ঈশ্বর লাভ করা যায় তা বলছেন, “এক এক বার নির্জনে বাস করতে হয়। সংসারের বাইরে একলা গিয়ে যদি ভগবানের জন্য তিন দিনও কাঁদা যায়, সেও ভালো। এমনকি অবসর পেয়ে একদিনও নির্জনেই তার চিন্তা করা যায় সেও ভালো।” (কথামৃত পৃঃ ৮৯)
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
আসল হল মন তৈরি করা। মন তৈরি হলে যেমন ইচ্ছা রাখা যায়। মাখন তৈরি হয়ে গেলে তখন জলে রাখলে আর ক্ষতি নেই। স্বামী যতীশ্বরানন্দ লিখেছেন, “বাহ্য নির্জনতা কেবল তখনই তোমার সহায় হবে, যখন তুমি অন্তরেও শান্ত হতে পারবে। প্রকৃত নীরবতা হল মনের নীরবতা। এ হল মনকে স্তব্ধ করে তা থেকে অবাঞ্ছিত চিন্তাগুলিকে দূর করে দেওয়া।… কেবল বাহ্য নির্জনতায় জগৎ ভুলিয়ে দেয় না, কেবল সেই নির্জনতাই সত্য যা জগৎ ভূলিয়ে দেয়, কেবল সেই নির্জনতাই সত্য যাতে সাধক ব্রহ্মে লীন হতে পারে।” যোগশাস্ত্রে মনকে নিরুদ্ধ করে আত্ম চিন্তার জন্য বলা হয়েছে। নিজের মধ্যেই নির্জনতা খোঁজা। মন শান্ত তো শব্দ মুখর জায়গার মধ্যেও মন নির্জনে থাকে।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।