রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


মহর্ষি বাল্মীকি।

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার লোকশিক্ষা প্রবন্ধে কথকতাকে লোকশিক্ষার একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। লোকসংস্কৃতির অঙ্গ ছিল কথকতা। হাজার হাজার মানুষকে মোহময়তায় আবিষ্ট রাখতেন কথক ঠাকুর। মুখে মুখে গল্প রচনা করে মাঝে মাঝে গানের অনুষঙ্গে পৌরাণিক কাহিনি পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধতায় ভরিয়ে তুলতেন কথক। এই কথক ঠাকুরানি মহাকাব্যের রসসমুদ্রে ডুব দিয়ে যে মনিমুক্তা আহরণ করে আনতে চেষ্টা করবেন তা পাঠকবর্গের রসগ্রাহী হবে কিনা জানা নেই।

শুন শুন পাঠকগণ শুন দিয়া মন,
মহাকাব্যের কথা ভনে আভাজন।


একজন কবি যখন কাব্য রচনা করেন তখন তা তাঁর জীবনবোধ নিঃসৃত বাণী। জীবনকে না জানলে জনমানসকে স্পর্শ করা যায় কী? আর্ষ মহাকাব্যের ঋষিদ্বয়ের একজন মহর্ষি বাল্মীকি, যিনি আদিকাব্যের স্রষ্টা, যিনি রামায়ণ মহাকাব্যে একজন পুরুষোত্তমের, নরচন্দ্রমার জীবনালেখ্য চিত্রিত করেছেন যার প্রভাব এখনো ভারতবাসীর আবেগকে জারিত করে, মথিত করে সতত প্রবহমান।
মহাকাব্য যখন একটি জাতীয় জীবনের সিগনেচার হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা মহাকাব্যের কাব্যকারের মহাজীবনের প্রত্যক্ষদর্শনজনিত অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন বলে মনে করা যেতে পারে। ত্রিলোকজ্ঞ ঋষি নারদকে মুনিবর বাল্মীকি প্রশ্ন করেছিলেন—

“কো ন্বস্মিন্ সাম্প্রতং লোকে গুণবান্ কশ্চ বীর্যবান্?”

সাম্প্রতিক কালে পৃথিবীতে একাধারে গুণবান ও বীর্যবান কেউ আছেন কী?
জীবনেরর প্রতি আকর্ষণই জীবনচিত্র আঁকতে প্ররোচিত করে। মহাজীবনের স্রোতে সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, মনুষ্যত্ববোধ, আদর্শবোধ, সভ্যতা, সংস্কৃতি শতধারায় তাতে বয়ে নিয়ে যায় একটি জাতীয় জীবনের সমস্ত চিহ্নগুলিকে, মিশে যায় এক মহাজীবন-পারাবারে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৪: ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের মাছ বৈচিত্র্যের ক্ষতিকারক প্রজাতি হল ক্রোকোডাইল ফিশ

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৯: মন্দির হয়ে বৌদ্ধবিহার

মহাজীবনের গল্প যুগান্তরের পথ বেয়ে লোকগাথায় পর্যবসিত হয়। আঞ্চলিক লোকগাথাগুলিকে মানুষ নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে একান্ত আপন করে নেয় যখন তখন সেটাই মনে হয় মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি বা বিস্তার। যাত্রা, পালাগান, লোকগান — এ ভাবে শেষে পথের পাঁচালীতে পূর্ণতা পায়। কখনও বা লোককথা মহাকবির মনীষায় মহাকাব্যের শিল্পিত রূপ হয়ে ওঠে। ওই যে “দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে।”

ঋষি চ্যবনের ঔরসজাত বা ভার্গবপুত্র যেই হন রত্নাকর তাঁর দস্যু জীবন থেকে ঋষিত্বে উত্তরণ যেন এক মহাকাব্যিক সূচনাপর্ব। সময়ের বল্মীক বা উই স্রষ্টার সৃজনের আখর মুছে ফেলতে পারল কী? রামায়ণের মহর্ষি বাল্মীকির অন্তরাত্মায় প্রাকৃত জীবনের ছোঁয়া লাগলো কবি কৃত্তিবাস ওঝার শ্রীরাম পাঁচালীতে। দস্যুর পাশবিকতা মুক্ত হয়েছে বাল্মীকি ঋষিকবির সৃজনী ছন্দের হিল্লোলে। রত্নাকরের পাপের ভাগী হতে চাননি তার পরিবারবর্গ। পাপ পুণ্যের ভাগ কি নিক্তিতে পরিমাপ করা যায়? কবি কিন্তু তাঁর কল্পনার যাদুলেখনীর স্পর্শে একটি সূক্ষ্ম বিভাজনরেখায় চরিত্রায়নের মধ্যে দিয়ে পাঠকবর্গের মনোজগতে উভয়ের ধারণা দিতে পারেন। আর তাতেই মজে রয়েছেন আপামর ভারতবাসী আজও — রাম রম্য, মনোরম, শুভ, তাঁর নামে পাপমুক্তি,আর রাবণ? তিনি কখনও ঘৃণ্য, কখনও বা অনুকম্পার পাত্র, মনোজগতের একচ্ছত্র অধীশ্বর? নৈব নৈব চ।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১০: সাধনা যে সত্যের আশ্রয় পাওয়ার তরে…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’

রত্নাকর হলেন রত্নের আকর, খনি। ঋষিত্বে উত্তীর্ণ তাঁর মননের উপহার ভারতবাসীকে, তাদের পারিবারিক গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম-অর্থ-কামের পরিপূর্ণ রূপ আদিকাব্য রামায়ণ। সময়ের বল্মীক, জড়ত্বের উইপোকা ঢেকে দিয়েছে জাতির বাহ্যিক চেতনার স্থূল আবরণ, অভ্যন্তরে অস্থির গভীরে স্পন্দমান মড়া থেকে রামনাম, অভিরাম পরম রমণীয়। ক্ষয়িষ্ণু জীবনের মধ্যে থেকে যেন উঠে আসে সেই অমোঘ বাণী—

যাবৎ স্থাস্যন্তি গিরয়ঃ সরিতশ্চ মহীতলে।
তাবদ্রামায়ণীকথা লোকেষু প্রচরিষ্যতি।।


এই পৃথিবীর পর্বত, নদীর অবস্থানের মতোই চিরন্তন রামকথার অস্তিত্ব, ফিসফিসিয়ে যেন বলে সে — এই ভোগবাদী জীবনেও আমি আছি, আমি থাকব।
আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ, আর্থারাইটিসের ব্যথায় দীর্ঘ দিন কষ্ট পাচ্ছেন? স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে ভরসা রাখুন আয়ুর্বেদে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৯: দাঁতে পোকা! সত্যি, নাকি নিছক ধোঁকা?

হেলদি ডায়েট: সর্দি-কাশিতে ভুগছেন? জেনে নিন কোন ঘরোয়া টোটকায় মিলবে আরাম

আর্ষ মহাকাব্যের আর একজন স্রষ্টা কবি হলেন শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। কৃষ্ণ গাত্রবর্ণের কারণে তিনি কৃষ্ণ। টিকাকার নীলককণ্ঠের মতে, “নারায়ণাবতারত্বাত্ কৃষ্ণত্বম্, কৃষ্ণনামকত্বঞ্চ।” শ্রীকৃষ্ণের অবতাররূপে তিনি কৃষ্ণ। কৃষ্ণের প্রলম্বিত ছায়া মহাভারতের কুরুপাণ্ডবের দ্বৈরথ, দ্বন্দ্ব, হিংসা, প্রতিহিংসা, সমস্যা, সমাধান, প্রতিকার সবকিছু ঢেকে দীর্ঘায়িত হয়েছে। পৌরাণিক ভাবনায় ভগবান বিষ্ণুর দ্বাপরযুগের অবতাররূপ হলেন কৃষ্ণ। মহাভারত স্রষ্টা বেদব্যাস এবং অর্জুনসখা শ্রীকৃষ্ণ দুজনেই কৃষ্ণ। দু’জনেই স্রষ্টা, একে অপরের পরিপূরক যেন। শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বৈদব্যাসের কথামালা যেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুণগরিমায় আনত শ্রদ্ধার্ঘ্য।

দ্বীপে অয়ন, জন্মস্থান বা উৎপত্তিস্থান তার, তাই তিনি দ্বৈপায়ন। কুরুকুলের বংশলতিকার অব্যাহত গতির জয়যাত্রা তাঁরই প্রদত্ত বীজে।জন্ম তাঁর একাকী, যমুনার এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। জন্মমাত্র তিনি ঋষির ঔদাসীন্যে সবকিছু উপেক্ষা করে চলে যান তপশ্চর্যায়। তিনি একক, অনন্য, নিরাসক্ত আবার কুরুকুলের আপদে বিপদে প্রবলভাবে সংসক্ত। কার্যোদ্ধারের পর সন্ন্যাসীর বৈরাগ্যে তিনি উদাসীন গৈরিকব্রতধারী তপস্বী। ঘটনাচক্রে দ্বৈপায়ন হ্রদ মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সরোবর জ্যেষ্ঠ কুরুনেতৃত্বের গুপ্ত আশ্রয়।

শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস।

আশ্চর্য এক যোগসূত্র ,যমুনার জলের গতিময়তায় ঘেরা দ্বীপে প্রবহমান জীবনের রূপকারের জন্ম,জলাধারের স্বচ্ছ নির্মল কিন্তু আবদ্ধ জলে শেষ আশ্রয়শয্যা পেতেছেন কুরুরাজ দুর্যোধন,অবরুদ্ধ জীবন, মৃত্যুতে যার চরম পরিণতি। বেদব্যাস বেদ বিভাগ করেছিলেন তার প্রজ্ঞায়, জ্ঞানে। “ঋগাদিভেদেন পৃথক্কৃত্য ব্যাসত্বং ব্যাসনামকত্বম্।” বেদবিভাগের গৌরবের সঙ্গে আছে শুধুমাত্র ব্যাস। ভরতবংশীয় বিষয়ক মহাজ্ঞান তিনি সংক্ষেপেও বলেছেন আবার বিস্তারিতভাবেও বলেছেন। কারণ, পৃথিবীতে সংক্ষেপে ও বিস্তারে অভ্যস্ত হওয়াই পণ্ডিতদের অভীষ্ট।

“ইষ্টং হি বিদুষাং লোকে সমাসব্যাসধারণম্”। ব্যাসশব্দের অর্থ বিস্তার। সংস্কৃত অভিধানগ্রন্থে ব্যাসশব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “সমাসঃ সংক্ষেপঃ ব্যাসো বিস্তারঃ”। বেদজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে লৌকিক বিষয়ের যা কিছু জ্ঞান এবং মানবেতিহাস কোন কিছুই আচার্য্য বেদব্যাসের জ্ঞানের পরিধির বাইরে ছিল না। তাই শুধু ভরতবংশীয়দেরই নয়, মানবজীবন সম্বন্ধে যা কিছু জ্ঞান তিনি অধিগত করেছিলেন সেই জ্ঞানই তিনি প্রয়োজনে সংক্ষেপে কখনও বা বিস্তারিতভাবে উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর মহাকাব্যে। তিনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস, সার্থকনামা যুগপুরুষ।—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content