রবিবার ১৯ মে, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

অযোধ্যার রাজা দশরথের মনে শান্তি নেই। তিনি অপরিমিত চতুরঙ্গ সেনা বলের অধিকারী, জনপ্রিয়, কুবেরতুল্য ধনবান, শত্রুহীন, ধার্মিক ও জিতেন্দ্রিয়। ইন্দ্রপ্রতিম রাজা সেই অমরাবতীর মতো সার্থকনামা অযোধ্যা নগরীতে রাজত্ব করেন।

পুরীমযোধ্যাৎ নৃসহস্রসঙ্কুলাৎ
শশাস বৈ শক্রসমো মহীপতিঃ।।


রাজার মনে কিন্তু সুখ নেই। কেন এই পুত্রাকাঙ্খা? সেই আমাদের অতি অহঙ্কারের গর্বিত পরম্পরার উত্তরাধিকার সেই ঋগ্বেদেই যে আছে—

“প্রজাভিরগ্নে অমৃতত্ত্বমশ্যাম্।”

হে অগ্নি, আমি যেন সন্ততিদের মধ্যে দিয়ে অমৃতত্ত্বরূপ অমরত্ব লাভ করতে পারি। সেই অমৃতবাণী মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে যে। সন্ততি আর পুত্র সমার্থক হয়ে গিয়েছে যেন। রাজা দশরথের কন্যা ছিলেন শান্তা, যাকে বন্ধুত্বের কারণে অঙ্গরাজকে দান করেছিলেন তিনি। সেই কন্যাটির কথা রাজা দশরথের একবারও কী মনে পড়ল না? অথচ ঋগ্বেদেই আছে—

শাসদ্বহ্নির্দুহিতুর্নপ্ত্যং গাদ্বিদ্বা ঋতস্য দীধিতিং সপর্যন্।
পিতা যত্র দুহিতুঃ সেকমৃঞ্জন্ত সং শগ্ম্যেন মনসা দধন্বে।।


পুত্রহীন পিতা সমর্থ জামাতাকে সম্মানিত করে শাস্ত্রবিধানানুসারে দুহিতার থেকে জাত পৌত্র প্রাপ্ত হন।অপুত্রক পিতা দুহিতার গর্ভজাত পুত্রের মধ্যেই নিজে শরীর ধারণ করেন। পরবর্তীকালে বেদের অনুসরণে লেখা স্মৃতিগ্রন্থে ধর্মশাস্ত্রকার মনু বলেছেন—

অপুত্রোঽনেন বিধিনা সুতাং কুর্ব্বীত পুত্রিকাম্।
যদপত্যং ভবেদস্যাং তন্মম স্যাত্ স্বধাকরম্।।


মাতামহ অপুত্রক হলে কন্যাকে সম্প্রদান করবার সময় চুক্তি করে নেন যে এই কন্যার যে পুত্র হবে সে আমার শ্রাদ্ধাধিকারী। এর সপক্ষে যুক্তি হল—

যথৈবাত্মা তথা পুত্রঃ পুত্রেণ দুহিতা সমা।
তস্যামাত্মনি তিষ্ঠন্ত্যাং কথমন্যো ধনং হরেত্।।
আত্মার মতো পুত্র ও কন্যা উভয়ই। সুতরাং সেই কন্যা থাকতে অন্য কেউ ধন হরণ করবে কেন? তা সত্ত্বেও পুত্রের জন্যে এত হাহাকার, কেন? পুত্রপ্রীতি কি নিদারুণ। মনকষ্টে সর্বদাই পীড়িত অপুত্রক রাজা দশরথ। তিনি ভাবলেন—

সুতার্থং বাজিমেধেন কিমর্থং ন যজাম্যহম্।।

কেন পুত্র লাভের জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করছি না? তিনি মনস্থ করলেন “যষ্টব্যমিতি” যজ্ঞ করতেই হবে। অতি দক্ষ বিবেচক নির্লোভ, হিতাকাঙ্খী আটজন মন্ত্রীদের মধ্যে অষ্টম মন্ত্রী, অর্থশাস্ত্রবিদ সুমন্ত। তিনিই মন্ত্রীশ্রেষ্ঠ। তাঁকেই রাজা বললেন—

শীঘ্রমানয় মে সর্ব্বান্ গুরূংস্তান্ সপুরোহিতান্।
সে এক মহাযজ্ঞ। নিখুঁত আয়োজন, সমারোহ, আড়ম্বর, অপরিমিত ব্যয়বহুল সে যজ্ঞ। বেদজ্ঞ গুরু ও পুরোহিতদের যথাবিধি পূজা ও সম্মান প্রদর্শন করে রাজা দশরথ জানালেন—

মম লালপ্যমানস্য সুতার্থং নাস্তি বৈ সুখম্।

পুত্রের জন্যে বিলাপের কারণে মনে আমার কিছুমাত্র সুখ নেই। শাস্ত্রানুসারে অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাই। সমবেত বশিষ্ঠ প্রমুখ ব্রাহ্মণ পরমানন্দে ‘সাধু’ ‘সাধু’ বলে উঠলেন। এই সমৃদ্ধ রাজোচিত গুণান্বিত রাজার উত্তরাধিকার কাকে দিয়ে যাবেন?

সর্বদা প্রাপ্স্যসে পুত্রানভিপ্রেতাংশ্চ পার্থিব।

রাজাকে নিশ্চিন্ত করে তাঁরা বললেন—হে রাজন, আপনি অবশ্যই অভিপ্রেত বহু পুত্র লাভ করবেন। সাজ সাজ রবে শুরু হয়ে গেল যজ্ঞের আয়োজন। রাজার তিন মহিষী রাজার মুখে এই মহাযজ্ঞবার্তা শোনবার পর হিমান্তে পদ্মিনীর মতো শোভা পেতে লাগল তাঁদের মুখমণ্ডল। বৈদিক এই যাগের মূল লক্ষ্য হল স্বাধিকারপ্রতিষ্ঠা। সার্বভৌম রাজার অধিকার স্থাপন। বহু আরম্বড়পূর্ণ যজ্ঞের নামটি অশ্বমেধ। মেধ অর্থাৎ বলি, হত্যা। মন্ত্রী সুমন্ত্র রাজাকে জানিয়েছেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি পুত্রেষ্টি যাগ সম্পন্ন করবার যোগ্য। তিনি আবার সম্পর্কে বিবাহসূত্রে রাজা দশরথের জামাতা।শিশুর মতো সরল ভিভাণ্ডক ঋষির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি।জীবনে ত্রিবর্গের অন্তর্গত ‘কাম’কী? তিনি জানেন না। সুন্দরী, চটুল বারাঙ্গনারা তাঁকে ভুলিয়ে নিয়ে এলেন দশরথসখা রোমপাদ রাজার অঙ্গরাজ্যে, যে অপুত্রক রাজাকে একদা নিজের জ্যেষ্ঠা কন্যা শান্তাকে উপহার দিয়েছিলেন অযোধ্যারাজ দশরথ। খরাকাতর বৃষ্টিহীন অঙ্গরাজ্যে, ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গের আগমনমাত্র করুণার ধারাবর্ষণ শুরু হয়ে গেল, যেন সরল শুদ্ধচিত্ত মানুষটিকে বৃষ্টিধারায় অভিষিক্ত করল প্রকৃতি। এমনই সুন্দর ছিল রাজা দশরথের জামাইভাগ্য।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪২: বাস কোথা যে পথিক — এবার কি গন্তব্য সুতীক্ষ্ণমুনির আশ্রম?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫০: ‘ফিশ পাস’ পুরোদমে চালু হলে ইলিশের প্রজনন বাধাহীনভাবে সম্ভবপর হবে

ফেরা যাক অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজনে। একটি স্বর্ণবর্ণের বলশালী অশ্ব নির্দিষ্ট করে তাকে বিভিন্ন দেশ পরিক্রমণের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেওয়া হল। সংবৎসরপর বাধাহীনভাবে বিভিন্ন দেশে বিচরণ করে ফিরে এল সেই অশ্ব। সেই বিস্তীর্ণ যজ্ঞভূমিতে নির্মিত, সুদৃশ্য, সুশোভিত একবিংশতি যূপকাষ্ঠে তিনশত প্রাণী বলি দেওয়া হল। প্রধানা রাজমহিষী কৌশল্যা যূপনিবদ্ধ যজ্ঞাশ্বটিকে তিন খড়্গাঘাতে ছেদন করলেন।যজ্ঞাশ্বের বপা অর্থাৎ চর্বি যজ্ঞাগ্নির আহুতিরূপে গন্ধে চতুর্দিক আমোদিত করে তুলল। যজ্ঞাশ্বটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আহুতি প্রদান করলেন
ষোড়্শসংখ্যক ঋত্বিক। রাজা দশরথ সহস্রকোটি স্বর্ণমুদ্রা দক্ষিণা দান করলেন।যজ্ঞে দ্বিজাতিগণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এছাড়াও শূদ্র, তাপস, সন্ন্যাসী সকলে উপাদেয় ভোজ্যবস্তু গ্রহণ করে তৃপ্ত হলেন। প্রার্থীদের প্রার্থনা পূর্ণ করা হল। পরিতৃপ্ত সকল রাজর্ষি সপ্রশংস মঙ্গলকামনা করতে লাগলেন রাজার। পাপনাশ এবং স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা—এই দুটি ছিল রাজার আরও দুটি লক্ষ্য।

এবার ঋষ্যশৃঙ্গকে রাজা দশরথ বংশবৃদ্ধির জন্যে কিছু যজ্ঞীয় ক্রিয়াকরণের অনুরোধ জানালেন।ঋষ্যশৃঙ্গ কল্পসূত্রনির্দেশিত অথর্ববেদোক্ত মন্ত্রদ্বারা পুত্রেষ্টি যাগ করবেন বলে মনস্থ করলেন।আহুতিপ্রদানান্তে সমবেত দেব, গন্ধর্ব, যক্ষরা ব্রহ্মাকে জানালেন যে তাঁরা রাক্ষসরাজ রাবণ দ্বারা উৎপীড়িত, এমনকি সূর্য,বায়ু,সমুদ্রও তাদের স্বাভাবিকক্রিয়া থেকে বিরত থাকছেন ভয়ত্রস্ত অবস্থায়।এই অবস্থার প্রতিবিধান করুন।চিন্তিত ব্রহ্মা ভাবলেন, রাবণ দেবযক্ষরাক্ষসদের অবধ্য হবেন— ইতিমধ্যেই এই মর্মে রাবণকে বর মঞ্জুর করেছেন তিনি। শুধুমাত্র—

নাকীর্ত্তয়দবজ্ঞানাত্তদ্রক্ষো মানুষাংস্তদা

মানুষের প্রতি অবজ্ঞাবশত,মনুষ্যের অবধ্য হব আমি—রাবণ এই প্রার্থনা করেননি।তখন সেইখানে আবির্ভূত বিষ্ণু দেবতাদের আশ্বস্ত করলেন যে তিনি অচিরেই সবংশে রাবণকে নিহত করবেন। কিন্তু উপায় কী? তখন মানবদেহ ধারণের উদ্দেশ্যে বিষ্ণু পুত্রেষ্টিযাগরত দশরথকে পিতারূপে পছন্দ করলেন।

পিতরং রোচয়ামাস তদা দশরথং নৃপম্।
আরও পড়ুন:

খাই খাই: সন্ধেবেলা খিদে পেলে শুধুই মুড়ি মাখা? স্বাদ বদলে মুড়ি দিয়েই তৈরি করে ফেলুন এই ৩ মুখরোচক নাস্তা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১১: ফুটবলের ব্ল্যাক প্যান্থার: লেভ ইয়াসিন

বস্তুত এই মাটির পৃথিবীতেই নর এবং নররাক্ষসের সহাবস্থান। বিষ্ণুরূপে শঙ্খ, চক্রের, গদায় সজ্জিত হয়ে তিনি অনায়াসে রাবণকে বধ করতে পারতেন কিন্তু সেখানে যে বাধা ওই— দেবতাদেরও অবধ্য সেই রাবণ। কোনও অলৌকিক শক্তির আশ্রয় নিয়ে নয়,কোন দিব্যাস্ত্রের প্রয়োগে নয়,অনৈতিক পরস্ত্রীধর্ষকের শাস্তি হোক এই মাটির পৃথিবীতেই, মানবিক গুণে বিভূষিত এক পুরুষশ্রেষ্ঠের দ্বারা, যা হবে দৃষ্টান্তমূলক—মহাকবি বাল্মীকির হয়তো এটিই ছিল অভীপ্সিত কাব্যরূপ।ঋষিকবির আর্ষমহাকাব্যে যেন বিষ্ণুর রামরূপে দেবত্ব থেকে নরত্বে অবনয়নে মানবিকগুণের উদ্বোধন, বিকাশ সবকিছুর উদ্ভাস। নররূপে নররাক্ষসের মোকাবেলা না হলে হবে কী করে?

এত পশুহত্যা, যে দিগ্বিজয়ের অশ্ব ছুটল দেশবিদেশবিজয়ের নিশান উড়িয়ে, আহুতির লেলিহান শিখা গ্রাস করল শত শত প্রাণী, রাজার কীর্তির সাক্ষর বহন করে যে অশ্বটি ফিরল তাকে যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হল। এই পদ্ধতিটিও নৃশংস। রাজার লক্ষ্য যে পাপক্ষয়।

ততঃ প্রীতমনা রাজা প্রাপ্য যজ্ঞমনুত্তমম্।
পাপাপহং স্বর্নয়নং দুস্তরং পার্থিবর্ষভৈঃ।।


রাজর্ষিরাও যে যজ্ঞ সমাধান করতে পারেন না সেই পাপবিনাশক স্বর্গপ্রাপ্তিরূপ ফলদায়ক যজ্ঞ সম্পন্ন করে রাজা দশরথ অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। বৈদিক যজ্ঞের সুচারুসম্পাদনে অভীষ্টলাভ রাজার লক্ষ্য ছিল। যজ্ঞে কত প্রাণ আহুতি দেওয়া হল তাতে কি আর এল গেল। শেষকথা রাজার পাপক্ষয় হল কী? পুত্রজনিত কারণেই এই পৃথিবীতেই বহু কষ্টকর অভিজ্ঞতায় তার নরকদর্শন আর বাকী রইল না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩১: মরুভূমির উপল পারে বনতলের ‘হ্রদ’

দশভুজা: ‘পুরুষ মানুষের কাজে হাত দিলে এমনই হবে, মহিলাদের এসব সাজে না’

পুত্রেষ্টিযজ্ঞপ্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। পুত্রেষ্টির যজ্ঞাগ্নি থেকে উত্থিত ব্রহ্মাপ্রেড়িত দীপ্তিময় প্রাণী রাজা দশরথকে বললেন—

ইদন্তু নৃপশার্দ্দূলং পায়সং দেবনির্ম্মিতম্।
প্রজাকরং গৃহাণ ত্বং ধনমারোগ্যবর্দ্ধনম্।


হে নৃপশার্দ্দূল, দেবনির্ম্মিত পায়স প্রজাকর ও আয়ুবর্দ্ধক, এটি তুমি গ্রহণ কর। রাজা সেই পায়স তিন মহিষীর মধ্যে ভাগ করে দিলেন। ফল — চার রঘুনন্দনলাভ। পুত্রলাভ কত প্রয়াসসাধ্য, প্রাণঘাতী, তবুও আজও এই পরম্পরা চলে আসছে, কত অনাকাঙ্খিত সন্তানের ভ্রূণের মারণযজ্ঞে আজও এর অব্যাহতগতি।

নায়িকা সীতা? তিনিও অযোনিসম্ভূতা, জননী বসুন্ধরার মাটির কন্যা। জমি কর্ষণের সময়ে লাঙ্গলের রেখাঙ্কিত ক্ষেত্রে তাঁর জন্ম। পিতা মিথিলারাজ জনক জানিয়েছেন—

অথ মে কৃষতঃ ক্ষেত্রং লাঙ্গলাদুত্থিতা ততঃ।
ক্ষেত্রং শোধয়তা লব্ধা নাম্না সীতেতি বিশ্রুতা।।


মাটিতে জন্ম। মাটি যে সর্বংসহা, কত কি ধারণ করে, মান অপমান সবকিছু। নিঃশব্দে কত অভিমান জমে,বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না তাঁর।সীতা রামায়ণের ট্র্যাজিক নায়িকা তাঁর পৃথিবীতে আগমন কত অনায়াস, কত সাবলীল।ভারতীয় জনজীবনে অনাকাঙ্খিত কন্যার আগমনের মতো, তার জন্যে কোন চাহিদা নেই, নেই কোন প্রার্থনা, শুধুমাত্র জন্মগ্রহণ, অনেকক্ষেত্রে সেটাও অভীপ্সিত হয় না।

ছবি: সংগৃহীত।

সীতার ভাগ্য পিতৃগৃহে অবশ্য সেরকমটি নয়।জনকরাজার আদরণীয়া কন্যা সীতা বীর্য্যশুল্কা। শুধুমাত্র শৌর্য্যপ্রদর্শনই তাঁর কন্যাপণ।

বীর্য্যশুল্কেতি মে কন্যা স্থাপিতেয়মযোনিজা।
ভূতলাদুত্থিতাং তান্তু বর্দ্ধমানাং মমাত্মজাম্।।


রাজা দশরথ অশ্বমেধের ঘোড়া, তার সঙ্গে সৈন্যদল পাঠিয়ে মাটির অধিকার লাভ করেছেন। রাজা জনক মাটির ধনকে গ্রহণ করেছেন, লালন করেছেন পরম মমতায়। রাজা দশরথ কন্যা শান্তাকে দান করে দিয়েছিলেন বন্ধু অঙ্গরাজ রোমপাদকে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে। পরে পুত্রকামনায় লালায়িত হৃদয়ে কন্যাটির কথা একবারও মনে আসেনি তাঁর। ব্যয়বহুল যজ্ঞে মেতেছেন বহু প্রাণের বিনিময়ে। শুধু এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম পুত্রেষ্টিযাগের পরমপ্রাপ্তি জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্র। রাজা দশরথ পুত্রকামনায় ব্যাকুল হয়েছেন যেমন তেমনই প্রিয়তম পুত্রবিচ্ছেদে প্রাণবিসর্জনে তিনি প্রবাদপ্রতিম পিতা। যে সন্তানের জন্যে তাঁর এই আকুলতা, আত্মক্ষয়ী শোক, সে, কি আশ্চর্য! নিজের সন্তানের প্রতি নির্লিপ্ত, উদাসীন। তিনি ধার্মিক রাজা তাঁর এই রাজসত্তার কাছে পিতৃসত্তার সন্তানবাৎসল্যরস হার মেনেছে। সন্তানের বিষয়ে এক অদ্ভুত নিরাসক্ত, ঔৎসুক্যহীন রাজার ভূমিকায় রামচন্দ্র যেখানে অনুপস্থিত তাঁর পিতৃত্ববোধ। বংশের গতিকে অক্ষুণ্ণ রাখবার কোন তাগিদ অনুভব করেননি তিনি। নির্মম প্রশাসক গর্ভবতী স্ত্রীর গর্ভে তাঁর নিজের ঔরসজাত সন্তান আছে জেনেও কঠোরভাবে আবেগকে সংযত রেখে স্ত্রীকে নির্বাসনের একক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। লৌকিক জীবনে এ এক অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত।এই কারণেই রঘুপতি রাম, যথার্থ সীতাপতি হয়ে উঠতে পেরেছেন কিনা,এ সন্দেহ বোধ হয় অমূলক নয়। লৌকিক চরিত্রের রাম হয়তো এখানে তাঁর দিব্যপ্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কাব্যকথায় স্থান পেয়েছেন, মন্দিরে পাথরের বিগ্রহ হয়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন, সুদূর ধরাছোঁয়ার বাইরের জগতে রয়ে গিয়েছেন, সমস্ত মানবিক গুণ ছাপিয়ে রাবণবধ করে তিনি জাতীয় নায়কে পরিণত হয়েছেন মাত্র।—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content