রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

সত্যব্রত কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বললেন, “চা-কফি কিছু খাবেন? তাহলে গোবিন্দকে আনতে বলি। কফি আনতে গেলে নার্সদিদিদের কোয়াটার্স থেকেই আনতে হবে। গোবিন্দ কফি তেমন বানাতে পারে না। এ দিকে আমার মিসেস তার বাচ্চাদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে গিয়েছেন। কালাদেওর আতঙ্কে তিনি এতটাই আতঙ্কিত যে, আর এখানে ফিরে আসবেন না জানিয়েছেন। ভাগ্যিস বাচ্চাদুটি ছোট বলে ওদের প্রথাগত লেখাপড়া এখনও শুরু হয়নি বলতে গেলে। নাহলে কী যে হত! যাক, নিজের কাঁদুনি গেয়ে আপনাদের আর ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাবো না। খাবেন? তাহলে গোবিন্দ সোরেনকে আনতে বলি?”
শাক্য হাত তুলে বাধা দিল। বলল, “সুদীপ্তবাবুর কথা জানি না। কিন্তু আমি খাব না। এই গরমে চা-কফি খাওয়ার কোন ইচ্ছেই হচ্ছে না! ও-সব থাক। কাজের কথায় আসা যাক্।”
সুদীপ্ত বলল, “আমিও খাব না। আপনি বিন্দুমাত্র ফর্মালিটি করবেন না। কাজের কথায় আসা যাক। আপনার কাছ থেকে ফিরে আমাদের অন্য কাজ আছে।”
সত্যব্রত বললেন, “অগত্যা!”
সুদীপ্ত বলল, “আপনি সেদিন আমার কাছে গিয়েছিলেন বুধন মাহাতোর কেসের ব্যাপারে কিছু বলতে। কিন্তু হঠাৎ ঘটে যাওয়া পরিস্থিতির জন্য সে-কথা আর শোনা হয় নি। এখন বলুন, কী বলতে চেয়েছিলেন সেদিন!”
সত্যব্রত বললেন, “দাঁড়ান, আগে দরজা বন্ধ করে দিই। সাবধানের মার নেই। কে কখন পেশেন্ট সেজে কিংবা পেশেন্ট পার্টি সেজে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে, তার ঠিক নেই। একটু দাঁড়ান…” বলে উঠে দরজা বন্ধ করে এসে চেয়ারে বসলেন।
সুদীপ্ত বলল, “বলুন!”
সত্যব্রত বললেন, “দেখুন, আমরা তো সবাই জানি, বুধন মাহাতো নামের একজনকে এখানকার স্থানীয় মাস্টার রথীনবাবু একদিন সকালে নিয়ে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে আসে মারুতি মাহাতো ও তাঁর স্ত্রী। এরা বুধনের বাবা-মা। বিষয়টা ছিল অদ্ভুত। ছেলে হওয়া সত্ত্বেও বুধন না-কি গর্ভবতী হয়ে পড়েছে এবং তার শরীরে গর্ভলক্ষণ প্রকট হয়ে পড়েছে ফলে স্বভাবতই সে ঘরের বাইরে বের হতে পারছে না। দিনের বেলায় তো নয়ই। আগে সে চার্চের ওয়ার্কশপে যেত, কিন্তু এখন লজ্জায় সেখানেও যাচ্ছে না। সারাদিন এমনকি বাবা-নায়ের সামনেও সে বেরোতে চায় না। ছোট্ট মাটির ঘরে অন্ধকারে সে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে। রাত্তিরে বেরিয়ে প্রাকৃতিক কাজটাজ সারে। খাওয়াদাওয়া করে। দিনের বেলায় সে তার ঘরে বসেই খাওয়াদাওয়া করত বলে পরে আমাকে বুধনের মা জানিয়েছে। সে যাই হোক, এমন কেস বিরল হলেও মেডিক্যাল জার্নালে এর উল্লেখ আছে। না, না, আপনারা যা ভাবছেন, তেমনটি মোটেও নয়। ছেলেরা, অন্তত মানুষের ক্ষেত্রে প্রকৃত প্রেগন্যান্ট হয়েছে, এখনও অবধি তার কোন নজির মেডিক্যাল জার্নালেও নেই। কিন্তু নানা কারণে তার শরীরে গর্ভলক্ষণ দেখা দিয়েছে, এমনটা শোনা গিয়েছে অনেকবার। যদিও সেটা প্রকৃত গর্ভ নয়, ফলস প্রেগন্যান্সি!”
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪০: বিশ্বকবির তিন মেয়ে— অকালে ঝরে যাওয়া প্রতিভা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

শাক্য নিস্তব্ধ হয়ে শুনছিল। এখন প্রশ্ন করলে বক্তব্যের ফ্লো নষ্ট হবে। সুদীপ্ত কিন্তু প্রতিক্রিয়া জানাল, “তাই না-কি? আজব কথা। এটা তো জানতাম না! ছেলেরাও প্রেগন্যান্ট হতে পারে?”
সত্যব্রত বললেন, “না না সুদীপ্তবাবু, প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা মানুষের ক্ষেত্রে কেবল মেয়েদের পক্ষেই সম্ভব। আমি বলছি ফলস্‌ প্রেগন্যান্সির কথা। যেখানে একজন পুরুষ প্রকৃত প্রেগন্যান্ট না-হয়েও প্রেগন্যান্সির মতো লক্ষণ দেখা যায় তার শরীরে, সেটাকেই বলে ফলস প্রেগন্যান্সি।”
সুদীপ্ত বলল, “ওহ্‌ আচ্ছা!”

সত্যব্রত আবার বললেন, “ফলস প্রেগন্যান্সির নানা কারণ হতে পারে। মেডিক্যাল জার্নালে এই রকম অনেক কেসের উল্লেখ আছে। টিউমার হতে পারে, অন্য কোন অসুবিধা থেকে হতে পারে। তবে আর-একটি উপায়েও হতে পারে। মেডিক্যাল টার্ম না ব্যবহার করে আমি বিষয়টা সহজভাবে ক্লিয়ার করে দিই। কখনও কখনও মায়ের পেটে একটা ভ্রূণ থাকার জায়গায় একইসঙ্গে দুটি ভ্রূণ বেড়ে উঠলে, আমরা জানি যমজ বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কখনও কখনও মায়ের আভ্যন্তরীন শারীরিক জটিলতার কারণে একটি ভ্রূণের মধ্যেই আর-একটি ভ্রূণ বেড়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে বেড়ে ওঠা ভ্রূণ থেকে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়, এবং প্রাথমিকভাবে ধরা না-পড়লেও, কিছুদিন পরে কিংবা কিছুকাল পরে বাচ্চার পেটের মধ্যে থেকে যাওয়া সেই ভ্রূণটি কিছুটা বৃদ্ধি পায় এবং টিউমারের মতো আকার ধারণ করে। এটি টিউমারের মতো বলা হলেও টিউমার নয়। নষ্ট ভ্রূণ বলতে পারেন। পেটের মধ্যে অনেকদিন সুপ্তভাবে থাকার পর কিছুদিনের মধ্যেই একটা অস্বাভাবিক গ্রোথ নয় এবং তার বাহ্যিক লক্ষণ প্রেগন্যান্সির সময়কালের লক্ষণের সঙ্গে মিলে যায়। ফলে আপাতভাবে যে-কেউ দেখলে মনে করতে পারে, ছেলে হয়েও কেউ প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছে। এটা কলকাতা কিংবা বড় শহরে নিয়ে গেলে আলট্রা-সোনোগ্রাফি করলেই ধরা পড়ে। কিন্তু এখানে তো তা সম্ভব নয়। তার উপর সো-কলড বুধন নামের সেই রহস্যময় ছেলেটি আদৌ রহস্যের সৃষ্টি করতে পারত না। আমাকেও ঘাবড়ে দিয়েছিল ছেলেটি। আমি যদিও প্রথমে ভেবেছিলাম টিউমার। যাই হোক, ছেলেটিকে আমি অ্যাডমিট করে নিই। পরের দিন ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব বলে ভেবেছিলাম। এখানে হয়তো সব টেস্ট করা সম্ভব হত না, সদরে পাঠাতে হত। কিন্তু সে-সুযোগ আর পাওয়া যায়নি, কারণ, ছেলেটি রাতের বেলাতেই পালিয়ে যায়। পরে বুধনের বডি পাওয়া যায় জঙ্গলে, সুদীপ্তবাবু ছিলেন, তাঁরাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, বুধন মাহাতো নামের ছেলেটির সেই লাশ সপ্তাহখানেকে পুরানো। অর্থাৎ এক সপ্তাহ আগেই যার মৃত্যু হয়েছে, তর্কের খাতিরে ধরে নিতে হয়, তারই অতৃপ্ত আত্মা প্রেতরূপী বুধন সেজে মারুতি মাহাতোর বাড়িতে অর্থাৎ তার জীবিত অবস্থার বাবা-মা’র সঙ্গে কাটিয়ে এসেছিল। এ-কথা আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে মেনে নেওয়া আপনার-আমার পক্ষে কোনমতেই সম্ভব নয়। তাই না?”
শাক্য এবং সুদীপ্ত দুজনেই মাথা নেড়ে সত্যব্রতর কথায় সায় দিল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

সত্যব্রত আবার বলতে শুরু করলেন, “তখন বিভ্রান্ত লাগলেও এখন আমি নিশ্চিত যে, নকল বুধনের পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর-কোনও উপায় ছিল না। নাহলে বিশেষভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে সে ধরা পড়ে যেত। তার এই পালানো দেখেই বোঝা যায়, সে যে প্রকৃতপক্ষে প্রেগন্যান্ট নয়, এ-কথা নকল বুধন নিজেই ভালো করে জানত। এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, কে, কেনই বা এমন রিস্ক নিয়ে নকল বুধন সেজে থাকল ? মারুতি মাহাতো যদি রাজা-উজির কিংবা একালের কোন মন্ত্রী হত, তাহলে হয়তো ধরে নেওয়া যেত, সম্পত্তিঘটিত কোন ব্যাপারে, কিংবা খাটের তলায়, ওয়াশরুমে কোটি-কোটি কালো টাকা হাতানোর লোভে কেউ এই কাজটি করেছে। কিন্তু মারুতি মাহাতোর নিজের একটুকরো জমি পর্যন্ত নেই, কোটি কোটি টাকা থাকা তো দূরস্ত। তাহলে, সম্পত্তিঘটীত কোনও বিবাদ-বিসংবাদে কিংবা ওই ধরণের কোন লড়াইয়ে আসল বুধন মারা পড়ে নি, নকল বুধনও উপস্থিত হয়নি মারুতি মাহাতোর বাড়িতে।

আমার অনুমান, সে উপস্থিত হয়েছিল আসল বুধন মাহাতোর যে মৃত্যু হয়েছে কিংবা হত্যা, সেই-ব্যাপারটি যতদিন সম্ভব ঢাকাচাপা দিতেই। তবে ছেলেটির যা-বয়স দেখেছি, তাতে তাকে আর কেউ না বলে দিলে কিংবা এই কাজটি করার জন্য নিযুক্ত না-করলে, তার মাথায় এই বুদ্ধি আসতেই পারে না। সুতরাং আড়ালে আরও ভয়ংকর কেউ আছে, যে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নকল বুধনকে এই কাজে নিয়োগ করেছিল। দু’টি ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো, এক নম্বর হচ্ছে, আসল বুধনের দেহকে গোটাটাই জ্বালিয়ে দেওয়া যেত, কিংবা জঙ্গলের গভীরে কোথাও নিয়ে গিয়ে গভীর গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলা যেত, তাহলে তার যে মৃত্যু হয়েছে, সে-ব্যাপারটা আর কেউ জানতে পারত না। সকলে ভাবত, বুধন লজ্জায় পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো জায়গায় বুধনের মাথাখানা কেবল ফেলে রাখা হল এমনভাবে, যাতে সকলে জানতে পারে, আসল বুধন মারা যাওয়ার পরেও তার প্রেত, কিংবা স্বয়ং কালাদেও বুধনের রূপ নিয়ে নিজের বাবা-মায়ের কাছে কিছুকাল কাটিয়ে এসেছে। আসল বুধনের দেহাংশ তথা মাথাটি আবার এমন জায়গায় ফেলে রাখা হল, যাতে সহজেই সকলের চোখে পড়ে। আমার মনে হয়, আসল অপরাধী কিংবা গ্রুপ অফ অপরাধীরা চেয়েছিল একটা আতঙ্ক ছড়াতে, যার দরুণ কালাদেওর ভীতি আরও দৃঢ়ভাবে মানুষের মনে সঞ্চারিত হবে। বুধনকে মরতে হল কেন? কিংবা আরও ভালো বলা, তাকে মারতে হল কী কারণে?

আমার অনুমান, আসল বুধন জেনে ফেলেছিল এমনকিছু রহস্যের কথা, যা লোক জানাজানি হলে বিপদ ঘটবে। অতএব তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল। দেওয়াও হল। তার বাকি দেহাংশ নিয়ে কে বা কারা কী করেছে, তা সঠিকভাবে আমার জানা না থাকলেও আমি কিছু অকাট্য অনুমান পেশ করতে পারি। তার আগে আর একটা বিষয়ে আমার ভিউ-পয়েন্ট ক্লিয়ার করে দিই। আমার মনে হয়, বুধনকে কালাদেও নামক কেউ হত্যা করেনি। মানুষই করেছে। আর করেছে যেখানে তার দেহাংশ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে নয়। কোন অপারেশন টেবিলে হতে পারে। কারণ যখন লাশ আবিষ্কার হয়, আমি সেখানে উপস্থিত থেকে পরীক্ষা করে দেখেছি যে, বুধনের চোখ খোলা ছিল না। তাকে সম্ভবত আগে ইথারাইজড্‌ করা হয়, তারপর অপারেশন টেবিলে তাকে কাটা হয়। আচমকা নিহত হলে, বিশেষ করে ওইরকমভাবে, তাহলে তার চোখ শেষ আতঙ্কে খোলা থাকত, মুখে-চোখেও মরণান্তক ভয়ের চিহ্ন প্রকট হতো। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। তার মুখ-চোখ ছিল শান্ত। ইথারাইজড করলেই সেটা হতে পারে। তাছাড়া আমি জেনেছি, তার মৃতদেহের ফোরেন্সিক রিপোর্টে মাথায় সাদা রঙের দামি সুতোর আঁশ লেগে থাকার কথা বলা হয়েছে। বুধনের বাড়ি আমি গিয়েছি। তার তেল-চিটচিটে বালিশও দেখে এসেছি। ফোরেন্সিক টিম যে সুতো পেয়েছেন, তা অন্য কিছুর।

আমার অনুমান, বুধনের হত্যা কোন অপারেশন টেবিলেই হয়েছে। ফলে আগে তাকে ইথারাইজড করে তারপর তার অঙ্গগুলি কালেক্ট করে যে তাকে মারা হয় নি, সে-কথা বলাই যায়। আমার মনে হয়, সেক্ষেত্রে আশ্চর্য হব না, যদি তার হার্ট, কিডনি এবং আরও অন্যান্য হিউম্যান অর্গান সংগ্রহ করার পর তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানলে। আমার অনুমান, এটা অপরাধীরা প্ল্যান করেই করেছে। বুধনকে মরতে হতই, কিন্তু খামোকা মরলে কী লাভ? তার চেয়ে মরলও আবার তারই দেহের উপযুক্ত অর্গান সংগ্রহ করে বাইরে বিক্রি করলে বিপুল লাভ। অর্গান-ট্র্যাফিকিং এখন একটা বড় সমস্যা। তার উপর পাশের রাজ্যের গা-ঘেঁষা অঞ্চল, বর্ডার এরিয়া। নার্সিং হোম কিংবা বড় বড় প্রাইভেট সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালগুলিতে এই-জাতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চাহিদা মারাত্মক। এক্ষেত্রে অপরাধীরা রথ দেখা কলা বেচা-দুটিই করেছে। বুধনের বয়স কম ছিল। সুস্থ-সবল ছেলে। অতএব তার অঙ্গের দাম নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন? তার অঙ্গগুলি হয় ইতিমধ্যেই!”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৪: ঝোপে-ঝাড়ে হায়েনা

সত্যব্রত আবার বলতে শুরু করলেন, “তখন বিভ্রান্ত লাগলেও এখন আমি নিশ্চিত যে, নকল বুধনের পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর-কোনও উপায় ছিল না। নাহলে বিশেষভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে সে ধরা পড়ে যেত। তার এই পালানো দেখেই বোঝা যায়, সে যে প্রকৃতপক্ষে প্রেগন্যান্ট নয়, এ-কথা নকল বুধন নিজেই ভালো করে জানত। এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, কে, কেনই বা এমন রিস্ক নিয়ে নকল বুধন সেজে থাকল ? মারুতি মাহাতো যদি রাজা-উজির কিংবা একালের কোন মন্ত্রী হত, তাহলে হয়তো ধরে নেওয়া যেত, সম্পত্তিঘটিত কোন ব্যাপারে, কিংবা খাটের তলায়, ওয়াশরুমে কোটি-কোটি কালো টাকা হাতানোর লোভে কেউ এই কাজটি করেছে। কিন্তু মারুতি মাহাতোর নিজের একটুকরো জমি পর্যন্ত নেই, কোটি কোটি টাকা থাকা তো দূরস্ত। তাহলে, সম্পত্তিঘটীত কোনও বিবাদ-বিসংবাদে কিংবা ওই ধরণের কোন লড়াইয়ে আসল বুধন মারা পড়ে নি, নকল বুধনও উপস্থিত হয়নি মারুতি মাহাতোর বাড়িতে।

আমার অনুমান, সে উপস্থিত হয়েছিল আসল বুধন মাহাতোর যে মৃত্যু হয়েছে কিংবা হত্যা, সেই-ব্যাপারটি যতদিন সম্ভব ঢাকাচাপা দিতেই। তবে ছেলেটির যা-বয়স দেখেছি, তাতে তাকে আর কেউ না বলে দিলে কিংবা এই কাজটি করার জন্য নিযুক্ত না-করলে, তার মাথায় এই বুদ্ধি আসতেই পারে না। সুতরাং আড়ালে আরও ভয়ংকর কেউ আছে, যে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নকল বুধনকে এই কাজে নিয়োগ করেছিল। দু’টি ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো, এক নম্বর হচ্ছে, আসল বুধনের দেহকে গোটাটাই জ্বালিয়ে দেওয়া যেত, কিংবা জঙ্গলের গভীরে কোথাও নিয়ে গিয়ে গভীর গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলা যেত, তাহলে তার যে মৃত্যু হয়েছে, সে-ব্যাপারটা আর কেউ জানতে পারত না। সকলে ভাবত, বুধন লজ্জায় পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো জায়গায় বুধনের মাথাখানা কেবল ফেলে রাখা হল এমনভাবে, যাতে সকলে জানতে পারে, আসল বুধন মারা যাওয়ার পরেও তার প্রেত, কিংবা স্বয়ং কালাদেও বুধনের রূপ নিয়ে নিজের বাবা-মায়ের কাছে কিছুকাল কাটিয়ে এসেছে। আসল বুধনের দেহাংশ তথা মাথাটি আবার এমন জায়গায় ফেলে রাখা হল, যাতে সহজেই সকলের চোখে পড়ে। আমার মনে হয়, আসল অপরাধী কিংবা গ্রুপ অফ অপরাধীরা চেয়েছিল একটা আতঙ্ক ছড়াতে, যার দরুণ কালাদেওর ভীতি আরও দৃঢ়ভাবে মানুষের মনে সঞ্চারিত হবে। বুধনকে মরতে হল কেন? কিংবা আরও ভালো বলা, তাকে মারতে হল কী কারণে?

আমার অনুমান, আসল বুধন জেনে ফেলেছিল এমনকিছু রহস্যের কথা, যা লোক জানাজানি হলে বিপদ ঘটবে। অতএব তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল। দেওয়াও হল। তার বাকি দেহাংশ নিয়ে কে বা কারা কী করেছে, তা সঠিকভাবে আমার জানা না থাকলেও আমি কিছু অকাট্য অনুমান পেশ করতে পারি। তার আগে আর একটা বিষয়ে আমার ভিউ-পয়েন্ট ক্লিয়ার করে দিই। আমার মনে হয়, বুধনকে কালাদেও নামক কেউ হত্যা করেনি। মানুষই করেছে। আর করেছে যেখানে তার দেহাংশ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে নয়। কোন অপারেশন টেবিলে হতে পারে। কারণ যখন লাশ আবিষ্কার হয়, আমি সেখানে উপস্থিত থেকে পরীক্ষা করে দেখেছি যে, বুধনের চোখ খোলা ছিল না। তাকে সম্ভবত আগে ইথারাইজড্‌ করা হয়, তারপর অপারেশন টেবিলে তাকে কাটা হয়। আচমকা নিহত হলে, বিশেষ করে ওইরকমভাবে, তাহলে তার চোখ শেষ আতঙ্কে খোলা থাকত, মুখে-চোখেও মরণান্তক ভয়ের চিহ্ন প্রকট হতো। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। তার মুখ-চোখ ছিল শান্ত। ইথারাইজড করলেই সেটা হতে পারে। তাছাড়া আমি জেনেছি, তার মৃতদেহের ফোরেন্সিক রিপোর্টে মাথায় সাদা রঙের দামি সুতোর আঁশ লেগে থাকার কথা বলা হয়েছে। বুধনের বাড়ি আমি গিয়েছি। তার তেল-চিটচিটে বালিশও দেখে এসেছি। ফোরেন্সিক টিম যে সুতো পেয়েছেন, তা অন্য কিছুর।

আমার অনুমান, বুধনের হত্যা কোন অপারেশন টেবিলেই হয়েছে। ফলে আগে তাকে ইথারাইজড করে তারপর তার অঙ্গগুলি কালেক্ট করে যে তাকে মারা হয় নি, সে-কথা বলাই যায়। আমার মনে হয়, সেক্ষেত্রে আশ্চর্য হব না, যদি তার হার্ট, কিডনি এবং আরও অন্যান্য হিউম্যান অর্গান সংগ্রহ করার পর তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানলে। আমার অনুমান, এটা অপরাধীরা প্ল্যান করেই করেছে। বুধনকে মরতে হতই, কিন্তু খামোকা মরলে কী লাভ? তার চেয়ে মরলও আবার তারই দেহের উপযুক্ত অর্গান সংগ্রহ করে বাইরে বিক্রি করলে বিপুল লাভ। অর্গান-ট্র্যাফিকিং এখন একটা বড় সমস্যা। তার উপর পাশের রাজ্যের গা-ঘেঁষা অঞ্চল, বর্ডার এরিয়া। নার্সিং হোম কিংবা বড় বড় প্রাইভেট সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালগুলিতে এই-জাতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চাহিদা মারাত্মক। এক্ষেত্রে অপরাধীরা রথ দেখা কলা বেচা-দুটিই করেছে। বুধনের বয়স কম ছিল। সুস্থ-সবল ছেলে। অতএব তার অঙ্গের দাম নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন? তার অঙ্গগুলি হয় ইতিমধ্যেই!”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

সত্যব্রত হাসলেন, তারপর বললেন, “নুনিয়ার সঙ্গে তো আপনার আলাপ হয়েছে। সে জঙ্গলের মধ্যে একটা মোবাইল কুড়িয়ে পেয়েছিল। সাইকেল মাহাতোর মোবাইল। সে সেই মোবাইলটি আমার কাছে গচ্ছিত রেখেছিল। সে আপনাদেরকেই দিতে পারত। কিন্তু দেয় নি। কারণ, কিছু মনে করবেন না, আপনাদের থানাকে সে ঠিক ভরসা করতে পারছিল না। সর্ষের মধ্যে ভূত আছে কি-না, সে তো জানা নেই। যাই হোক, আমার মনে হয়েছিল, এই মোবাইলটা কোথায় পাঠানো উচিৎ। আজ যখন লালবাজার থেকে শাক্যবাবু এসেছেন এই কেসের তদন্তে, তাঁকে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। শাক্যবাবুরা এক্সপার্টকে দিয়ে ফোনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালে হয়ত কিছু পাওয়া গেলেও যেতে পারে!”
শাক্য বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। দেবেন। পরীক্ষানিরীক্ষা তো করতেই হবে ওটা। এখন বলুন, কে নকল বুধন মাহাতো সেজে এত বড় প্রতারণার অংশীদার হয়েছিল?”—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content