শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা।।
যুগাবতার ঠাকুর জগতের কারণ নির্গুণ-নিরাকার চৈতন্যস্বরূপকে স্বয়ং মাতৃস্বরূপে অনুভব করেছেন। শুধু তাই নয়, নিজের সন্ন্যাস দীক্ষাগুরু অদ্বৈতবেদান্তী তোতাপুরী মহারাজকেও সেই স্বরূপই উপলব্ধি করিয়েছেন। ঠাকুর চেয়েছেন সকলের মধ্যে কেবল নির্গুণ জ্ঞানতত্ত্বের ভাব বিস্তার না হয়ে পরম কল্যাণময় মাতৃভাবের বিস্তার হোক। যাঁর অভয় আশ্রয়ে সংসারী মানুষ সকল যন্ত্রণা নিঃশেষে ভুলতে পারবে।
উমেশবাবু একবার শ্রীমাকে বলেছিলেন যে, ঠাকুর সংসার থেকে অপ্রকট হওয়ার পর তিনি সংসারে থেকে লোককে শিক্ষা দিচ্ছেন। অন্যান্য অবতারের ক্ষেত্রে তাঁদের শক্তিরা এই কাজ করেছেন বলে শোনা যায় না। অবতারদের যাঁরা পার্ষদ ও ভক্ত তাঁরাই এরূপ লোকশিক্ষা দিয়েছেন। উমেশবাবু শ্রীমার কাছে এই নূতনত্বের কি কারণ, তা জানতে চেয়েছেন। উত্তরে শ্রীমা বলেন, “বাবা, জান তো, ঠাকুর সকলের ভেতর মাকে দেখতেন, সেই মাতৃভাব জগৎকে শেখাবার জন্যে এবার আমাকে রেখে গেছেন। শ্রীমা সহজকথায় কত ছোট ছোট সুভাষিতাবলী বলে গেছেন। সেইসব সুভাষিতাবলীর অনেকটাই হারিয়ে গেছে লিপিবদ্ধ না থাকার জন্য। তবুও তাঁর ভক্তদের স্মৃতিচারণ থেকে কিছু জানা যায়। যেমন শ্রীমার বিখ্যাত কিছু বাণী, ‘যদি শান্তি চাও, অপরের দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের।” আবার, “পৃথিবীর সমান সহ্যগুণ চাই, বা সন্তোষের সমান ধন নেই, অথবা সহ্যের সমান গুণ নেই।”
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?
মা সারদার দৈনন্দিন গৃহকর্মের মধ্যেও নীতিশিক্ষার অপূর্ব নিদর্শন থাকত। উঠোনের কোথাও যদি কোন তরকারির খোসা, খোলামকুচি প্রভৃতি পড়ে থাকত, তাহলে তিনি নিজে ঘুরে ঘুরে তুলে রাখতেন। ঝাঁট দিয়ে সেগুলো ফেলে দিতে নিষেধ করতেন। তিনি বলতেন, “এসব গরু, ছাগলের খাদ্য, তাদের দেব।” এ প্রসঙ্গে মা সারদার শিক্ষা হল, “যার যা প্রাপ্য তা তাকে দিতে হয়।” যদি গরু ছাগলে না খায় তো পুকুরে দিলে মাছে খাবে। তাঁর কথা, “কাউকেই বঞ্চিত করতে নেই।”
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা
একদিন একটি মেয়ে তার ঘর ঝাঁট দিয়ে ক্ষয়ে আসা মুড়োঝাঁটাটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাই দেখে মা সারদা বলে ওঠেন, “ও কিগো, কাজটি হয়ে গেল, অমনি ঘেন্নায় ছুঁড়ে ফেলে দিলে?” তারপরই বলেন, “যাকে রাখ, সে-ই রাখে। ওটি সংসারের একটি অঙ্গ। ওরও সম্মান আছে।” ঠাকুর শ্রীমাকে সধবার পোশাক ত্যাগ করতে বারণ করেছিলেন। শ্রীমাও ঠাকুরের কথা মতো হাতে সোনার বালা আর পাড় দেওয়া শাড়ি পরতেন। তাহলেও চওড়া পাড় শাড়ির পাড় ছিঁড়ে সরু করে নিতেন। মা সারদার অনেক ভক্ত তাঁকে ভাল ভাল শাড়ি এনে দিতেন। তবে সেসব তিনি গরীব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। নিজে পুরনো ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে, নয়তো গেরো দিয়ে পরতেন। তাঁর কাছে যেসব ভক্ত আসত, তারাও শ্রীমাকে দেখে সরল জীবন যাপনের শিক্ষা পেত। সেকালের বিধবা ব্রাহ্মণ নারীর পক্ষে বিদেশিনী ও বিধর্মী কন্যাদের গ্রহণ করা কল্পনাতীত ছিল।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না
এই বিদেশিনী মেয়েদের আবদার রাখতেই তিনি জীবনে প্রথম নিজের আলোকচিত্র তুলতে রাজি হন। শ্রীমতী ওলি বুল শ্রীমাকে বলেন যে, দেশে ফিরে কি নিয়ে সে থাকবে। মায়ের মুখখানিও দেখতে পাবে না! নিবেদিতারও মায়ের ছবি চাই। তিনি নিজের হাতে সেদিন শ্রীমাকে সাজিয়েছিলেন। মা সারদার ছিল এক ঢাল চুল। পরিপাটি করে তা আঁচড়ে নামিয়ে দিলেন সামনে। প্রথমে নতনয়নে সারদা মা কিছুতেই ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছেন না। ফোটোগ্রাফার হ্যারিংটন সাহেব তখন একটা কৌশল করলেন। ক্যামেরার একটা শব্দ করেই বললেন, ব্যাস। মা সারদা ভাবলেন যে, ঝামেলা গেল। এ বার তিনি মুখ তুললেন। তখনই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে হ্যারিংটন সাহেব ক্যামেরা ক্লিক করলেন। মা সারদার পঁয়তাল্লিশ বছরে তোলা এই ছবিটিই ঘরে ঘরে সর্বাধিক পরিচিত ও আজও পূজিত হয়ে চলেছে। শ্রীমার মাতৃহৃদয়ের শুভকামনা থেকে কেউ বঞ্চিত হত না। তাঁর মাতৃভাব সংকীর্ণ ছিল না।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৬: প্রথমে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির বিজ্ঞাপনে উত্তম কুমারকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও
একবার ডাক্তার কাঞ্জিলালের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মা সারদাকে প্রণাম করে বলেন, ‘আশীর্বাদ করুন, আপনার ছেলের যেন উপায় হয়’। শ্রীমা সেকথা শুনে তার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘বৌমা, এমন আশীর্বাদ আমি করব! যাতে সকলের অসুখ হোক, কষ্ট পাক? আমি তো তা করব না মা, সকলে ভাল থাক, জগতের মঙ্গল হোক মা’। পুকুর থেকে স্নান করে উঠে করজোড়ে প্রণাম করে মা সারদা বলতেন, ‘মা জগদম্বে, জগতের কল্যাণ কর’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।