শনিবার ২৭ এপ্রিল, ২০২৪


ছবিঃ সংগৃহীত।

তীর্থভ্রমণের পথে ভাইদের সঙ্গে করে যুধিষ্ঠির সেদিন যমুনানদীর তীরে উপস্থিত হয়েছেন। লোমশমুনি যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ করে বলে ওঠেন, ‘মহারাজ! যমুনানদীর দু’ পাশে এই যে দুটি নদী দেখছেন, এদের নাম জলা আর উপজলা। এখানেই উশীনররাজা যজ্ঞ করেছিলেন আর ইন্দ্রের থেকেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। যুধিষ্ঠির যথারীতি উত্সুক চোখে লোমশমুনির দিকে তাকান। মুনিবর যুধিষ্ঠিরের নীরব প্রশ্ন বোঝেন আর তাই তাঁর জিজ্ঞাসার পূর্বেই বলা শুরু করেন উশীনরের কাহিনী।
প্রাচীনকালে উশীনর নামে এক রাজা ছিলেন, যিনি নিজের ধর্মে অবিচল ছিলেন। একবার দেবরাজ ইন্দ্র আর অগ্নিদেবতা স্থির করেন, রাজা নিজের ধর্মের প্রতি কতটা অবিচল তা পরীক্ষা করবেন। ইন্দ্র বাজপাখির রূপ গ্রহণ করেন আর অগ্নি কপোতের রূপ নিয়ে উশীনরের রাজ্যের দিকে গমন করেন। রাজা উশীনর তখন যজ্ঞকার্যে ব্যস্ত। হঠাৎ একটি কপোত প্রাণভয়ে রাজার কোলে আশ্রয় নিল। রাজা অবাক চেয়ে দেখেন একটি বড় সড় আকৃতির বাজপাখি ভয়ঙ্কর দৃষ্টি মেলে কপোতটির প্রতি ধেয়ে এসেছে, কিন্তু কপোতটি রাজার কোলে আশ্রয় নেওয়ার ফলে কিছু করতে পারছে না।

রাজা আশ্রিত কপোতের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে বাজপাখির দিকে ঘুরে তাকাতেই বাজপাখিটি মানুষের গলায় বলে ওঠে, ‘হে রাজন! এই কপোত আমার ভক্ষ্য। অতএব আপনি ওটিকে আমার হাতে ছেড়ে দিন।’ রাজা পাল্টা উত্তর দেন, ‘ওহে পক্ষিবর! আমি এমন কাজ কখনোই করতে পারব না। কারণ এই পাখিটি আমার শরণাপন্ন। আর আশ্রিতকে রক্ষা করা আমার কাজ।’
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫১: তীর্থযাত্রার ফল কি তবে প্রশান্তি!

ক্লাসরুম: মাধ্যমিক ২০২৩: ইংরাজি পরীক্ষার প্রস্তুতি কীভাবে নিলে ভালো ফল করা সম্ভব, তা দেখে নাও একঝলকে

মাধ্যমিক ২০২৩: পাঠ্যবই খুঁটিয়ে পড়লে বাংলায় বেশি নম্বর পাওয়া কঠিন নয়

বাজপাখিটি বলে ওঠে, ‘হে মহারাজ! আপনি ধর্মজ্ঞ, এমনটাই লোকে বলে থাকে। আপনি কিভাবে ক্ষুধার্ত্তের মুখের খাবার কেড়ে নিতে পারেন!’ রাজা বলে ওঠেন, ‘আমি তোমার আহার্য হিসেবে বৃষ বরাহ কিংবা অন্য কোন পশুর বন্দোবস্ত করব। তুমি এই কপোতটিকে ছেড়ে দাও। এ বড়ই ভীত হয়েছে।’ বাজপাখিটিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে পাল্টা বলে ওঠে, ‘হে রাজন্! বাজপাখির ভক্ষ্য কপোত, এ তো সর্বজনবিদিত। আপনি কি এ কথা জানেন না?’ রাজা তবুও হাল ছাড়েন না। নাছোড় বাজপাখিকে বোঝাতে থাকেন, ‘হে পক্ষিরাজ! তোমায় সমৃদ্ধিযুক্ত রাজ্য দেব। তুমি এই অসহায় পাখিটিকে ছেড়ে দাও। অথবা তুমি এমন কোনও উপায় বল যা করলে তুমি এই পাখিটিকে ছেড়ে দেবে’।

বাজরূপী ইন্দ্র হয়তো এমন একটি প্রস্তাবেরই অপেক্ষা করছিলেন। বাজপাখিটি তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে, ‘আপনি যদি এমন মনস্থির করে থাকেন যে এই কপোত আপনার আশ্রয়ে রয়েছে আর আপনি একে রক্ষা করতে চান, তবে একটি তুলাযন্ত্রে এই কপোতটিকে বসিয়ে তার সমান ওজনের আপনার নিজের মাংস দিন। যে মুহূর্তে আপনার মাংস এবং কপোতের ওজন সমান হবে, সেই পরিমাণ মাংস আমায় দেবেন। আমি সেই মাংস নিয়েই খুশি হব।’ রাজা স্বধর্মে অটল ছিলেন। তিনি তিলমাত্র অপেক্ষা না করে বাজপাখিটিকে বললেন, ‘তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি। তুমি যেমনটি বলেছ ঠিক তেমনি হবে।’
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪: যা পুরুষ নন, তাই হলেন নারী

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪০: শুধু খাল-বিল ঝিল নয়নজুলিতে মৌরালা মাছ করে প্রায় ২০ লক্ষ শিশুর অনুপুষ্টির ঘাটতি মেটানো সম্ভব

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৪: যেখানে অর্জিত ভক্তি ও বিশ্বাস আছে, সেখানেই ভগবান আছেন

এরপর রাজা উশীনর একটি তুলাযন্ত্রের একপাশে কপোতপাখিটিকে বসালেন। আর একদিকে নিজের শরীর থেকে মাংস কেটে রাখতে লাগলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, রাজা যতই নিজের শরীরের মাংস রাখেন একপাশে, অপরপাশে কপোতের সমান হয় না, কিছুতেই। অবশেষে রাজা নিজেই তুলাযন্ত্রের ওপর চেপে বসলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে দেখা গেল, কপোত আর রাজার ওজন সমান সমান। নিজের অজান্তেই যে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন রাজা, সেই পরীক্ষায় সফল হলেন তিনি। ইন্দ্র আর অগ্নি নিজশরীরে ফিরে এলেন। রাজাকে উদ্দেশ্য করে তাঁরা বলে উঠলেন, ‘হে রাজন্! আপনার ধর্মপরায়ণতার কোনও তুলনা হয় না। শরণাগতকে রক্ষা করবার জন্য এমন ত্যাগ জগতে বিরল। আপনার কীর্ত্তি জগতে লোকমুখে অক্ষয় হয়ে থাকবে।’
আরও পড়ুন:

স্বাদে-গন্ধে: সামনেই জন্মদিন? বিশেষ দিনের ভূরিভোজে বানিয়ে ফেলুন কাশ্মীরি পদ মটন রোগান জোস!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২১: কে তুমি নিলে আমার চিরসবুজের ‘অগ্নিপরীক্ষা’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪: আপনি কি খেয়ে উঠেই শুয়ে পড়বেন? জানেন কী হচ্ছে এর ফলে

এ পর্যন্ত উশীনররাজার সেই আশ্চর্য কাহিনী বলে লোমশমুনি যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, ‘হে রাজন্! একথা বলে ইন্দ্র আর অগ্নি নিজ নিজ স্থানে ফিরে গেলেন। আর এদিকে উশীনর রাজাও স্বধর্মে নিরত থেকে, বহুবিধ যাগযজ্ঞ করে, বহু জনের হিতে রত থেকে যথাসময়ে মরদেহ ত্যাগ করলেন। পুণ্যাত্মা উশীনরের পবিত্র বিচরণস্থলে বিচরণ করলে, সে আশ্চর্য আখ্যানের কথা স্মরণ করলেও মন পবিত্র হয়।’

লোমশমুনির বলে যাওয়া আখ্যান যুধিষ্ঠিরের মনেও অনুরণন তোলে। কবেকার সে কাহিনী যেন সত্যি হয়ে ভেসে ওঠে তাঁর চোখের সামনে।
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content