
ছবি: প্রতীকী।
লিঙ্গ রাজনীতির শিকার কি শুধুই মেয়েরা? আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের মাসে আমি এই প্রশ্ন রাখছি পাঠকদের কাছে। প্রশ্নটি করার একটি বড় কারণ, এখনও আমরা মনে করি সমাজে দুটি মাত্র লিঙ্গ আছে। পুরুষ এবং নারী। বাকি কোনও লিঙ্গের উপস্থিতি নেই সমাজে। সমাজে যখন প্রথম নারীদের প্রতি অবিচারের প্রসঙ্গ তোলা হয়, তখন নারীদের জন্য কিছু আইনি রক্ষাকবচ দেওয়া হয়। কিন্তু এই অবিচারের প্রতিকার রূপে লিঙ্গ বৈষম্যের কারণগুলি পাঠ্যবই বা পাঠ্যক্রমের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারেনি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যা প্রতিফলিত হয়েছে রাষ্ট্র কাঠামোতে, নিজে এগিয়ে এসে বৈষম্যের দরজা খুলে সাম্যের বাগান বানাতে চায়নি। তার ফলাফল হল এখনও আমরা নারীকে বাড়ির মধ্যে বা খুব বেশি হলে চাকরি করতে বলছে (এখনও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বলতে ভালোবাসে, তারা মেয়েদের চাকরি করার অনুমতি দেয়। মেয়েরা স্বেচ্ছায় চাকরি করতে পারে না!)। মেয়েদের একটি নির্দিষ্ট এবং অবশ্যই ছোট স্থানের মধ্যেই আটকে রাখতে চায় সমাজ। সমাজ নারীদের পায়ে গতি দিতে চায় না। সে হেঁটে যাবে কিন্তু গতিময় যানবাহন নিজে চালিয়ে যাবে না। অথচ সভ্যতার ইতিহাসে চাকা আবিষ্কার মানব সভ্যতায় আমূল বদল এনেছিল।
এক দল মানুষ মনে করেন, মেয়েরা এখন সিগারেট টেনে ধুঁয়া উড়িয়ে সমাজকে গঠন করার বদলে রসাতলে পাঠাচ্ছে। পুরুষেরা সেখানে সব রকম নেশা করে গাড়ি চালিয়ে ফুটপাথে শুয়ে থাকা মানুষদের পিষে দিয়ে চলে গেলেও সেই অপরাধের বিচার শেষ হয় না। মেয়েদের এই রসাতলে পাঠানোর মধ্যে নতুন সংযোজন হল যখন তারা নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য গাড়ি চালাতে শুরু করেছে। মেয়েরা মূলত পছন্দ করে স্কুটি চালাতে। মেয়েদের জন্যই বাজারে স্কুটি আনা হয়েছে? এই প্রশ্ন উঠছে কারণ, শহর এবং মফঃস্বলে মেয়েদের স্কুটি চালাতে দেখা যায় বেশি। সাধারণত স্কুটি বিক্রেতাদের বিজ্ঞাপন কিংবা ব্যবসায়িক ব্যক্তব্যতে দেখা যায় বলতে যে, মেয়েরা চড়ছেন এবং চালাচ্ছেন স্কুটি। কারণ, ভারতীয় সনাতনী পোশাক পরে চালাতে সুবিধে হয়। স্কুটি হালকা হয়। তাই মেয়েদের নাকি ‘ম্যানেজ’ করতে সুবিধা হয়। স্কুটির গঠন ঠিকঠাক বলে মেয়েদের শিখতেও না কি সুবিধে হয়। একটি সমীক্ষা বলছে, মেয়েরা স্কুটি কেনে চালাতে সহজ হবে বলে। আর পুরুষরা কেনে তেলের খরচ বা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণেরর খরচ কম হবে বলে। অর্থাৎ মেয়েরা যখন শুধু সনাতনী ধারণার আবেগে থেকে স্কুটি পছন্দ করছেন, সেখানে পুরুষরাও হয়ত সহজ হবে চালাতে বলে কিনছেন। কিন্তু বাইকের পৌরুষকে অস্বীকার করতে পারছেন না। তাই যুক্তি দিচ্ছেন অন্য। এবার কি বোঝা যাচ্ছে, গাড়ি চালানো এবং রাস্তায় মেয়েদের চালকের আসনে বসা লিঙ্গ রাজনীতির অন্য একটি আদলকে তুলে আনে?
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৪: বৈষম্যের চোরাবালি ভাবনার কিনারায়

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?
বাড়ির বাইরে নারীরা বেরোচ্ছেন কারণ তাঁকে লেখা পড়ার জন্য, কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য কিংবা চিকিৎসা বা অন্য কোনও প্রয়োজনের জন্য বাড়ির বাইরে যেতেই হয়। তারা গাড়ি অর্থাৎ সাইকেল, রিকশা হোক বা বাস, ট্রেন— চড়তে হয়। সেই সঙ্গে সহযাত্রী বা চালক কিংবা কন্ডাক্টারের দ্বারা শারীরিক বা মানসিক ভাবে যৌন নিগ্রহের শিকার তো আছেই। নারীদের জন্য নির্দিষ্ট আসন অথবা কামরা অথবা ট্রেন থাকছে এই নিগ্রহ থেকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিগ্রহ বন্ধ করা যাচ্ছে না। বনগাঁ লোকালে দীর্ঘ দিন যাতায়াত করে দেখেছি কোনও কম্পার্টমেন্ট স্বস্তি দিতে পারেনি। অযাচিত শারীরিক ছোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে না বসার জায়গা, না দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যাচ্ছে। ট্রেনের দরজা দিয়ে সবাই একসঙ্গে উঠতে চায় ফলে। আরও ধাক্কাধাক্কি বাড়তে থাকে। চ্যাঁচামেচি বাড়তে থাকে। পুরুষ যাত্রীরা এই নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকে। ফুলের বা সব্জির ব্যবসা করা দিদিরাও বোঝা নিয়ে উঠছেন লেডিস কম্পার্টমেন্টে। ফলে আরও সমস্যা হচ্ছে। এরকম অবস্থায় প্রতিবাদ করতে গেলে বা সমাধান সূত্র খুঁজতে গেলে শুনতে হয়, প্রাইভেট গাড়ি বা ট্যাক্সিতে কেন যাতায়াত করি না?
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পর্ব-৯: আকাশ এখনও মেঘলা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭০: বিচারক
যাতায়াতের সমস্যা আরও বড় গোলমালে পৌঁছয় যখন দেখি কোনও মহিলা ট্রেন চালাচ্ছেন, কিংবা বিমান চালাচ্ছেন। সেদিন যাত্রীদের প্রতিক্রিয়া অন্যরকম। এরকম ঘটনা আকছার ঘটে এই ভারতে। সব মহিলাকর্মীদের নিয়ে বিমান উড়ছে এরকম ঘটনা এখনও ভারতে খুব আনন্দের বিষয় বা স্বাভাবিক বিষয় বলে ভাবা হয় না। ট্রেন চালালে মৃদু গুঞ্জন আর বিমান চালালে ভবিষ্যতের গল্পো-আসরের রসিয়ে গল্পের রসদ হয়ে যায়। এই গল্পের বিষয় হয়, পুরুষ যাত্রীরা কতটা চিন্তায় ছিলেন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাকে নিয়ে। অর্থাৎ বড় যন্ত্র মানেই ধরে নেওয়া হয়, মহিলারা পারবেন না বা ভুল করার সম্ভাবনা বেশি। এরকম গুঞ্জন বা প্রকাশ্যে অনাস্থা প্রকাশ করা অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া। নারীরা দুর্বল মনের দিক থেকে এবং বুদ্ধির প্রয়োগের ক্ষমতা কম। এই ধারণা সমাজে প্রোথিত করে রাখার জন্য বারংবার আলোচনা করা হয়। নারীরাও শুনে শুনে নিজেদের বার্বি ডলের সংসারে ব্যস্ত রাখতে শিখে যায়।

ছবি: প্রতীকী।
আমিও অনেক দিন ধরে শুনে এবং পরিবারের অনেকের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে, না দুই চাকার গাড়ি শিখেছি আর না চার চাকার গাড়ি চালাতে শিখেছি। এই ভাবে চলছিল পিছনে বসে যাতায়াত। তারপর যাত্রা পথের অযথা দেরি আমার মধ্যে একটু বিপ্লব করার বাসনা জাগিয়ে তুললো। আমি একেবারে চার চাকার গাড়ি চালাতে শিখতে গেলাম। গাড়ি চালানো শেখার স্কুলে শেখায় পুরুষ শিক্ষকরাই। আমি গাড়ি চালানো শেখার পুরো সময়টাই শুনে গেলাম মহিলারা যারা রাস্তায় স্কুটি চালান তারা খুব খারাপ চালান। নারীরা গাড়ি খুব আস্তে চালান। এই শুনে আমি একদিন একটু জোরে চালাতে শুরু করলাম আর আমাকে শুনতে হল, আমি জোরে চালাই মানেই খুব খারাপ চালাই। তারপর একদিন শুনলাম এবং দেখলাম কিছু দুর্ঘটনার ঘটনা যেখানে মেয়েরা হয় স্কুটি থেকে পড়ে গিয়েছেন না বা ধাক্কা মেরেছেন। সেই সব বিষয় দেখিয়ে বলা হল, দোষ মেয়েটির বা মেয়েদের। তারপর শুনলাম বাজারে অটোমেটিক গাড়ি এসেছে যেখানে ক্লাচ নামক চালানোর যন্ত্রটি নেই। শিক্ষক বললেন, এগুলি মেয়েদের কথা মাথায় রেখে করা হয়েছে। কারণ মেয়েরা এক সঙ্গে ক্লাচ, ব্রেক এবং এক্সেলেটর ম্যানেজ করতে পারে না। সেই কথা শুনে কেউ প্রতিবাদ করেনি, উলটে সবাই শুনে হেসেছিল। এরপর আমার অভিজ্ঞতা অন্য এক খাতে বইল যখন আমি নিজে গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। আমি বুঝতে পারলাম লিঙ্গ বিভাজন শুধু গাড়ির ডিজাইন করার সময় প্রয়োগ করা হয়েছে তাই নয়, যে রাস্তায় আমি গাড়ি চালাচ্ছি সেখানে প্রতি পদে আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে আমি একজন মেয়ে, ভুল করে চলে এসেছি শুধু পুরুষদের খেলার ময়দানে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৩: সাত-সহেলি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৬: ভারতীয় পারিবারিক জীবনে স্নেহময় জ্যেষ্ঠর ভূমিকায় রামচন্দ্র কতটা আকর্ষণীয়?
গাড়িতে হাত সেট করতে গিয়ে প্রথমেই শুনলাম মেয়েদের কী কী সমস্যা হয় গাড়ি চালাতে গিয়ে। অনেকে বলেছিলেন, গাড়ির সিট আমার জন্য সমস্যা হবে, কারণ আমার দৈর্ঘ্য কম। আমার সমস্যা হয়েছিল সিট অ্যাডজাস্ট করতে গিয়ে। তবে সিট অ্যাডজাস্ট হয়ে গেল অনেক সহজেই। পরে সেটা নিজেই ঠিক করে নিতে পেরেছিলাম। তারপর বলতে শুনলাম, মেয়েদের ভয় বেশি এবং তারা ডান দিক দিয়ে চালায় বেশি। আমি দেখলাম জাতীয় সড়কে চালাবার কিছু নিয়ম আছে। গতি অনুযায়ী এবং গাড়ি ওভারটেক করার প্রয়োজন অনুযায়ী ডান দিক বাঁ দিক করা যায়। আরও লক্ষ্য করলাম, রস্তায় ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলে গাড়ি চালানোর হার খুব কম। সেই সঙ্গে গাড়িকে নিয়মত সারিয়ে ভালো রাখার সংখ্যা আরও কম। তাই দুর্ঘটনা ঘটার পর দোষ দেওয়ার প্রবণতা দুর্বলদের উপরেই করতে বেশি দেখি। অর্থাৎ এখানে জোর যার রাস্তা এবং রাস্তায় খবরদারি করার অধিকার তার বেশি। রাস্তায় আলফা মেলদের দাপট বেশি বিটা মেলদের উপর।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯o: মা সারদার কথায় ‘ঈশ্বর হলেন বালকস্বভাব’
তার পরেই দেখলাম রাস্তায় এক অদ্ভুত আধিপত্যবাদের খেলা। রাস্তায় গাড়ি অন্য গাড়িকে কীভাবে ওভারটেক করবে অর্থাৎ আপনি আস্তে চালালে আপনাকে বাধ্য করবে রাস্তায় একদিকে সরে গিয়ে জায়গা করে দিতে অন্য গাড়ি বা বাস বা লরিকে। কারণ সেই সব গাড়ির ড্রাইভার রা আপনাকে পাত্তা দিতে রাজি না। এও দেখলাম, একজন মহিলা চালাচ্ছে বলে গাড়িকে আমার গাড়ির খুব কাছে নিয়ে এসে আবার দূরে সরিয়ে নেওয়া। এরকম করে গাড়ির কাছাকাছি চলে এসে বুঝিয়ে দেওয়া আমি খুব ভুল করছি নিজে গাড়ি চালাতে গিয়ে। এরপরের অভিজ্ঞতা হল, গালাগালি দেওয়ার প্রবণতা। ট্রাফিক সিগনালে আপনি গাড়ি বন্ধ রেখেছেন। ফলে চালু করে এগতে সময় নিচ্ছেন। তখন যদি না দেখতে পায় যে আপনি মহিলা তাহলে আপনাকে চার অক্ষর, ছয় অক্ষরের গালি দিতে থাকবে। যার বেশিরভাগের মানেই হয় আপনি দুর্বল। আপনাকে ধর্ষণ বা আপনার পরিবারের মেয়েদের ধর্ষণ করে দেওয়া দরকার। আমি এরকম পরিস্থিতে পড়েছিলাম। শুনতে হয়েছিল, “মেয়েছেলেরা মেয়েছেলেই হয়”। অর্থাৎ তারা আনাড়ি হয়।

ছবি: প্রতীকী।
আসলে রাস্তায় গাড়ি চালাতে গেলে অন্য জায়গার মতো এখানেও আপনাকে “ইম্পস্টার সিনড্রোমে” ভুগতে হবে। আপনি যতই ভালো করে চালাতে শিখুন না কেন, আপানকে ভাবতে বাধ্য করবে, আপনি আসলে ভালো করে চালাতে পারছেন না। নিয়মভাঙা এখানে দস্তুর। রাস্তা এবং যানবাহন আমাদের গতিশিলতা দেয়, যার থেকে আমাদের সজীবতা, এগিয়ে যাওয়ার সূচনা হয়। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সত্ত্বা এই গতিশীলতাকে রুদ্ধ করছে বারে বারে। গ্রামীণ কলেজে পড়ানোর সুবাদে জানি, কত মেয়ে এই সাইকেলের ভরসায় ডিগ্রি অর্জন করতে পেরেছে। দীর্ঘ পথ তারা নিজেরা সাইকেল চালিয়ে আসত ক্লাস করবে বলে। আমি এদের দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছি বারে বারে। প্রতি মাসের পিরিয়ড চলাকালীন সাইকেল চালানোর কষ্ট সহ্য করেও তারা লড়াই জারি রেখেছে, একটা চাকরি যোগাড় করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে বলে।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, মৌলানা আজাদ কলেজ।