বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

তেতো মুখে নিজের রুমে বসেছিল অঞ্জন। উন্মেষাও তার মুখোমুখি বসে। রুম-সার্ভিসে ব্ল্যাক কফির অর্ডার দিয়েছিল উন্মেষা। কফি দিয়ে গিয়েছে। দু’জনের হাতেই ধরা কফিমগ ভর্তি কফি। কিন্তু কেউই তাতে চুমুক দিচ্ছিল না।

অঞ্জন এক সময় বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল, “তোমার মনে হয়, আর্য সঠিক কথা বলছে?”
উন্মেষা বলল, “কী বলি বল তো? আমি নিজেই খুব লজ্জিত। আমি তোমাকে রিকয়েস্ট না করলে তুমি হয়তো বাইকটা আর্যকে দিতে না। কিন্তু আমি ভাবলাম, যদি এই সুযোগে সত্যিই ওর কথামতো রথ দেখা আর কলা বেচার কাজটা হয়ে যায়, তাহলে ভালোই তো! ওর স্পেশাল ফিচারের জন্য একদিন যদি তোমার বাইকটা ও নেয়, তাহলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। কিন্তু তখন কী করে জানবো যে, তোমার অত দামি বাইকখানা ও চোরেদের দিয়ে আসবে! আর তারপরেও নিশ্চিন্তে ওর ফিচার লেখার মালমশলা জোগাড় করার কাজ করে যাবে!”

অঞ্জন বলল, “আচ্ছা তুমি বল, ওর কথামতো চোরেরা ওর মোবাইলখানাও খোলা জানালা দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেখানে ও ছিল, সেখানে কারও একটা মোবাইল ছিল না? ও তো দিব্যি তাদের কারুর মোবাইল থেকে একটা ফোন করে কিংবা মেসেজ করে জানাতে পারত! আমরাই না-হয় তখন ফোন করে কথা বলে নিতাম!”
“হয়তো যে-বাড়িতে ও ছিল, সে-বাড়িতে কারুর কোন মোবাইল ছিল না!” উন্মেষা সম্ভাবনার কথা বলে।
অঞ্জন তাতে রেগে যায়, “তোমার এই এক স্বভাব উন্মেষা! তুমি আর্যকে সবসময় প্রোটেক্ট করার চেষ্টা কর। কিন্তু কেন? এতকিছুর পরেও তুমি তাকেই প্রোটেক্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছ! আচ্ছা বলতে পারো, যে-বাড়িতে আর্য উঠেছিল, তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম, সে-বাড়িতে কারও কোন মোবাইল ছিল না। কিন্তু ওই গ্রামে? আজকাল দারিদ্র্য যতই থাক, লোকে পেটের ভাত না জোগাড় করতে পারুক, মোবাইল থাকবেই থাকবে। অনেকে তো আজকাল এসেনসিয়াল কমোডিটিজের মধ্যে মোবাইলকেও ধরেন। বরং খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের আগে মোবাইলের স্থান। আর সেখানে আর্য কি-না মোবাইল খুঁজে পেল না। এটা বিশ্বাসযোগ্য ?”

উন্মেষা একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। কাজটা মোটেই ঠিক করেনি আর্য। সত্যিই তো, যে-বাড়িতে তুই উঠেছিলি, সে-বাড়িতে মোবাইল না থাকতে পারে, তর মোবাইল চুরি হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু আজকালকার দিনে একটা গোটা গ্রামে একজনেরও মোবাইল নেই, এটা অসম্ভব অবিশ্বাস্য। সেক্ষেত্রে আর্য কেন জানাল না, এটা সে বুঝে উঠতে পারছে না। হতে পারে আর্য যেমনটি বলছে, তেমনটিই হয়েছে। তার মোবাইল, অঞ্জনের বাইক রাতের বেলায় চুরি হয়ে গিয়েছে, হতেই পারে। কিন্তু তারপরেও দু’দিন আর্যর সেই গ্রামেই পড়ে থাকা এবং ফিরে এসে ‘কুল’ বিহেভ করার ব্যাপারটা কেবল অঞ্জন কেন, সে-ও ভালোভাবে নিতে পারছে না।

অঞ্জন বলল, “আমার কী মনে হচ্ছে জান?”
“কী?” কফিমগে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল উন্মেষা।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৭৮: নুনিয়া যখন ত্রাতা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

“ওর ফিচার-টিচার সব বাজে কথা। ও কোন পরিচিত লোকের সঙ্গে ব্যবস্থা করে হাঁড়িয়া কিংবা মহুয়া নিয়ে পড়েছিল এই দু’দিন। পরে নেশা কাটতে উঠে দেখেছে, বাইক লোপাট, মোবাইলও। ফিরে এসে সে-কারণে গল্প ফেঁদে বসেছে। এই শ্লা কবিব্রিগেডদের আমি চিনি। মহুয়া পেটে পড়লে আবেগ আর কবিত্ব জেগে ওঠে! রাবিশ!”

“হতে পারে। আর্য যে ওই জাতীয় মদ ইত্যাদি পছন্দ করে না, এমন তো নয়। বরং য্যুনিভার্সিটি লাইফে একবার মধুপুরে বেড়াতে গিয়ে ও মহুয়া খেয়ে টাল হয়ে পড়েছিল চার দিন!” উন্মেষা স্বীকার করে।
“তাহলেই বোঝ! আমি তো এই তথ্যটা জানতাম না। তুমি এখন বললে। কিন্তু দেখ, আমি আগেই কেমন সঠিক গেস করেছি। অ্যাকচুয়ালি এদের নেচার একদম সেম। এরা যেখানেই যাবে, এইরকম করবে আর লাথ খাবে। দুই ধরণের মানুষদের আমি দেখতে পারি না জানো। এক, ল্যাদখোর আর দুই, লাথখোর। দুটিই সমান ডেঞ্জারাস!”
উন্মেষা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। আর্য তার মানসম্মান একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। অঞ্জনের অত শখের বাইক। তার কষ্টটা বুঝতে পারছিল সে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৪: স্বার্থান্বেষীকেও চিনতে শেখায় এই গ্রন্থ

অঞ্জন কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, “ছ্যা! এরা ব্ল্যাক কফিটাও ঠিক করে বানাতে পারে না। আবার রিসর্টের বিজনেস খুলে বসেছে!”

উন্মেষা বুঝতে পারল, যেহেতু মেজাজ খিঁচড়ে আছে, সেই কারণে এখন কিছুই অঞ্জনের ভালো লাগবে না। সে খানিকটা অন্তরঙ্গ সুরে বলল, “কিন্তু এই ব্ল্যাক কফি খেয়েই তুমি প্রথম দিন দিব্যি কমপ্লিমেন্ট দিয়েছিলে কুককে!”
“ওটা ভদ্রতা ছিল। কিন্তু এমন ছ্যাঁচড়া জায়গা যে আর সেই ভদ্রতা রক্ষা করার কোনও অর্থই হয় না!”
“এটা তোমার রাগের কথা। যাই হোক, বাদ দাও। খেতে না-পারলে সরিয়ে রাখ। এখন আমাদের ভাবতে হবে, তোমার বাইকটা কীভাবে উদ্ধার হবে, সেই বিষয়টি। থানা যে বাইকটা উদ্ধার করেছে, তা তো তুমি বর্ণনা শুনে বলেছ, ওতা হয়তো তোমার হারানো বাইকটিই। কিন্তু তোমার উচিত নয় কি যে থানায় গিয়ে নিজের চোখে বাইকটাকে দেখে কনফার্ম করা?”

“সময়টা কোথায় পেলাম বল? একের পর এক যা শুরু হয়ে গেল রিসর্টে। অনিলের মৃত্যু আমার মাথাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। আচ্ছা। আজ যাব। অন্তত চোখের দেখা দেখে নিশ্চিন্ত হতে চাই যে, পুরানা মোকামের জঙ্গলে উদ্ধার হওয়া বাইকটা আমারই!” অঞ্জন বলল।
“ক্যাজুয়ালি বল না অঞ্জন। আজ যাব নয়, এক্ষুনি যাচ্ছিস বল। এখন দুপুর গড়িয়ে যেতে বসেছে। এর পর গেলে থানার ভারি বয়েই গিয়েছে তোমাকে উদ্ধার হওয়া বাইক দেখাতে!”
“আরে ওদের দরকার পড়বে না। নিশ্চয়ই থানার বাইরে ফেলে রেখেছে বাইকটাকে। আমি একবার দেখেই বুঝতে পারবো সেখানা আমার বাইক কি-না!”
“বেশ। দেখে বুঝে এসো। কিন্তু যা করবে তাড়াতাড়ি কর। এ-জায়গা থেকে এখন যেতে পারলে বাঁচি!” উন্মেষা বিরক্তির সুরে বলল।
“আমিও। কিন্তু পুলিশ অত সহজে যেতে দেবে কি আমাদের?”
“পুলিশকে রিকোয়েস্ট করতে হবে। দেখ ওদের অনন্তকাল লাগবে কালাদেও-কেস সলভ করতে বলে আমরাও অনন্তকাল এখানে-এই রিসর্টে থানা গেড়ে বসে থাকব, এটা কি খুব যুক্তিযুক্ত কথা?”
“দেখ, সে কথা তো আমারও। কিন্তু চাইলেই তারা আমাদের পারমিশন দেবে না এখন। যেহেতু আমাদের গ্রুপের একজন ব্রুটালি মার্ডার হয়েছেন, সুতরাং এখন এখান থেকে যেতে চাওয়ার জিদ ধরলে তোমার-আমার প্রতিই পুলিশের সন্দেহ হবে। তখন না লক-আপে রাত কাটাতে হয়!”
“সত্যিই আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল যা-হোক! এই পিশাচপাহাড়ে না এলেই ভালো হত। কোথা থেকে এক কালাদেও এসে হাজির হল, তারপর আমাদের ভাগ্যটাও বদলে গেল!”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৩: রাজসভায় মিথিলার সঙ্গীতজ্ঞ

অঞ্জন বলল, “তা নয় উন্মেষা। আমি লাল্বাজারের দুই অফিসারের সঙ্গে লোকাল থানার ওই ইয়াং চ্যাপের কথোপকথন কিছু শুনছিলাম, তাতে মনে হচ্ছে কোন গ্রেটার কন্সপিরেসি এর পিছনে আছে। না হলে আজকের এই দুনিয়ায় কোনও হাজার-হাজার বছরের প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে? আর যদি থাকেও, তাকে ধরতে বা চিহ্নিত করতে না-পারার দায়ও নিতে হবে প্রশাসনকে!”
উন্মেষা গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি কালাদেও-মিথকে বিশ্বাস করো না?”
“না! করি না! করবার দরকারও বোধ করি না!”
“কিন্তু দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ মিস্টার অঞ্জন! হতেই তো পারে, কালাদেও নামক কোন প্রাগৈতিহাসিক জীব কোনক্রমে গুহার অন্ধকারে থেকায় বেঁচে যেতে সমর্থ হয়েছে। তাই নয় কি?”
অঞ্জন বলল, “ও-সব তত্ত্বের কথা আমায় শুনিয়ে কোন লাভ নেই, বুঝলে? কালদেও আবার কী? যতসব রাবিশ! প্রাগৈতিহাসিক জীবের আজও বেঁচে থাকা, তার এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে মানুষ শিকার করা, এইসব গাঁজাখুরি কথাগুলিকে কীভাবে যে তোমরা বিশ্বাস করো, কে জানে! আমার মনে হচ্ছে, স্থানীয় কোন রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক নানা কারণে সাময়িক একটা অস্থিরতার জন্ম হয়েছে। আর তারই রেজাল্ট হিসেবে একের পর এক মার্ডার হয়ে চলেছে ! দেখ। আমার মত যদি নাই মেলে তাহলে বলো!”
“কী বল তো, আমার মনে হচ্ছে আমরা সকলেই যেন গোয়েন্দা হয়ে উঠেছি লালবাজারের ওই হ্যাণ্ডসাম গোয়েন্দা অফিসারটির মতো!”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

“আসলে তো আমরা সকলেই গোয়েন্দা। জীবনের সব ক্ষেত্রেই নিজেদের কত যুক্তি সাজিয়ে, খণ্ডন করে, ভালো করে খতিয়ে দেখে তবেই না সিদ্ধান্ত নিতে হয়? আমরা গোয়েন্দাদের তুলনায় কম কিসে?”
উন্মেষা কোন জবাব দিল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলল, “তুমি কিন্তু এখনই বেরিয়ে পড়ো। থানার দিকে। অন্তত একবার চোখের দেখা দেখে সনাক্ত তো করো যে ওটা তোমার না-কি তোমার নয়!”
“হ্যাঁ। যাব। সুদীপ্তবাবু নিজেই তো ফোন করেছিলেন। আমিও বলেছিলাম, পরের দিন সকালে যাব! কিন্তু কাল যেতে পারিনি। আজ যাব! গিয়ে সুদীপ্তবাবাবু আর বড়বাবু মালাকার না কী যেন, তাঁদের কাছে গিয়ে পিশাচপাহাড় ছেড়ে কলকাতা ফেরার আবেদন করব।”
“আর তোমার বাইক? বাইক ফেরৎ নিতে আসতে হবে না?”
“তোমার কী মনে হয় উন্মেষা, যে-বাইকটায় অন্য কারও রক্ত লেগে আছে বলে শুনেছি, তার উপর চুরি যাওয়া বাইক, সে-বাইক আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাব? লোহালক্কড়ের দামে বেচে দেব সে-ও ভি আচ্ছা, কিন্তু ও বাইকে আর নয়। তবে একটা শিক্ষা হল, বই আর বউয়ের পাশাপাশি বাইকও যদি একবার অন্যের হাতে যায়, তাহলে আর ফিরে আসে না!”

এত সমস্যার মধ্যেও উন্মেষা হাসল। বলল, “ভালো বলেছ। আমিও শিখলুম!”
অঞ্জন উঠে পড়ল। বলল, “যাই, থানা থেকে তাহলে ঘুরেই আসি। তুমি যাবে?”
উন্মেষা একটু ভাবল। তারপর বলল, “গেলেই হয়। বেড়াতে এসে আনওয়ান্টেড ফ্যাসাদে পড়ে রিসর্টের রুমেই আট্‌কা পড়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বাইরে বেরুতে গেলেই সকলের সন্দেহের দৃষ্টি আমাদের উপরে পড়বে, এই ভেবে কোথাও তো বেরোতেও পারছি না! তাও থানায় যাব শুনে যদি সকলে একটু কৃপা করে! থানাই সই, বাইরে তো বেরুতে পারা যাবে। এখানে পড়ে থেকে থেকে বোর হওয়ার চেয়ে থানায় যাওয়া অনেক বেটার অপশন। চল।” —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content