রবিবার ১৯ মে, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

বিশালা নগরীর রাজভবনে রাজা সুমতির আতিথ্যে রাত্রি অতিবাহিত হবার পর রামচন্দ্র, মুনিগণ-সহ, মিথিলার উপকণ্ঠে উপস্থিত হলেন। সেখানে পুরাতন কিন্তু রমণীয়, নির্জন, উপবনস্থ আশ্রম দেখতে পেলেন। অদূরেই দৃশ্যমানা মিথিলা নগরী। তার প্রশংসায় সাধু সাধু বলে উঠলেন সমবেত সকলে। হয়তো এই দুই স্থানের বৈপরীত্যই প্রশ্নমুখর করে তুলল রামচন্দ্রকে। ইদমাশ্রমসঙ্কাশং কিং ন্বিদং মুনিবর্জ্জিতম্। শ্রোতুমিচ্ছামি ভগবন্ কস্যায়ং পূর্ব্ব আশ্রমঃ।। জিজ্ঞাসু রামচন্দ্রের অনেক প্রশ্ন। এই মুনিশূন্য স্থানটি আশ্রমতুল্য, অথচ আশ্রম নয়। এই আশ্রমটি আগে কার ছিল?হে ভগবন্! বড়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার।

মহর্ষি বিশ্বামিত্র শুরু করলেন পরিত্যক্ত আশ্রমটির করুণ পরিণতির ইতিবৃত্ত। হন্ত তে কথয়িষ্যামি শৃণু তত্ত্বেন রাঘব। এটি একটি অভিশাপের ফল। এই আশ্রমটি ছিল মহাত্মা ঋষি গৌতমের। ঋষি গৌতম, পত্নী অহল্যার সঙ্গে, বহু বৎসর তপস্যা করেছিলেন এখানে। একদা ঋষি গৌতমের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে শচীপতি সহস্রাক্ষ ইন্দ্র, ঋষি গৌতমেরই বেশ ধারণ করে, অহল্যার সম্মুখে হাজির হলেন। সম্ভোগেচ্ছায় প্রস্তাব রাখলেন, ঋতুকালং প্রতীক্ষন্তে নার্থিনঃ সুসমাহিতে। সঙ্গমং ত্বহমিচ্ছামি ত্বয়া সহ সুমধ্যমে।। ভোগী ব্যক্তি, কখনও, কোন রমণী যদি সঙ্গমযোগ্যা অবস্থায় থাকে তবে সেই কামার্থী তার ঋতুকালের অপেক্ষা করে না। হে সুমধ্যমে, তোমার সঙ্গম কামনা করি।

দেবী অহল্যা কিন্তু দেবরাজকে চিনতে পারলেন। কিন্তু দুর্বুদ্ধি তাঁর। দেবতার সঙ্গমসঙ্গিনী হতে অনিচ্ছা নেই তাঁর,এ বিষয়ে কৌতূহল অপার। মতিঞ্চকার দুর্ম্মেধা দেবরাজকুতুহলাৎ।। ক্রুদ্ধ ঋষি গৌতম হতে সম্ভাব্য বিপদ অনুমান করে অহল্যা, দেবরাজকে সত্বর পলায়নের পরামর্শ দিলেন। কৃতার্থাস্মি সুরশ্রেষ্ঠ গচ্ছ শীঘ্রমিতঃ প্রভো।। আত্মানং মাঞ্চ দেবেশ সর্ব্বথা রক্ষ গৌরবাৎ। হে সুরশ্রেষ্ঠ আমি কৃতার্থ হয়েছি। শীঘ্র এই স্থানত্যাগ করুন। আমার ও আপনার মর্যাদা রক্ষা হোক। দেবেন্দ্র তুষ্টির হাসি হেসে অহল্যাকে বললেন, সুশ্রোণি,পরিতুষ্টোঽস্মি গমিষ্যামি যথাগতম্। হে সুন্দরি, আমি পরিতৃপ্ত। এখন যথাস্থানে প্রস্থান করি। ঋষি গৌতম, ত্রস্তপায়ে পলায়নপর ইন্দ্রকে দেখে ফেললেন। দেবদানবের ত্রাস ঋষি গৌতমের তপশ্চর্যার শক্তি। তীর্থজলে স্নাত, হাতে যজ্ঞকাষ্ঠ সমিধ ও কুশঘাস, অগ্নিতুল্য দীপ্যমান ঋষি গৌতম সম্মুখে। দেবদানবদুর্দ্ধর্ষং তপোবলসমন্বিতম্। তীর্থোদকপরিক্লিন্নং দীপ্যমানমিবানলম্।। গৃহীতসমিধং তত্র সকুশং মুনিপুঙ্গবম্। দীপ্ততেজস্বী মুনিরকে দেখে ম্রিয়মাণ হলেন সুরেন্দ্র।
মুনিবেশধারণকারী ইন্দ্রকে দেখে ক্রোধে ফেটে পড়লেন ঋষি গৌতম। মম রূপং সমাস্থায় কৃতবানসি দুর্ম্মতে। অকর্ত্তব্যমিদং যস্মাদ্বিফলস্ত্বং ভবিষ্যতি।। রে দুর্বুদ্ধি, আমার বেশ ধারণ করে দুষ্কর্ম করেছিস, তাই অচিরেই তুই বিফল অর্থাৎ অণ্ডকোষবিহীন হবি। ঋষি সরোষবচন উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই দেবরাজের অণ্ডকোষদ্বয় খসে পড়ল। এবার দেবী অহল্যার পালা। স্ত্রীর প্রতি অভিশাপটি হল, ইহ বর্ষসহস্রাণি বহূনি নিবসিষ্যসি।। বাতভক্ষ্যা নিরাহারা তপ্যন্তৌ ভস্মশায়িনী। অদৃশ্যা সর্ব্বভূতানামাশ্রমেঽস্মিন্ বসিষ্যসি।। তুমি এইখানে বহু সহস্র বৎসর অনাহারে বাস করবে তুমি। ভস্মরাশি হবে তোমার শয়নশয্যা। সকল প্রাণীদের থেকে অদৃশ্য অবস্থায় এখানেই তোমায় বাস করতে হবে।

এই অভিশপ্ত জীবন থেকে স্ত্রী অহল্যার মুক্তির উপায়ও জানিয়ে দিলেন। দশরথনন্দন রামচন্দ্রের এই স্থানে আগমনহেতু তুমি পবিত্র হয়ে উঠবে। লোভমোহহীনভাবে রামচন্দ্রের অতিথিজনোচিত সেবায় তোমার আত্মা পূত হবে যখন,তখন, সানন্দে স্বদেহ ধারণ করে আমার সঙ্গে মিলিত হতে পারবে তুমি। আগমিষ্যতি দুর্দ্ধর্ষস্তদা পূতা ভবিষ্যসি।। তস্যাতিথ্যেন দুর্ব্বৃর্ত্তে লোভমোহবিবর্জ্জিতা। মৎসকাশং মুদা যুক্তা স্বং বপুর্ধারয়িষ্যসি।। ব্যাভিচারিণী স্ত্রীকে এমন অভিশাপ দিয়ে ঋষি গৌতম সিদ্ধপুরুষ অধ্যুষিত রমণীয় হিমালয়শিখরে তপস্যায় ব্রতী হলেন।

পুরুষত্বহীন বিষণ্ণ ইন্দ্র তাঁর কুকীর্তির বৃত্তান্ত অগ্নি প্রভৃতি দেবতাদের, সিদ্ধপুরুষ, গন্ধর্ব, চারণগণকে জানালেন। তাঁর এই আচরণের সমর্থনে যুক্তির অবতারণা করলেন, কুর্ব্বতা তপসো বিঘ্নং গৌতমস্য মহাত্মনঃ। ক্রোধমুৎপাদ্য হি ময়া সুরকার্য্যমিদং কৃতম্।। অফলোঽস্মি কৃতস্তেন ক্রোধাৎ সা চ নিরাকৃতা।শাপমোক্ষেণ মহতা তপো২স্যাপহৃতং ময়া।। ঋষি গৌতমের তপস্যায় বিঘ্ন ঘটানোর উদ্দেশ্যে ঋষির ক্রোধোৎপাদনের জন্যেই তাঁর নিজের এই প্রয়াস।ক্রুদ্ধ হয়ে নিদারুণ অভিশাপদানের ফলে ঋষিরও তপশ্চর্যার ফল ক্ষয় হয়েছে। এর মূলেও রয়েছেন তিনিই। সুতরাং সমবেত সকলের আশু কর্ত্তব্য ইন্দ্রের পুরুষত্ব উদ্ধারে যত্ন নিয়ে দেবকার্য সফল করে তোলা। অগ্নিদেব মেষের অণ্ডদ্বয় উৎপাটিত করে দেবরাজের দেহে স্থাপন করলেন। পুরুষত্ব ফিরে পেলেন দেবরাজ শচীপতি ইন্দ্র। অতঃপর মহর্ষি বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রকে অনুরোধ জানালেন, তদাগচ্ছ মহাতেজ আশ্রমং পুণ্যকর্ম্মণঃ। তারয়ৈনাং মহাভাগামহল্যাং দেবরূপিণীম্।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা. পর্ব-১৯: কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু আচার্য দ্রোণ এবং তাঁর বিখ্যাত শিষ্যদ্বয়, কে মহান? গুরু না শিষ্য?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’

তাহলে চল, গৌতম মুনির পবিত্র আশ্রমে। সেই মহাসম্মানীয়া দেবীর মতো রূপবতী অহল্যাকে মুক্তি দাও। আশ্রমে প্রবেশমাত্র রামচন্দ্র সেই আলোকবর্ণা দ্যুতিময়ী অহল্যাকে দেখতে পেলেন। সেই অহল্যা যাঁকে দেখে দেবরাজেরও সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায়, কামপরবশ হয়ে পড়েন তিনি। কামোদ্রেককারিণী অহল্যার সেই প্রজ্জ্বলিত রূপ আর নেই, রূপে আছে ধূমাচ্ছন্ন অগ্নিশিখার প্রচ্ছন্ন দীপ্তি,আছে মেঘ ও কুয়াশায় আবৃত জ্যোৎস্নার প্রসারিত গভীরতাময় কান্তি, অবশিষ্ট আছে জলে প্রতিবিম্বিত সূর্যের অবদমিত ঔজ্জ্বল্যের প্রশান্তি।

এত দীর্ঘকাল দেবদানবের অগোচরে কোনও কলুষিত দৃষ্টি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই এই নির্বাসন তাঁকে দিয়েছে কঠোর তপস্যার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত, শুদ্ধ, পবিত্র মায়াময় সৌন্দর্য। রামচন্দ্রের দর্শনে অহল্যা শাপমুক্ত হলেন। বিমুগ্ধ রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণ সানন্দে তাঁর পাদবন্দনা করলেন। গৌতমপত্নী অহল্যাও স্বামীর বাক্য স্মরণ করে রামচন্দ্রের পাদমূলে প্রণতা হলেন। অবশেষে দেবতাদের প্রশংসাধন্যা বিশুদ্ধাঙ্গী অহল্যাকে গ্রহণ করলেন ঋষি গৌতম। তিনি স্ত্রীর সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে ঋষি রামচন্দ্রকে আতিথ্যদানে অভিনন্দিত করলেন।এরপর শান্তিতে তপস্যায় মনোনিবেশ করলেন ঋষি গৌতম।

দেবরাজ ইন্দ্র ঋষিগৌতমের পত্নীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে নিজের কামোপভোগ চরিতার্থ করেছিলেন। আদিকবি বার বার শচীপতি নামে তাঁকে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে দেবেন্দ্র যে নব্য যুবা নন, বেশ পরিণত এক বিবাহিত পুরুষ—হয়তো এ বিষয়ে স্পষ্ট আভাস দিয়েছেন কাব্যকার। কিংবা হয়তো সুরেন্দ্রর কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার মাধ্যম ছিলেন দেবী অহল্যা। তবে এ বিষয়ে ঋষিপত্নী অহল্যাও যে সক্রিয় ছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহাবকাশ নেই। তিনি তখন এক পুত্র শতানন্দের জননী। কিন্তু মতিভ্রম বা দিব্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গসুখের লিপ্সায় ভুলেছিলেন তপঃক্লিষ্ট, অমিত তপস্যার বলে তেজস্বী পত্নীপ্রেমী ঋষি গৌতমকে। ভোলা স্বাভাবিক।

কারণ দেবরাজের বাহ্যিক রূপটিও ছিল তাঁর স্বামীর মতোই, যদিও সেটির অন্তরালে মহেন্দ্রকে আবিষ্কার করতে তাঁর বিশেষ সময় লাগেনি। তখন হয়তো ফিরে আসবার উপায় আর ছিলনা। তাঁর এই দেবরাজের সঙ্গে সঙ্গম উপভোগ করাতেই হয়তো ছিল অপার কৌতূহল। জীবন এমনই। কখন যে, কে, কীভাবে কোনদিকে আকৃষ্ট হয় তা নিয়তিনির্দিষ্ট হলেও কিছু বিবেকবোধ, সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়া মানুষের স্বচ্ছাচারিতাকে বাঁধা দেয়।দেবরাজ ইন্দ্রের ঋষিপত্নী অহল্যাকে উপভোগ —লাম্পট্যের একটি যথার্থ উদাহরণ বললে হয়তো অত্যুক্তি হয় না।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-২: রাজাদের স্থাপত্য-কীর্তি ও রাজধানী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য

আর অহল্যা? তাঁর আচরণ কিন্তু সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।ঋষি গৌতম পুরুষসিংহ, তাঁর মর্যাদায় আঘাত লেগেছে, ছলেবলে কৌশলে বিবাহিতা অহল্যাকে স্বামীর বেশে ভোলানো বলাৎকারের নামান্তর। শাসনদণ্ডটি ঋষি নিজের হাতে তুলে নিয়ে, চরম দণ্ড দিয়েছেন। নিজের পৌরুষত্ব বিসর্জন দিয়ে ভবিষ্যতে কখনও এমন কাজে নিজেকে যুক্ত করতে দেবরাজ হয়তো একবার ভেবেছেন। অন্যায় আচরণে, স্বেচ্ছাচারিতায়, শাসকের অতিলৌকিক শক্তিও যে ঋষিশক্তির কাছে চরম লাঞ্ছিত হতে পারে তার দৃষ্টান্ত রেখেছেন, ঋষিকবি বাল্মীকি।

‘হল’ শব্দের অর্থ কুরূপতা। এই বিরূপতা যার থেকে উৎপন্ন হয় সেটাই ‘হল্য’। যে নারীর মধ্যে কোন বিরূপতা নেই তিনিই অহল্যা। সুন্দরীমাত্রই দেবভোগ্যা — তাই হয়তো দেবরাজ মনে করেছেন অহল্যা আমারই, পত্নী মমৈবেতি। ব্রহ্মার মানসকন্যা অহল্যাকে ন্যাস অর্থাৎ গচ্ছিতধনরূপে গ্রহণ করেছিলেন ঋষি গৌতম। চরিত্রবলে, সংযমের সঙ্গে, তাঁকে সযত্নে রক্ষা করে ব্রহ্মাকে ফিরিয়ে দিলেন কন্যা অহল্যাকে। ঋষির সংযমে তপস্যার বৈভবে তুষ্ট ব্রহ্মা ঋষি গৌতমকেই কন্যাদান করলেন। দেবতারা হতাশ হলেন। তাঁদের প্রতিনিধি দেবেন্দ্র অগ্নিতুল্যা প্রভাময়ী অহল্যাকে বলাৎকারে সফল হলেন। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ল সমগ্র মানবজাতির ওপরে,তাঁর ফলভোগ এখনও চলেছে ।ঋষির অভিশাপে এটিও ছিল — ইন্দ্রের নারীলিপ্সা, অসংযম মানবকুলেও সংক্রামিত হবে। এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই। অয়ন্তু ভাবো দুর্ব্বুদ্ধে যস্ত্বয়েহ প্রবর্ত্তিতঃ। মানুষেষ্বপি লোকেষু গমিষ্যতি ন সংশয়ঃ।।

কাব্যের উদাহরণ যে প্রাকৃত জনজীবনের শিক্ষণীয় বিষয়। ঋষির অভিশাপে দেবেন্দ্রর সিংহাসনের ধ্রুবত্ব বা স্থিরতাও আর থাকল না। ন চ তে স্থাবরং স্থানং ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ। যশ্চ যশ্চ সুরেন্দ্রঃ স্যাৎ ধ্রুবঃ স ন ভবিষ্যতি।। তোমার আসনের স্থায়িত্ব থাকবেনা আর, ভবিষ্যতে যিনিই রাজা হবেন চিরকাল তাঁর রাজার আসনটিতে অধিকার থাকবে না।

রাজাসনের স্থিরতা কোথায়? প্রশাসকের রদবদলতো আজ যুগান্তরেও অব্যাহতগতিতে চলে আসছে। পাশ্চাত্যের পুরাকাহিনিতে নিষিদ্ধ ফলভক্ষণে আদম ও ইভের মধ্যে এসেছিল, যৌনতা, কামভাব, লজ্জাবোধ। মহাকাব্যে ইন্দ্রের অসংযম, নারীলিপ্সা প্রভৃতি পতন দেবদত্ত কিনা জানা নেই। তবে যা নিষিদ্ধ তা গ্রহণীয় নয়। অহল্যা অসামান্যা তাই হয়তো দুষ্প্রাপ্যা ছিলেন ইন্দ্রেরও। যেটি পাওয়ার নয় তাতে হাত বাড়ালেই পদস্খলন অনিবার্য, সেটি জগত ও জীবনের ক্ষেত্রেও হয়তো প্রযোজ্য। বলাৎকারের সপক্ষে ইন্দ্র সাফাই গেয়েছেন এই বলে যে, ঋষি গৌতমের ক্রোধকে অভিশাপে পরিবর্তিত করে, তিনি নাকি দেবসিংহাসনের ধ্রুবত্ব রক্ষা করেছেন। কারণ ঋষি গৌতমের অভিশাপদানে তপস্যার ফলের ক্ষয়ের ফলেই দেবতাদের স্বর্গের ওপর অধিকারবোধ অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অভিশাপের বিষময় পরিণাম ভোগ করেন অভিশাপদাতাও।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: আমি আর কখনওই ফিরে আসার প্রত্যাশা করি না…

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: রোজের খাদ্যতালিকায় তেঁতুল নেই! এ সব জানলে এমন ভুল আর নয়

দেবরাজের এই মূল্যায়নের দিকটি আপাতদৃষ্টিতে সদর্থক হলেও একজন বলাৎকারীর এই অজুহাত হয়তো ধোপে টেকে না। এর বিকল্প উপায় হয়তো ছিল। কারণ, অতিলৌকিক শক্তিতে কি না সম্ভব? ইন্দ্র আশ্রয় নিয়েছেন পশুশক্তির, তাও চরম প্রতারকের ছদ্মবেশে, ধর্ষিতার স্বামীর রূপ গ্রহণ করে বলাৎকার করছেন, নিছক কামনার বশবর্তী হয়ে, নারীদেহ ভোগেচ্ছায়। এ যে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ এবং বর্তমান যুগেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। স্ত্রী অহল্যার অপরাধও ঋষি গৌতম ক্ষমা করেননি।

অহল্যার প্রতি ঋষির অভিশাপটিরও আরও একটি দিক ছিল। রূপযৌবনসম্পন্না যস্মাত্ত্বমনবস্থিতা তস্মাদ্রূপবতী লোকে ন ত্বমেকা ভবিষ্যতি। রূপঞ্চ তে প্রজাঃ সর্ব্বা গমিষ্যতি ন সংশয়ঃ।। রূপযৌবনই তোমার অস্থিরতার মূল। তাই পৃথিবীতে তুমি আর একা রূপবতী থাকবে না। তোমার রূপ সর্বজনীন হবে। ঋষির এই অভিশাপ সত্যতার অপেক্ষা রাখে না। রূপবতী, রূপবান কে নয়? মানুষমাত্রই বিশিষ্ট রূপে অপরূপ। সাধারণ এবং বিশিষ্টর কোনও ভেদাভেদ নেই।

দেবী অহল্যার শাপমুক্তির নিয়ামক রামচন্দ্র। ‘রাম’—এই নামটির মহিমা অপার, যিনি সকলকে আনন্দ দান করেন, তিনিই রাম। তাই কী তিনিই মুক্তির আবহ এনে দিলেন অহল্যার জীবনে? নবীন রামচন্দ্র জীবনের ঊষর কঠিন মরুপ্রান্তরে তখনও পদার্পণ করেননি। তাই হয়তো অনুশোচনার আগুনে পুড়ে শুচিস্নিগ্ধা, বিনম্রা, অহল্যাদর্শনে মুগ্ধ হয়েছেন, তাঁর পদতলে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন তিনি। সেই একই পরিণত যুবক রামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণের কবলমুক্তা স্ত্রী সীতাকে অকুণ্ঠিতচিত্তে গ্রহণ করতে পারেননি। প্রিয়সঙ্গসুখবর্জিতা সীতার যুদ্ধ ছিল প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে এক অসম মানসযুদ্ধ।সেই যুদ্ধে কী তিনি বিজয়িনী হতে পেরেছেন? আগুনের লেলিহান শিখায় হয়েছে তাঁর সতীত্বের মূল্যায়ন। মিথ্যা অপযশ সীতার জীবনে এনেছে অস্থিরতা, নির্বাসিতার শাস্তি, যা হয়তো তাঁর প্রাপ্য ছিল না।

অহল্যা ও সীতা—এই দুই নারীরই প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারতেন একজন, তিনি শ্রীরামচন্দ্র। সেটি সম্ভব হল না। প্রশাসক রামচন্দ্র আর নবীন সুকোমল হৃদয়বৃত্তিতে সমৃদ্ধ অহল্যার মুক্তিদাতা রামচন্দ্র—এই দুজনের মধ্যে কে মহান?এ প্রশ্ন হয়তো যুগান্তরেও থেকেই যায়।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content