জীবন অনেকগুলো পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায়, শরীরী মানুষমাত্রেই তা বুঝতে পারে। বাঙালীর বঙ্গজীবনে বিশেষ করে, এই সব পর্যায়েই পুজো আসে। কেউ পুজো বলতে কাশফুল শিউলি বোঝে তো কেউ বোঝে হোলনাইট হপিং। কেউ কেউ পুজো বলতে নিখাদ ছুটি, কেউ কেউ পাহাড় সমুদ্র, কেউ বা সারা বছরের জমে থাকা কাজ করার ফুরসত বোঝে। অনেকেরই পুজোতে ছুটি নেই। অনেকেই পুজোতেও দৈনন্দিন যাপনের ছন্দেই চলে, পুজো কাউকে ছুঁয়ে যায়, কাউকে ছোঁয় না। পঁচিশ বছর আগেও পুজোর গন্ধ ঠিক যেমন ছিল, এখন তেমন নয়। গন্ধটা বেড়েছে না কমেছে সেটা আপেক্ষিক, তবে প্রতি দশকে দশকে পুজো আর তার পুজো পুজো ভাব ব্যাপারটা বদলে যাচ্ছে।
পুজো মানে দুর্গাপুজো। মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গতিহারিণীর অকালবোধন। আর পুজো পুজো ভাব মানে, পুজো আসার কিছুদিন আগে থেকে আকাশে বাতাসে একটা চোখে পড়ার মতো বদল আসা। হঠাত্ করে রোদ ঝলমলে আকাশ, আকাশের রঙে নীল নীল ভাব, বাতাসেও একটা ঝলমলে আনন্দ, কলকাতার আশেপাশেই কিংবা দূরে দূরে কাশফুল, এছাড়াও পাড়ার শিউলি ফুলের গাছটা হঠাৎ করেই শরতের চিঠি রেখে যেত। ক্রমে চিঠির দিন গেল। শুধু পরীক্ষার প্রশ্নেই চিঠি লিখতে বলা হয়। সময় বদলে গেল। ই-মেইল, হোয়াটস্যাপ, সমাজমাধ্যমের সমাজেও শিউলি, কাশ ফোটে, আকাশ নীল হয়। মানুষ নিজের মতো করে ভাবে আর ছবি তোলে। নীল আকাশের নিচে কাশফুল-দোলা পৃথিবীতে দেবী কখনও অশ্বে, কখনও গজে, কখনও দোলায়, ক্রমে ক্রমে ম্যাটাডোর, মিনিডোর, জাহাজে, বিমানে কিংবা ভার্চুয়ালি আসেন, যান; দোলা দিয়ে যান।
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১: হাতির মতো বুদ্ধি?
শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/৩
ক্রমে ক্রমে পুজোর বাজার শপিং হয়েছে, পুজো থিমের রূপটানে মহার্ঘ্য, পুজোর অর্থনীতি বর্ষার ভরা মরসুমেই আকর্ষণীয় ছাড় নিয়ে ঢাকের তালে কোমর দোলায়। একটা অপেক্ষা, দৌড়, তাড়া শুরু হয়ে যায়। কুমোরটুলিতে প্রতিমা, যথাসময়ে ঢাকিদের ভিড়, আনুষঙ্গিক অনুসারী শিল্প ও শিল্পীদের তৎপরতা, ফুটপথের পসরা, বাজারের সব্জি সকলেই একটা মাহেন্দ্রক্ষণের উদযাপনের প্রতীক্ষা করতে থাকে। পুজো আসে। আর এসেই বলে, যাই।
আরও পড়ুন:
বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
একটা বিতর্ক চলতে থাকে পুজো ভালো নাকি পুজো আসছে এই অপেক্ষাটাই মধুর? কারণ মধুর তোমার শেষ যে না পাই ভেবেই যে রসচর্বণা, তাতেই কল্পজীবীর অচিনপুর বুঝি অনন্ত হয়। পুজো আসে, চলে যায়, এবারেও এসে চলে যাচ্ছে এটা যেমন বাস্তব, তেমনই পুজো পুজো আগমনীর স্বপ্ন দেখা মানুষদের দৈনন্দিন হতাশা, অবসন্ন সুখের আঙিনায় মধুর হাওয়ার আসা যাওয়াটাও মিথ্যে অলীক নয়।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার
পুজোর টিউবলাইট ডুম বাল্বের আলো এখন চাইনিজ, এল ই ডি হয়ে অন্যরকম। চন্দননগরের আলো যুগের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে। দেবীপ্রতিমার আকার, প্রকার, দাম বদলে গেছে। ঠাকুরের সাজে সাবেকী, আধুনিকের ধরণ বদলেছে। যারা ঠাকুর দেখবে তাদের রুচি, টেস্ট, পোষাক, কথাবার্তা বদলে গেছে। তিরিশ বছর আগের ট্রাডিশনাল আর হাল আমলের ট্রাডিশনাল এক নয়। বিজয়ার আবেগ, বিসর্জনের শোভাযাত্রা, শোভাযাত্রার শোভাও বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে। এমনকী, শোভা আর শোভনের সংজ্ঞা বদলেছে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
এককালের ঠেলা, ভ্যান, ক্লাবব্যাণ্ড, ব্যাঞ্জো, তাসা পার্টির হলুদ আলোর শোভাযাত্রা এখন সাদা ফ্লাডলাইট আর ডিজের হুঙ্কারে অন্যরকম। বিসর্জনের ভাসান ড্যান্সের মুদ্রা, ভঙ্গী, শরীরী ভাষা আর এক নেই। রোল চাউমিনের পাশে মোমো বিরিয়ানি, চাইনিজ কণ্টিনেণ্টাল ইত্যাদি ইত্যাদির বিপুল সমারোহে যে ঢাকের বাদ্যি তাতেও সিন্থেটিক, পলিমার, মেটালের সুর। এমনকী, পুজোয় বৃষ্টির ধরণটাও এক নেই।—চলবে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।