রবিবার ১৯ মে, ২০২৪


রামচন্দ্র, বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে, মা কৌশল্যা ও ভাই লক্ষ্মণের প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হলেন। নিজের বনবাসগমনের প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে উভয়কে জানালেন—
যশো হ্যহং কেবলরাজ্যকারণাৎ
ন পৃষ্ঠতঃ কর্ত্তুমলং মহোদয়ম্।
অদীর্ঘকালে ন তু দেবি জীবিতে
বৃণে বরামদ্য মহীমধর্ম্মতঃ।।


রাজ্যলাভের জন্যে তিনি মহাফলদায়ক যশ পরিত্যাগ করতে পারেবেন না। জীবন দীর্ঘস্থায়ী নয়। তিনি ধর্মবিরুদ্ধ রাজ্যলাভের পরিপন্থী। ধর্মবিষয়ে তাঁর নিজস্ব অভিমতটি প্রাঞ্জলভাষায় বুঝিয়ে দিলেন লক্ষ্মণ এবং দেবী কৌশল্যাকে।

প্রিয় জ্যেষ্ঠের বনগমনের দৃঢ় মানসিকতায়, একান্ত হিতাকাঙ্খী, লক্ষ্মণ, অসহ্যক্রোধে, বিস্ফোরিতচোখে, হস্তীশ্রেষ্ঠের মতো ঘন ঘন গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। তাঁর অন্তর্নিহিত ক্ষোভে, দুঃখের বহিঃপ্রকাশ অনুভব করলেন রাম। ধৈর্যগুণে রোষ প্রশমিত করবার জন্য প্রিয় হিতাকাঙ্খী অনুজ লক্ষ্মণকে রামচন্দ্র বললেন, রামের অভিষেকের আয়োজন থেকে মনটি সরিয়ে নিয়ে অভিষেকনিবৃত্ত করবার দিকে মনোনিবেশ করুন লক্ষ্মণ। অভিষেকায়োজনের প্রতি যাঁর উৎসাহ সবচেয়ে বেশি সেই কৌশল্যামায়ের শোক দূর কর। যস্যা মদভিষেকার্থে মানসং পরিতপ্যতে। মাতা নঃ সা যথা ন স্যাৎ সবিশঙ্কা তথা কুরু।। মায়ের মনের আশঙ্কার ভীতিপ্রদ দুঃখ আর সহ্য হয় না রামের। বরং লক্ষ্মণ মায়ের এই শঙ্কাজনিত দুঃখলাঘবের প্রতি যত্নবান হন।

রাম জানালেন, কোনওদিন তিনি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে পিতার বা মায়েদের কিছুমাত্র অপছন্দের কোন কাজ করেছেন—এমনটা তাঁর জানা নেই। সত্যবাদী পিতা অসত্য আশ্রয়ের কারণে পরলোকভয়ে ভীত। অবিলম্বে অভিষেকের আয়োজন বন্ধ না হলে পিতা দশরথ আশঙ্কিত হতে পারেন এই ভেবে, যে তিনি সত্যচ্যুত হতে চলেছেন। তাঁর ভীতি দূরকরবেন রাম। তাঁর প্রতিশ্রুতি অসত্য হবে ভেবে পিতা আশঙ্কাগ্রস্ত। পিতার মনোবেদনা রামকে বেদনার্ত করে তুলেছে, সত্যং নেতি মনস্তাপস্তস্য তাপস্তপেচ্চ মাম্। সেই কারণেই অভিষেকের আয়োজন স্থগিত হওয়া প্রয়োজন। অবিলম্বে তিনি বনগমনে ইচ্ছুক। বিমাতা কেকয়রাজনন্দিনী কৈকেয়ী তাঁর নিজের পরিকল্পনা সফল হয়েছে ভেবে নিশ্চিন্তমনে পুত্র ভরতকে নির্দ্বিধায় যুবরাজপদে অভিষিক্ত করতে পারবেন। জটাজিনধারী, বল্কলপরিধানে, রামকে দেখে রানি কৈকেয়ী তৃপ্ত হবেন।

রামচন্দ্র তাঁর নিজের বনগমনের ফলে রাজ্যপদ অপ্রাপ্তি এবং বনগমনের কারণ এই সবকিছু জন্য নিয়তিকে দায়ী করে বললেন, এসবই বিধাতা নির্দিষ্ট। না হলে দেবী কৈকেয়ীর এমন বুদ্ধি হত না। মায়েদের প্রতি ভক্তিপ্রদর্শনে রামচন্দ্রের কোনও ভেদজ্ঞান নেই। দেবী কৈকেয়ীও, সন্তানদের অভিন্ন মনে করেন। কাজেই রামের অভিষেকের বিরোধিতা করে স্বামী দশরথের প্রতি দুর্বাক্যপ্রয়োগ, এ সব কিছুই বিধাতা পুরুষের চক্রান্ত। গুণবতী রাজনন্দিনী কৈকেয়ী সাধারণ নারী নন। স্বামীর উপস্থিতিতে সাধারণ মহিলার মতো তাঁর কঠোরবাক্যপ্রয়োগে মতি, এ সবই দৈবেরই পরিকল্পনা বলেই মনে হয়। দৈবের অপ্রতিহত শক্তি ব্যাখ্যা করে রামচন্দ্র বললেন, যদচিন্ত্যন্তু তদ্দৈবং ভূতেরপি না হন্যতে। ব্যক্তং ময়ি চ তস্যাঞ্চ পতিতো হি বিপর্য্যয়ঃ।।
দৈবের অচিন্তনীয় প্রভাব প্রাণীমাত্রের ওপরে কখনও প্রতিহত হয় না। স্পষ্টত দেবী কৈকেয়ী ও আমি এই ভাগ্যবিপর্যয়ের শিকার। রামের উপলব্ধি হল, এমনকি সুখদুঃখ, ভয়ক্রোধ, লাভ ও অলাভ, উৎপত্তিবিনাশ সবকিছু দৈবের আয়ত্তাধীন। দৈব, এগুলিতে প্রকাশমান হয়। এগুলির মধ্যে দিয়েই ভাগ্যদেবতাকে চিনে নেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অজ্ঞাত দৈবের সঙ্গে যুদ্ধ করা কী সম্ভব? উগ্রতপস্বী মুনি ঋষিরাও যে দৈবাধীন। তা না হলে তাঁরা কাম ও ক্রোধের বশবর্তী হন কীভাবে? তাঁদের তপঃশক্তি বিনষ্ট হয় এই কারণেই। সংকল্পরোহিত কাজে প্রবৃত্তি এবং আরব্ধকাজে নিবৃত্তি—এ সবই ভাগ্যের ফেরে হয়ে থাকে। এই তত্ত্ব, বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করে রাজ্যাভিষেকের বিঘ্নকে মেনে নিয়েছেন রাম। তাই দুঃখ বা অনুশোচনাবোধ তাঁর নেই। এতয়া তত্ত্বয়া বুদ্ধ্যা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা। ব্যাহতেঽপ্যভিষেকে মে পরিতাপো ন বিদ্যতে।। লক্ষ্মণকে রামচন্দ্রের অনুরোধ, আর দুঃখ নয়। দ্রুত অভিষেকের আয়োজন অবসানে উদ্যোগী হও। প্রতিসংহারয় ক্ষিপ্রমাভিষেচনিকীং ক্রিয়াম্।

রামচন্দ্রের অভিষেকের মাঙ্গলিক জলপূর্ণপাত্রগুলিতে সংগৃহীত জলে বনবাসের নিমিত্ত তপস্বীযোগ্য ব্রতস্নান সম্পন্ন হোক। রাজ্যলাভ ও বনবাসজীবন দুয়ের মধ্যে বনবাসই, রামের শ্রেয়দায়ক। মা কৈকেয়ীর প্রতি আশঙ্কার আঙ্গুল তোলা উচিত নয়। কারণ দৈবের অমোঘপ্রভাবের কারণে মানুষ ক্ষতিকর কাজে প্রবৃত্ত হয়।

রামের উপদেশ শুনে লক্ষ্মণের প্রতিক্রিয়া কী? একাধারে বিষণ্ণ ও ক্রুদ্ধ লক্ষ্মণ যেন উদ্যতফণা ক্রুদ্ধ সাপটি, যে গর্তে আত্মগোপন করেছে। পশুরাজ কিংবা হাতি যেমন শুঁড়টি আন্দোলিত করে তেমনি হাতের অগ্রভাগ নাড়িয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন। রাম যদি, ধর্মহানিকর কাজে প্রবৃত্ত হন এবং পিতৃবাক্যে অনাস্থা প্রকাশ করেন তবে সেটি লোকসাধারণের কাছে অবিনয়ের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে। লক্ষ্মণের মতে, আনুগত্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবার জন্যেই রামের বনবাসের এই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তগ্রহণ করেছেন। ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ রামের এই হঠকারী সিদ্ধান্ত আজ লক্ষণকে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করেছে, নিষ্ক্রিয় দৈবের দোহাই দিয়ে পুরুষাকারকে অস্বীকার করছেন কেন রাম? ভাগ্যকে দায়ী করে অনেক অধার্মিক প্রতারক শঠতার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। পাপাচারে প্রবৃত্ত পিতা-মাতা কি শঙ্কার ঊর্ধ্বে? তাঁরা দুজনে মিলেইতো ছলনার আশ্রয় নিয়ে বিনাদোষে স্বার্থনিষ্ঠভাবে নির্দোষ রামকে বনে নির্বাসিত করছেন? সন্তি ধর্ম্মোপবাসক্তা ধর্ম্মাত্মন্ কিং ন বুধ্যসে। তয়োঃ সুচরিতং স্বার্থং শাঠ্যাৎ পরিজিহীযর্তোঃ।।

ধর্মাত্মা রাম কেন বুঝতে পারছেন না? লক্ষণের মতে, কৈকেয়ীকে রাজা দশরথের বরদানের প্রতিশ্রুতিও পূর্বপরিকল্পিত। রাজা দশরথ প্রতিশ্রুতবর পূর্বেই দান করতে পারতেন। জ্যেষ্ঠকে বঞ্চিত করে কনিষ্ঠকে অভিষিক্ত করতে আগ্রহী হয়েছেন রাজা। এ বিষয়টি লক্ষ্মণের অসহনীয় মনে হয়েছে। নোৎসহে সহিতুং বীর তত্র মে ক্ষন্তুমর্হসি। সেই কারণে লক্ষ্মণ ক্ষমাপ্রার্থী। বৃদ্ধ রাজা, সাধারণের অপ্রিয় কাজ করে সকলের বিদ্বেষভাজন হবেন। কিন্তু একথা লক্ষ্মণ বলবেনই যে, ধর্মবোধের কারণে রামের এই দোলাচলচিত্ততা।সংশয়ের মুখোমুখি হয়েছেন রাম। তথাকথিত ধর্মবোধকেও লক্ষ্মণ ঘৃণা করেন। যেনৈবমাগতা দ্বৈধং তব বুদ্ধির্ম্মহামতে। সোঽপি ধর্ম্মো মম দ্বেষ্যো যৎপ্রসঙ্গাদ্বিমুহ্যসি।।

রানি কৈকেয়ীর বশংবদ অথচ কর্মদক্ষ পিতা, এই ধর্মবিরুদ্ধ প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন। কেন রাজা ও রানির এই অভিষেক পণ্ড করে দেবার বাহানাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন রাম? এটি লক্ষ্মণের দুঃখের কারণ। রামের এই লোকনিন্দিত ধর্মবোধ নিতান্তই গর্হিত। বাবা-মা নামধারী যথেচ্ছাচারী রাজা ও রানির মনোবাসনা পূরণ করবার ইচ্ছা একমাত্র রামেরই কাম্য। পিতামাতার আচরণ নিয়তিনির্দিষ্ট বলে যদি তা উপেক্ষা করেন তবে তা নিতান্তই অনুচিত। কাপুরুষ বা দুর্বল ব্যক্তিরা দৈব বা ভাগ্যের অনুগত। দৈব ও পুরুষাকারের দ্বন্দ্বে ক্ষমতাশালী বীরেরা দৈবকে গুরুত্ব দেন না। সদম্ভে লক্ষ্মণ ঘোষণা করলেন, আজই সাধারণের সমক্ষে রাজ্যাভিষেকে বিঘ্নসৃষ্টিকারী সেই দৈবকে, পুরুষাকারদ্বারা হত্যা করব। অদ্য মৎপৌরুষহতং দৈবং দ্রক্ষ্যন্তি বৈ জনাঃ। যৈর্দ্দৈবাদাহতং তেঽদ্য দৃষ্টং রাজ্যাভিষেচনম্।। সাধারণ লোকচক্ষুর সমক্ষেই তা ঘটবে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৩: রাজা জনমেজয়কৃত সর্পমারণযজ্ঞের অবসানে, কোন সদর্থক মহাভারতীয় শিক্ষা লুকিয়ে আছে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৭: তীর্থদর্শন

মদোন্মত্ত হস্তীকে তেমন অঙ্কুশ দ্বারা প্রতিহত করা যায় তেমনই ধাবমান দৈবকে আমি পৌরুষদ্বারা শায়েস্তা করব। অত্যঙ্কুশমিবোদ্দামং গজং মদজলোদ্ধতম্। প্রধাবিতমহং দৈবং পৌরুষেণ নিবর্ত্তয়ে।। একরোখা জেদী একগুঁয়ে লক্ষ্মণ উদ্ধতপৌরুষের অহঙ্কারে জ্বলে উঠলেন। শুধু পিতা কেন? লোকপাল, ত্রিলোকপাল, প্রাণীকুল, কেউই রামের রাজ্যাভিষেকে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবেননা। যাঁরা রামচন্দ্রকে চতুর্দশ বৎসর অরণ্যবাসের বিধান দিয়েছেন তাঁদের জন্য ওই বনবাসজীবন নির্দিষ্ট হল। রানি কৈকেয়ীর প্রত্যাশাকে বিফল করবেন লক্ষ্মণ।
দৈববলে সুখলাভ রানির কপালে নেই। লক্ষ্মণ সেই বংশানুক্রমিক রাজ্যাধিকারে বিশ্বাসী। পূর্বতন রাজার পুত্রেরাই প্রজাপালনে যোগ্য উত্তরাধিকারী। এই পরম্পরাক্রমে সহস্রবৎসরান্তে রামচন্দ্রের পুত্ররাই প্রজাপালনের উত্তরাধিকার লাভ করবেন। অন্য কেউ নয়। আর রাষ্ট্রদ্রোহের সম্ভাবনায় রাম যদি সিংহাসন প্রত্যাখ্যান করে থাকেন তবে, বেলাভূমি যেমন সাগরকে রক্ষা করে তেমনি লক্ষ্মণও রামের জন্য সেই সুরক্ষাবলয় সৃষ্টি করবেন। তা না হলে বীরলোকপ্রাপ্তি যেন তার জন্যে নির্দিষ্ট না হয়। তিনি একাই সমস্ত বিরুদ্ধ রাজশক্তির মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। তার বাহু শুধু অঙ্গের শোভামাত্র নয়, ধনু্র্বাণ তাঁর শুধুমাত্র ভূষণ নয়, অসি তাঁর কোষবদ্ধ নয়, এগুলি শত্রুধ্বংসের জন্যেই নির্দিষ্ট। তিনি শত্রুকে প্রতিহত করবার লক্ষ্যে, দেবরাজ ইন্দ্রেরও বিরোধিতায় প্রস্তুত।

লক্ষ্মণের অস্ত্রাঘাতে হাতির শুঁড়, ঘোড়ার ঊরু, সৈনিকের মস্তকে সমাকীর্ণ হয়ে উঠবে রণভূমি। তিনি যখন গোধা অর্থাৎ চামড়ার অঙ্গুলিত্রাণ ও ধনুর্বাণ ধারণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবেন, তখন বীর প্রতিপক্ষের পৌরুষত্বের অভিমান আর থাকবে না। তার তীরের লক্ষ্য হবেন কখনও একজন কখনও বা একযোগে বহু বীর এবং হস্তি অশ্ব প্রভৃতি বাহক পশুরাও। রামচন্দ্রের প্রভুত্বপ্রতিষ্ঠায় এবং পিতা দশরথের প্রভুত্বনাশে ক্রিয়াশীল হবে তাঁর অস্ত্র। লক্ষ্মণের চন্দনের অনুলেপন কেয়ূর প্রভৃতি অলংকারধারণযোগ্য,ধনবিতরণে অভ্যস্ত, মিত্রদের পালনে উপযোগী দুই বাহু,রামের অভিষেকের বিরুদ্ধবাদীদের শাস্তি দিয়ে, রামের উপযোগী উচিত কাজটিই করবে। লক্ষ্মণ সবিনয়ে ঘোষণা করলেন, তিনি রামের সেবক,রামের রাজ্যলাভের জন্য তিনি নিঃসংকোচে রামের শত্রুদের নাশ করবেন। এখন শুধু রামের আদেশের অপেক্ষায় আছেন লক্ষ্মণ।
ভাই লক্ষণের এই তেজোদীপ্ত আবেগ প্রশমিত করবার জন্য রাম বারবার ভায়ের অশ্রুজল মুছিয়ে দিতে লাগলেন। লক্ষ্মণকে প্রবোধ দিয়ে বললেন পিতৃআজ্ঞা পালনই সৎপুত্রের আচরণীয় ধর্ম।এই কারণেই রামের যা কিছু সিদ্ধান্ত।

পিতৃসত্যপালনে অনমনীয়, প্রস্থানে উদ্যত পুত্রের, ভাবি দুঃখময় বনবাসজীবনের কষ্ট অনুভব করে, দেবী কৌশল্যা চোখের জলে ভেসে গেলেন। বেদনায় রুদ্ধ হল তাঁর কণ্ঠ। রামের ভৃত্য এবং অনুজীবিরা পর্যন্ত সুস্বাদু অন্ন ভোজন করে, সেই রাম বন্য ফলেমূল কীভাবে ভোজনার্থে গ্রহণ করবেন? যস্য ভৃত্যাশ্চ দাসাশ্চ মৃষ্টান্যন্নানি ভুঞ্জতে। কথং স ভোক্ষ্যতে রামো বনে মূলফলান্যয়ম্।। রামের বনবাস যে সাধারণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যই হবে না। দেবী কৌশল্যা, রামের সঙ্গে একমত। দৈবই সবকিছুর নিয়ামক, এটি তিনিও বিশ্বাস করেন। কারণ লোকপ্রিয় হয়েও রাম, আজ শক্তিমান দৈবের কারসাজিতেই বনবাসবরণে বাধ্য হয়েছেন। নূনং তু বলবান্ লোকে কৃতান্তঃ সর্ব্বমাদিশন্। লোকে রামাভিরামস্ত্বং বনং যত্র গমিষ্যসি।।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ

শীতের সূর্যতাপদগ্ধ শুষ্ক তৃণের মতোই পুত্রবিচ্ছেদের অপরিমিত শোকানল মায়ের অন্তরাত্মা দগ্ধ করবে। ত্বয়া বিহীনামিহ মাং শোকাগ্নিরতুলো মহান্। প্রধক্ষ্যতি তথা কক্ষং চিত্রভানুর্হিমাত্যয়ে।। এইসব বিলাপোক্তি এবং পুত্রের অনুগমনে প্রবলভাবে ইচ্ছুক মায়ের শোকার্তহৃদয় শান্ত করবার লক্ষ্যে রাম বললেন, কৈকেয্যা বঞ্চিত রাজা ময়ি চারণ্যমাশ্রিতে। ভবত্যা চ পরিত্যক্তো ন নূনং বর্ত্তয়িষ্যতি।। আমি অরণ্য আশ্রয় করলে, রানি কৈকেয়ীর কাছে প্রতারিত রাজাকে, আপনিও যদি পরিত্যাগ করেন তবে তিনি আর বাঁচবেনই না। নারীদের স্বামীত্যাগ নৃশংসতার নামান্তরমাত্র। তাই রাজা দশরথকে পরিত্যাগ নয়, কারণ নারীদের আদর্শ হল পতিসেবা। সেই সনাতনধর্ম মনে রেখে তাঁর রাজার সেবায় আত্মনিয়োগ করাই কর্তব্য।

পুত্র রামচন্দ্রের উপদেশ মেনে নিলেন, মা কৌশল্যা। রাজা শুধু স্বামী নন, তিনিই পালনকর্তা, গুরু, মাননীয় এবং সকলের প্রভু। মা কেঁদে ফেলে বললেন, হে রাম, এই সপত্নীদের সঙ্গে বসবাস করা আর সহ্য হয় না। আসাং রাম সপত্নীনাং মধ্যে বস্তুং ন মে ক্ষমম্। তিনি নাছোড়বান্দা, পুত্রের সঙ্গে যাবেনই। রামের চোখে জল। মহিলাদের জীবদ্দশায় স্বামীই গুরু ও দেবতুল্য। রাম ও কৌশল্যা উভয়ের প্রভু রাজা দশরথ। তাঁর জীবনকালে কেউ অনাথ নন। ধার্মিক ভরতের প্রতি রামের গভীর আস্থা। তিনি কৌশল্যার বাধ্য থাকবেন। রামের অনুপস্থিতিতে,পুত্রশোকে ক্লান্ত শোকার্ত রাজা যেন প্রাণত্যাগ না করেন, প্রমত্ততা বর্জন করে একাগ্রচিত্তে পিতার প্রাণরক্ষার কল্যাণচিন্তায় মনোনিবেশ করাই রানি কৌশল্যার আশু কর্তব্য। শ্রমং নাবাপ্নুয়াৎ কিঞ্চিদপ্রমত্তা তথা কুরু। দারুণশ্চাপ্যয়ং শোকো যথৈনাং ন বিনাশয়েৎ।। পতিসেবা পরম ধর্ম—রাম এ বিষয়ে বেদ ও পুরাণসমর্থিত যুক্তিপূর্ণ নানা উপদেশ দিলেন মা কৌশল্যাকে। এখন থেকেই রামের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষার প্রহরগণনার সূচনা হোক।

দেবী কৌশল্যা, নিয়তির বিধান নতমস্তকে স্বীকার করে নিলেন। বনগমনে দৃঢ়সঙ্কল্প পুত্রকে ফিরিয়ে আনবার শক্তি তাঁর নেই। যেহেতু কালের বিধান অনতিক্রমণীয়। বনগমনে উৎসুক রামের মঙ্গল হোক। বিনিবর্ত্তয়িতুং বীর নূনং কালো দুরত্যয়ঃ গচ্ছ পুত্র ত্বমেকাগ্রো ভদ্রং তেঽস্তু সদা বিভো।। পুত্রের সহমত পোষণ করেন তিনি, কৃতান্তস্য গতিঃ পুত্র দুর্ব্বিভাব্যা সদা ভুবি। বিধির বিধান চিন্তারও অগম্য। তাই তিনিও বোধ হয় সেই দৈবনির্দেশিত বনবাসের আজ্ঞাই প্রদান করলেন। তিনি পুত্রকে আশ্বস্ত করলেন, পিতৃঋণমুক্ত হয়ে মনস্কামনা সিদ্ধ করে, চরিত্রবল অক্ষুণ্ণ রেখে রাম নিজ সৌভাগ্যবলে ফিরে আসুন। জটাবল্কলধারী পুত্রের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় রইলেন দেবী কৌশল্যা। তিনি, স্থিরপ্রতিজ্ঞ রামের পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাঁকে মন উজার করে আশীর্বাদে ভরিয়ে তুলে মঙ্গলাচরণে প্রবৃত্ত হলেন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৯: গুরুদেবের দেওয়া গুরুদায়িত্ব

আজও ভারতবর্ষের জাতীয় আবেগের কেন্দ্রবিন্দু হলেন মহাকাব্যের নায়ক রাম। রামনামে হয় চিত্তবিকারে প্রলেপ, রামনামশ্রবণে বেদনাবোধের উপশম, আপামর ভারতবাসীর কাছে রাম একজন রোল মডেল। রামের জীবনে রাবণের মতো খলনায়কের আবির্ভাব হয়নি তখনও। যদিও তাঁর স্বঘোষিত খলনায়ক হলেন,না বিমাতা কৈকেয়ী নন, নন পিতা তথাকথিত স্ত্রৈণ, কামুক, প্রিয় স্ত্রীর বশংবদ, যথেচ্ছাক্রমে প্রিয় স্ত্রীকে বরদানে ইচ্ছুক, অপরিণামদর্শী পিতা দশরথ। রামচন্দ্রের মতে, এর জন্যে একমাত্র দায়ী বিধাতা পুরুষ।কোন অভিযোগ নয়, কোন অনুযোগ নয়, একবাক্যে তিনি মেনে নিয়েছেন মা কৈকেয়ীর ইচ্ছা। পিতার কাছে এর সত্যতা যাচাই পর্যন্ত করেননি। কারণ তিনি, দুঃখে শোকে নিজের প্রিয়পুত্রকে বঞ্চনার অভিঘাতে মর্মাহত পিতাকে, দায়মুক্ত করতে চেয়েছেন। পিতার সত্যরক্ষার দায়ভার তুলে নিয়েছেন নিজে।

যৌথপরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্রের কাছে প্রত্যাশা থাকে অনেক। রাম অযোধ্যার রাজপরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রতিহত করতে চেয়েছেন হয়তো বৃহত্তর রাষ্ট্ররক্ষার স্বার্থেও তাঁর এই প্রচেষ্টা। তিনি প্রজাদের মতো বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রিয় ভ্রাতার প্রতিবাদ শোনেননি, মায়ের কাতর অনুনয়, অবহেলায় অস্বীকার করেছেন। সাধারণের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধের সার্বিক সাফল্য মানুষের সীমিত সাধ্যের অতীত। তাই হয়তো পুরুষাকারকে সব সমস্যার সমাধানের হাতিয়ার বলে মনে করেই এগিয়ে যায় দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ জীবনপথে। শেষে অসফল হয়ে,ব্যর্থতার গ্লানিতে, ক্ষোভে দুঃখের ফেটে পড়ে লক্ষ্মণের মতো। মনে মনে কিন্তু স্থির, স্নিগ্ধ, ধৈর্য্যধারী, ক্ষমাশীল রামচন্দ্রের মতো কোন চরিত্রে নিজের অপূর্ণতার সম্পূর্ণতা খুঁজে পায়। রাম দৈবের দোহাই দিয়ে রাজপরিবারের ভাঙ্গনরোধ করতে চেয়েছেন হয়তো।এই মহানুভবতার জন্যেই হয়তো তাঁর রাবণবধের পুরুষাকারকে ছাপিয়ে সর্বত্যাগী, ব্যতিক্রমী চরিত্রমাধুর্য প্রকট হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষের পরম্পরাই হল ত্যাগের মধ্যে আত্মতৃপ্তি। সেই সাযুজ্য রামের মধ্যে কী খুঁজে পান সাধারণ ভারতবাসী? তাই কী যুগান্তরেও ভারতবাসীর মনোজগতে অবিচল অধিষ্ঠান আদিকাব্যের নায়কের?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content