সোমবার ৬ মে, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

মহাভারতে সৌতি উগ্রশ্রবা নৈমিষারণ্যে এসেছেন সুদূর হস্তিনাপুর বা সেখানকার রাজাদের বিজিত রাজ্য তক্ষশীলা থেকে। তিনি তাঁর কথাসূত্রে শ্রোতা ঋষিদের জানিয়েছেন— হস্তিনাপুরে পাণ্ডবদের উত্তরাধিকারী রাজা জনমেজয় সর্পমারণযজ্ঞে ব্রতী হয়েছেন। তার প্রতিহিংসার যজ্ঞাগ্নিতে শত শত সাপ মন্ত্রশক্তিতে আহুতিতে পরিণত হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে একজন মহান ঋষি উতঙ্কের অতি উগ্র প্রতিহিংসাপ্রবণতা। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধবিধ্বস্ত হস্তিনাপুরে কৃষ্ণের বরে জীবিত একমাত্র শিবরাত্রির সলতে ছিলেন উত্তরা এবং যুদ্ধে নিহত অভিমন্যুর পুত্র পরীক্ষিত। প্রতিহিংসার অব্যর্থ অস্ত্রাঘাতে অশ্বত্থামা গর্ভেই তার প্রাণহরণ করলে পর কৃষ্ণের বরে তার প্রাণ রক্ষা পায়।

কিন্তু দীর্ঘায়ু তাঁর ভাগ্যে নেই।মৃগয়ায় গিয়ে ক্ষুধার্ত পরিশ্রান্ত রাজা পরীক্ষিত মৌনব্রতধারী ঋষি শমীককে প্রশ্ন করে উত্তর না পাওয়ায়,বিরক্ত হয়ে ঋষির গলায় একটি মৃত সাপ ঝুলিয়ে দিয়ে এলেন। ঋষি শমীকের পুত্র শৃঙ্গী এই ঘটনা জানতে পেরে রাজা পরীক্ষিতকে অতি ভয়ঙ্কর এক অভিশাপ দিলেন। অভিসম্পাতটি হল—

তং পাপমতিসংক্রুদ্ধস্তক্ষকঃ পন্নগেশ্বরঃ।
আশীবিষস্তিগ্মতেজা মদ্বাক্যবলচোদিতঃ।।
সপ্তরাত্রাদিতো নেতা যমস্য সদনং প্রতি।
দ্বিজানামবমন্তারং কুরূণামযশস্করম্।।


পাপাত্মা কুরুকুলের যশনাশক ব্রাহ্মণদের অবমাননাকারী রাজাকে আজ থেকে সপ্তমদিনের পর অতিক্রুদ্ধ সর্পরাজ তক্ষক আমার বাক্যবলে প্রেরিত হয়ে যমালয়ে প্রেরণ করবেন। স্থিতধী মুনি শমীক এই ঘটনা জানতে পেরে ক্ষমাসুন্দর মনে পুত্রকে বোঝালেন,

ন মে প্রিয়ং কৃতং তাত! নৈষ ধর্মস্তপস্বিনাম্।

এ আমার প্রিয় কাজ নয়,ব ৎস।তোমার এই ক্রোধ তপস্বীদের ধর্মসঙ্গত নয়।রাজা আমাদের ন্যায়পরায়ণ রক্ষক, *রক্ষ্যমাণাঃ বয়ং তাত রাজভির্ধর্মদৃষ্টিভিঃ।

বৎস, রাজা ধর্মানুযায়ী আমাদের রক্ষা করেন। সুতরাং রাজা সর্বদাই ক্ষমার যোগ্য।

অজানতা কৃতং মন্যে ব্রতমেতদিদং মম।

ক্ষুধার্ত ও পরিশ্রান্ত রাজা আমার মৌনব্রতের কথা জানতেন না তাই এই কাজ করে ফেলেছেন।

কস্মাদিদং ত্বয়া বাল্যাৎ সহসা দুষ্কৃতং কৃতম্।
ন হ্যর্হতি নৃপঃ শাপমস্মত্তঃ পুত্র!সর্ব্বথা।
হঠকারিতাবশত, তোমার বালকসুলভ দুষ্কার্য্য, এই অভিশাপ —রাজা এর যোগ্য নন। পুত্র শৃঙ্গীকে বোঝাতে ব্যর্থ হলেন ঋষি শমীক। শৃঙ্গী জানালেন তিনি নিরুপায়—

প্রিয়ং বাপ্যপ্রিয়ং বা তে বাগুক্তা ন মৃষা ভবেৎ।

এ কাজ প্রিয় বা অপ্রিয় যাই হোক যা বলেছি তা মিথ্যা হবার নয়।

নাহং মৃষা ব্রবীমি।

আমি মিথ্যা বলি না। ঋষি শমীক পুত্রকে আত্মক্ষয়ী ক্রোধকে সমূলে বিনষ্ট করবার উপদেশ দিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন—

ময়া তু শমমাস্থায় যচ্ছক্যং কর্ত্তুমদ্য বৈ।

শমগুণ অবলম্বন করে অর্থাৎ ক্রোধ বর্জন করে আমি যা করবার তাই করব। তিনি শিষ্যকে দিয়ে রাজা পরীক্ষিতকে খবর পাঠালেন —

মম পুত্রেণ শপ্তোঽসি বালেনাকৃতবুদ্ধিনা।
মমেমাং ধর্ষণাং ত্বত্তঃ প্রেক্ষ্য রাজন্নমর্ষিণা।।


হে রাজন, আমার প্রতি আপনার কৃত আচরণ অপমানজ্ঞানে ক্রোধী অশিক্ষিত বুদ্ধি আমার পুত্র আপনাকে অভিশাপ দিয়েছে।

শিষ্যটি সেই নিদারুণ অভিশাপবার্তা মন্ত্রীদের সামনে রাজাকে নিবেদন করলেন। রাজার সুরক্ষাব্যবস্থায় রাজা এবং মন্ত্রীরা তৎপর হয়ে উঠলেন। একটিমাত্র স্তম্ভের ওপর নির্মিত সুরক্ষিত প্রাসাদে অবস্থান করতে লাগলেন রাজা পরীক্ষিত। বিষচিকিৎসকেরা, মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণরা ঘিরে রাখলেন রাজাকে। সপ্তমদিনে, কাশ্যপ যিনি প্রখ্যাত বিষচিকিৎসক, তিনি যে কোন সাপের বিষ মুক্ত করবার উপায় জানতেন, তিনি যখন রাজার কাছে যাচ্ছিলেন তখন পথে তক্ষক তাঁর শক্তিমত্তা পরীক্ষা করবার জন্যে একটি বটগাছকে দংশনে ভস্মীভূত করলেন। কাশ্যপ সেই বটগাছের ভস্ম থেকে অঙ্কুরিত, পল্লবযুক্ত বৃক্ষ সৃষ্টি করলেন। তক্ষক তখন কাশ্যপকে রাজার প্রতিশ্রুত অর্থের দ্বিগুণ দিয়ে, ফিরিয়ে দিলেন তাঁকে। এরপর তক্ষক একটি সুমিষ্ট ফলের ভেতরে তাম্রবর্ণ কীট হয়ে আত্মগোপন করে রইলেন। তাঁর নির্দেশমতো নাগেরা ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে সেই ফল প্রভৃতি রাজা পরীক্ষিতকে উপহার দিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪: অপবাদ এবং রামচন্দ্রের সুশাসনের রামরাজত্ব

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৯: মিশ্র মাছচাষ পদ্ধতিতে শুধু ফলন বাড়েনি, মাছের বৈচিত্রের সমাহারও নজর কেড়েছে

শাশ্বতী রামায়ণী, শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪১: চরৈবেতি—গভীর বনপথে জীবন বহমান

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৯: দ্রৌপদীর জন্য স্বর্গীয় ফুলের খোঁজে ভীমসেন কোনও পথে পাড়ি দিলেন!

রাজা ফলটি খাবার উপক্রম করলেন। সেই ফলের ভেতর তাম্রবর্ণ কীট দেখে বললেন, সূর্যাস্ত সমাগত, আমার বিষাদ নেই, নেই ভয়ও, তাহলে এই কীটই তক্ষক হয়ে দংশন করুক আমায়, শৃঙ্গীমুনির কথাই সত্য হোক। তাঁর কথায় হয়তো শমীকমুনিকে অপমানজনিত হীনমন্যতাবোধ কাজ করছিল।মৃত্যুপথযাত্রী রাজা কীটটিকে নিজের গলায় রেখে হাসতে লাগলেন। কীটরূপী তক্ষক নিজমূর্তি ধারণ করে রাজার দেহ সবেগে বেষ্টন করে ভয়ঙ্কর শব্দে রাজাকে দংশন করলেন। রাজার মৃত্যু হল। নাবালক পুত্র জনমেজয়কে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন মন্ত্রীরা। সময়মতো বিবাহ করে মহানন্দে কাল কাটাতে লাগলেন রাজা জনমেজয়।

তক্ষশিলা জয় করে সবেমাত্র ফিরেছেন রাজা জনমেজয় ঠিক সেইসময় প্রবল প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে গুরুগৃহ থেকে শিক্ষাজীবন শেষে গুরুর আশীর্বাদধন্য বিদ্যামাহাত্ম্যবান উতঙ্ক হাজির হলেন হস্তিনাপুরে মন্ত্রীপরিবৃত জনমেজয়ের সমক্ষে।

উতঙ্কের কেন এই প্রতিশোধস্পৃহা? গল্পটি হল— ব্রাহ্মণ ঋষি উতঙ্ক গুরুদক্ষিণা হিসেবে গুরুপত্নীর প্রার্থনা অনুযায়ী পৌষ্যরাজমহিষীর একজোড়া কানের দুল সংগ্রহ করতে গেলেন। তাঁর এই কাজে ভয়ানক বিঘ্নবিপত্তি। ভীষণভাবে নাকাল হওয়ার পর যখন কৃতকার্য হলেন তখন নাগরাজ তক্ষক সেই দুলজোড়া চুরি করে নিয়ে পাতালে আশ্রয় নিলেন। উতঙ্ককে গভীর বিপদে ফেলে দিলেন সেই নাগরাজ তক্ষক।উতঙ্ক পাতাল ঢুরে গুরুবন্ধু ইন্দ্রের সহায়তায় দুল উদ্ধার করলেন। তক্ষকের প্রতি ক্রোধের আগুন কিন্তু তাঁর মনের গভীরে দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল। প্রতিশোধপরায়ণ উতঙ্ক হস্তিনাপুরের রাজসভায় জনমেজয়কে বললেন, আপনার যেটা কাজ সেটা না করে ছেলেমানুষের মতো অন্যকাজে সময় নষ্ট করছেন। উতঙ্কের গলায় বিদ্রুপের সুর। রাজকর্তব্যে সচেতন জনমেজয় বললেন,কেন?রাজধর্ম প্রজাপালন, সেটাই ঠিকভাবে করছি। আপনি বলুন, কী করণীয়? উতঙ্ক সুযোগসন্ধানী, বললেন আপনার আশু কর্তব্য হল— তক্ষকের হিংসার শিকার হয়েছিলেন আপনার পিতা। তার প্রতিকার করুন।

তক্ষকেণ মহীন্দ্রেন্দ্র! যেন তে হিংসিতঃ পিতা।
তস্মৈ প্রতিকুরুস্ব ত্বং পন্নগায় দুরাত্মনে।।


রাজা জনমেজয়ের ক্রোধ তাতিয়ে তুললেন এই বলে—

রাজর্ষিবংশগোপ্তামরপ্রতিমং নৃপং।
যিযাসুং কাশ্যপঞ্চৈব ন্যবর্তয়ত পাপকৃৎ।।
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১১: ফুটবলের ব্ল্যাক প্যান্থার: লেভ ইয়াসিন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প

উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১১: রাত বাড়লে গুলি-বোমার শব্দ, দরজায় অচেনা লোক এলে সন্দেহ হতো

রাজর্ষিবংশের রক্ষক দেবপ্রতিম ঋষি কাশ্যপ (বিষচিকিৎসক) এসেছিলন রাজাকে (পরীক্ষিতকে) বাঁচাতে তাঁকেও তক্ষক ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনি সর্পযাগেরঅনুষ্ঠান করুন, প্রজ্বলিত সেই যজ্ঞের আগুনে তক্ষককে দগ্ধ করুন। তার ফলে আপনার ও আমার দুজনেরই প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ হবে।

এবং পিতুশ্চাপচিতিং কৃতবাংস্ত্বং ভবিষ্যতি।
মম প্রিয়ঞ্চ সুমহৎ কৃতং তব ভবিষ্যতি।।


পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ এবং আমারও প্রিয়কার্য অর্থাৎ বদলা নেওয়া সেটাও হবে। পিতার নৃশংস নিধনবার্তায় জ্বলে উঠলেন জনমেজয়। পুরোহিতদের সঙ্গে পরামর্শ করে সর্পসত্র নামে মহাযজ্ঞ শুরু করলেন। নানা বর্ণের, নানা আকৃতির সাপ এসে যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি হিসেবে ন্যস্ত হতে লাগল।

বস্তুত প্রতিহিংসার কোন শেষ নেই। প্রতিহিংসার বিষে জর্জরিত হলেন রাজা জনমেজয়,যার নিয়ামক হলেন উতঙ্ক, যিনি গুরুর একান্ত অনুগত। নিজের উদ্দেশ্যসাধনে একাগ্রচিত্ত, তিনি, একটি চুরির দোষে সম্পূর্ণ নাগকুলের ধ্বংসলীলায় ইন্ধন যোগালেন। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের সাযুজ্য নষ্ট হতে লাগল। সর্পশূন্য হওয়ার পথে পৃথিবী। তক্ষক, ঋষি শৃঙ্গীর নির্দেশ কার্যকর করেছেন মাত্র। হয়তো এ ছাড়া তাঁর আর কোনও উপায় ছিল না। নিয়তির খেলা বিচিত্র। রাজা জনমেজয় সুন্দর নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করছিলেন, উত্তেজিত স্বার্থনিষ্ঠ উতঙ্ক কানে বিষ না ঢাললে হয়তো এই সর্পসত্র অনুষ্ঠিত হতনা। কারণ কাল সবকিছু ভুলিয়ে দেয়,পরিণত বয়সে ক্ষমা প্রগাঢ় হয়, প্রতিশোধের আকাঙ্খা স্তিমিত হয়ে আসে। কালক্রমে পরিণত বয়সে বাবার মৃত্যুর কারণ জানা সত্ত্বেও জনমেজয় হয়তো এতটা উত্তেজিত হতেন না। পরিণত বয়সে, সুদীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা যেমন বিবেচক করে তুলেছে ঋষি শমীককে, তেমনি নবীন বয়স, ধার্মিক পুত্র শৃঙ্গীকে করে তুলেছে সত্যনিষ্ঠতায় উদগ্র, উদ্ধত। যৌবনের ধর্মই যে তাই। সত্যনিষ্ঠা ও জীবনহানির দ্বন্দ্বে বারবার সত্যনিষ্ঠতা যে জীবনের থেকে বড় নয়,মহাভারতে সেটি প্রমাণিত হয়েছে নানা কাহিনিসূত্রে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’

ভারতীয় সাহিত্যের এই সাধক যখনই কলম ধরেছেন বাংলাভাষা ততই পদ্ধতিগতভাবে এগিয়েছে/২

রামায়ণের রামচন্দ্র লোকাপবাদে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তিনি প্রিয় স্ত্রীর প্রতি নির্মম হয়েছেন। তবে তাঁর এই আচরণ ছিল রাজ্যের বৃহত্তর প্রজাস্বার্থে, বংশের সুখ্যাতি অক্ষুণ্ণ রাখাও তাঁর লক্ষ্য ছিল। মহাভারতে কুরুরাজ জনমেজয় প্রভাবিত হয়েছিলেন ঋষির প্ররোচনাপ্রসূত পিতৃনিধনবার্তায়। তিনি উত্তেজনায় অগ্রপশ্চাৎ ভাবেননি, পারিপার্শ্বিক ভুলে মারণযজ্ঞে মেতেছেন, পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধের আগুনে ছারখার হতে চলেছে একটি সম্পূর্ণ জীবকুল। মারাত্মক বিধ্বংসী এই প্রতিক্রিয়া।

অনুশোচনার পশ্চাত্তাপ মানুষের তথাকথিত পাপমুক্তি ঘটায়। জাগতিক জীবনে সংশয়ের,যা কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্বের সব কিছু নিরসন হয় প্রতিপক্ষের প্রতিক্রিয়াহীন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে।অপরাধীর মনে যদি অনুশোচনা থাকে তবে তার দহনজ্বালায় যেন শান্তিজল বর্ষণ করে, নিবৃত্ত করে প্রতিহিংসার আগুন —কমাত্র ক্ষমা।
প্রতিহিংসার সুদূরপ্রসারী দাবানল জ্বলছিল শমীকপুত্র শৃঙ্গীর মনে তা স্ফুলিঙ্গ হয়ে অগ্নিসংযোগ ঘটালো সর্পনিধনযজ্ঞাগ্নির শিখায়।

একটি অবমাননার প্রতিশোধের ক্ষত্রতেজ যে অনেক হত্যা, অনেক মৃত্যু ডেকে আনতে পারে এই বোধ, অকৃতবুদ্ধি অর্থাৎ অশিক্ষিত বুদ্ধি, হঠকারী ঋষি শৃঙ্গীর হয়তো ছিল না। উত্তঙ্ক চৌর্যবৃত্তির প্রতিশোধ নিয়েছিলেন রাজা জনমেজয়ের মন বিষাক্ত করে।বুদ্ধিমান রাজা জনমেজয় বিবেচক ধার্মিক। তিনি মন্ত্রীদের কাছে বাবার মৃত্যুর সত্যতা যাচাই করেছিলেন। তারপর তাঁর সর্পসত্রের সিদ্ধান্ত।

ছবি: সংগৃহীত।

উতঙ্কের কাহিনি মহাভারতের বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়, এ যেন আমাদের লৌকিক জীবনচর্চার অঙ্গ। উত্তঙ্করা বসে আছেন যাঁরা লঘুপাপে থুরি লঘু অপরাধে ক্ষমতার দম্ভকে, গুরুদণ্ডদানের হাতিয়ার করে, নিজেদের প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করেন। কোন স্বচ্ছহৃদয়েকে বিষাক্ত করেন। উৎকোচগ্রহণ এখনও আছে তখনও ছিল। মহান ঋষি কাশ্যপ অর্থপ্রাপ্তির লোভ সামলাতে পারেননি। রাজা পরীক্ষিতের প্রতিশ্রুত অর্থের দ্বিগুণ, তক্ষকের কাছ থেকে গ্রহণ করে পরীক্ষিতকে বাঁচিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিলেন। কিছু মানুষ আছেন যারা পরিস্থিতির শিকার। যারা শুধু প্রতিশোধকে কার্যকর করবার নিয়ামক তক্ষকের মতো। তক্ষকের স্থূলবুদ্ধি, ক্রুর ,খলস্বভাব— প্রাকৃত জনসুলভ, একমুখী। যে কোন উপায়ে ছলে,বলে,কৌশলে, নৃশংস উপায়ে মানবিকতার পরিপন্থী, নিজের স্বার্থসাধনে তৎপর। মানবিকতার মূর্ত বিগ্রহ ঋষি শমীক, বিপন্ন মানবতাবোধকে তিনি হুঁশিয়ার করে দেন — চেতনার আলোয় সুরক্ষিত কর নিজেকে।

মানবিকতার রুদ্ধ দ্বার যখন বন্ধ থাকে,তখন অবমাননার মৃতসাপ গলায় আবদ্ধ করে দেয় দিকভ্রষ্ট মানুষ, যেন নিজেকে না চেনার অবক্ষয়। স্তব্ধ, মৌন ঋষি শমীক, পরীক্ষকের ভূমিকায়, দিকভ্রষ্ট মানবিক মূল্যবোধের ধৈর্যের মূল্যায়ন।

অবোধ আত্মক্ষয়ী অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয় মানবিক সত্তা। ফল? ক্রোধের আগুনে সামাজিক ভারসাম্যের স্খলন, পতন, বিচ্যুতি। সর্পমারণযজ্ঞ যার বিষাক্ত পরিণাম। শৃঙ্গী জ্ঞানী, গুণী সর্বজ্ঞ পণ্ডিতন্মন্য বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একজন তাঁরা সর্বদাই নিজেদের সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করে অনড় অবিচলিত থাকেন পাথরের মতো।

রাজা পরীক্ষিত জীবনের উদ্দেশ্যবিহীন বিপন্ন মানবতাবোধ। তাঁরা ক্ষণে ক্ষণে দিকভ্রষ্ট হয়ে অনুশোচনার তীরবিদ্ধ হন। অবিরাম রক্তাক্ত হয় হৃদয় তাঁদের। পশ্চাত্তাপ, অনুশোচনা, জাগ্রত মানবিকচেতনার উজ্জ্বল দিশারী। কিন্তু জীবনের উগ্র প্রতিবন্ধকতা তাঁদের বাঁচতে দেয় না। চেতনার অপমৃত্যু ঘটে, যেমন ঘটেছিল কুরুরাজ পরীক্ষিতের।

উতঙ্করা উত্তেজনার বিষবাষ্প ছড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে দেয় না বিভ্রান্ত মানুষদের,শৃঙ্গীদের অহমিকাবোধ আত্মম্ভরী সবজান্তাভাব অন্যায়জেদে অটল থাকে।তক্ষকরা নির্দয়ভাবে ক্ষমতাশালীদের আদেশ পালন করেন নির্মম নির্লিপ্ততায়। উতঙ্করা আছেন, থাকবেন।—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content