রামকৃষ্ণদেব ও সারদা দেবী।
রাধুর প্রসবকালীন অবস্থায় যখন মা সারদা তাকে নিয়ে কোয়ালপাড়ায় বাস করছিলেন, সেই সময় জয়রামবাটিতে গিয়ে সুশীলার তিনবছরের ছেলে ন্যাড়া ডিপথেরিয়া রোগে মারা যায়। এই দেবস্বভাব মাকুর শিশুপুত্রটিকে মা সারদা জন্মের পর থেকে নিজে লালন করেছেন। তাই তার মৃত্যুর শোক শ্রীমাকে এতটাই বিচলিত করেছিল যে, মৃত্যুর আট, দশদিন পরেও ন্যাড়ার কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ দিয়ে জল ঝরেছে। শ্রীমাকে এ ভাবে কাঁদতে দেখে কেউ বলেছিল, ‘সংসারী মানুষের ছেলেমেয়ের মৃত্যুতে কতটা কষ্ট হয়, এ বার বোধ হয় আপনিও বুঝতে পারলেন’।
শ্রীমা বলেন, “তা কি আর বলতে? কি যে কষ্ট হচ্চে মাকুর ছেলেকে পালন করে ভুলতে পাচ্চি নি”। ন্যাড়ার মৃত্যুর দু’তিন দিন পর শ্রীমা বলেছিলেন যে, ন্যাড়া তাঁকে যাবার সময় পেন্নাম করে যায়নি। তিনি বলেন, ‘দুফুরবেলা আমি খেয়ে শুয়েচি, পালকি এসে পৌঁছেচে, নলিনী চিৎকার করে বলচে, মাকি, এখনও দাঁড়িয়ে রয়েচিস? শীঘ্রি চলে আয়। মাকু অমনি ন্যাড়াকে নিয়ে চলে গেল, মাকু আমাকে পেন্নাম না করিয়েই চলে গেল।
শ্রীমা যখন দক্ষিণদেশ থেকে কলকাতা আসেন, ঠাকুরের ভাইপো রামলাল তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সেই সময় রাখাল ছেলেরা ঢিল ছুঁড়ছিল, তা রামলালের কপালে এসে লাগে। হাওড়ায় গাড়ি থেকে নেমে শ্রীমাকে প্রণাম করে যখন তিনি ঢিল লাগার কথা বলেছিলেন, তখন শ্রীমা তাকে বলেন, “রামলাল, গাড়িতে ওঠার সময় তুমি তো আমাকে প্রণাম করনি?” শ্রীমা বলছেন যে, ন্যাড়া তাঁকে সীতা বলেছিল। “ন্যাড়া যে আমাকে সীতা বলেচে! আমার দাঁত পড়ে গেছে, ন্যাড়া পা দুলিয়ে দুলিয়ে নিজের দাঁত দেখিয়ে বলচে, পিসিমা, আমার দাঁতদুটি লাও।”
শ্রীমা যখন দক্ষিণদেশ থেকে কলকাতা আসেন, ঠাকুরের ভাইপো রামলাল তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সেই সময় রাখাল ছেলেরা ঢিল ছুঁড়ছিল, তা রামলালের কপালে এসে লাগে। হাওড়ায় গাড়ি থেকে নেমে শ্রীমাকে প্রণাম করে যখন তিনি ঢিল লাগার কথা বলেছিলেন, তখন শ্রীমা তাকে বলেন, “রামলাল, গাড়িতে ওঠার সময় তুমি তো আমাকে প্রণাম করনি?” শ্রীমা বলছেন যে, ন্যাড়া তাঁকে সীতা বলেছিল। “ন্যাড়া যে আমাকে সীতা বলেচে! আমার দাঁত পড়ে গেছে, ন্যাড়া পা দুলিয়ে দুলিয়ে নিজের দাঁত দেখিয়ে বলচে, পিসিমা, আমার দাঁতদুটি লাও।”
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৮: বিয়ের পর রাধুর প্রত্যাবর্তন,
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল
রামলালের ছোটমেয়ে রাধার বিয়েতে শ্রীমা কামারপুকুর আসেন। সেখানে বাসর জাগার কোনও লোক না থাকায় তাঁকেই জাগতে বলা হয়। বাসরঘরে বসে শ্রীমা আপন মনে গান ধরলেন, “রাধাশ্যাম একাসনে সেজেছে ভাল। রাই আমাদের হেমবরণী শ্যাম চিকন কালো”। নিজের ভাই কালীকুমারের ছেলে ভূদেবের বিবাহে শ্রীমাকে খুব পরিশ্রম করতে হয়েছিল। ভাইদের সংসারের এমন সব ব্যাপারেই তাঁকে এরূপ পরিশ্রম করতে হত। ভূদেবের বিয়ের দু-দিন পর শ্রীমা নিজের পায়ের ফোলা দেখিয়ে বলেছিলেন, “গিরীশবাবু সত্যই বলেচেন, এরা সব মাথা কেটে তপস্যা করেচে”। ১৩২০ সালের ২৪ বৈশাখ ভূদেবের যখন বিয়ে হয়, তখন তার স্ত্রী নিতান্ত বালিকা। বিয়ের কিছুদিন পরেই তার শাশুড়ি নতুন বউকে শাসন করছেন দেখে মা সারদা হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন, “ও মেজোবৌ, চুপ কর্। এলো কি অমনি এসেচে? এলোর বিয়েতে কত বাদ্যি বেজেচে।” তারপর গম্ভীরভাবে বলেন, “তুই ওকে বকচিস কেন? কত সাধের বউ।”
আরও পড়ুন:
মুভি রিভিউ: মহাভারতের প্রেক্ষাপটে তৈরি টানটান ক্রাইম সিরিজ মৎস্যকাণ্ড
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
একবার সারদা মা তাঁর ভাজ ইন্দুমতীকে সোনার চুড়ি করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তাঁরা কলকাতায়। বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ছোট ভাজ সুরবালা হনহন করে ঢুকছে আর পাড়ার ছেলেরা বলছে, “পাগলী মামী এসেচে রে, পাগলী মামী এসেচে।” মা সারদা পুজোয় বসেছিলেন, তিনি তাড়াতাড়ি উঠে এসে ইন্দুমতীকে বলেন, “চুড়িগুলো হাতে দিয়ে ঠান্ডা কর। আমি বিকেলবেলা চুড়িওলী ডেকে হাতে চুড়ি দিয়ে দেব।” নগেনবালা সিংহ যখন কলকাতায় শ্রীমার কাছে দীক্ষা নিতে যান, তখন তার বার-তের বছর বয়স।
সেইসময় রেশমি চুড়ি নতুন বের হয়েছে। রাধুকে দিয়ে শ্রীমা চুড়িওলীকে ডেকে বললেন, “বৌমাকে চুড়ি পরিয়ে দাও, এক এক হাতে ছয়গাছি করে পরাও।” লাল, নীল, সাদা সবুজ, হলদে নানা রঙের চুড়ি। রাধু বলল, একরঙের পরাতে, শ্রীমা বললেন, “না এর একখানা, তার একখানা পরাও।” চুড়ি পরানো হয়ে গেলে নগেনবালার হাত নিজের হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে শ্রীমা বললেন, “বেশ হয়েচে, ছোট বৌমাটির হাতে মানিয়েছে ভাল। তিনি নিজেই চুড়ির দাম দিলেন। ঠাকুরের মতোই রসিকস্বভাব শ্রীমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। পাত্রভেদে অনেকসময় এর মধ্য দিয়ে তিনি শিক্ষাদান করতেন। এবিষয়ে অক্ষয়কুমার সেন বলেছেন, আমি একদিন মার কাছে গিয়ে বল্লুম, “মা”। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বাবা’। তখন অক্ষয়কুমার বলেন, ‘মা, আমি বললাম, মা, তুমি বললে হ্যাঁ, আর কিসের ভয়’।”
সেইসময় রেশমি চুড়ি নতুন বের হয়েছে। রাধুকে দিয়ে শ্রীমা চুড়িওলীকে ডেকে বললেন, “বৌমাকে চুড়ি পরিয়ে দাও, এক এক হাতে ছয়গাছি করে পরাও।” লাল, নীল, সাদা সবুজ, হলদে নানা রঙের চুড়ি। রাধু বলল, একরঙের পরাতে, শ্রীমা বললেন, “না এর একখানা, তার একখানা পরাও।” চুড়ি পরানো হয়ে গেলে নগেনবালার হাত নিজের হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে শ্রীমা বললেন, “বেশ হয়েচে, ছোট বৌমাটির হাতে মানিয়েছে ভাল। তিনি নিজেই চুড়ির দাম দিলেন। ঠাকুরের মতোই রসিকস্বভাব শ্রীমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। পাত্রভেদে অনেকসময় এর মধ্য দিয়ে তিনি শিক্ষাদান করতেন। এবিষয়ে অক্ষয়কুমার সেন বলেছেন, আমি একদিন মার কাছে গিয়ে বল্লুম, “মা”। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বাবা’। তখন অক্ষয়কুমার বলেন, ‘মা, আমি বললাম, মা, তুমি বললে হ্যাঁ, আর কিসের ভয়’।”
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
সন্তান কম মনোযোগী কিন্তু অতি সক্রিয়? সহজ উপায়ে বাড়িতেই এর চিকিৎসা সম্ভব
শ্রীমা তখন বলেন যে, অমন কথা বলতে নেই, যার আছে ভয়, তারই হয় জয়। শ্রীমার জ্বর হয়েছে, তাই তাঁকে একটা বাটিতে প্রায় একসের পরিমাণ দুধসাগু খেতে দেওয়া হয়েছে। তিনি খানিকটা মাত্র খেয়ে বাটি হাতে করে হাসতে হাসতে বলছেন, “আজ যে কারো প্রসাদে ভক্তি নেই?” তাই শুনে ভক্তরা তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়ে সেই প্রসাদ ভাগ করে খেলেন। মা সারদা ঘরের ভিতর পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। এমন সময় প্রকাশ মহারাজ হাতে করে পদ্মফুল নিয়ে তাঁর চরণে প্রণাম করতে ঢুকলেন। আর তাঁর কাছ থেকে একটি ফুল নিয়ে প্রবোধবাবু পিছন পিছন ঢুকলেন। প্রকাশ মহারাজ শ্রীমার চরণকমলে পদ্মফুল অর্পণ করে বললেন, “মা, আমাকে আর ঘুরোবেন না”। মা সারদা হাসিমুখে তাঁকে বলেন, “আমাকে ছেড়ে এতদিন ঘুরতে পাল্লে, আমি একটু ঘুরব নি?”—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।