রবিবার ১৯ মে, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

কশ্যপপত্নী কদ্রু ও বিনতার প্রতিযোগিতার রেষারেষির সূচনা ঠিক কী কারণে হয়েছিল?
সত্যযুগে দক্ষ প্রজাপতি দুই স্ত্রী, কদ্রু ও বিনতার প্রতি তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলেন। কদ্রু স্বামীর কাছে বর চাইলেন, বব্রে কদ্রুঃ সুতান্নাগান্ সহস্রং তুল্যবর্চ্চসঃ। কদ্রু সমান বলশালী সহস্রসংখ্যক নাগপুত্রের জননী হতে চাইলেন। আর বিনতা বললেন, তাঁর এমন দুই পুত্র হোক যাঁরা কদ্রুর পুত্রদের থেকেও শারীরিক বলে, শৌর্যপ্রকাশে সকলের থেকে শ্রেষ্ঠ। দ্বৌ পুত্রৌ বিনতা বব্রে কদ্রুপুত্রাধিকৌ বলে। তেজসা বপুষা চৈব বিক্রমেণাধিকৌ চ তৌ।। কদ্রু ও বিনতা উভয়েই যোগ্য অভীপ্সিত পুত্রলাভের বড়প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট, কৃতার্থ হলেন। কদ্রু ও বিনতা যথাকালে যথাক্রমে কদ্রু সহস্র ডিম এবং বিনতা দুটি ডিম প্রসব করলেন। যথাকালে সহস্র ডিম থেকে সহস্র নাগপুত্রের জন্ম হল।

বিনতা আর নির্ধারিত সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে পারলেন না। একটি ডিম ভেঙ্গে ফেললেন। সেই ডিম থেকে অপরিণত শরীরে, শুধুমাত্র দেহের ঊর্ধ্বভাগ নিয়ে জন্ম দিলেন একটি পুত্র। ভূমিষ্ঠ পুত্রটি মায়ের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিলেন, তাঁর অপরিণত দেহের কারণে, মা বিনতা, পাঁচ শত বৎসর ধরে প্রতিস্পর্ধিনী সপত্নী কদ্রুর দাসত্ব করবেন। শরীরেণাসমগ্রেণ তস্মাদ্দাসী ভবিষ্যসি। পঞ্চ বর্ষশতান্যস্যা যয়া বিস্পর্দ্ধসে সহ।। শাপমুক্তির উপায় হল, অপর ডিমটি যদি অসহিষ্ণু মা বিনতা, না ভেঙ্গে ফেলেন, তবেই সেই ডিম থেকে জাতপুত্র, মাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করবেন। সেই অপরিণত দেহ অরুণবর্ণবিশিষ্ট সূর্যসম উজ্জ্বল তেজোদীপ্ত পুত্রটিকে দেখে সন্তুষ্টচিত্তে সূর্য তাকে সারথির কাজে নিযুক্ত করলেন। পুত্রটির নাম হল অরুণ। যথাকালে নির্ধারিত সময়ে অপর ডিম ভেঙ্গে যথানিয়মে জন্ম নিলেন মহাবলশালী গরুড়।গরুড়ের শক্তিমত্তার পরিধি কতদূর? মহাসত্ত্ববলোপেতঃ সর্ব্বা বিদ্যোতয়ন্ দিশঃ। কামরূপঃ কামগমঃ কামবীর্য্যো বিহঙ্গমঃ।।

মহাবলশালী চারিদিকে আলোকোদ্ভাসে উজ্জ্বল করে যথেচ্ছ রূপধারী, স্বেচ্ছায় সর্বত্র গমনশীল, ইচ্ছানুসারে বলশালী, ‘বিহায়সা আকাশেন গচ্ছতীতি’আকাশে বিচরণকারী বিহঙ্গম অর্থাৎ পক্ষীরূপে আবির্ভূত হলেন। দীপ্ত, অগ্নির মতো তাঁর প্রকাশ।পিঙ্গলবর্ণ বিদ্যুতপ্রভার মতো উদ্দীপিত চোখদুটি। জন্মমাত্রই বিপুলাকৃতি ধারণ করে প্রলয়কালীন অগ্নির মতো তেজস্বী গরুড় আকাশে বিচরণ করতে করতে ভয়ঙ্কর গর্জন করতে লাগলেন। আশঙ্কিত দেবতারা অগ্নির শরণাপন্ন হলেন। গরুড়কে অগ্নিভ্রমে অগ্নিকে বললেন, অগ্নি কী দেবতাদের দগ্ধ করতে ইচ্ছুক? অগ্নি আশ্বাস দিয়ে বললেন,ইনি গরুড়, তিনি তেজে অগ্নির সমতুল্য। গরুড়ো বলবানেষ নাগতুল্যশ্চ তেজসা অগ্নি,আরও বিশদে গরুড়ের পরিচয় দিয়ে বললেন, কশ্যপপুত্র এই মহাশক্তিমান গরুড়, নাগকুলকে ধ্বংস করবেন, দেবতাদের কল্যাণকামী ইনি দৈত্যরাক্ষসদের অনিষ্টসাধন করবেন। নাগক্ষয়করশ্চৈব কাশ্যপেয়ো মহাবলঃ। দেবানাঞ্চ হিতে যুক্তস্ত্বহিতো দৈত্যরাক্ষসাম্।। কম্পিতচিত্তে দেবতারা গরুড়ের স্তুতি করতে লাগলেন। সমবেত ঋষি ও দেবতাদের প্রার্থনায় গরুড় নিজের তেজ সঙ্কুচিত করলেন।
গরুড় যেকোনও স্থানে নিজের ইচ্ছা অনুসারে গমনে সক্ষম। ভাই অরুণকে পিঠে তুলে নিয়ে সমুদ্রের অপরপাড়ে মায়ের কাছে উপস্থিত হলেন গরুড়। সূর্য সেই সময় সকল লোক দগ্ধ করতে উদ্যত হলে গরুড় অরুণকে পূর্ব দিকে স্থাপন করলেন। কেন সূর্যদেবের এইরকম মতি? কেন তাঁর এই রোষ? দেবাসুরের অমৃতমন্থনের সময়ে, বিষ্ণু, মোহিনীরূপ ধারণ করে, অসুরদের কবল থেকে অমৃত উদ্ধার করলেন। বিষ্ণু, দেবগণের মধ্যে, অমৃত বণ্টন করতে উদ্যত হলে, রাহু নামে দানব ছদ্ম দেবরূপ ধারণ করে অমৃতপানে প্রবৃত্ত হলেন। সেই অমৃত,রাহুর কন্ঠ পর্যন্ত পৌঁছতে না পৌঁছতেই তার উভয়পার্শ্ববর্তী চন্দ্র ও সূর্য দেবতাদের হিতাকাঙ্খী বিষ্ণুকে, রাহুর এই দুরভিসন্ধির কথা জানালেন। তৎক্ষণাৎ বিষ্ণুর চক্র, রাহুর মস্তকটি ছিন্ন করল। তখন থেকেই চন্দ্র ও সূর্যের সঙ্গে রাহুর শত্রুতার শুরু। রাহু সূর্যকে গ্রাস করে পীড়িত করত,সেখান থেকেই দেবতাদের প্রতি সূর্যের ক্রোধের জন্ম। বৈরানুবন্ধং কৃতবাংশ্চন্দ্রাদিত্যৌ তদানঘ। বাধ্যমানং গ্রহেণাথ হ্যাদিত্যং মন্যুরবিশৎ।।

দেবতারা সূর্যের উপকারের কথা মনে রাখেনি। রাহুর ক্রোধের শিকার হয়েছেন সূর্য অথচ তিনি একাকী রাহুর ক্রোধের ফলভাগী হচ্ছেন। দেবতারা সূর্যের সহায় নন। তাঁরা রাহুর অত্যাচারের প্রতিকারের কোন চেষ্টা করেন না। তাই সূর্য সুযোগ পেয়ে ক্রোধে জগৎ দগ্ধ করতে উদ্যত হয়েছেন। এর প্রতিবিধান কামনা করে দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা, বিনতাপুত্র অরুণকে সূর্যের সম্মুখে স্থাপন করলেন। সূর্যের ক্রোধ হ্রাস করাই তাঁর লক্ষ্য। সেই থেকে অরুণ সূর্যের সারথির কাজ করে চলেছেন।

কদ্রুর দাসীরূপে মা বিনতা অত্যন্ত দুঃখে দিন কাটাচ্ছেন। সেখানে উপস্থিত হলেন গরুড়। দেবী কদ্রু, দাসী বিনতাকে আদেশ করলেন, সমুদ্রের মাঝখানে নাগেদের বসবাসের উপযুক্ত সুন্দর দ্বীপটিতে নিয়ে চলো আমায়। নাগানামালয়ং ভদ্রে!সুরম্যং চরুদর্শনম্। সমুদ্রকুক্ষাবেকান্তে তত্র মাং বিনতে! নয়।। বিনতা কদ্রুকে বহন করে নিয়ে চললেন। মায়ের আদেশে গরুড়ও সাপগুলিকে বহন করে নিয়ে চললেন।সূর্যের অভিমুখে ধাবমান পক্ষিরাজ গরুড়ের পৃষ্ঠদেশে, সাপগুলি, সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে সংজ্ঞা হারাল। কদ্রু দেবরাজ ইন্দ্রকে স্তুতিদ্বারা তুষ্ট করলেন। মেঘেদের অবিরাম বর্ষণের ফলে নাগেরা আনন্দিত হয়ে গন্তব্য সেই রমনীয় দ্বীপটিতে এসে নামল। গরুড়কে সঙ্গে নিয়ে নাগেরা একটি সুন্দর বন দেখতে পেল। সাগরের জলবেষ্টিত সেই বন, পাখির কাকলিকে মুখর, ফুল ফলে সমৃদ্ধ,নির্মল জলের হ্রদবিশিষ্ট।

পুষ্পিত গাছগুলি নাগেদের ওপর পুষ্প বর্ষণ করতে লাগল। ভ্রমরগুঞ্জনরত সুন্দর লতাগুল্মযুক্ত পবিত্র বনটিতে নাগেরা আনন্দে বিহার করল। মুগ্ধ নাগেরা পক্ষিরাজ গরুড়কে বলল, এমনি সুনির্মল জলে ভরা অন্য কোন সুন্দর দ্বীপে নিয়ে চলো আমাদের। বহাস্মানপরং দ্বীপং সুরম্যং বিমলোদকম্। গরুড় চিন্তিত হয়ে মা বিনতাকে প্রশ্ন করলেন, কি কারণে এই নাগেদের কথা অনুযায়ী আমায় কাজ করতে হবে? কিং কারণং ময়া মাতঃ! কর্ত্তব্যং সর্পভাষিতম্। দেবী বিনতা পুত্রকে জানালেন, সপত্নীর প্রতারণার কারণে বাজি হেরেছেন তিনি। তাই শর্তসাপেক্ষ দাসীবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন। গরুড় মায়ের অবমাননার বৃত্তান্ত শুনে দুঃখের প্রতিবিধানের লক্ষ্যে, সাপেদের বললেন, কি আহরণ করলে? কি জানলে? বা কোন পৌরুষ প্রদর্শন করে আমরা তোমাদের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করব? কিমাহৃত্য বিদিত্বা বা কিংবা কৃত্বেহ পৌরুষম্। দাস্যাদ্বো বিপ্রমুচ্যেয়ং তথ্যং বদত লেলিহাঃ।। নাগেরা প্রস্তাব দিল, আহরামৃতমোজসা।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

তুমি বলপূর্বক অমৃত হরণ করে আনো। এটিই ছিল দাসত্বমুক্তির শর্ত। অমৃত আহরণে স্থিরপ্রতিজ্ঞ গরুড়ের অমৃত সংগ্রহের অভিযান শুরু হল। গরুড় মায়ের কাছে জানতে চাইলেন, তিনি পথে কী আহার করবেন? বিনতা জানালেন সমুদ্রপ্রান্তে আছে নিষাদপল্লী। হিংস্র, ধন আহরণের উদ্দেশ্যে নরহত্যাকারী, নির্মম, নৃশংস, পাপিষ্ঠ ব্যাধেদের বসতি সেখানে। তারাই হবে গরুড়ের খাদ্য। কিন্তু অবধ্য, সকল প্রাণীর গুরুতুল্য ব্রাহ্মণকে যেন গরুড় ভক্ষণ না করেন। ক্রোধের বশবর্তী হলেও ব্রাহ্মণদের প্রাণহরণ কখনও নয়। গরুড়ের সরল প্রশ্ন- ব্রাহ্মণরা দেখতে কেমন? তাঁদের স্বভাব কী রকম? শক্তিই বা কতদূর? তাঁরা কী অগ্নিতুল্য না কি সৌম্যকান্তি তাঁরা। কিংরূপো ব্রাহ্মণো মাতঃ! কিংশীলঃ কিংপরাক্রমঃ। কিংস্বিদগ্নিনিভো ভাতি কিংস্বিৎ সৌম্যদর্শনঃ। শ্রেষ্ঠব্রাহ্মণকে হজম করা দুষ্কর। দুঃখিনী বিনতা গরুড়কে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। অরিষ্টং ব্রজ পন্থানং পুত্র!কার্যার্থসিদ্ধয়ে।

নির্বিঘ্নে যাত্রা কর, পুত্র। তোমার উদ্দেশ্য সফল হোক। ক্ষুধার্ত পক্ষিরাজ গরুড় বিধ্বংসী আকৃতি ধারণ করে নিষাদদের সংহার করলেন। খাদ্যভক্ষণের উদ্দেশ্যে যেই না তিনি মুখ সঙ্কুচিত করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে পত্নীসহ এক ব্রাহ্মণ গরুড়ের মুখগহ্বরে প্রবেশ করে দহন সৃষ্টি করলেন। গরুড় তাঁকে ব্রাহ্মণরূপে চিনতে পারলেন। নিষাদীভার্যাসহ মুক্তি দিলেন ব্রাহ্মণকে। গরুড়কে আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন ব্রাহ্মণ। গরুড়ের দেখা হল পিতা কশ্যপের সঙ্গে। কুশল বিনিময়ের পরে গরুড় পিতাকে জানালেন, আহারে তিনি পরিতৃপ্ত নন। সহস্র ব্যাধ ভক্ষণ করেও তাঁর ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়নি। এমন কোন খাদ্য দরকার যা তাঁকে অমৃত আহরণের শক্তি যোগাতে পারে। পিতা কশ্যপ নিকটস্থ জলাশয়ে একটি নিম্নমুখে শুঁড়বিশিষ্ট হাতী এবং কচ্ছপকে দেখিয়ে একটি কাহিনির অবতারণা করলেন।

পুরাকালে বিভাবসু নামে অতিক্রোধপরায়ণ এক ঋষি ছিলেন। তাঁর ভাই মহাতপস্বী সুপ্রতীক। সুপ্রতীক পারিবারিক ধনবিভাগে আগ্রহী। বিভাগে অনিচ্ছুক বিভাবসু ভাইকে অভিশাপ দিলেন হস্তিত্বং সমবাপ্স্যতি তুমি হাতিতে পরিণত হও।সুপ্রতীকও কম নন।তিনিও জ্যেষ্ঠকে অভিশাপ দিলেন ত্বমপ্যন্তর্জলচরঃ কচ্ছপঃ ভবিষ্যতি। তুমিও জলচরয কচ্ছপে পরিণত হও। দু’জনে হাতী ও কচ্ছপে রূপান্তরিত হয়েও কিন্তু পরস্পর শত্রুতা ও বিদ্বেষভাব ভুললেন না। দুজনেই পরস্পরকে আক্রমণ করবার জন্যে সরোবরে উপস্থিত হলেন।কশ্যপ বললেন, যুযুধান দুই শত্রু গজ ওয কচ্ছপকে আহার্যরূপে গ্রহণ করে নিজের অভীষ্ট —অমৃত আহরণে প্রবৃত্ত হও। তাবুভৌ যুদ্ধসম্মতৌ পরস্পরবধৈষিণৌ। উপযুজ্যাশু কর্ম্মেদং সাধয় হিতমাত্মনঃ।। হে গরুড়, ওই বিশাল মেঘ ও বনের সদৃশ কূর্ম এবং বিরাট পর্বততুল্য ভীষণ আকৃতি গজকে ভক্ষণ করে অমৃত আহরণে যাও। মহাভ্রবনসঙ্কাশং তং ভুক্ত্বামৃতমানয়। মহাগিরিসমপ্রখ্যং ঘোররূপঞ্চ হস্তিনম্।।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩০: সুন্দরবনে লৌকিক দেবতা ছাওয়াল পীর ও রাখাল ঠাকুর

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৭: কী করে তোকে বলব!

পিতা কশ্যপের আশীর্বাদধন্য গরুড়, সেই সরোবরে উপস্থিত হয়ে একটি নখে হাতিকে, অপর নখে কচ্ছপকে বিদ্ধ করে ঊর্ধ্বাকাশে উড়তে উড়তে অলম্ব নামে তীর্থে উপস্থিত হলেন। সেখানের স্বর্গীয় বৃক্ষগুলি গরুড়ের পাখার দাপটে, ভয়ে কাঁপতে লাগল। গরুড় তাদের ছেড়ে অন্য বৃক্ষের সন্ধানে গেলেন। একটি সুন্দর বিশাল স্বর্গীয় বৃক্ষের উচ্চতা ছিল সহস্র যোজন। সেটি ছিল বহু শাখাযুক্ত। সেই বিস্তৃত উচ্চ যোজনব্যাপী বটবৃক্ষটি, মনের মতো গতিশীল গরুড়কে, তার বিস্তৃত শাখায় বসে, গজকচ্ছপদুটিকে ভোজনের অনুরোধ জানাল। কিন্তু গরুড় সেই বৃক্ষ শাখায় উপবেশনমাত্র, শাখাটি ভেঙে পড়ল।

গরুড় দেখলেন, সেই ভগ্ন শাখায় অধোমুখে ঝুলছেন বালখিল্য মুনিরা। মুনিদের জীবনরক্ষার তাগিদে, শাখাটি ধরে ফেললেন গরুড়। তখনও দুই নখে বিদ্ধ অবস্থায় রয়েছে গজ ও কচ্ছপ। সর্পভোজী গরুড়ের এই গুরুভার বহনের সামর্থ্যে দেখে বালখিল্যমুনিরা পক্ষীরাজের নামকরণ করলেন গরুড়। গুরুং ভারং সমাসাদ্যোড্ডীন এব বিহঙ্গমঃ। গরুড়স্তু খগশ্রেষ্ঠস্তস্মাৎ পন্নগভোজনঃ।। গরুড় গন্ধমাদন পর্বতে তপস্যারত পিতার শরণাপন্ন হলেন। পিতা কশ্যপ বালখিল্যমুনিদের তুষ্ট করলেন। সেই বালখিল্যমুনিরা তখন বৃক্ষশাখা ত্যাগ করে হিমালয় পর্বতে তপস্যার উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলেন। পিতার উপদেশ অনুসারে গরুড়, জনহীন এক পর্বতে, সেই বিশাল বৃক্ষ শাখাটিকে নিক্ষেপ করে সেই পর্বতের শৃঙ্গে বসেই গজকচ্ছপ দুটিকে ভক্ষণ করলেন।

এ বার অমৃত আহরণের চেষ্টা শুরু হল। গরুড়ের প্রতিপক্ষ অলৌকিক বলশালী দেবতারা। তাঁরা পর্যন্ত গরুড়ের শৌর্যপ্রকাশের বহর দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলেন। অমৃতের রক্ষক ছিলেন, প্রখর বুদ্ধিমান, প্রোজ্জ্বল দেহ, মহাশক্তিমান বিশ্বকর্মা। তাঁর সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হল। গরুড় দেবগণের প্রহারে জর্জরিত হয়ে গর্জন করতে লাগলেন। তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। অবশেষে গরুড় হাজির হলেন অমৃতের কাছে। অমৃতের চারিদিকে আগুন জ্বলছে। বহুরূপধারী গরুড়, বহুমুখে, অনেক নদীর জল পান করে, সেই জলন্ত অগ্নিকে নির্বাপিত করলেন। আরও ক্ষুদ্র দেহ ধারণ করে অমৃতালয়ে প্রবেশ করলেন তিনি। অমৃতভান্ডের কাছে এক তীক্ষ্ণধারবিশিষ্ট লৌহচক্র ঘুরে চলেছে। কামরূপী গরুড় আরও ক্ষুদ্রাকৃতি হয়ে সেই চক্রের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে দেখলেন অমৃত রক্ষা করছে দুটি সাপ। তাদের চোখ আগুনের ভাটার মতো, বিদ্যুতের মতো লেলিহান জিহ্বা, দীর্ঘ শরীর,ঝকঝকে চোখে বিষদৃষ্টি, তারা ক্রোধী,ভয়ানক আকৃতি ও দ্রুতগতিসম্পন্ন তারা। গরুড় ধুলো নিক্ষেপ করলেন সাপেদের চোখে। তাদের দৃষ্টিহীনতার সুযোগ নিয়ে গরুড় তাদের প্রহার শুরু করলেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৩: রাজসেবায় পুরস্কার মিলতেও পারে, নাও মিলতে পারে! কিন্তু সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে রাজরোষে মৃত্যু নিশ্চিত

সেদিন ‘খণ্ডরে’র পুনঃপ্রদর্শন আনন্দ দিয়েছিল বিশ্বের তাবড় সিনেমাপ্রেমী থেকে বরেণ্য সেই পরিচালককে

সাপদুটিকে হত্যা করলেন গরুড়। অমৃতভান্ড অবশেষে হাতে এলো তাঁর। কিন্তু হাতে পেয়েও গরুড় নিজে কিন্তু অমৃত পান করলেন না। অমৃত নিয়ে প্রত্যাবর্তনের সময়ে, আকাশপথে তাঁর সঙ্গে দেখা হল বিষ্ণুর। নির্লোভ গরুড়কে, বিষ্ণু বর দিলেন, অমৃত বিনা, গরুড় অজর ও অমর হবেন। গরুড়ও বিষ্ণুকে বর দিতে চাইলেন, বিষ্ণুর প্রার্থনা— গরুড় যেন বিষ্ণুর বাহন হন।বিষ্ণুর ইচ্ছাপূরণ করলেন গরুড়। অমৃত আহরণকারীকে দেবরাজ বজ্রাঘাতে বাধা দিলেন। দেবরাজের সম্মানার্থে পাখার একটিমাত্র পালক,ত্যাগ করলেন গরুড়। এই বজ্রাঘাতের কোনও বেদনাই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। গরুড়ের পরিত্যক্ত এই সুন্দর পর্ণ অর্থাৎ পক্ষ তাই তার নাম হল সুপর্ণ। সুরূপং পত্রমালক্ষ্য সুপর্ণোঽয়ং ভবত্বিতি। ইন্দ্র নতিস্বীকার করলেন।

চিরস্থায়ী মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হলেন দু’জনে। গরুড়ের কাছে শুধু একটাই অনুরোধ ইন্দ্রের, যদি নিজের অমৃতের কোনও প্রয়োজন না থাকে তবে অমৃত ফিরিয়ে দাও আমায়। তুমি যাদের এটি দেবে তাঁরাই অমরত্বলাভের কারণবশত আমাদের উৎপীড়ক হয়ে উঠবেন। ন কার্য্যং যদি সোমেন মম সোমঃ প্রদীয়তাম্। অস্মাংস্তে হি প্রবাধেয়ুর্যেভ্যো দদ্যাদ্ভবানিমম্।।

গরুড় জানালেন, তিনি অমৃত আহরণ করেছেন কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে, কিঞ্চিৎ কারণমুদ্দিশ্য সোমোঽয়ং নীয়তে ময়া। ইন্দ্রকে কথা দিলেন, এই অমৃত তিনি কাউকে দেবেন না। গরুড়ের কার্যসিদ্ধি হলে, ইন্দ্র যেন সেটি সংগ্রহ করে নেন। গরুড়ের এই সরল স্বীকারোক্তিতে ইন্দ্র মুগ্ধ হয়ে বর দিতে চাইলেন। নাগেদের মায়ের কপটাচরণ এবং সন্তানদের ব্যবহার স্মরণ করে গরুড় বর প্রার্থনা করলেন, হে ইন্দ্র, নাগেরা যেন আমার ভক্ষ্য হয়। ভবেয়ুর্ভুজগাঃ শক্র!মম ভক্ষ্যা মহাবলাঃ। সম্মত হলেন ইন্দ্র। বিষ্ণু বরপ্রার্থনা অনুমোদন করলেন। স্থির হল অমৃত রাখামাত্রই ইন্দ্র সেটি হরণ করবেন। আনন্দিত গরুড়,মায়ের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে সাপেদের বললেন, তোমাদের জন্য অমৃত এনেছি, কুশের ওপর অমৃত রাখব, আমি।

ইদমানীতমমৃতং নিক্ষেপ্স্যামি কুশেষু বঃ। নাগেরা যেন স্নান করে মাঙ্গলিকচিহ্ন ধারণ করে অমৃত পান করেন। নাগেদের শর্ত অনুযায়ী, মা বিনতা আজ হতে দাসবৃত্তি থেকে মুক্ত হলেন। সেটাই হোক তথেতি বলেই ব্যস্তসমস্ত অমৃতপানে উদগ্রীব নাগেরা আবশ্যিক স্নানাদি সম্পন্ন করে অমৃত পান করতে উপস্থিত হলেন। কে আগে অমৃত পান করবে? হুড়োহুড়ি পড়ে গেল সাপেদের মধ্যে। ইতিমধ্যে অমৃত ভাণ্ডটি হরণ করেছেন ইন্দ্র।কুশের ওপর ছিল অমৃত। যদি তাতে একবিন্দুও থেকে থাকে এই ভেবে কুশ লেহন করতে লাগল নাগেরা। তাদের জিহ্বাগুলি দু’ভাগ হয়ে গেল। কুশের ওপরে অমৃত ছিল, তাই কুশ’পবিত্র’ নামে ভূষিত হল। এরপরে গরুড় সাপ ভক্ষণ করে, আনন্দিত মনে, মা দেবী বিনতার সঙ্গে বসবাস করতে লাগলেন। বিনতার দাসীবৃত্তির কারণ হল দুটি। একটি কদ্রুর তঞ্চকতা বা প্রতারণা এবং অপরটি হল পুত্র অরুণের অভিশাপ। দুটো থেকেই মুক্ত হলেন তিনি।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মহাভারতের বিশাল ব্যাপ্তিতে কত যে নামমাহাত্ম্য,কত পরিচিত চরিত্রের বৈচিত্র্যময় আখ্যান লুকিয়ে আছে এখানে। অজানা গল্পকথার ভাণ্ডার, ভারতীয়দের অমূল্য সম্পদ মহাকাব্য মহাভারত। কদ্রুবিনতার পারিবারিক কলহের ছবি, রেষারেষির প্রতিযোগিতায় সন্তানরাও যুক্ত হয়েছে। কদ্রুর প্ররোচনায় নাগেরা, আর মা বিনতার দাসত্বের যন্ত্রণায় মর্মাহত গরুড়। আধুনিক ভারতবংশীয়দের মধ্যে, প্রতিযোগিতা এখন সংক্রামক ব্যাধির পর্যায়ে রয়েছে। এর পরম্পরা বোধ হয় মহাকাব্যেও ছিল। কদ্রুবিনতার সন্তানকামনায় তাঁর প্রতিফলন, মহাভারতীয় ভারতযুদ্ধের উদাহরণ তার ব্যতিক্রম নয়। ফল ভোগ করতে হয় সন্তানদের। মায়েরাও তার কুপ্রভাব এড়িয়ে যেতে পারেন না।

বিনতার প্রতি কদ্রুর প্রতারণার মাধ্যমে যার সূচনা, তাঁর সন্তান নাগেরাও অমৃতলাভে বঞ্চিত হয়েছেন। বঞ্চনা, প্রতারণায় পরিসমাপ্তি। কদ্রুকৃত বঞ্চনা ইগোর লড়াইয়ের প্রতিফলন, আর গরুড়ের সাপেদের প্রতি প্রতারণাটি শক্তির অপব্যবহার প্রতিরোধ। ঠিক কুরুপাণ্ডবদের শত্রুতা আর যুদ্ধজয়ের যেন ছোট প্রতিচ্ছবি। কদ্রুবিনতার শত্রুতার আপাত পরিসমাপ্তি ঘটেছে। যদিও পাখীদের ভোজ্য সাপেরা, আবার সাপেরাও পাখীদের বাগে পেলে ছেড়ে দেয় না। এতো প্রাকৃতিক জৈবধর্ম। সেই ভোজ্য এবং ভোজনকর্তার সাধারণ ধর্মটিকে এক অনবদ্য কাহিনি পরিবেশনের মাধ্যমে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন মহাকাব্যকার। এর মধ্যে আছে শিশুচিত্তকে আকর্ষণের রসদ, পরিণতবুদ্ধির রসগ্রাহিতার সাযুজ্য, চরিত্রের বৈচিত্র্যময় সমাহার, আরও কত কি—সব বয়সের, সব কাব্যরসিকের রসের অনুপান। এ সবকিছুই মহাকাব্যিক সংযোজনের রঙবাহার।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content