শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

সাইকেল বলল, “নমস্তে ডাগ্দারবাবু, আবার দেখা হয়ে গেল! হেঁ হেঁ!” বলে দেঁতো হাসি হাসল সে।
সত্যব্রত একবার মাত্র দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, তাও কয়েক মুহূর্তের জন্য, কিন্তু বাইরে তা বুঝতে দিলেন না। মুখে হাসিটা ধরে রেখে বললেন, “তাই তো দেখছি! আমার কপাল ভালো বলতে হবে। নাহলে, পর পর দু’ দিন সাইলেক বাবুর সঙ্গে দেখা হওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার।”
“কী যে বলেন ডাগ্দারবাবু। আমরা খেটে খাওয়া গরিবগুর্বো মানুষ। আমাদের আর কে পোঁছে?” বিনয় ঝরে পড়ে সাইকেলের গলায়।
“কিন্তু আমি তো শুনেছি, সাইকেল মাহাতো এই জঙ্গলের রাজা। তাকে এড়িয়ে একখানা পাতাও গাছ থেকে খসে পড়ার যো নেই! ভুল শুনলাম না কি?”
সাইকেল বলল, “কারা এ-সব বাত বোলে ডাগ্দারবাবু ? আমি হাতে-পায়ে খেটে রোজগার করি। কারও ক্ষেতি করিনি কখনও! লোকের আসলে চোখ টাটায়, নানা ইঙ্গিত করে, সেই কারণে আমাকে সবাই ভুল বোঝে!”
সত্যব্রত বললেন, “আমি একটুও ভুল বুঝছি না তোমায়। তোমার আচার-ব্যবহার, রুচি, শিক্ষা ইত্যাদি প্রমাণ করে যে, তুমি একজন রইস আদমি। কত বড় বড় মানুষ কি আর এমনি এমনি তোমায় ভালোবাসে? নির্ভর করে এত? সেই জন্যই বললাম, যার ঘোরাঘুরি, ওঠাবসা বড় মানুষদের সঙ্গে, সে যদি আমার মতো সাধারণ একজন মানুষকে নমস্কার করে, তাহলে তো বলতেই হয় আমার কপাল সত্যিই আজ আমার প্রতি প্রসন্ন।”
সাইকেল বলল, “বড় মানুষ কি না জানি না, তবে হ্যাঁ, অনেক এমপি, এমএলএ-র প্রয়োজনে ডাক পড়ে এই অধমের। তা সাইকেল পারে বলেই তো তাঁরা ডাকেন। আমি আবার কাউকে না বলতে পারি না! যে-যেখানে ডাকে, সেখানেই যাই। হেঁ হেঁ হেঁ !” কথার পিঠে হাসা সম্ভবত তার মুদ্রাদোষ।
হরিপদ বলল, “কী মাহাতো ভাই, ভালো আছো?”
“আরে দাদা, তুমি কেমন আছো? আমি খেয়ালই করিনি।”
“ভালো আছি কি না জানি না ভাই, তবে বলি মোটামুটি আছি!” হরিপদ উত্তর দেয়।
“এ আবার কেমন কথা?” অবাক হয় সাইকেল।
এই শান্ত ছোট জায়গাতেও যা ঘটছে একের পর এক, তা অকল্পনীয়। তিন-তিনটে খুন পর পর দু’দিনে? ভাবা যায় না। আমার তো ধারণা, আগে কখনো হয়নি এমন!”
“সত্তর সালের দিকে শুনেছি, এখানে একদল নকশাল যুবক-যুবতী লুকিয়ে ছিল। পুলিশ খোঁজ পেয়ে একেবারে ক্লোজ এনকাউন্টারে ঠুকে দেয়। সেবার এক লপ্তে দশ-পনেরোটি লাশ গাড়ি বোঝাই করে যেতে দেখেছি। তখন অবশ্য আমরা খুবই ছোট। দেখবার কথা নয় এটা, বোঝবার ও মনে রাখবার মতো কথা। তারপর আর হয় নি। অন্তত আমরা শুনিনি কখন।”
“তাহলেই বোঝো! তুমি শুনেছ কি না জানি না, আমার পরিবার কলকাতায় চলে গেছে, তারা কেউই এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নয়।” ইচ্ছে করেই বললেন সত্যব্রত। যেন, সাইকেল কত ঘনিষ্ঠ তাঁর, ঘরের কথা সে জন্য শেয়ার করছেন তার সঙ্গে।
“তাই না কি?” উত্তেজনার লেশমাত্র দেখা গেল না সাইকেলের মুখে-চোখে, কিন্তু বাইরে দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, “তাহলে তো ভারি অসুবিধা হয়ে গেল আপনার ডাগ্দারবাবু ! আপনি একা এখানে পড়ে রইলেন, আর বাকিরা চলে গেল! ভাবীজীরও তো অসুবিধা হবে। আপনি আর একা পড়ে থাকবেন কেন? আপনিও চলে যান। যত তাড়াতাড়ি পারেন।”
সাইকেলের গলার স্বরে প্রচ্ছন্ন হুমকি কিংবা সতর্কতার বার্তা যেন ধ্বনিত হল। সত্যব্রত এমনটাই আশা করছিলেন। সাইকেল হেমব্রম যতই খতরনাক্ ক্রিমিনাল মাইণ্ডের লোক হোক না কেন, বড় বোকা। তা না হলে এমন কাঁচা কাজ কেউ করে? আসলে সে হুমকি দিচ্ছে, যাতে সত্যব্রতও তাঁর পরিবারের মতো দ্রুত এখান থেকে পাততাড়ি গোটান।
সত্যব্রত বললেন, “সেটাই তো চাই। কিন্তু হচ্ছে কই ? আমি চাইলেই তো আর সরকার আমায় এখান থেকে নড়াবে না ? হেলথ্ সেন্টার খালি ফেলে রাখতে কোন সরকারই বা চায় বলো?”
সাইকেল মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে, “আরে ছোঃ! ডাগ্দারবাবু, ওটা কোন ব্যাপার নয়। আপনি বললে আমি সিওএমএইচ সাহেবের সঙ্গে বাত্ করতে পারি! মন্ত্রী লেভেলেও কিছু জানপহচান আছে আমার। বলেন তো…!”
মারুতি এবং তার স্ত্রী এতক্ষণ চুপ করে উভয়ের কথাবার্তা শুনছিল। সাইকেলের কথা শুনে থাকতে না পেরে মারুতি বলে উঠল, “আরে সাইকেল, এটা তুই কী করছু? ডাগ্দারবাবু চলে গেলে হামাদের মতো গরীব মানুষের কী হবে?”
সাইকেল দাঁ মুখ খুঁচিয়ে বলে উঠল, “আরে যা জানিস না তা নিয়ে বাত করতে আসিস কেন? ব্যাটা চুল্লুখোর কোথাকার! চুপ থাক্!”
“আমি চুল্লুখোর ঠিক আছে। কিন্তু তুই তো একই ঠেকে বসে চুল্লু খাস, তুই কী খোর শুনি?”
“তোর বড় বুলি ফুটেছে মুখে দেখছি! ঠান্ডা করার অস্ত্র আমার হাতে আছে!” শীতল গলায় বলে উঠল সাইকেল। তার চোখ-মুখ বদলে গিয়েছে সম্পূর্ণ।
“আরে রাখ। তোর অস্ত্র বলতে তো ওই মুঙ্গেরী বন্দুক আর ড্যাগার! ও দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করবি ভেবেছিস?”
“সে দেখা যাবে! ডাগ্দারবাবু চলে যান, হিসেব-নিকেশ বরাবর করে দেবো!”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৩: যেখানে দেখিবে ছাই

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু! পর্ব-২৮: সব রহস্যই কি ট্রেনের টিকিটে লুকিয়ে?

সত্যব্রত অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, “কী সাইকেল? তুমি মুঙ্গেরী বন্দুক কোথায় পেলে ? আর ড্যাগার ? ও নিয়ে কী করো ? লাইসেন্স আছে তো বন্দুকের?”
“আজ্ঞে, আছে। বিশ্বাস না হয়, যাকে খুশি জিজ্ঞাসা করবেন এই গাঁও-ঘরে। সে-ই বলে দেবে।”
“আমি তো যাঁরা পারমিশন দেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করার কথা ভাবছি। যাই হোক, আমার জন্য যে এইটুকু ভেবেছ, তার জন্য ধন্যবাদ !”
“আরে ডাগ্দার বাবু, এ তো আমার ডিউটি আছে। এর জন্য হামাকে ধন্যবাদ কেন দিচ্ছেন? আপনি একবার বলুন, হামি আপনার চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি!”
সত্যব্রত এ বার হাসিমুখে বললেন, “আমাকে তাড়াতে চাইছ সাইকেল?”
সাইকেল এক মুহূর্ত ফ্রিজ হয়ে গেল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, “কী যে বলেন ডাগ্দারবাবু! হামি কেন আপনাকে তাড়াতে চাইবো? হামার কী স্বার্থ?”
“সেটাই তো জানতে চাইছি সাইকেল? এর আগেও চার্চের লবিতে দাঁড়িয়ে তুমি আমায় প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছিলে। কিন্তু কেন? আমি তো তোমাদের পিছনে লাগিনি!” সত্যব্রত মোটেই ঠাট্টার স্বরে কথাগুলি জিজ্ঞাসা করলেন না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

সাইকেল এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল সত্যব্রতর দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আপনাকে হুমকি দিতে যাব কেন ডাগ্দারবাবু ? আমি আপনার ভালোর জন্যই বললাম। বাড়ির সকলে আপনাকে ফেলে চলে গেছে বললেন, একা আছেন। কোনদিন কী না কী হয়ে যায় তার ঠিক আছে। জঙ্গল বহোত খতরনাক জায়গা আছে ডাগদার বাবু! হামরা যারা এখানে জন্মেছি, তারা জানি, সেই জন্যই বললাম। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, মানুষের ভালো করতে গিয়েছ কী মরেছ! অত ভালো করতে যাবেন না। বুধন মরেছে, মরেছে। হামাদের মতো গরীবদের ঘরে অমন মত্ অনেক হয়। ও সব কিছুই না! আপনি কেন বুধনকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন?”
“আমি যে বুধনকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি, তা তোমায় কে বলল সাইকেল? তুমি তো এইমাত্র এলে আর তোমার সামনে তো মারুতির সঙ্গে ও নিয়ে কোন কথা হয়নি, তবে? তুমি কি আমার উপর স্পাইং করছ না কি সাইকেল?”
“মানে?”
“নজর রাখছ আমার গতিবিধির উপরে? না কি কেউ তোমাকে খবর সাপ্লাই করছে? কিসের এত ভয় তোমার ? একজন ডাক্তার হিসেবে বুধনের কেসটা আমার কাছে একটু অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে। আমাদের ডাক্তারদের ক্ষেত্রে এই রকম অদ্ভুত মেডিকেল কেস এলে আমরা সেটা নিয়ে গবেষণা করি, কোথাও ওই বিষয়ে তথ্য ইত্যাদি দিয়ে লেখা লিখি, যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোথাও একই ধরণের পেশেন্ট এলে, তার চিকিৎসার ব্যাপারে তাঁরা ওয়াকিবহাল থাকেন। সেই কারণেই আমি বুধনের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে এসেছি। একটা লেখা লিখব বলে। কিন্তু এসে দেখছি রহস্য একটা আছেই। তা না হলে, তুমি আগ বাড়িয়ে এখানে পৌঁছে যেতে না। কিন্তু রহস্যটা কী, সেটাই আমি বুঝতে পারছি না!”
“সব কিছু বুঝে কি কিছু লাভ আছে ডাগ্দারবাবু ?”
“ওই যে আগেই বললাম, কিসে লাভ আর কিসে ক্ষতি! তবে তুমি বুঝবে না। বোঝার কথাও নয়। ও নিয়ে মাথা ঘামালে বুঝতে হয়তো!”
“আমার মাথা ও সব ব্যাপারে ঘামাই না ডাগদার বাবু ! আমার অন্য অনেক কাজ আছে।”
“জানি তো তুমি কাজের মানুষ। প্রথমেই তো তোমায় বললাম। চার্চের ফাদার থেকে এলাকার বিধায়ক সবাইকে তুমি হাতের মুঠোয় রেখেছ, কিংবা তাঁরা তোমায় মুঠোবন্দী করে রেখেছেন। তবে দেখ, কখনো যদি মুঠো আলগা হয়, তাহলে কিন্তু তোমারই বিপদ!”
“এ বার আপনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন ডাগ্দারবাবু?”
“পাগল ! আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা। জঙ্গলে বসে জঙ্গলের নেকড়কে হুমকি দেবো? আমি কেবল বলতে চাইছি, কোন প্রাণির থেকে বিপদ আসতে পারে, সে-বিষয়ে আমার জ্ঞান বা ধারণা আছে!”
“হতে পারে আপনার সে ধারণা ভুল। এমন কোন প্রাণি থাকতে পারে, যা আপনার জ্ঞান বা ধারণার বাইরে। তার সামনে পড়লে তখন আফশোস করবেন!”
“কালাদেও-র কথা বলছ?”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা

সাইকেল সত্যব্রতর প্রশ্নের জবাব দিল না কোনও। মারুতির দিকে বলল, “হামি এখন আসি রে মারুতি। আবার পরে দেখা করব। দেখিস, নেশার ঘোরে এমন কিছু বলিস না যাতে, তুর প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়! আসি!” বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content