শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

শাক্য তুম্বো মুখ করে বলল, “আসুন।”
অজয়বাবু কান এঁটো করা হাসি মুখে এঁটে এগিয়ে এসে সশব্দে চেয়ার টেনে বসে বলল, “আমাকে শুনলাম ইন্টারোগেট করা হবে?”
শাক্য বলল, “সেটাই দস্তুর নয় কি? যেখানে ক্রাইম হয়, সেখানে উপস্থিত সকলকে সাসপেক্ট হিসেবে সন্দেহ করাটাই পুলিশি তদন্তের প্রাথমিক নিয়ম, নিশ্চয়ই এটা জানা আছে?”
অজয়বাবু বলল, “তা বলে আমি? আমার মতো নিরীহ, গোবেচারা, সাতে পাঁচে না থাকা ডকুফিচার বানানো পাবলিক, সে করবে দু’-দুটো খুন? তাও কালাদেওর কাণ্ড হলে খুন বলা চলে না!”
শাক্য অজয়বাবুর কথায় পাত্তা দিল না যেন, বলল, “আপনি কাল রাত বারোটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?”
“লে হালুয়া! এ যে দেখছি সত্যি সত্যিই আমাকে সন্দেহ করছে? তাও যদি কোন মহিলা খুন হতেন, তাহলেও বলা যেত আমার সঙ্গে ইয়ে করছিল, বেশিবার হওয়ায় মারা গিয়েছিল ফলে তদন্ত অন্য দিকে ঘোরাতে আমি ওইভাবে ব্রুটালি মার্ডার করে ফেলে রেখে এসেছি। কিন্তু খুন তো হয়েছে দু’-দুজন দামড়া লোক!”
“কেন আপনার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টাশন ডিফারেন্ট হলে এই খুনও কি আপনার পক্ষে স্বাভাবিক নয় করা? কিছুদিন আগেই তো আমাদের ডিপার্টমেন্ট বৌবাজারের এক ব্যবসায়ী খুনে এই লাইনে এগিয়েই সাফল্য পেয়েছিল। জানেন না?”
“আরে মাইরি, শাক্য, তুমি কী বলছ? আমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে এমনিতেই ঝামেলা চলছে, এই সব কেসে ফাঁসিয়ে দিলে একেবারে সব শেষ হয়ে যাবে। তখন ওই তৃতীয় পা একেবারে বেকার হয়ে যাবে!” বলে কপট ভয় দেখাল অজয়বাবু।
“শাট্‌ আপ! তদন্তকারী অফিসারকে তদন্তের সময় ‘মাইরি’ বলা, নাম ধরে ডাকা কিন্তু আইনগত ভাবে অপরাধ!”
“দূর শালা!” বলে একটা ছাপার অযোগ্য খিস্তি দিল অজয়বাবু, “এ বার আমার মুখে কিন্তু আর ভালো ভালো কথা বেরুবে না! একেজি-কে ফোন করে বলবো, শাক্যর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, অন্য কাউকে পাঠান!”
“করো, করো! একেজি নিশ্চয়ই তোমার ফোনের অপেক্ষায় না থেকে আগেই তোমায় ফোন করেছেন? পাভেলবাবুর মতো একজন ধুরন্ধর অফিসার অকুস্থলে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে দু’-দুটো মার্ডার হতে পারে, এটা নিশ্চয়ই তাঁর কল্পনার অতীত!”
অজয়বাবু ওরফে পাভেলের মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেল। সে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, ‘সত্যিই শাক্য, এটা লজ্জার কথা। কিন্তু তুমি জানো, আমি এই মাসখানেক বসে ছিলাম না। কালাদেও সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জোগাড় করেছি, মার্ডার স্পটে গিয়ে সেখানে তদন্ত করেছি এমনভাবে যেন আমি কালাদেওর উপর কিছু অংশ রাখবো আমার ডক্যুফিচারে। তুমি তো জানো, লোকে পুলিশ দেখলে কেমন গুটিয়ে যায়, অন্য কারুর কাছে, তা সে অপরিচিত হলেও আবার কত সহজে নিজেকে মেলে ধরে, সেই ভাবেই আমি তথ্য জোগাড় করছিলাম। কিন্তু আমি একটা ভুল করেছি। একচক্ষু হরিণের মতো ভেবে নিয়েছিলাম যে, আমাদের রিসর্টটা নিরাপদ। কিন্তু কাল ভোর রাত্রে সেটা ভুল প্রমাণিত হল। আর আমি ভাবতেও পারিনি, এখানে বেড়াতে আসা একটা ট্যুরিস্ট পার্টিকে কালাদেও টার্গেট করতে পারে!”

“কালকের সন্ধ্যার ঘটনা তো শুনেছ? সেখানে উপস্থিত ছিল স্যারের ভাগ্নী আর তার উডবি হাজব্যান্ড। যদিও আমি তাদের ইন্টারোগেট করেছি, এবং আমার মনে হিওয়েছে তারা সন্দেহের ঊর্দ্ধে, তবে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না। কিন্তু তোমায় আমি কলকাতায় যে কথা বলেছিলাম যে, এই কেস আসলে একতা বলে মনে হলেও একটা নয়। বেশ কয়েকটা কেস একসঙ্গে জড়িয়ে আছে, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে একটার সঙ্গে আর-একটা লিংক-আপ করে সবাইকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে!”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫৫: রঘুই কি ছেলেকে ভয় দেখিয়েছে?

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-২০: আসল নাম মিতুল হলে ওই ফোন নম্বরটা কার?

“আমারও তাই মনে হয়। কাল ভোর রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি এক তলায় ইচ্ছে করেই রুম নিয়েছিলাম। যাতে সময় সুযোগমতো আসা যাওয়া করতে অসুবিধে না হয়। আর এঁরাও ধরে নিয়েছিলেন, আমি এক বদ্ধ উন্মাদ ফিল্ম-মেকার। ফলে আমার যখন খুশি আসা-যাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা করেননি। তবে এখানকার নিয়ম যে, রাত নটার সময় মেইন গেট বন্ধ হয়ে যায়, কোন ট্যুরিস্টের আসার কথা থাকলে গেট খুলে দেওয়া হয়। দারোয়ান বলতে কেউ নেই। নাইটগার্ড আছে, তার কাজ খুলে দেওয়া। সে সন্ধের পর আসে এবং ভোরবেলা চলে যায়। তবে এক সপ্তাহ হল তার অসুখ বলে সে আসছে না। সুবলই কাজ সামলাত কিংবা কংসারি। আমি যদিও বেশি রাত করতাম না। তবে খুব ভোরে বেরিয়ে যেতাম। তুমি জানো যতটা সম্ভব অন্য বোর্ডারদের এড়িয়ে যাওয়াই আমার লক্ষ্য ছিল। তা কাল ভোর রাতের দিকে আমি হঠাৎ বাগানের দিকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পাই। আলোটা যেন এক-দুবার জ্বলে উঠেই নিভে যায়। আমার কেমন সন্দেহ হল। কলকাতায় এখন গরম পড়ে গেলেও এখানে ভোরের দিকে ঠান্ডা কম না। এই অবস্থায় বাগানে আলো জ্বেলে কে কী খুঁজছে? আমি রিভলভার আর টর্চ হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাই। সামান্য এক-দু’মিনিট দেরি হয়েছিল বলতে পারো। আমি ভেবেছিলাম, চোরটোর কেউ হবে। তা না হলে এই সময় আর কেউ বাইরে বাগানে ঘোরাফেরা করবে না। এখানে এটা মর্ণিং-ওয়াকের সময় নয়। যাই হোক, বেরিয়ে আমি কাউকে দেখতে পাই নি প্রথমে। তারপর মনে হল, পিছনের বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে একটা ছোট গেট আছে, সেইদিক দিয়ে যদি চোর ঢোকে। আমি সেইদিকে গিয়েছিলাম। তখন যদি নীচের দিকে আলো ফেলে দেখবার কথা আমার মাথায় আসতো, তাহলে অনিলের ডেডবডি আমিই প্রথম দেখতাম। কিন্তু বললাম না, আমার মাথার মধ্যে ছিল যে, এই রিসর্টে কেউ মার্ডার বা আর-কিছু করতে পারে না। এখন আফসোস হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, আলোটা মার্ডারারের ছিল!”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৪: শোভনাসুন্দরী—ঠাকুরবাড়ির এক সরস্বতী!

শাক্য শুনছিল মনে দিয়ে পাভেলের কথা। পাভেলকে সেই একেজি-র অনুমতিক্রমে এখানে ছদ্মবেশে এসে কালাদেও সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পাঠিয়েছিল। সত্যি সে-ও তখন ভাবেনি এই ভাবে এই রিসর্টে কালাদেও হানা দিতে পারে। পাভেল ডে-টু-ডে একেজি-কে রিপোর্ট করেছে। তাকেও মেইল করে দিয়েছে। পড়েছে তার মেইল করা তথ্য। কালাদেও সম্পর্কে ক্রমে একটা নির্দিষ্ট রূপরেখা তার মনের মধ্যে তৈরি করে নিয়েছে সে। কালাদেও-মিথ না সত্যি সে জানে না, কিন্তু তার ইনট্যুইশন বলছে, রিসর্টের ডাবল মার্ডারের পিছনে অন্য গল্প আছে।

শাক্যকে চুপ করে থাকতে দেখে পাভেল বলল, “তুমি কী আমায় ওয়ার্থলেস ভাবছ শাক্য?” শাক্য তাকাল তার দিকে। বলল, “তোমার কি আমাকে দেখে তেমনটা মনে হচ্ছে? আমি ভাবছি, আততায়ীর সাহস দেখে। একইদিনে দু’-দুটো খুন সে করতে পারল কী করে? যেখানে আগের দিনই রিসর্টে পুলিশ এসেছিল? এবং আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে কালকের বাসরাস্তায় যে স্ম্যাশড্‌ হেড লাশ পাওয়া গিয়েছে, তা আর্যরই। আর্যের মিসিং-এর ব্যাপারটা তো শুনেছ?”
“আজ সকালেই শুনেছি। তা মর্গে এদের যাওয়ার কথা শুনছিলাম। যায়নি?”
“এই ইন্টারোগেশন শেষ হলেই যাবে। সুদীপ্তকে বলে দিয়েছি।”
“হুঁ, সুদীপ্ত বেশ করিতকর্মা। বেশ সেলফ-কনফিডেন্স রাখে!”
“ওটাই ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে থেকে প্রিজিউম করা সিদ্ধান্ত নিয়ে তদন্ত করতে চায়, ফলে ভুল পথে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় ষোলো আনা!”
“হুঁ। হয়তো। আমার সঙ্গে বার-দুয়েক কথা হয়েছে। আমি ডকুফিচার বানাবো বলে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কিছু তথ্য সংগ্রহ করবো এই কথা আগেভাগে জানানোর ছলে থানায় গিয়েছিলাম। থানার বড়বাবুটিকে তো দেখলাম একেবারে হোপলেস। সুদীপ্তকেই যা চৌকস মনে হয়েছিল। আমাকে অনেক জ্ঞানও দিয়েছিল!”
“আপাতত অজ্ঞানীর মতো সুবলের ঘর সার্চ করেছিল বলে আবার পাঠানো হয়েছে ভালো করে ছানবিন করতে!”
“তুমি যাওনি?”
“নাহ্‌। আমি অনিলের স্পটে ছিলাম। ভেবেছিলাম, সুবলের ঘর সার্চ করে যা রিপোর্ট দেবে সুদীপ্ত সেটাই যথেষ্ট। কিন্তু ও তড়িঘড়ি করে ওখানটা দেখেই অনিলের স্পটে চলে এসেছিল। আসলে ভেবেছিল, দুটো স্পটই একা বাহাদুরি দেখিয়ে আমাকে চমকে দেবে। কিন্তু চমক দেখাতে গিয়ে ভালো করে সার্চ পর্যন্ত করেনি!”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান

“তাহলে এখন?”
“সুদীপ্ত ফিরুক। আমাদের এই ক’দিন কোন বিশ্রাম নেই। একটা ভয়ঙ্কর জটিল কোন ঘটনার সঙ্গে আমরা জড়িয়ে পড়েছি বলতে পারো। আর আততায়ী খুব ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে। সেই সঙ্গেই ফেরোশাস। ক্রিমিন্যাল মাইন্ড এবং কিলিং ইন্সটিংক্ট খুব প্রবল। আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। যে-কোনও মুহূর্তে আমাদের উপরও অ্যাটাক হতে পারে!”
“কী বলছ শাক্য?”
“ঠিক বলছি। ভেবেচিন্তেই বলছি। আততায়ীর হাত খুব লম্বা। সে হয়তো বন্ধুবেশেই আমাদের মাঝখানে রয়েছে কিংবা আড়ালে রয়েছে। তা সে আমাদের পাশেই থাকুক আর আড়ালে, আমার বিশ্বাস তার এক বা একাধিক সহযোগী রয়েছে, যারা বাসরুটে আর্যকে হত্যা করতে পারে আবার একই দিনে ভর রাতে অনিল ও সুবলকে হত্যা করতে পারে!”
“আলাদা আলাদা অপরাধী নয় তো ? সুবলকে একজন আর অনিলকে একজন খুন করেছে ?”
“নাহ্‌, মনে হয় না। জঙ্গলে বাঘেদের শুনেছি নিজেদের নিজেদের এলাকা আছে। কেউ কারও এলাকায় সচরাচর ঢুকে পড়ে না। এক্ষেত্রেও তেমনটাই। আমার মনে হচ্ছে অপরাধী নিজস্ব একটা অঞ্চল তৈরি করে নিয়েছে পিশাচপাহাড় ট্যুরিস্ট স্পটকে কেন্দ্র করে। আর তাকে সাহায্য করেছে কালাদেও সম্পর্কিত ঘটনা !”
“আগের আক্রমণগুলি কিন্তু স্থানীয় নানা পেশার মানুষদের উপরেই নেমে এসেছে!” পাভেল বলল।
“জানি। ভাবছি। কিন্তু পাভেল, আমাদের আগে আততায়ীকে খুঁজলে হবে না, আগে খুঁজতে হবে কেন? কোন উদ্দেশ্যে সে এই খুনগুলি করছে? না কি নিছক এ-তার হত্যাবিলাস? সে পারভার্টেড কোন খুনি, যার রক্ত আর থেঁটলানো মাথা দেখলেই আনন্দ হয়?”
এমনসময় দরজায় শব্দ হল। সুদীপ্ত ঢুকল। তার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content