রবিবার ১৭ নভেম্বর, ২০২৪


মা সারদা।

১৩১৯ সালের ঊনিশে কার্তিক শ্রীমা কাশীর উদ্দেশে যাত্রা করেন। পরের দিন বেলা একটার সময় কাশী পৌঁছন। শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈত আশ্রমের কাছে লক্ষ্মীনিবাসে তিনি প্রায় আড়াই মাস থাকেন। গোলাপমা, ভানুপিসি, কেদারের মা, নিকুঞ্জদেবী, মহামায়া মিত্র প্রমুখ মহিলা ভক্তরা আর মাস্টারমশাই, বিভূতিবাবু প্রভৃতি পুরুষভক্তরা তাঁর সঙ্গে সেবার কাশী যান।
গণেন্দ্রনাথ শ্রীমাকে কাশীতে পৌঁছে দিয়ে কিছুদিন পর কলকাতায় ফিরে আসেন। মহারাজ, হরিমহারাজ, মহাপুরুষ মহারাজ প্রমুখ ঠাকুরের ত্যাগী ভক্তরা আগে থেকেই কাশীতে ছিলেন। কাশীর ডাক্তার ভক্ত নৃপেন্দ্র মুখোপাধ্যায় মা সারদার তীর্থযাত্রার সব ব্যয়ভার বহন করেন। তিনি প্রতিদিন সকালে গঙ্গাস্নান করে এক ঠোঙা মিষ্টি নিয়ে এসে শ্রীমাকে প্রণাম করতেন আর মা সারদা তার দিকে করুণদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৪: শ্রীমার সঙ্গে বেলুড়মঠে দুর্গোৎসব পালন

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

এর আগে দুবার কাশীতে থাকলেও শ্রীমা সেখানে বেশি দিন বাস করতে পারেননি। এ বার সেই সুযোগ পেয়ে শ্রীমা শিবমহাপুরাণের কাশীখণ্ড শোনেন ও বিশেষ বিশেষ মন্দির আর স্থানগুলো দর্শন করেন। বিখ্যাত গায়ক অঘোরনাথ চক্রবর্তী গঙ্গাস্নান এবং বিশ্বনাথমন্দির দর্শন করে এসে শ্রীমাকে রামপ্রসাদী ও কাশীমাহাত্ম্যযুক্ত গান শুনিয়েছিলেন। একদিন শ্রীমা বাবু শম্ভুনাথের ঘোড়ার গাড়ীতে দুর্গাবাড়ি যান। বাবু শম্ভুনাথ নৃপেন ডাক্তারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি সস্ত্রীক শ্রীমাকে দর্শন করেন আর নিজের গাড়ি তাঁকে ব্যবহার করতে দেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

যাবার সময় মা সারদা বিভূতিবাবুকে বাড়িতে থাকতে বললেন। তিনি বলেন, ‘ঠাকুর আমাকে বলতেন, কত আর ঠাকুরদের প্রণাম করবে? একটা কলসীর ভেতর সব ঠাকুরদের পুরে, সেই কলসীটিকে প্রণাম কল্লেই সবাইকে প্রণাম করা হল’। কেদারনাথের আরতি দেখে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘এ কেদার সেই কেদার এক, যোগ আছে, এঁকে দর্শন কল্লেই তাঁকে দর্শন করা হয়, বড় জাগ্রত’।

কাশীতে মা সারদা দু’জন সাধুকে দর্শন করেছিলেন। গঙ্গাতীরে নানকপন্থী এক সাধুকে তিনি টাকা দিয়ে প্রণাম করেন ও ঠাকুরের গুরু তোতাপুরীর আখড়ার সঙ্গে যুক্ত এক নাগাসন্ন্যাসী চামেলিপুরীকে দেখে এসে তাঁর জন্য ফল, মিষ্টি ও কম্বল পাঠান। একদিন মা সারদা দুটি আশ্রমের সাধুদের খাইয়ে প্রত্যেককে একটি করে কাপড় দক্ষিণারূপে দিয়েছিলেন। সেবাশ্রম ঘুরে দেখে তিনি সেই প্রতিষ্ঠান ও তার স্থাপয়িতার খুব প্রশংসা করেন। নিজে সেখানে অর্থভাণ্ডারে দশটাকা দান করেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪০: বিশ্বকবির তিন মেয়ে— অকালে ঝরে যাওয়া প্রতিভা

এরপর শ্রীমাকে একদিন সারনাথ দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে সেদিন মহারাজ ও অন্য অনেকেই সারনাথে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় মহারাজ নিজে যে গাড়িতে গিয়েছিলেন, সেই গাড়িতে আগে শ্রীমাকে পাঠিয়ে দেন। আর মা সারদা যে গাড়ীতে গিয়েছিলেন, সেই গাড়িতে নিজে যান। কিছুদূর যেতে না যেতেই পেছনের গাড়ির ঘোড়াটি হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে পথভ্রষ্ট হয় আর গাড়িটি বেগের সঙ্গে নিকটবর্তী ধ্বংসস্তূপের গায়ে ধাক্কা খায়। আঘাত লেগে মহারাজের শরীরের জায়গায় জায়গায় রক্ত বেরিয়ে আসে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

মহারাজের গাড়িতে আরও দু’তিনজন সাধু ছিলেন। আঘাত আসন্ন দেখে মহারাজ তাদের ‘মাথা বাঁচাও’ বলেই নিজের মাথা দুহাতে দু’ দিকে চেপে ধরেছিলেন। আঘাত লাগামাত্র ভাবের ঘোরে গেয়ে ওঠেন, ‘সুখের বাসনা কর আর কদিন। ছাড়ি অন্য বোল, কালী কালী বল, মানবজীবন যদিন’। শ্রীমা শুনে বলেছিলেন, ‘এ বিপদ আমারই অদৃষ্টে ছিল, রাখাল জোর করে নিজের ঘাড়ে টেনে নিলে!’
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content