বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

বোধিসত্ত্ব সে জন্মে রাজা ব্রহ্মদত্তের এক প্রধান অমাত্য হয়ে রাজসন্নিধানে রাজসেবা করছেন। বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্ত অত্যন্ত বাচাল ছিলেন। রাজপদে আসীন থেকে এমন বাচালতা কাম্য নয়, উল্টে তা বিপদ ডেকে আনতে পারে। অমাত্য সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন, অপেক্ষা করতে লাগলেন একটা যথাযথ দৃষ্টান্তের, যার সাহায্যে তিনি রাজাকে সচেতন করতে পারবেন।
রাজনীতিশাস্ত্রে রাজাকে যেমন মন্ত্রণার উপদেশ দেওয়া হবে তেমনই মন্ত্রগুপ্তির পরামর্শ দেওয়া হবে। যথাযথ মন্ত্রণা এবং মন্ত্রগুপ্তি ব্যতীত সাফল্য আসে না। মন্ত্রভেদ রাজা এবং রাজ্যের বিনাশ ডেকে আনে। বিশেষত, মন্ত্রণার দ্বারা স্থিরীকৃত কর্তব্য যতক্ষণ না কাজে পরিণত হচ্ছে, রাজা ততক্ষণ, ততদিন তা সুগুপ্ত রাখবেন। আবার, রাজা বিপথগামী হলে অমাত্যের কর্তব্য হবে তাঁকে সচেতন করে রাজকর্তব্যে অবিচল রাখা। রাজা নিজে আত্মরক্ষা করবেন, নিজে রক্ষা পেলে তবেই রাজ্যকে রক্ষা করতে পারবেন।

অতয়েব, সেই প্রাজ্ঞ অমাত্য একটি সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন। অনতিবিলম্বেই সেই মহাক্ষণ উপস্থিত হল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৮: শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলেন দ্বারকানাথ

সেদিন রাজা উদ্যানে গিয়ে মঙ্গলশিলাপট্টে বসে আছেন। সঙ্গে আছেন সেই অমাত্য। মাথার ওপরে আমগাছে একটি কাকের বাসা, সেখানে এক কোকিলা নিজের ডিম পেড়ে গিয়েছে, কাকি তাকে নিজের মনে করেই রক্ষণাবেক্ষণ করে, যথাকালে সেই ডিম ফুটে শাবক নির্গত হলে কাকি নিজের তুণ্ড অর্থাৎ ঠোঁটে করে তাকে খাবার খাওয়ায়, লালন পালন করে। কিন্তু পক্ষ্মোদ্গমের আগেই একদিন সেই শাবক বিজাতীয় কোকিলরবে ডেকে উঠল। তা শুনে সচকিত কাকি তার স্বরূপ উপলব্ধি করে তুণ্ডের আঘাতে তার প্রাণ নাশ করে বাসার নিচে ফেলে দিল। সেই শাবকের দেহ এসে পড়ল রাজার পদমূলে। চমৎকৃত হয়ে রাজা জানতে চাইলেন “এ কি হল? কী হল!”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৮: রামানুজ ভরত ও লক্ষ্মণ, আনুগত্যের প্রকাশে দু’জনেই অনন্য

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৩: তুণ্ডিল-জাতক

লক্ষণীয়, কাকি যে তুণ্ডের দ্বারা শাবককে পরিপালন করেছে, সেই তুণ্ডের আঘাতেই নিমেষে তার প্রাণহরণ করতে বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করেনি।

সেই অমাত্য ভাবলেন, এই দৃষ্টান্তের দ্বারাই তিনি রাজার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করবেন। তিনি রাজাকে জানালেন যারা অতিমুখর, অকালে অধিক কথা বলে, তাদের এরকম পরিণতিই হয়। এই কোকিলশাবক পাখা গজানোর আগেই অকালে ডেকে উঠেছে, আত্মরক্ষার সুযোগটুকু পায়নি। উড়তে শেখার আগেই এমন অবিমৃষ্যকারিতায় তার জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছে। মনুষ্যেতর প্রাণী হোক বা মানুষ-ই হোক, অকালে বহুভাষীর এমন নিদারুণ দুর্দশাই ঘটে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮১: ইষ্টদেবীরূপে মা সারদা

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৬: ‘রাজর্ষি’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘বিসর্জন’ নাটক

শাণিত অস্ত্র কিংবা বিষও এত দ্রুত প্রাণহরণ করে না, যেমনটা ঘটে অসংযত বচনের ফলে। অতয়েব, কালে কিংবা অকালে, সম্পদে কিংবা বিপদে সর্বদা সংযতভাষী হয়ে সাবধানে কথা বলাই শ্রেয়। এমনকী পরমাত্মীয়ের সামনেও যা মুখে আসে তা বলা কখনও উচিত নয়। যিনি পরিণাম চিন্তা করে সংযত হয়ে বাক্যপ্রয়োগ করেন, সেই বিচক্ষণ ব্যক্তি শত্রুকুলকে অনায়াসে জয় করতে পারেন, পুরাণপ্রসিদ্ধ গরুড় যেমন করেন সর্পকুলকে।

এই সদুপদেশ শুনে রাজা তখন থেকে মিতভাষী হলেন, সেই অমাত্যের পদযর্যাদা বৃদ্ধি করে তাঁকে উত্তরোত্তর প্রভূত সম্পদে ভূষিত করতে থাকলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া

রাজা রাজ্যের পালক। প্রজাপালক হয়ে সুশাসন ও প্রজানুরঞ্জন রাজকর্তব্যের পরাকাষ্ঠা বলে বিবেচিত হয়। আদর্শবাদী ও বস্তুনিষ্ঠ রাজনীতিশাস্ত্রগুলি রাজার বিবিধ কর্তব্য স্থির করেন। ন্যায়পথে রাজ্যশাসন, প্রয়োজনে আপাত অনৈতিক কৌশলে রাজ্যরক্ষা, শত্রুবধ, পররাজ্যের অধিকার, বিবিধ বিষয়ে শাস্ত্রভেদে মতভেদ থাকলেও সুশাসনের প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সকলেই সহমত পোষণ করেন।

সুশাসনের জন্য যেমন সুশাসক প্রয়োজন, তেমনই সুশাসকের নানাবিধ গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম প্রধান হল মন্ত্রগুপ্তি, যথাযথ ও মিতভাষণের অভ্যাসেই সেই মন্ত্রগুপ্তির সাধন ঘটে। মন্ত্রভেদে রাজার সমূল বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, পরম বান্ধবজনের আঘাতেও রাজা ধ্বস্ত হতে পারেন। ইতিহাস সেই সাক্ষ্য বহন করে। কাকী যে তুণ্ডে পরিপালন করে সেই তুণ্ডের আঘাতেই বিনাশ করে, এই দৃষ্টান্ত প্রজার সুপ্ত শক্তির ইঙ্গিত করে। সুশাসনে যে প্রজা নিয়ন্ত্রিত থাকে, মাত্স্যন্যায় ঘটলে সেই প্রজাবিক্ষোভেই রাজ্য ও প্রাণহানি ঘটে। রাষ্ট্রশক্তির কর্তব্য ও প্রজাবলের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বহন করে এই জাতককথাটি বিশেষ স্মরণীয় হয়ে থাকে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content