ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।
আলাস্কায় সবাই সবার সঙ্গে বেশ একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক রেখে চলে। আর কথা বলার লোক পেলেই যে যাঁর রাজ্যের কথা উজাড় করে দেন। তার ওপরে ওদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তনী। সেখানে আমি ইন্টারভিউ দিতে এসেছি শুনে তারা তো বেশ আহ্লাদিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের এটা-ওটা-সেটা করে কত কথাই না বললেন আমাকে। সব কথা আমার মনেও নেই। তবে কোনও খারাপ কথা কেউই কিছু বলেননি, এটুকু বেশ মনে আছে।
খানিকক্ষণের মধ্যেই জিনিসপত্তর সঙ্গে করে বেরিয়ে এলাম বিমানবন্দর থেকে। বলাই বাহুল্য, যে এখানে ভাড়া গাড়ি বা উবের ট্যাক্সি, কোনওটাই সহজলভ্য নয়। তাই পরিকল্পনা মাফিক, বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক অধ্যাপক বিমানবন্দরে এসে তার একটা পুরোনো গাড়ি আমাকে দিয়ে গেল এই দু’ দিন ব্যবহার করার জন্য। সেটা একটা পিক আপ ট্রাক। আলাস্কায় বিশেষত ফেয়ারব্যাঙ্কসের মতো জায়গায় চালানোর জন্য ওরকম ট্রাকই সবচেয়ে ভালো। কারণ, রাস্তা মাঝে মধ্যেই এখানে বেশ খারাপ। শীতকালে রাস্তার মধ্যে জল জমে বরফ জমে বরফ হয়ে গিয়ে রাস্তাকে ফাটিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে বেশ বড় বড় গর্ত যাদের আমরা প্রচলিত ভাষায় বলি গাড্ডা।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩১: আলাস্কায় কারও সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বললেই আত্মীয়তার স্পর্শ পাওয়া যায়
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল
শহর থেকে দু’ মিনিট বাইরে গেলেই সেখানে পুরোপুরি কাঁচা রাস্তা। কোথাও কোথাও বা পাথুরে রাস্তা। কাজেই ওসব রাস্তায় ট্রাক বা ওই ধরণের শক্তপোক্ত গাড়িই ভালো চলে। আমি অবশ্য গাড়ির ব্যাপারে একটু সৌখিন। ভবিষ্যতে এখানে চলে আসার পরে একটা অডির সেডান গাড়ি কিনেছিলাম। কিন্তু সে সৌখিন গাড়ি কিনে আমার বেশ হয়রানি হয়েছিল একবার। সে কথা পরে কখনও বলব।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৭: সারদা মা ও তাঁর রাধু
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
মুশকিল হল, ফেয়ারব্যাঙ্কস শহরে ইউরোপিয়ান বিলাসবহুল গাড়ি সারানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। সেগুলোর কোনও ডিলার বা শোরুম পর্যন্ত নেই এখানে। এই সমস্ত গাড়ির শেষ ডিলার আছে অ্যাঙ্করেজ শহরে। আলাস্কা থেকে ৩৮০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত এই শহর। গাড়িতে যেতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা মতো। কাজেই বেশ বোঝা গেল, এই চাকরিটা হলে বিলাসের জীবন পিছনে ফেলে চলে আসতে হবে। আর সত্যি কথা বলতে কি, বিলাসবহুল গাড়ির ডিলারের উদাহরণের দরকার নেই। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে সবদিক দেখেই সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত, যখন এখানকার ফেটে যাওয়া, ধসে যাওয়া রাস্তা দিয়ে কিছুটা গাড়ি চালানোর পরই সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৪: অপরাজিতা রাধারাণী
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
যাই হোক, রাস্তার বর্ণনা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, চিরাচরিত যুক্তরাষ্ট্র বলতে আমরা যা বুঝি বা আমি এতদিন আমি যা দেখে এসেছি এখানে তার কিছুই নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরের ঝাঁ চকচকে চেহারা বা অনুভূতি তো দূর অস্ত, আমাদের কলকাতা হাওড়ার মফঃস্বল এলাকাতেও এর চেয়ে বেশি ঝকঝকে। এখানে রাস্তা তো খারাপই, সেই সঙ্গে শহরের মধ্যে কোনও শপিংমল নেই। তেমন কোনও উঁচু বাড়িও নেই। থাকার মধ্যে আছে চারটে কি পাঁচটা বড় বড় খুচরো কেনাকাটার জায়গা, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনও শহরেই ন্যূনতম সুবিধার মধ্যে গণ্য করা হয়। এদের মধ্যে আছে একটা বড় ওয়ালমার্ট, একটা বড় কস্টকো, দুটো বেশ বড় বড় ফ্রেডমেয়ার, আর দুটো মাঝারি মাপের সেফওয়ে।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৪: প্রজাদের আনন্দ, স্বস্তি, আশ্রয় রাম—তাঁর কাছে প্রজাদের আনুগত্যের স্থান কোথায়?
যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ইন্টারনেটে একটু খোঁজ নিলেই এই বড় বড় খুচরো কেনাকাটির জায়গাগুলো, বা বলা ভালো এই কোম্পানিগুলোর সম্পর্কে জানা যাবে। অথবা কারও চেনা পরিচিত কেউ যদি যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেও এগুলো সম্পর্কে জানা যাবে। মোটের ওপর বলতে গেলে এই সব জায়গায় রোজদিনের খাবার থেকে শুরু করে, নিত্যদিনের মুদিখানা, জামা কাপড়, গাড়ির যন্ত্রাংশ, বিনোদনের জিনিস, বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি, হরেক মাল সব কিছুই পাওয়া যায় এক ছাদের তলায়। তবে আলাস্কা হওয়ার কারণে এখানে জিনিসপত্রের জায় বা মজুত অনেক কম।
ছবি: লেখক।
অনেক কিছু জিনিসপত্র আছে যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চলে সহজেই পাওয়া যায়, সেগুলো এখানে পাওয়া যায় না। আলাস্কা এতটাই দূরে যে জিনিসপত্রের পরিবহনের খরচটাই অনেকটা বেশি পড়ে যায়। তাই সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য জায়গা থেকে রপ্তানি করা সম্ভব হয় না সব কোম্পানির পক্ষে। এ জন্য এখানে অনেক জিনিস পাওয়া যায় না। বিশেষ করে যদি কোনও জিনিসের পরিমাপ একটু বেশি হয়, যেমন ধরা যাক বড় সোফা, বড় খাট বা বিছানা সেগুলো তো এখানে বেশ দুর্লভ। দুর্লভ না হলেও তাদের দাম তো অবশ্যম্ভাবী ভাবে অনেকটাই বেশি যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনও জায়গার তুলনায়।—চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।