রামকৃষ্ণদেব ও শ্রীমা।
ভাইদের মধ্যে জমিজমা, বিষয় নিয়ে বিরোধ বাড়ছে দেখে মা সারদা ভাইদের ইচ্ছানুসারে বিষয় ভাগের দায়িত্ব দেন শরৎ মহারাজকে। বিষয় নিয়ে মীমাংসা করার জন্য বড়ভাই প্রসন্ন সারদা মাকে বোঝান যে, মেজভাই কালীকুমারের সেরকম রোজগার নেই। আর তার নিজের বড় সংসার। তার দুই মেয়ের ভার শ্রীমা নিলেও প্রসন্নের দ্বিতীয় স্ত্রী সুবাসিনীর যদি ছেলে হয়, তখন তাকে সামলানোর জন্য ভালো ব্যবস্থা করতে হবে তো। শ্রীমার চিঠি পেয়ে শরৎ মহারাজ যোগীনমা, গোলাপমা ও ভূমানন্দকে সঙ্গে নিয়ে জয়রামবাটি আসেন। প্রায় দু’ মাস এখানে তিনি থাকেন। শরৎ মহারাজ শ্রীমাকে গ্রাম্যজীবনের এই টানাপোড়েনে উৎকণ্ঠিত থাকার বদলে উদাসীন দেখেন। কিন্তু সারদানন্দ স্বামীর মনে সন্দেহ ছিল যে, তাঁর মীমাংসা মামারা মেনে নেবেন কিনা। শ্রীমা তাঁকে বোঝান যে, ভাইদের ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে তারা শরৎ মহারাজের কথাকে অমান্য করবে। তারা কি জানে সারদানন্দের স্বরূপ!
সারদানন্দ তখন শ্রীমাকে জানান যে, এর জন্য তাঁকে জমি-বাড়ির দলিল দেখতে হবে আর কোয়ালপাড়ার মুহুরি কেদার দত্তকে ডাকতে হবে জমির মাপজোখের জন্য। শ্রীমা তাঁকে জানান বাড়ি, জমির কাগজপত্র সব কালীকুমারের কাছেই আছে। ঘর ভাগাভাগির সময় শ্রীমা কোন ঘরে থাকবেন, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলে পাঠান, ‘ঠাকুর বলতেন যে ইঁদুর গর্ত করে আর সাপ সেই গর্তে থাকে’। তিনি দুদিন প্রসন্নের ঘরে ও দুদিন কালীর ঘরে থাকবেন। মায়ের এই ইচ্ছা ভূমানন্দের লেখা “স্বামী সারদানন্দ” থেকে জানা যায়। যাঁরা বিভাগ করেছিলেন, তাঁরা শ্রীমা যে ঘরটিতে থাকতেন, সেটি প্রসন্নের ভাগে ফেলেন। এরপর বিষয়ভাগের পর্ব মিটলে শ্রীমা দু’ জন সেবিকা সহচরী এবং দুই ভাইঝি রাধু ও মাকুকে নিয়ে কলকাতায় আসেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৯: ইন্দুমতী ও সুরবালা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’
ঠাকুরের দেহরক্ষার পর তেইশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এর মাঝে শ্রীমা বহুবার কলকাতায় এলে হয় ভাড়াবাড়িতে নয়ত গৃহস্থবাড়িতে উঠেছেন। ভাড়াবাড়ি সবসময় গঙ্গার কাছে পাওয়া যেত না। তাছাড়া এখানে থাকাও ছিল ব্যয়বহুল। আবার নানাকারণে শ্রীমা গৃহস্থবাড়িতে বেশিদিন থাকতে পছন্দ করতেন না। এখন তাঁর সঙ্গে ভাইঝিরা সবসময়ই থাকে। এছাড়া নানাস্থান থেকে ভক্ত দর্শনার্থীরাও এখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এইসব দেখে শ্রীমার জন্য কলকাতাতে থাকার অসুবিধা দূর করতে শরৎ মহারাজ নিজে দায়িত্ব নিয়ে বহু অর্থ ব্যয় করে মায়ের ভক্ত কেদারদাসের দেওয়া জমির উপর মার একটা নিজস্ব বাড়ি তৈরি করিয়ে দেন।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫: কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসনে বসেই উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন আগরতলায়
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য
বেলুড়ে রামলোচন সায়ার ঘাটের কাছে বলার শ্মশানের সামনে শ্রীমার বাড়ির জন্য কিছু জমি কেনা হয়। কিন্তু শ্মশানের গন্ধ বের হয় বলে শ্রীমা সেই জমি দেখে পছন্দ করেননি। কেদারদাসের জমির সঙ্গে সংলগ্ন আরও এক কাঠা চার ছটাক জমি কেনা হয়। শরৎ মহারাজের কথা থেকে জানা যায় যে, এই বাড়ি করতে তাঁকে এগারো হাজার টাকা ধার করতে হয়েছিল। এখন উদ্বোধন পত্রিকার কার্যালয় হলেও এটি শ্রীমায়ের নামে নির্মিত মায়েরই বাড়ি। সেখানে ১৩১৬ সালের ৯ জ্যৈষ্ঠ শ্রীমার প্রথম পদধূলি পড়েছিল। এই বাড়ির নিকটবর্তী গঙ্গা প্রবাহিত বলে ছাদে উঠলেই তা দেখা যায়। আর দূরে উত্তরদিকে তাকালে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির ঝাউগাছগুলোর উঁচু মাথা দেখতে পাওয়া যায়। আর তাই দেখে শ্রীমা খুবই আনন্দিত হন।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৮: মোহিতকুমারী এক মহিলা আত্মজীবনীকার
শ্রীমাকে তাঁর নিজবাটিতে নিয়ে এসে এতদিনে শরৎ মহারাজেরও আনন্দ আর ধরে না। তিনি নিজেকে শ্রীমার দারোয়ান মনে করে আগের মতোই সব কাজ করতে লাগলেন। তবে তাঁকে দেখে বোঝা যেত যে, তাঁর কর্মসামর্থ্য যেন বহুগুণ বেড়ে গিয়ে সকল কাজে তাঁকে জয়যুক্ত করেছে। এখানে সন্ধ্যারতির পর শ্রীমা জপাদি সম্পন্ন করে মাঝে মাঝে বলতেন, ‘শরৎকে বল দুটো গান শোনাতে’। বৈঠকখানায় একটা তানপুরা আর দুটো বাঁয়া তবলা ছিল।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৬: সুখের লাগিয়া
শিশু পেটের ব্যথায় ভুগছে? তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি মেনে চলুন
তানপুরার তার বেঁধে শরৎমহারাজ একজনের হাতে দিতেন আর নিজে বাঁয়া হাতে গান ধরতেন, ‘এস মা, এস মা, শিবসঙ্গে সদা রঙ্গে, দনুজদলনী নিজজনপ্রতিপালিনী’… এইভাবে একটার পর একটা গান তিনি তন্ময় হয়ে গেয়ে যেতেন। আর ওপরে ভক্ত মেয়েদের সঙ্গে বসে শ্রীমাও একমনে গান শুনতেন। মায়ের এই ছোট বাড়িখানি তখন দিব্যভাবের আবেশে অনুরণিত হয়ে উঠত।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।