রবিবার ১৯ মে, ২০২৪


ছবি সংগৃহীত।

বাল্মীকি মুনিবর নারদের কাছে রামচরিত শ্রবণ করে যোগবলে নরচন্দ্রমার আলোকিত বর্তমান জীবন ও অতীত এবং অনালোকিত ভাবীকাল প্রত্যক্ষ করলেন। অভিরাম রামের ধর্ম, কাম ও অর্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত রত্নখচিত জীবনচরিত পদবন্ধনে কাব্যে রূপায়িত করলেন ঋষি। এই মহার্ঘ সম্পদকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসবেন কারা? কাদের দিয়ে যাবেন এই দায়ভার? মহর্ষি বাল্মীকি গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে ভাবছেন— ঠিক সেই মুহূর্তে তার সম্মুখে উপস্থিত হলেন আশ্রমিক, যশস্বী, বেদবিদ্যায় পারঙ্গম, ধার্মিক মেধাবী দুই রাজপুত্র কুশ ও লব। বেদের তাৎপর্যসহিত জ্ঞান অর্থাৎ পরম্পরাগত শিক্ষা ছাড়াও পিতা রামের গুণগরিমা, মাতা সীতার চারিত্রিক মহত্ত্ব, রাবণের নিধন বিষয়ক এই মহাকাব্য যে তাদের শিক্ষণের বিষয় ছিল।

সেই কাব্য প্রচারে পাঠ ও গানে, দ্রুত মধ্য ও বিলম্বিত এই ত্রিবিধ রূপে, ষড়জ, মধ্যম প্রভৃতি স্বরসপ্তক সংযুক্তিতে, বীণার তন্ত্রীবাদ্যের সঙ্গে শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীর রসসংযুক্ত করে গন্ধর্বদের মতো রূপবান দুই কুমার গাইতে লাগলেন। দৃশ্য ও শ্রব্য কাব্যের মেলবন্ধনে কুশ ও লব হলেন দৃশ্য কাব্যের চিরন্তন কুশীলব। কানের ভেতর দিয়ে মরমে পৌঁছোয় যে সুর মূর্ছনা তার আবেদন যে বিশ্বজনীন। জীবন রঙ্গমঞ্চে আনন্দ, বিষাদ, শোক, শৌর্য, গুণগৌরবের অন্যতম প্রচার মাধ্যম সংগীত।
পরিশীলনে সুসংস্কৃত সংগীত যে অনেক বৃহৎ পরিসরে সুরের মার্গদর্শনের পথরেখার সূচনা করে। পিতৃগৌরব, মায়ের স্বচ্ছ জীবনালেখ্য প্রচার করবেন কারা? যোগ্য সুসন্তান। ঋষি কবি বাল্মীকি নান্দনিক বোধের উচ্চতার সঙ্গে বিনোদনেও নিয়ে এলেন রামায়ণকে। প্রাকৃত মনোজগত জয়ের প্রথম সোপান মনে হয় বিনোদন। সেই অনিন্দ্যসুন্দর দুই কুমার যারা সেই রামেরই প্রতিবিম্ব স্বরূপ তারা মুনি ও সাধুসমাগমে প্রথম রাম কথা সুরসংযোগে পরিবেশন করলেন। কী হল তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া? যাঁরা সাংসারিক বন্ধনমুক্ত কোনও নন্দনতত্ত্ব যাঁদের নীরস জীবনে কোনও আবেদনই রাখে না, যাঁরা ধর্ম, অর্থ, কাম এই ত্রিবর্গের থেকেও মোক্ষতেই আপ্লুত হয়ে তপশ্চর্যাকে জীবনের ব্রত হিসেবে মেনে নিয়েছেন তাঁদের মরমে সারা জাগাতে পারল কী সেই সঙ্গীত? ঋষি কবির বর্ণনায়—

তচ্ছ্রুত্বা মুনয়ঃ সর্বে বাষ্পপর্যাকুলেক্ষণাঃ।
সাধুসাধ্বিতি তাবুচুঃ পরমং বিস্ময়মাগতাঃ।।
করুণরসে বিগলিতচিত্ত মুনি ঋষিরা চোখের জলে আবেগে ভেসে গেলেন। ধার্মিক ঋষিগণ ‘সাধু’ ‘সাধু’ বলে প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। কী তাঁদের উপলব্ধি?

চিরনিবৃত্তমপ্যেতত্ প্রত্যক্ষমিব দর্শিতম্।

তাঁদের কাছে অতীতের ঘটনাও যেন চোখের সামনে মঞ্চস্থ অভিনয় বলে মনে হল। এ যেন সংগীতবহুল চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্যায়ন। মুনিগণ সন্তুষ্ট চিত্তে বল্কল, কৃষ্ণাজিন, যজ্ঞসূত্র, কমন্ডলু, কৌপীন, আসন কুঠার, কাষায় বস্ত্র, জটা ও কাষ্ঠভার বহনের রজ্জু প্রভৃতি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী উপহার দিলেন দুজনকে। দীর্ঘায়ু কামনায় ও শুভেচ্ছা বার্তায় অভিনন্দিত করলেন দুই কুশীলবকে। এরপর অযোধ্যার পথে পথে রামকথা গাইতে লাগলেন সুন্দরকান্তি দেবশিশুর মতো সেই দুই কুমার লব ও কুশ। ক্রমে ক্রমে মহারাজ রামচন্দ্রেরও কর্ণগোচর হল সেই শ্রুতিসুখকর সঙ্গীত। তপোবনের প্রাজ্ঞমুনিদের বিমুগ্ধতায় যার অনুমোদন তা জনচিত্তকে স্পর্শ করল। যেন জীবনের গীতিকাব্যের সূচনা করলেন দুই রামনন্দন, যার সুর মূর্ছনা এখনও পর্যন্ত বিমোহিত করে রেখেছে ভারতীয় জীবনমঞ্চ তথা নাট্যমঞ্চ।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২: রামকথার পটভূমি এবং মহাভারতে কথকের কথাসূত্র

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৯: ঋষির আশীর্বাদে যাত্রা এবার গভীর অরণ্যপথে

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৮: দেবতাদের আশীর্বাদে আর অর্ব্বাবসুর প্রার্থনায় যবক্রীত বেদজ্ঞান লাভ করলেন

 

মহাভারতের প্রাথমিক প্রচার

নৈমিষারণ্যে এসেছেন সৌতি কথক ঠাকুর। শ্রোতৃমন্ডলী, যে সে নন, তাঁরা প্রজ্ঞাবান, বেদবিদ, স্মৃতিনিষ্ঠ, ব্রতচারী তাত্ত্বিক মুনিঋষিগণ। তপঃক্লিষ্ট মুনি ঋষিরা, মোক্ষ চিন্তাই যাদের উদ্দেশ্য তাঁরা বিচিত্রকথা শ্রবণে আগ্রহী, হয়তো ছেড়ে আসা বিগত জীবনের কিছু রং রূপ আজও ক্ষণিক উঁকি দিয়ে যায় তাঁদের মনে। সুরসিক পেশাগত দিক দিয়ে যিনি গল্প বলায় দক্ষ সেই সৌতির গল্পকথায় তাঁরা আগ্রহী—

চিত্রাঃ শ্রোতুং কথাস্তত্র পরিবব্রুস্তপস্বিনঃ।

গভীর আগ্রহে তাঁকে ঘিরে ধরলেন তাঁরা। কুশলবার্তা বিনিময়ের পর মুনিদের অসীম কৌতূহল না জানি কোন বিচিত্র কথকতার আসর থেকে এসেছেন কথক ঠাকুর। বেশ আকর্ষণীয় চেহারা কথকের। পদ্ম পাতার মতো আয়তনয়ন তাঁর। অনেক সময়ে চোখও কথা বলে যে। হে পদ্মপত্রতুল্য নয়ন, কোথা থেকে আসছেন আপনি? কোথায় এতকাল ছিলেন? দয়া করে বলুন।

কুত্র আগম্যতে সৌতে!ক্ব চায়ং বিহৃতস্ত্বয়া।
কালঃ কমলপত্রাক্ষ!শংসৈতত্ পৃচ্ছতো মম।।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

স্বাদে-আহ্লাদে: কুলের আচারের নাম শুনলে জিভে জল আসে? রইল সহজ রেসিপি

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১১: বন থেকে বনান্তরে

সেই বিস্তীর্ণ সভায় ‘সৌতি লোমহর্ষণি’ অনুভবে রোমাঞ্চ জাগিয়ে ‘ভাবিতাত্মনাম্’ শুদ্ধচিত্র মুনিগণ ও রাজর্ষিদের চরিতাশ্রিত যথাযথ এবং সঙ্গত অর্থযুক্ত কথাবিস্তারে ব্রতী হলেন। সৌতি উগ্রশ্রবা জানালেন, রাজা জনমেজয়ের সর্পনাশক যজ্ঞে বেদব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন যথানিয়মে শ্রীবেদব্যাস রচিত মহাভারতের নানা উপাখ্যান বলেছিলেন সেই বিচিত্র অর্থযুক্ত মহাভারত কথা আমি শ্রবণ করেছি শুধু তাই নয় বহু তীরবর্তী এবং স্থলবর্তী তীর্থক্ষেত্র ঘুরে পঞ্চহ্রদবিশিষ্ট সমন্তপঞ্চকদেশে যেখানে কুরুপাণ্ডবদের এবং অন্যান্য রাজাদের যুদ্ধ হয়েছিল সেই যুদ্ধক্ষেত্র দেখে, এসেছি এই পুণ্যতীর্থে, ব্রহ্মাতুল্য ঋষিগণ অধ্যুষিত পুণ্যভূমি নৈমিষারণ্যে। বলুন কোন অভিপ্রেত কাহিনি শুনতে চান আপনারা? পবিত্র পৌরাণিক কাহিনি? ধর্ম, অর্থ, বিষয়ক উপাখ্যান? না মহাত্মা নরশ্রেষ্ঠ রাজাদের ও ঋষিদের ইতিহাস? কোনটি মনপসন্দ? ঝুলিতে হরেক কিসিমের গল্প মজুত আছে, শুধু আদেশের অপেক্ষামাত্র।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩: ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছিল পঞ্চমের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৮: পূর্ণ অপূর্ণ-র মাঝে পথ দেখায় ‘দেবত্র’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১১: লিকার চা খাওয়া কি সত্যই শরীরের পক্ষে ভালো?

ঋষিগণ পরম আগ্রহে শুনতে চাইলেন, ইন্দ্রপ্রভৃতি দেবগন এবং ব্রহ্মর্ষিদের দ্বারা প্রশংসিত, শ্রীবেদব্যাসের আদেশে বৈশম্পায়নমুনি দ্বারা কথিত, ভরতবংশীয়দের ইতিহাস, যা প্রাচীন ঘটনা অবলম্বনে শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস বিরচিত। কেন ওই বিচিত্র কাহিনীতেই শ্রবণে তাঁদের উৎসাহ? কারণ, ওই শ্রেষ্ঠ ইতিহাসের পদবন্ধ সহজবোধ্য। পবিত্র ঋকমন্ত্র আর যজুর্বেদমন্ত্রের মতো ব্যাখ্যাগম্য নয়। এর মধ্যে আছে সূক্ষ্মতত্ত্ব আর আছে যুক্তি, যা মগজাস্ত্রে শান দেয়, আছে বেদপ্রতিপাদ্য বিষয়, সমাজনীতিতে যা অনুসরণযোগ্য এবং অপরিহার্য, যা শুনেও পুণ্য। পড়ে পাওয়া চোদ্দআনা হল পুণ্যলাভ।বেদব্যাস বিরচিত এই আশ্চর্য মহাভারত শুনতে চাইলেন সমবেত ঋষিরা।

ছবি সংগৃহীত।

সৌতি নারায়ণকে প্রণাম নিবেদন করে শুরু করলেন তার মহা ইতিহাস। দ্বাপর যুগ যার বিচিত্র লীলায়িতকথায় চিহ্নিত তিনি যে নরোত্তম।তাইতো ইতিহাসসৃজনের মধ্যমণি তিনি। তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত তদানীন্তন রাজাদের ইতিহাস। তিনি দেবতা নন, মানবায়নে শ্রেষ্ঠ মানুষের গুণে সমৃদ্ধ। হিংসা, দ্বেষ, ক্রোধ, ক্ষমা, সহমর্মিতা, সখার কোমল প্রেমে ভরপুর, মানবিক গুণে পরিপূর্ণ একজন মানুষ। নরনারায়ণের দোষত্রুটি, গুণগরিমা বিশ্লেষণে যে হয় ইতিহাসের বিনির্মাণ। তাই ইতিহাস বর্ণনায় জনতাজনার্দনের প্রতিনিধিকে প্রথম বন্দনা নিবেদন সৌতির। আর এই ইতিহাসকে হৃদয়ে ধারণ করবেন কারা? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য নির্বিশেষে সকল দ্বিজাতি সংক্ষেপে ও বিস্তারিতভাবে একে ধরে রাখবেন। শুধুই ইতিহাসের নথিভুক্তকরণ নয় যুগান্তরের স্রোতে ভেসে আসা অদ্ভুত বিশাল এই গ্রন্থের বিষয়, পূর্বেও আংশিক ভাবে বলেছেন ক্রান্তদর্শী কবিগণ,বাল্মীকি প্রভৃতি পথপ্রদর্শক কবিরা যেমন রামায়ণাদি রচনা করে নিদর্শন রেখেছেন, বৈশাম্পয়নরা কাহিনি ব্যাখ্যা করে ধরে রেখেছেন স্মৃতিতে, এরপরেও কবি ভারবি, কিরাতার্জুনীয়ম্ মহাকাব্যে, নাট্যকার ভট্টনারায়ণের বেণীসংহার দৃশ্যকাব্যে এরই মহিমা কীর্তন করে চলবেন। ভাবীকাল তার প্রমাণ। সৌতি, মহাভারতের অতীত গৌরব, বর্তমান বহমান জীবনের গরিমা, ভাবী কালের বহু কবির সম্ভাবনাময় সৃজনের আকর যে গ্রন্থ তার মহিমাময় বিষয়বস্তু বিচিত্র পদবন্ধনে বলতে চলেছেন তার ইঙ্গিত রাখলেন।

মহাকালের অব্যাহত গতিতে এখনও সমানভাবে চর্চিত ভরতবংশীয়দের এই ইতিহাস, গম্ভীর তত্ত্বসমৃদ্ধ বিচিত্র বিষয়বস্তু বাহুল্যে অনন্য মহাভারত।
শ্রীবেদব্যাসের মতে—

হ্রদানামুদধিঃ শ্রেষ্ঠো গৌর্বরিষ্ঠা চতুষ্পদাম্।
যথৈতানীতিহাসানাং তথা ভারতমুচ্যতে।।


প্রাকৃতিক জলাশয়ের মধ্যে সমুদ্র শ্রেষ্ঠ, চতুষ্পদ প্রাণীদের মধ্যে গাভিজাতীয় তৃণভোজী প্রাণী সর্বোত্তম, ইতিহাসের মধ্যে মহাভারত মহত্তম।—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content