রবিবার ১৯ মে, ২০২৪


শ্বেতকি নামে এক মহাবিক্রমশালী রাজা ছিলেন। তিনি অন্য কোনও প্রকার কাজের থেকেও যজ্ঞ দান ইত্যাদি কাজই বেশি পছন্দ করতেন। এদিকে অনবরত যাজনের ফলে যজ্ঞের ধোঁয়ায় রাজার পুরোহিতদের চোখ আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। আকুল হয়ে থাকতেন তাঁরা। ধীরে ধীরে তাঁদের চোখের রোগ হল। একসময় তাঁরা আর যজ্ঞ করতে রাজি হলেন না। রাজা তখন তাঁদের অনুমতি নিয়ে অন্য পুরোহিতদের সাহায্যে যজ্ঞের কাজ শেষ করলেন। এই করে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। রাজার মনে মনে আবার যজ্ঞ করবার ইচ্ছা জাগল। এবারে আরও বড় আয়োজন হবে, আর যজ্ঞও হবে দ্বাদশবর্ষব্যাপী। তিনি পুরোহিতদের শরণাপন্ন হলেন। দ্বাদশবর্ষব্যাপী সত্রযাগ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তাঁদের কাছে। কিন্তু পুরোহিতেরা যজ্ঞপাগল রাজার এই অনুরোধে কেউই গরজ দেখালেন না। রাজার বারংবার একান্ত অনুরোধেও যখন চিঁড়ে ভিজল না তখন রাজা সখেদে বলে উঠলেন, ‘কী কারণে আপনারা আমার সঙ্গ ত্যাগ করেছেন! কী কারণেই বা আমার যজ্ঞকার্যে সহায়তা করছেন না?’ পুরোহিতেরা বলে ওঠেন, ‘অনবরত যজ্ঞানুষ্ঠানে আপনাকে সহায়তা করতে করতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর কোনও মতেই আমাদের পক্ষে যজ্ঞকাজের বিপুল ভার বহন করা সম্ভব নয়।’ রাজার অনুনয়ে পুরোহিতেরা কিছুটা নরম হন আর বলেন একমাত্র দেবাদিদেব মহাদেব তাঁকে যাজন করতে পারেন। পুরোহিতদের পরামর্শে রাজা শ্বেতকি মহাদেবের দর্শন পাওয়ার ইচ্ছায় কঠোর তপস্যায় ব্রতী হন। অবশেষে রাজার একাগ্রতায় তুষ্ট হন আশুতোষ। তিনি বলেন, একটিমাত্র শর্তে তিনি রাজার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করবেন। রাজা যদি বারো বছর ধরে একমনে অগ্নিকে ঘৃতাহুতিতে তৃপ্ত করেন, তবে তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। শ্বেতকিরাজার যজ্ঞই ছিল প্রাণ। তিনি মহাদেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। বারো বছর ধরে অগ্নিদেবকে ঘৃত দ্বারা তৃপ্ত করে তিনি ফিরে গেলেন মহাদেবের কাছে। আবার জানালেন তাঁর আর্জি। মহাদেবের নির্দেশে দুর্বাসামুনি শ্বেতকিরাজার যজ্ঞে যাজন করেছিলেন। শ্বেতকিরাজার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। রাজার সেই সত্রে যারা উপস্থিত ছিল, তারা সকলেই অপূর্ব সে আয়োজন আর যজ্ঞের সাক্ষী হতে পেরে ধন্য ধন্য করেছিল। এদিকে শ্বেতকিরাজার সত্রযাগে অগ্নিতে অনবরত ঘৃতাহুতি দেওয়ার ফলে অগ্নিদেবও অত্যন্ত তৃপ্ত হলেন। কিন্তু অগ্নিদেব অজীর্ণ রোগে আক্রান্ত হলেন। অজীর্ণতা থেকে তাঁর ভয়ানক অরুচি উপস্থিত হল। তিনি ক্রমশ তেজোহীন হয়ে পড়লেন। রোগের কষ্টে তিনি পিতামহ ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা তাঁকে খাণ্ডববন দগ্ধ করবার পরামর্শ দিলেন। অগ্নি ইতিপূর্বেও দেবতাদের আদেশে দেবশত্রুদের নিবাস সেই খাণ্ডববন দগ্ধ করেছেন। সে বনে অনেক জন্তুর নিবাস। ব্রহ্মা বললেন দগ্ধীভূত খাণ্ডববনের পশুদের দগ্ধ মেদ ভক্ষণ করলেই অগ্নি আবার পূর্বের অবস্থা ফিরে পাবেন। অগ্নিও দ্রুত রোগ মুক্তির আশায় পূর্বপরিচিত খাণ্ডববনে গমন করলেন আর প্রবল বেগে জ্বলে উঠলেন। কিন্তু সেখানকার পশুরা নানা উপায়ে অগ্নির সে কাজে জল ঢেলে দিল। এমনি করে সাত সাতবার অগ্নির খাণ্ডববন দহনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। ক্রুদ্ধ হলেন অগ্নি। রোগযন্ত্রণায় কাতর হয়ে তিনি আবার ব্রহ্মার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মা তখন তাঁকে উপদেশ দিলেন আরও কিছুকাল অপেক্ষা করবার জন্য। তিনি বললেন নর আর নারায়ণ ঋষি কৃষ্ণ আর অর্জুন রূপে জন্মাবেন। তাঁরাই অগ্নিদেবের খাণ্ডববনদহনে সহায়ক হবেন।

এদিকে দ্রৌপদীর সঙ্গে বিবাহের পর পাণ্ডবেরা ইন্দ্রপ্রস্থে এসে সবে থিতু হয়েছেন। সহায় হিসেবে পাশে পেয়েছেন রাজা দ্রুপদকে। কৃষ্ণের সঙ্গে আগে থাকতেই পাণ্ডবদের আত্মীয়তা ছিল। সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিবাহের পর সেটা আরও গাঢ় হল। কৃষ্ণ আর অর্জুন পরস্পরের সখা হলেন। মনের আরও কাছাকাছি এলেন তাঁরা। যুধিষ্ঠিরের মিষ্ট স্বভাবের গুণে খুব তাড়াতাড়িই তিনি ইন্দ্রপ্রস্থের প্রজাদের প্রিয় হয়ে উঠলেন। বহুকাল পর এমন নির্বিঘ্নে কাটানোর পর কৃষ্ণ আর অর্জুন একদিন যমুনাতীরবর্তী উপবনে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে গেলেন। যমুনানদীর তীরেই খাণ্ডববনের অবস্থান। সেই খাণ্ডববন বহুবিধ প্রাণীর আবাসস্থল। কৃষ্ণার্জুন সেইস্থানে মনোমতো বিহার করতে লাগলেন। এমন সময়ে এসে উপস্থিত হলেন এক ব্রাহ্মণ। সেই ব্রাহ্মণের আকৃতি বিশেষ দর্শনীয়। অতি দীর্ঘ আকৃতি সেই ব্রাহ্মণের, গায়ের তপ্ত সোনার মতো, শ্মশ্রু হলদেটে রঙের, অত্যন্ত তেজস্বী তিনি আর চোখদুটি পদ্মপাতার মতো দীর্ঘ আর আয়ত। এমন আকৃতিবিশিষ্ট ব্রাহ্মণ কোনও সাধারণ ব্যক্তি হতে পারেন না। কৃষ্ণ আর অর্জুন যেন কতকটা সম্মোহিতের মতোই উঠে দাঁড়ালেন তাঁকে দেখে। সেই অপরিচিত ব্রাহ্মণ নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনি অগ্নি। বহুভোজী তিনি। তবে বর্তমানে একটি রোগে আক্রান্ত। তাই খেতে পারেন না। এমতাবস্থায় কৃষ্ণার্জুনই একমাত্র এ বিপদ থেকে উদ্ধারে তাঁকে সহায়তা করতে পারেন বলে তাঁর বিশ্বাস। কৃষ্ণার্জুন জানতে চাইলেন কীভাবে তাঁরা সাহায্য করতে পারেন? অগ্নি তখন জানালেন সে উপায়। অগ্নি বলে চলেন, তিনি যদি খাণ্ডববন দগ্ধ করে দগ্ধ পশুদের মেদ ভক্ষণ করেন, তবেই রোগমুক্তি সম্ভব। এদিকে এ বিরাট খাণ্ডববন রক্ষা করছেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। কারণ এই বনেই সদলবলে বাস করে ইন্দ্রের বন্ধু তক্ষকনাগ। কিন্তু অগ্নি যখনই এই বন দগ্ধ করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, বাধা পেয়েছেন ইন্দ্রের কাছ থেকে। প্রবল বৃষ্টিতে ব্যাহত হয়েছে দহনকাজ। এখন একমাত্র কৃষ্ণ আর অর্জুনই পারেন ইন্দ্রকে বাধা দিয়ে তাঁকে খাণ্ডববন দহনে সহায়তা করতে। অর্জুন আর কৃষ্ণ উভয়েই সম্মত হলেন অগ্নিদেবকে এ রোগযাতনা থেকে মুক্তি দিতে। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্রের দেবশক্তির মোকাবিলা করবার জন্য যথোপযুক্ত ধনুক ছিল না অর্জুনের। অগ্নির আদেশে বরুণদেব অর্জুনকে গাণ্ডীব ধনু দিলেন, দুটি আশ্চর্য তূণ এবং একটি চমত্কার রথ দিলেন। রথখানি বিশ্বকর্মা চন্দ্রদেবের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন। এবার অর্জুন সেই রথটি পেলেন। অগ্নিদেবের কাছ থেকে কৃষ্ণ পেলেন আশ্চর্য সুদর্শনচক্র আর বরুণদেবের কাছ থেকে পেলেন কৌমোদকী গদা। এমন সব অত্যাশ্চর্য অস্ত্র পেয়ে তাঁরা দুজনেই অত্যন্ত আনন্দিত ও উৎসাহিত হয়ে অগ্নিদেবকে জ্বলনকার্য শুরু করতে অনুরোধ করলেন। অগ্নির খাণ্ডববন দহন, কৃষ্ণার্জুনের সহায়করূপে উপস্থিতি সবটাই পূর্বনির্ধারিত ছিল। অগ্নির এ বারের জ্বলে ওঠাও রোগমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে ভরপুর ছিল। প্রবল সে ইচ্ছা ফলপ্রসূ হল। দেবরাজ ইন্দ্র বন্ধু নাগেদের রক্ষা করতে চাইলেন। শুরু হল বজ্রবিদ্যুত্সহ প্রবল বৃষ্টি।

একদিকে আগুনের লেলিহান শিখা, অন্যদিকে বিদ্যুতের ঝলকানি আর প্রবল বর্ষণ, সে এক প্রলয়ংকর পরিস্থিতির সাক্ষী হতে লাগল খাণ্ডববন। কৃষ্ণ আর অর্জুন ইন্দ্রকে রোধ করবার জন্য প্রবল প্রতাপে মহাবেগে বাণবর্ষণ করে জলবর্ষণ বন্ধ করতে লাগলেন। সবটাই বুঝি পূর্বনির্ধারিত। ইন্দ্র অর্জুনের সে প্রবল যুদ্ধে দেবতারাও অস্ত্র ধারণ করলেন কৃষ্ণার্জুনের বিরুদ্ধে। ইন্দ্র বুঝি পুত্র অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন এভাবে! পাণ্ডব আর কৌরবদের মধ্যে বিবাদের আগুন তখন ধিকি ধিকি জ্বলছে। সে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে পারে যে কোনও সময়েই। এ সময় পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জুনের ক্ষাত্রতেজে শান দেওয়ার জন্যই যেন অগ্নি আর ইন্দ্রদেবের আবির্ভাব। কৃষ্ণ এবং অর্জুন প্রবল প্রতাপে দেবতাদেরকেও বিধ্বস্ত করলেন। দেবতাদের রক্ষা করবার মানসে ইন্দ্র এক বিপুল পর্বতশৃঙ্গ অর্জুনকে লক্ষ্য করে ছুঁড়লেন। সে পর্বত অর্জুনের বাণে বহু টুকরো হয়ে খাণ্ডববনে এসে পড়ল। অস্থির হয়ে উঠল সেখানকার প্রাণীরা। ইন্দ্রসহ দেবতারা কৃষ্ণ ও অর্জুনের পরাক্রমের সঙ্গে পেরে উঠলেন না। তাঁরা কৃষ্ণার্জুনের এমন পরাক্রম দেখে তুষ্ট হলেন এবং দেবরাজও উপলব্ধি করলেন খাণ্ডববন দগ্ধ হওয়া বিধিনির্দিষ্ট। দেবতাদের সঙ্গে ইন্দ্র স্বর্গে ফিরে গেলেন। খাণ্ডববন অভিভাবকশূন্য হল। একে একে দগ্ধ হল সেখানকার জীবজন্তুরা। অগ্নিদেবও অতি আনন্দে জীবসকলের মেদমাংসে তৃপ্ত হলেন। সে ভীষণ অগ্নিকাণ্ডের সময় তক্ষকনাগ সেখানে উপস্থিত ছিল না। তক্ষকপত্নী নিজের পুত্র অশ্বসেনকে রক্ষা করবার জন্য গিলে ফেলল তাকে। অর্জুনের শরাঘাতে তক্ষকপত্নীর মৃত্যু হল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ইন্দ্র প্রবল বায়ুবর্ষণ করালেন। সেই সুযোগে অশ্বসেন মুক্ত হয়ে গেল। তক্ষকের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল ময় নামের এক অসুর। সে বাঁচতে চেয়ে কৃষ্ণার্জুনের শরণাপন্ন হল। রক্ষা পেল সে।

অগ্নি পনেরোদিন ধরে নির্বিঘ্নে খাণ্ডববন দগ্ধ করেছিলেন। ময়দানব ছাড়াও তক্ষকনাগের ছেলে অশ্বসেন আর চারটি খঞ্জনপাখি সে ভীষণ আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিল।

জনমেজয় এতক্ষণ ধরে স্তব্ধ হয়ে খাণ্ডববন দহন বৃত্তান্ত শুনছিলেন। বৈশম্পায়নের বর্ণনার মাঝখানেই তাঁকে থামিয়ে জনমেজয় বলে ওঠেন, ‘ছোট্ট খঞ্জনপাখিগুলো কীভাবে এমন ভীষণ অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা পেল? এ জানতে বড় উৎসাহী আমি।’

গল্প বলায় ক্লান্তি নেই সৌতি বৈশম্পায়নের। মন্দপালমুনির পুত্র চারটি খঞ্জনপাখির সে আশ্চর্যকাহিনি বলে চলেন তিনি…

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

Skip to content