রবীন্দ্রনাথ ও মহারাজ রাধাকিশোর।
রবীন্দ্রনাথ সাত বার আগরতলা সফরে এসেছিলেন। এর মধ্যে পাঁচ বারই আসেন রাধাকিশোরের রাজত্বকালে। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে রাজাই প্রথম কবিকে আমন্ত্রণ করে আগরতলা নিয়ে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন সপরিবারে শিলাইদহে। লেখা এবং চাষ আবাদ নিয়ে দিন কাটছে তাঁর। বছরের গোড়ায় ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকালমৃত্যু বিশেষ আঘাত দিয়েছে তাঁকে। কুষ্টিয়ার ‘ঠাকুর কোম্পানি’র ক্ষতি, কবি ঋণগ্রস্হ। আর্থিক, পারিবারিক পীড়া—সব মিলিয়ে সংকটে কবি। বন্ধু রাজা রাধাকিশোর ভাবলেন এই অবস্থায় কবিকে একটু স্বস্তিদানের প্রয়োজন। তিনি তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসলেন আগরতলায়।
আজকের আগরতলা দেখে অবশ্য সেদিনের রাজধানীর ছবিটা কল্পনা করাও কষ্টকর। শহরটি মোটেই গড়ে উঠেনি তখন। উল্লেখযোগ্য রাস্তা ছিল মাত্র দু’টি। রাজবাড়ির পিছনে ছিল মণিপুরী পল্লী রাধানগর। সেদিন আখাউড়া স্টেশনও হয়নি।রেল স্টেশন মোগরা থেকে আগরতলা আসতে হতো। নৌকায়, হাতির পিঠে কিংবা পাল্কীতে পাঁচ মাইল পথ অতিক্রম করে পৌঁছতে হতো রাজধানীতে। আগরতলা তখন মাত্র কয়েক হাজার লোকের বাস। রাজপরিবারের সদস্য-সহ উজির নাজির আর রাজকর্মচারী ও রাজদরবার নির্ভর জীবিকার লোকদেরই বাস তখন শহরে। কবির থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল কর্ণেল মহিম ঠাকুরের বাড়িতে। কবির সম্বর্ধনার আয়োজন হয়েছিল কুঞ্জবন টিলায়। পার্বত্য পল্লীর জনজাতিদের টং ঘরের নমুনায় বাঁশ দিয়ে মঞ্চ করা হয়েছিল। ফুল, পাতা দিয়ে সাজানো হয়েছিল তা। দিনটি ছিল বসন্তের শ্রীপঞ্চমী। স্ত্রী পুরুষ সবাই বাসন্তী রঙের পোশাক পরেছিলেন।
কবির সম্বর্ধনা উপলক্ষে মণিপুরী নৃত্য গীতের আয়োজন হয়েছিল। কবি অভিভূত হয়েছিলেন এই রাজকীয় সম্বর্ধনায়। এর কিছুদিন পর কবি মহারাজকে একটি রেশমের শাল উপহার পাঠিয়েছিলেন। উপহারের সঙ্গে তিনি রাজপারিষদ মহিম ঠাকুরকে লিখলেন-“…শিল্প বিদ্যালয়কে উৎসাহ দেবার জন্য সেখান হইতে আমি সর্বদা রেশমের বস্ত্রাদি ক্রয় করিয়া থাকি-দোষের মধ্যে লোক ও সামর্থ্য অল্প হওয়াতে তাহারা শীঘ্রই অধিক পরিমাণে কাপড় যোগাইতে পারে না—বন্ধুদের নিকট আমার এই বস্ত্র উপহার কেবল আমার উপহার নহে তাহা স্বদেশের উপহার।…” উল্লেখ করা যায় যে,মহিম ঠাকুর বীরচন্দ্রের আমল থেকেই দীর্ঘদিন ত্রিপুরার রাজপারিষদ ছিলেন। কলকাতায় পড়াশোনার সময় ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কবি ও রাজপরিবারের মধ্যে যোগাযোগে তিনি প্রথম দিকে অনেকটা সেতু হিসেবে কাজ করেছিলেন।
আজকের আগরতলা দেখে অবশ্য সেদিনের রাজধানীর ছবিটা কল্পনা করাও কষ্টকর। শহরটি মোটেই গড়ে উঠেনি তখন। উল্লেখযোগ্য রাস্তা ছিল মাত্র দু’টি। রাজবাড়ির পিছনে ছিল মণিপুরী পল্লী রাধানগর। সেদিন আখাউড়া স্টেশনও হয়নি।রেল স্টেশন মোগরা থেকে আগরতলা আসতে হতো। নৌকায়, হাতির পিঠে কিংবা পাল্কীতে পাঁচ মাইল পথ অতিক্রম করে পৌঁছতে হতো রাজধানীতে। আগরতলা তখন মাত্র কয়েক হাজার লোকের বাস। রাজপরিবারের সদস্য-সহ উজির নাজির আর রাজকর্মচারী ও রাজদরবার নির্ভর জীবিকার লোকদেরই বাস তখন শহরে। কবির থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল কর্ণেল মহিম ঠাকুরের বাড়িতে। কবির সম্বর্ধনার আয়োজন হয়েছিল কুঞ্জবন টিলায়। পার্বত্য পল্লীর জনজাতিদের টং ঘরের নমুনায় বাঁশ দিয়ে মঞ্চ করা হয়েছিল। ফুল, পাতা দিয়ে সাজানো হয়েছিল তা। দিনটি ছিল বসন্তের শ্রীপঞ্চমী। স্ত্রী পুরুষ সবাই বাসন্তী রঙের পোশাক পরেছিলেন।
কবির সম্বর্ধনা উপলক্ষে মণিপুরী নৃত্য গীতের আয়োজন হয়েছিল। কবি অভিভূত হয়েছিলেন এই রাজকীয় সম্বর্ধনায়। এর কিছুদিন পর কবি মহারাজকে একটি রেশমের শাল উপহার পাঠিয়েছিলেন। উপহারের সঙ্গে তিনি রাজপারিষদ মহিম ঠাকুরকে লিখলেন-“…শিল্প বিদ্যালয়কে উৎসাহ দেবার জন্য সেখান হইতে আমি সর্বদা রেশমের বস্ত্রাদি ক্রয় করিয়া থাকি-দোষের মধ্যে লোক ও সামর্থ্য অল্প হওয়াতে তাহারা শীঘ্রই অধিক পরিমাণে কাপড় যোগাইতে পারে না—বন্ধুদের নিকট আমার এই বস্ত্র উপহার কেবল আমার উপহার নহে তাহা স্বদেশের উপহার।…” উল্লেখ করা যায় যে,মহিম ঠাকুর বীরচন্দ্রের আমল থেকেই দীর্ঘদিন ত্রিপুরার রাজপারিষদ ছিলেন। কলকাতায় পড়াশোনার সময় ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কবি ও রাজপরিবারের মধ্যে যোগাযোগে তিনি প্রথম দিকে অনেকটা সেতু হিসেবে কাজ করেছিলেন।
মহারাজ রাধাকিশোরের জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ বীরেন্দ্র কিশোরের বিবাহ উপলক্ষ্যে রাজা কবিকে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পুত্রের অসুস্থতার জন্য আগরতলায় যুবরাজের বিবাহোৎসবে যোগ দিতে পারেননি।কবি যুবরাজ্ঞীর জন্য যে উপহার পাঠিয়েছিলেন—তা পেয়ে রাজা জানালেন, “বস্ত্রখানা শ্রীমতী বধূমার উপযুক্তই হইয়াছে।”
বিবাহের পর যুবরাজের সহচর সচিব এবং যুবরাজ্ঞীর সহচরী শিক্ষিকা নির্বাচনের জন্য মহারাজ বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ত্রিপুরার আগামী দিনের রাজাকে সময়োপযোগী ভাবে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। চাই উপযুক্ত শিক্ষক। মহারাজ রাধাকিশোর কবির সাহায্য চাইলেন। কবি তখন যতীন্দ্রনাথ বসুকে মহারাজের সঙ্গে দেখা করবার জন্য পাঠালেন। ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৭ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে রাধাকিশোরকে লিখলেন—”…যুবরাজ ও যুবরাজ্ঞীর জন্য যে লোক নির্বাচন করিয়াছি তাঁহারা ভদ্রবংশীয় এবং সচ্চরিত্র। একান্ত মনে আশা করিতেছি তাঁহাদের জন্য কোন কারণে মহারাজের নিকট আমাকে অপরাধী ও লজ্জিত হইতে না হয়।তাঁহাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে আমি তাহাদিগকে বারম্বার উপদেশ দিয়াছি তথাপি যদি প্রকৃতিগত কোন ত্রুটি বশতঃ তাঁহারা স্বপদের লেশমাত্র অযোগ্য হন তবে মহারাজ যেন তাঁহাদিগকে তৎক্ষণাৎ বিদায় করিতে তিলমাত্র কুণ্ঠিত না হন। ইহা নিশ্চয় মনে জানাবেন ইহাদের সহিত আমার যেটুকু বন্ধুত্বের বন্ধন আছে যুবরাজের মঙ্গল আমার নিকট তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি গুরুতর।…”
মহারাজ রাধাকিশোর এর উত্তরে ১৪ বৈশাখ কবিকে লিখলেন—”যতীন্দ্রবাবুকে দেখিয়াছি। তাঁহার সহিত আলাপে সুখী হইয়াছি। আপনি যখন স্বয়ং বাছনি করিয়া শ্রীমান ও শ্রীমতীর জন্য লোক নিযুক্ত করিয়াছেন তখন আমার আর কি বলিবার আছে। যতী ও তাহার স্ত্রীতে মিলিয়া এই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত থাকিলে আশানুরূপ ফল প্রত্যাশা করা যায়। যতীন্দ্রবাবু চলিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সহিত শেষ আলাপ হইয়া গিয়াছে। বোধ হয় শীঘ্রই সস্ত্রীক ফিরিয়া আসিবেন। তাঁহাদের বাসার বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। আসিবা মাত্রই তাঁহার কার্যারম্ভ হইবে।…” এর কয়েক মাস পর ১৩ ভাদ্র মহারাজ কবিকে যুবরাজের শিক্ষা বিষয়ে আবার লিখলেন—”যতীর নিকট আপনার একখানা পত্র দেখিয়াছি। শ্রীমানের উন্নতিকল্পে আপনি যে রূপ বিশদ ভাবে শিক্ষা প্রণালী নির্দেশ করিয়াছেন তাহাতে আপনার ঐকান্তিকতা প্রতিফলিত দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছি। বন্ধুরূপে যিনি এমন সহৃদয়তা দেখাইতে পারেন জগতে তাঁহার মত বন্ধু দুর্লভ। আপনার ন্যায় বন্ধুর অবিশ্রান্ত সহায়তার সহিত যতী ও তাঁহার পরিবারকে এ সময়ে এই ভাবে পাওয়া বাস্তবিক চিরস্মরণীয়। আপনার উপদেশ গুলি যাহাতে যথাযথ প্রতিফলিত হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখিয়া শ্রীমান যতীবাবুকে সাহায্য করিব।”
বিবাহের পর যুবরাজের সহচর সচিব এবং যুবরাজ্ঞীর সহচরী শিক্ষিকা নির্বাচনের জন্য মহারাজ বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ত্রিপুরার আগামী দিনের রাজাকে সময়োপযোগী ভাবে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। চাই উপযুক্ত শিক্ষক। মহারাজ রাধাকিশোর কবির সাহায্য চাইলেন। কবি তখন যতীন্দ্রনাথ বসুকে মহারাজের সঙ্গে দেখা করবার জন্য পাঠালেন। ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৭ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে রাধাকিশোরকে লিখলেন—”…যুবরাজ ও যুবরাজ্ঞীর জন্য যে লোক নির্বাচন করিয়াছি তাঁহারা ভদ্রবংশীয় এবং সচ্চরিত্র। একান্ত মনে আশা করিতেছি তাঁহাদের জন্য কোন কারণে মহারাজের নিকট আমাকে অপরাধী ও লজ্জিত হইতে না হয়।তাঁহাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে আমি তাহাদিগকে বারম্বার উপদেশ দিয়াছি তথাপি যদি প্রকৃতিগত কোন ত্রুটি বশতঃ তাঁহারা স্বপদের লেশমাত্র অযোগ্য হন তবে মহারাজ যেন তাঁহাদিগকে তৎক্ষণাৎ বিদায় করিতে তিলমাত্র কুণ্ঠিত না হন। ইহা নিশ্চয় মনে জানাবেন ইহাদের সহিত আমার যেটুকু বন্ধুত্বের বন্ধন আছে যুবরাজের মঙ্গল আমার নিকট তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি গুরুতর।…”
মহারাজ রাধাকিশোর এর উত্তরে ১৪ বৈশাখ কবিকে লিখলেন—”যতীন্দ্রবাবুকে দেখিয়াছি। তাঁহার সহিত আলাপে সুখী হইয়াছি। আপনি যখন স্বয়ং বাছনি করিয়া শ্রীমান ও শ্রীমতীর জন্য লোক নিযুক্ত করিয়াছেন তখন আমার আর কি বলিবার আছে। যতী ও তাহার স্ত্রীতে মিলিয়া এই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত থাকিলে আশানুরূপ ফল প্রত্যাশা করা যায়। যতীন্দ্রবাবু চলিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সহিত শেষ আলাপ হইয়া গিয়াছে। বোধ হয় শীঘ্রই সস্ত্রীক ফিরিয়া আসিবেন। তাঁহাদের বাসার বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। আসিবা মাত্রই তাঁহার কার্যারম্ভ হইবে।…” এর কয়েক মাস পর ১৩ ভাদ্র মহারাজ কবিকে যুবরাজের শিক্ষা বিষয়ে আবার লিখলেন—”যতীর নিকট আপনার একখানা পত্র দেখিয়াছি। শ্রীমানের উন্নতিকল্পে আপনি যে রূপ বিশদ ভাবে শিক্ষা প্রণালী নির্দেশ করিয়াছেন তাহাতে আপনার ঐকান্তিকতা প্রতিফলিত দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছি। বন্ধুরূপে যিনি এমন সহৃদয়তা দেখাইতে পারেন জগতে তাঁহার মত বন্ধু দুর্লভ। আপনার ন্যায় বন্ধুর অবিশ্রান্ত সহায়তার সহিত যতী ও তাঁহার পরিবারকে এ সময়ে এই ভাবে পাওয়া বাস্তবিক চিরস্মরণীয়। আপনার উপদেশ গুলি যাহাতে যথাযথ প্রতিফলিত হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখিয়া শ্রীমান যতীবাবুকে সাহায্য করিব।”
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৭: রাজাও বুঝতে পেরেছিলেন বন্ধু কবির অভিমান
এই সব পত্র যোগাযোগ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে যুবরাজের শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপারে মহারাজ রাধাকিশোর রবীন্দ্রনাথের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। সে বছর মহারাজের আমন্ত্রণে কবি দার্জিলিং সফরে গিয়েছিলেন। দার্জিলিং-এ কবি ও রাজার মধ্যে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে রাজ্য পরিচালনার সুব্যবস্হা ছাড়াও ছিল যুবরাজ ও রাজকুমারের শিক্ষা, জগদীশচন্দ্রের গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি। জগদীশচন্দ্রের বিলেত অবস্থান কালে ১৩০৭ বঙ্গাব্দে কবি তাঁকে লিখছেন—”ত্রিপুরার মহারাজ এখন কলকাতায়। তোমার সফলতায় তিনি যে কি রকম আন্তরিক আনন্দ অনুভব করেন তা তোমাকে আর কি বলিব! বাস্তবিক তিনি যে হৃদয়ের সঙ্গে তোমাকে শ্রদ্ধা করেন এতেই বিশেষ রূপে আমার হৃদয় আকর্ষণ করেছেন।…”
১৩০৭ বঙ্গাব্দে মহারাজ রাধাকিশোরকে কলকাতায় অভিজাত সমাজের পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা জানানো হয়।কবি শিলাইদহ থেকে কলকাতা আসেন তখন। রাজার অভ্যর্থনায় রচনা করেন গান। ১লা পৌষ ‘ভারত সঙ্গীত সমাজ’ কলকাতার পার্কস্ট্রিটে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে মহারাজ রাধাকিশোরের সম্বর্ধনার আয়োজন করেছিল। এই অনুষ্ঠানে ‘বিসর্জন’ নাটক অভিনীত হয়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই নাটকে রঘুপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই ভাবেই কবির সঙ্গে রাজার ঘনিষ্ঠতা দিন দিন বাড়তেই থাকে। রাজা নানা ব্যাপারে পরামর্শ চান কবির কাছে। দার্জিলিং-এ রাজা তাঁর ভ্রমণসঙ্গী করেন কবিকে।দু’জনের মধ্যে পত্র যোগাযোগও বেড়ে চলে। নানা বিষয়ে কবির অনুরোধে রাজা অর্থ সাহায্য করেন।আর সে সব নিয়ে কালক্রমে গুঞ্জনও উঠে আগরতলাতে।
১৩০৮ বঙ্গাব্দের ১৪ বৈশাখ মহারাজ রাধাকিশোর কবিকে লিখছেন—”বঙ্কিমের বঙ্গদর্শনের পুনঃপ্রকাশের সংবাদ অতি সুসংবাদ।প্রসিদ্ধ লেখকদের উৎসাহ আরও সুসংবাদ। আমার মতে আপনি অগৌণে এবং অবিচারিত চিত্তে ইহার সম্পাদকীয় ভার গ্রহণ করুন এবং আমাকে কি কি করিতে হইবে বলুন। আমি সর্বতো ভাবে ইহার ভার গ্রহণ করিতে প্রস্তুত রহিলাম।…পলিটিক্যাল এজেন্টের পরামর্শে মহিম ও যতীকে তাড়াতাড়ি আজমীর পাঠাইলাম না। ভালোই হইয়াছে।আপনার সহিত পরামর্শ করিবার সুবিধা পাইয়াছি।…”
১৩০৭ বঙ্গাব্দে মহারাজ রাধাকিশোরকে কলকাতায় অভিজাত সমাজের পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা জানানো হয়।কবি শিলাইদহ থেকে কলকাতা আসেন তখন। রাজার অভ্যর্থনায় রচনা করেন গান। ১লা পৌষ ‘ভারত সঙ্গীত সমাজ’ কলকাতার পার্কস্ট্রিটে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে মহারাজ রাধাকিশোরের সম্বর্ধনার আয়োজন করেছিল। এই অনুষ্ঠানে ‘বিসর্জন’ নাটক অভিনীত হয়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই নাটকে রঘুপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই ভাবেই কবির সঙ্গে রাজার ঘনিষ্ঠতা দিন দিন বাড়তেই থাকে। রাজা নানা ব্যাপারে পরামর্শ চান কবির কাছে। দার্জিলিং-এ রাজা তাঁর ভ্রমণসঙ্গী করেন কবিকে।দু’জনের মধ্যে পত্র যোগাযোগও বেড়ে চলে। নানা বিষয়ে কবির অনুরোধে রাজা অর্থ সাহায্য করেন।আর সে সব নিয়ে কালক্রমে গুঞ্জনও উঠে আগরতলাতে।
১৩০৮ বঙ্গাব্দের ১৪ বৈশাখ মহারাজ রাধাকিশোর কবিকে লিখছেন—”বঙ্কিমের বঙ্গদর্শনের পুনঃপ্রকাশের সংবাদ অতি সুসংবাদ।প্রসিদ্ধ লেখকদের উৎসাহ আরও সুসংবাদ। আমার মতে আপনি অগৌণে এবং অবিচারিত চিত্তে ইহার সম্পাদকীয় ভার গ্রহণ করুন এবং আমাকে কি কি করিতে হইবে বলুন। আমি সর্বতো ভাবে ইহার ভার গ্রহণ করিতে প্রস্তুত রহিলাম।…পলিটিক্যাল এজেন্টের পরামর্শে মহিম ও যতীকে তাড়াতাড়ি আজমীর পাঠাইলাম না। ভালোই হইয়াছে।আপনার সহিত পরামর্শ করিবার সুবিধা পাইয়াছি।…”
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান
দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম
মহারাজের এই আন্তরিক প্রতিশ্রুতি রবীন্দ্রনাথকে বঙ্গদর্শন সম্পাদনায় উৎসাহ জুগিয়েছিল নিশ্চিত। কিন্তু সেই সময় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ত্রিপুরার রাজপরিবারে নানা আলোচনা, সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। মহারাজের সহিত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে কবি নানা স্বার্থ সিদ্ধি করছেন এরকম অপবাদ উঠে। কবির কানেও সেসব কথা পৌঁছায়। ব্যথিত হন কবি। রাজপারিষদ মহিম ঠাকুরকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তিনি লেখেন—”আমি তোমাকে সকল কথা খোলসা করিয়াই বলিতেছি। বঙ্গদর্শন যখন আমার হাতে আসিল তখন উহাকে সর্বাংশে প্রথম শ্রেণির কাগজ করিবার জন্য আমার ঔৎসুক্য জন্মিয়াছিল। সে জন্য যে ব্যয় এবং চেষ্টার প্রয়োজন দুর্ভাগ্যক্রমে আমার বর্তমান অবস্থায় তাহা কোন মতেই সম্ভবপর নহে।সেই ব্যগ্রতায় অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়াই আমি বঙ্গদর্শন চালনায় মহারাজের সাহায্য চাহিয়াছিলাম। নানা কারণে ধারণা হইয়াছে যে তোমরা ইহাতে আমার স্বার্থাভিসন্ধি কল্পনা করিয়াছ। আমি ভাবিলাম তোমরা রাজপারিষদ।লোকের সাধু উদ্দেশ্যে তোমাদের বিশ্বাস নাই-সকলকেই তোমরা সন্দেহ চক্ষে দেখ-মহারাজের স্বাভাবিক ঔদার্যকে তোমরা আচ্ছন্ন করিয়া আছ।
বস্তুতঃ মহারাজের মত লোকের সহিত সংস্রব রাখিলেই সাধারণ লোকে সন্দেহের চক্ষেই দেখে। সাধারণের কাছে আমার প্রতিপত্তি আছে-আমি স্বার্থপর ভাবে ভিক্ষুভাবে মহারাজের দ্বারে গমনাগমন করি এ অপবাদ গ্রহণ করিতে সঙ্কোচ বোধ করি।…মহারাজের প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও অনুরাগ সত্ত্বেও আমি ক্রমশঃ দূরে নির্লিপ্ত থাকিবার চেষ্টায় ছিলাম।…” কবি অপর একটি চিঠিতে মহিম ঠাকুরকে লেখেন—” …বঙ্গদর্শন সম্বন্ধে যদি তোমাদের মনে লেশমাত্র দ্বিধা থাকে আমাকে জানাইতে সঙ্কোচ করিও না—তোমাদের প্রতিশ্রুতি হইতে আমি তোমাদিগকে প্রসন্ন মনে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দান করিব-আমি মহারাজকে কোন বিষয়ে লেশমাত্র সংকটে ফেলিতে চাই না।তাঁহার সুপ্রসন্ন সৌহার্দ্যই আমি চাই, আর সমস্ত তুচ্ছ জ্ঞান করি।”
কবির এই সব চিঠিপত্র থেকে এটা নিশ্চিত ধারণা করা যায় যে, সেই সময়ে ত্রিপুরার রাজপরিবারের গুঞ্জন কবিকে ভীষণ ভাবে ব্যথিত করেছিল। ঘটনাচক্রে সুদূর এক পার্বত্য রাজ্যের রাজপরিবারের সঙ্গে পরিচয় এবং পরবর্তী সময়ে এই পরিবারের সঙ্গে কবির নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠার প্রেক্ষাপট ছিল ঐতিহাসিক। কবি যে বিভিন্ন বিষয়ে রাজার আর্থিক সাহায্য কামনা করেছিলেন এবং মহারাজ রাধাকিশোরও যে তাঁর রাজকোষের করুণ অবস্থার মধ্যেও সেদিন উদার ভাবে জগদীশচন্দ্রের গবেষণাকার্য-সহ নানা বিষয়ে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন তাও ছিল মূলত ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই। প্রাক স্বাধীনতা যুগে নব জাগরণের সেই অধ্যায়ে ত্রিপুরা খানিকটা হলেও যুক্ত হয়েছিল মূলত মহারাজের প্রচেষ্টাতেই। যদিও আজকের দিনে তা ভেবে আমরা পুলকিত হই, তবু, ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়ের ক্ষীণ কালো চিহ্নগুলোও প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় এসে যায়!
১৩০৮ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ কবি মহারাজা রাধাকিশোরকে লিখছেন-“মহারাজের সহিত আমি এমন কোন সম্বন্ধ রাখিতে ইচ্ছা করিনা যাহাতে লোকে স্বার্থ সিদ্ধির অপবাদ দিতে পারে।আমার সাধ্য যৎসামান্য হইলেও এবং উদ্দেশ্য লোক-হিতকর হইলেও, যে কাজ নিজের হাতে লইয়াছি সে সম্বন্ধে মহারাজের নিকট হইতে আর্থিক সহায়তা লইব না আমি স্হির করিয়াছি।…মহারাজ আপনাকে স্পষ্ট কথা বলি-আমি যদি দুর্ভাগ্যক্রমে পরের অবিবেচনা দোষে ঋণজালে আপাদমস্তক জড়িত হইয়া না থাকিতাম তবে জগদীশবাবুর জন্য আমি কাহারও দ্বারে দন্ডায়মান হইতাম না,আমি একাকী তাঁহার সমস্ত ভার গ্রহণ করিতাম।…”
বস্তুতঃ মহারাজের মত লোকের সহিত সংস্রব রাখিলেই সাধারণ লোকে সন্দেহের চক্ষেই দেখে। সাধারণের কাছে আমার প্রতিপত্তি আছে-আমি স্বার্থপর ভাবে ভিক্ষুভাবে মহারাজের দ্বারে গমনাগমন করি এ অপবাদ গ্রহণ করিতে সঙ্কোচ বোধ করি।…মহারাজের প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও অনুরাগ সত্ত্বেও আমি ক্রমশঃ দূরে নির্লিপ্ত থাকিবার চেষ্টায় ছিলাম।…” কবি অপর একটি চিঠিতে মহিম ঠাকুরকে লেখেন—” …বঙ্গদর্শন সম্বন্ধে যদি তোমাদের মনে লেশমাত্র দ্বিধা থাকে আমাকে জানাইতে সঙ্কোচ করিও না—তোমাদের প্রতিশ্রুতি হইতে আমি তোমাদিগকে প্রসন্ন মনে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দান করিব-আমি মহারাজকে কোন বিষয়ে লেশমাত্র সংকটে ফেলিতে চাই না।তাঁহার সুপ্রসন্ন সৌহার্দ্যই আমি চাই, আর সমস্ত তুচ্ছ জ্ঞান করি।”
কবির এই সব চিঠিপত্র থেকে এটা নিশ্চিত ধারণা করা যায় যে, সেই সময়ে ত্রিপুরার রাজপরিবারের গুঞ্জন কবিকে ভীষণ ভাবে ব্যথিত করেছিল। ঘটনাচক্রে সুদূর এক পার্বত্য রাজ্যের রাজপরিবারের সঙ্গে পরিচয় এবং পরবর্তী সময়ে এই পরিবারের সঙ্গে কবির নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠার প্রেক্ষাপট ছিল ঐতিহাসিক। কবি যে বিভিন্ন বিষয়ে রাজার আর্থিক সাহায্য কামনা করেছিলেন এবং মহারাজ রাধাকিশোরও যে তাঁর রাজকোষের করুণ অবস্থার মধ্যেও সেদিন উদার ভাবে জগদীশচন্দ্রের গবেষণাকার্য-সহ নানা বিষয়ে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন তাও ছিল মূলত ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই। প্রাক স্বাধীনতা যুগে নব জাগরণের সেই অধ্যায়ে ত্রিপুরা খানিকটা হলেও যুক্ত হয়েছিল মূলত মহারাজের প্রচেষ্টাতেই। যদিও আজকের দিনে তা ভেবে আমরা পুলকিত হই, তবু, ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়ের ক্ষীণ কালো চিহ্নগুলোও প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় এসে যায়!
১৩০৮ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ কবি মহারাজা রাধাকিশোরকে লিখছেন-“মহারাজের সহিত আমি এমন কোন সম্বন্ধ রাখিতে ইচ্ছা করিনা যাহাতে লোকে স্বার্থ সিদ্ধির অপবাদ দিতে পারে।আমার সাধ্য যৎসামান্য হইলেও এবং উদ্দেশ্য লোক-হিতকর হইলেও, যে কাজ নিজের হাতে লইয়াছি সে সম্বন্ধে মহারাজের নিকট হইতে আর্থিক সহায়তা লইব না আমি স্হির করিয়াছি।…মহারাজ আপনাকে স্পষ্ট কথা বলি-আমি যদি দুর্ভাগ্যক্রমে পরের অবিবেচনা দোষে ঋণজালে আপাদমস্তক জড়িত হইয়া না থাকিতাম তবে জগদীশবাবুর জন্য আমি কাহারও দ্বারে দন্ডায়মান হইতাম না,আমি একাকী তাঁহার সমস্ত ভার গ্রহণ করিতাম।…”
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
মহারাজ রাধাকিশোরকে লেখা কবির এই চিঠিতেই ধরা পড়েছে তাঁর হৃদয়ের ব্যথা বেদনার কথা।কি বিষয়ে রাজার সাহায্য চেয়েছিলেন কবি তাও চিঠিতেই স্পষ্ট। জগদীশচন্দ্রের গবেষণা কিম্বা বঙ্গদর্শন প্রকাশ করা—কবির সামগ্রিক ধ্যান ধারণা ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণ কেন্দ্রীক। কিন্তু সেদিন সে সব নিয়েই কথা উঠেছিল রাজধানী আগরতলায়। কবি প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু মহারাজ এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে কিছুদিন পর কবিকে একটি চিঠিতে লেখেন—” আগরতলা একটি দায়িত্ব বিহীন গুজব প্রধান স্হান। তাহার একমাত্র কারণ বাহিরের অকর্ম্মণ্য লোক এখানে আসিয়া তাহাদের আড্ডা বাঁধিয়া বসিয়াছে। আপনি যদি এই সব লোকের কু-কথার অর্থ গ্রহণ করেন তাহা হইলে আমার উপর অবিচার করা হয়।”
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মহারাজের উপর মোটেই অবিচার করেননি। পরবর্তী সময় এই যোগাযোগ আরও সুদৃঢ় হয়েছে। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও মহারাজ কবিকে সাহায্য করেন। ১৩০৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে কবি দ্বিতীয়বার আগরতলায় আসেন। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তখন মহারাজের সঙ্গে কবির বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই বিদ্যালয়ের জন্য মহারাজ বাৎসরিক এক হাজার টাকা সাহায্যও মঞ্জুর করেছিলেন। কবি পরবর্তী সময়ে এ সম্পর্কে বলেছেন—”সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত আমাদের দেশের লোকের মধ্যে একমাত্র রাধাকিশোর মাণিক্যের কাছ থেকে আমি নিয়মিত আনুকূল্য পেয়েছি।” শুধু আর্থিক আনুকূল্য নয়, রবীন্দ্রনাথই এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, মহারাজ ত্রিপুরার অনেক ছাত্রকে ছাত্রবৃত্তি দিয়ে শান্তিনিকেতনে বিদ্যাশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন।
আগরতলায় দ্বিতীয়বারের সফরে জগদীশচন্দ্রকে সাহায্যের ব্যাপারেও মহারাজের সঙ্গে কবির আলোচনা হয়েছিল। মহারাজ জগদীশচন্দ্রের গবেষণার জন্য দশ হাজার টাকা দেয়ার কথা ঘোষণা করেন এবং কিছুদিন পর আরও দশ হাজার টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সে সময় আগরতলা অবস্থানকালেই কবি জগদীশবাবুকে একটি পত্রে লেখেন—”আমি তোমার কাজেই ত্রিপুরায় আসিয়াছি। এইখানে মহারাজের অতিথি হইয়া কয়েকদিন আছি। তোমার প্রতি তাঁহার কিরূপ শ্রদ্ধা তাহাত জানই। সুতরাং তাঁহার কাছে আমার প্রার্থনা জানাইতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ অনুভব করিতে হয় নাই। তিনি শীঘ্রই দুই এক মাসের মধ্যেই তোমাকে দশ হাজার টাকা পাঠাইতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন।…”
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মহারাজের উপর মোটেই অবিচার করেননি। পরবর্তী সময় এই যোগাযোগ আরও সুদৃঢ় হয়েছে। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও মহারাজ কবিকে সাহায্য করেন। ১৩০৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে কবি দ্বিতীয়বার আগরতলায় আসেন। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তখন মহারাজের সঙ্গে কবির বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই বিদ্যালয়ের জন্য মহারাজ বাৎসরিক এক হাজার টাকা সাহায্যও মঞ্জুর করেছিলেন। কবি পরবর্তী সময়ে এ সম্পর্কে বলেছেন—”সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত আমাদের দেশের লোকের মধ্যে একমাত্র রাধাকিশোর মাণিক্যের কাছ থেকে আমি নিয়মিত আনুকূল্য পেয়েছি।” শুধু আর্থিক আনুকূল্য নয়, রবীন্দ্রনাথই এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, মহারাজ ত্রিপুরার অনেক ছাত্রকে ছাত্রবৃত্তি দিয়ে শান্তিনিকেতনে বিদ্যাশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন।
আগরতলায় দ্বিতীয়বারের সফরে জগদীশচন্দ্রকে সাহায্যের ব্যাপারেও মহারাজের সঙ্গে কবির আলোচনা হয়েছিল। মহারাজ জগদীশচন্দ্রের গবেষণার জন্য দশ হাজার টাকা দেয়ার কথা ঘোষণা করেন এবং কিছুদিন পর আরও দশ হাজার টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সে সময় আগরতলা অবস্থানকালেই কবি জগদীশবাবুকে একটি পত্রে লেখেন—”আমি তোমার কাজেই ত্রিপুরায় আসিয়াছি। এইখানে মহারাজের অতিথি হইয়া কয়েকদিন আছি। তোমার প্রতি তাঁহার কিরূপ শ্রদ্ধা তাহাত জানই। সুতরাং তাঁহার কাছে আমার প্রার্থনা জানাইতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ অনুভব করিতে হয় নাই। তিনি শীঘ্রই দুই এক মাসের মধ্যেই তোমাকে দশ হাজার টাকা পাঠাইতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন।…”
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন
মহারাজ রাধাকিশোরও তখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। রাজ্যভার গ্রহণের আগে থেকেই রাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিল। অনেক মূল্যবান কাগজপত্র হাফিজ হয়ে গিয়েছিল। সিংহাসনের দাবি নিয়েও রাধাকিশোরের বিরোধীপক্ষ ইংরেজদের দ্বারস্থ হয়েছিল। সব মিলিয়ে সিংহাসন ঘিরে পরিব্যাপ্ত অশান্তি। কিন্তু এতসবের মাঝেও রাজা ধৈর্য হারাননি। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও থেমে যায়নি বিভিন্ন কল্যাণকর কাজে রাজার সাহায্য দান। এমনকি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাজার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টাকেও ইংরেজরা সুনজরে দেখেনি। তখন দেশ ও সমাজের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করেছিলেন। সমকালীন নানা প্রবন্ধে তাঁর এ সম্পর্কে মৌলিক চিন্তাভাবনা ধরা পড়েছে। কাজ করছেন পল্লী উন্নয়নের বিষয়ে। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরের চিন্তাধারাকে বেশ প্রভাবিত করেছিলেন। দেশীয় রাজ্য ও রাজাদের সম্পর্কেও কবির পৃথক একটা চিন্তাভাবনা ছিল।রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, প্রজাপালনই রাজার কর্তব্য। ঐশ্বর্যের অধিকার নয়,কর্তব্যের অধিকারই আসল। বৃটিশ অধিকৃত ভারত ভূখণ্ডের দেশীয় রাজাদের এই কর্তব্য আরও দ্বিগুণ ভাবে পালন করা উচিত বলে তিনি মনে করতেন। ১৩০৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরকে লিখছেন—”…ঐশ্বর্য ও সিংহাসন অধিকার যে রাজার চরম কর্তব্য নহে তাহা সংহিতা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায়— আমাদের রাজার রাজত্ব কর্তব্যের অধিকার, ঐশ্বর্যের অধিকার নহে… য়ুরোপে রাজত্বই রাজার সমস্ত। প্রাচীন ভারতে ভোগ এবং ক্ষমতার হিসাবে না দেখিয়া রাজত্বকে সামাজিক ও ব্যক্তিগত কর্তব্য হিসাবে দেখা হইত।…”
মহারাজ রাধাকিশোরকে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সেই সময় নানা ভাবে চাপের মধ্যে রেখেছিলেন। একদিকে রাজ্যের আর্থিক সংকট এবং অপরদিকে রাজার বিরোধী পক্ষের তৎপরতা যেন তখন ইংরেজদের কাছে অনেক সুযোগ এনে দিয়েছিল। যুবরাজের শিক্ষাদান যাতে ইংরেজ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে হয় সেজন্য মহারাজের উপর বৃটিশ গভর্নমেন্টের চাপ ছিল। রাধাকিশোর এ ব্যাপারেও রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ চান। রবীন্দ্রনাথ তখন কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে রাধাকিশোরের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেন। উভয় রাজার মধ্যে প্রথম এই সাক্ষাৎ ঘটে দার্জিলিং-এ। কবির উদ্যোগে দুই রাজার মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটলেও কবি সেসময় সেখানে হাজির থাকতে পারেননি। জরুরি প্রয়োজনে তাকে কলকাতা চলে যেতে হয়েছিল। দুই রাজার মধ্যে এই সাক্ষাৎ পরিচয় প্রসঙ্গে কবির উদ্দেশ্য ধরা পড়েছে রাধাকিশোরকে লেখা তাঁরই এক চিঠিতে। তিনি লিখেছেন—”…দুই মহারাজের মধ্যে বন্ধুত্ব হইলে মন্ত্রণাদি দ্বারা উভয়ে বল লাভ করিবেন। রাজকার্য সম্বন্ধে গভর্নমেন্টের সহিত কোন গুরুতর আন্দোলন উপস্থিত হইলে নিঃস্বার্থ, নিরপেক্ষ ও মহারাজের সমশ্রেণীর ব্যক্তিদের সহিত পরামর্শ যোগে মহারাজের সেই অভাব মোচন হইবে কল্পনা করিয়া আমি আশ্বস্ত হইতেছি।…”
কোচবিহারের মহারাজের সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হয়েছিল যে, যুবরাজের শিক্ষার জন্য বিলেত থেকেই একজন শিক্ষক নিযুক্ত করা হবে। সে সময় বিলেতে অবস্থানরত জগদীশচন্দ্রকেও রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার যুবরাজের জন্য বিলেত থেকে একজন শিক্ষক নির্বাচন করে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। যাইহোক, শেষপর্যন্ত অবশ্য কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের চেষ্টায় ত্রিপুরার যুবরাজের শিক্ষার জন্য বিলেত থেকে নিযুক্ত হয়ে এসেছিলেন মিঃ টি আর উইলিয়ামস নামে একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।—চলবে।
মহারাজ রাধাকিশোরকে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সেই সময় নানা ভাবে চাপের মধ্যে রেখেছিলেন। একদিকে রাজ্যের আর্থিক সংকট এবং অপরদিকে রাজার বিরোধী পক্ষের তৎপরতা যেন তখন ইংরেজদের কাছে অনেক সুযোগ এনে দিয়েছিল। যুবরাজের শিক্ষাদান যাতে ইংরেজ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে হয় সেজন্য মহারাজের উপর বৃটিশ গভর্নমেন্টের চাপ ছিল। রাধাকিশোর এ ব্যাপারেও রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ চান। রবীন্দ্রনাথ তখন কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে রাধাকিশোরের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেন। উভয় রাজার মধ্যে প্রথম এই সাক্ষাৎ ঘটে দার্জিলিং-এ। কবির উদ্যোগে দুই রাজার মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটলেও কবি সেসময় সেখানে হাজির থাকতে পারেননি। জরুরি প্রয়োজনে তাকে কলকাতা চলে যেতে হয়েছিল। দুই রাজার মধ্যে এই সাক্ষাৎ পরিচয় প্রসঙ্গে কবির উদ্দেশ্য ধরা পড়েছে রাধাকিশোরকে লেখা তাঁরই এক চিঠিতে। তিনি লিখেছেন—”…দুই মহারাজের মধ্যে বন্ধুত্ব হইলে মন্ত্রণাদি দ্বারা উভয়ে বল লাভ করিবেন। রাজকার্য সম্বন্ধে গভর্নমেন্টের সহিত কোন গুরুতর আন্দোলন উপস্থিত হইলে নিঃস্বার্থ, নিরপেক্ষ ও মহারাজের সমশ্রেণীর ব্যক্তিদের সহিত পরামর্শ যোগে মহারাজের সেই অভাব মোচন হইবে কল্পনা করিয়া আমি আশ্বস্ত হইতেছি।…”
কোচবিহারের মহারাজের সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হয়েছিল যে, যুবরাজের শিক্ষার জন্য বিলেত থেকেই একজন শিক্ষক নিযুক্ত করা হবে। সে সময় বিলেতে অবস্থানরত জগদীশচন্দ্রকেও রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার যুবরাজের জন্য বিলেত থেকে একজন শিক্ষক নির্বাচন করে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। যাইহোক, শেষপর্যন্ত অবশ্য কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের চেষ্টায় ত্রিপুরার যুবরাজের শিক্ষার জন্য বিলেত থেকে নিযুক্ত হয়ে এসেছিলেন মিঃ টি আর উইলিয়ামস নামে একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।