শুক্রবার ২৯ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

“এই নুনিয়া, হিথা কী করচিস বটেক?”
নুনিয়া ঘাড় ঘোরাল। তার পরনে জীর্ণ কামিজ আর রংচটা, কারও ফেলে দেওয়া, দু-এক জায়গায় তালি দেওয়া বেঢপ পালাজো। চার্চে অনেকে পুরানো জামাকাপড় দান করেন। কেবল এই এলাকার মানুষ নয়, অন্য জায়গা থেকে আসে দানের জিনিসপত্র। তার থেকে তাদের যা দেওয়া হয়, সেই গুলিই পরতে হয় নুনিয়াদের। তাদের বাছবিচার করার অধিকার নেই। আর নুনিয়া তো বিশেষ কিছু বলেই না। সে এই বয়সে বুঝে গিয়েছে, দয়ার দানে বিচার চলে না। ভিক্ষের চাল তায় কাড়া আর আঁকাড়া! সে যা পায়, তাই-ই পরে। সপ্তাহে দু’-দিন চার্চের লোক আসে, সকলের জামা কাপড় চেক করে, যাদের জামাকাপড় বেশি ময়লা হয়েছে, তাদেরটা জমা করেন। পরে কেচে সেগুলিই চলে আসে।

নুনিয়া অবশ্য নিজেই শিখে গিয়েছে কাচতে। একখানা চাকুলিয়া বাটি সাবান দিয়ে সে কেচে নেয় তার জামাকাপড়। দরিদ্র হওয়ার সঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনও সম্পর্ক নেই। এটা একদিন আগের ফাদার চার্চের প্রার্থনার পরে সকলকে বলেছিলেন। সেটা সেই বিরল দিন, যেদিন নুনিয়া চার্চের প্রেয়ারে উপস্থিত ছিল। সে এমনিতে উপস্থিত হয় না বঠে, কিন্তু যেদিন হয় সেদিন সে একাগ্রচিত্তে শোনে। মনে মনে ভাবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইংরাজি কিংবা বাংলায় সে খুব স্বচ্ছন্দ নয় বলে, মুখ খুলতে লজ্জা পায়। না হলে কত কথার যে পাহাড় জমে আছে তার বুকের মধ্যে! যদি কোনওদিন কাউকে সে-সব বলতে পারত, তাহলে তার বুক হালকা হতো।

“কী রে, কুনো কথা বলচিস না যে বড়ো? ইখানে কী করচিস তুই? ফাদারকে বুলবো? সেদিন কী মারটাই না মারল উরা, তাতেও তুর লাজ নাই? হ্যাঁ রে?” বলে প্রশ্নকর্তা মুখে উঠে আসা থুতুটাকে প্রবল আক্রোশে প্রায় নুনিয়ার গায়ের কাছেই ছুঁড়ে দিল।
নুনিয়া কুল খাচ্ছিল। কাঁচা কুল। অনেকখানি নুন সে চার্চের রসুই থেকে চেয়ে এনেছে। রসুইয়ের ধীরাজ স্যামুয়েল মহাপাত্র তাকে খুব ভালোবাসে। মাঝে মধ্যে সুযোগ-সুবিধা মতো তার পছন্দের খাবার করে তাকে খাওয়ায়। ওখানে বসে তো খাওয়ার যো নেই, অতএব, শালপাতার ডোঙায় করে কখনও তেলেভাজা, কখনও নিমকি, কখনও অন্য কিছু সে নিয়ে আসে এখানে, আর নিশ্চিন্তে খায়। এখানে কেউ কিছু বলবার নেই। চারদিকে শাল-সেগুনের জঙ্গল। মাটিতে কেউ যেন অনন্তলতার বিছানা পেতে রেখেছে। দু-একটা কাঠবিড়ালি তাকে দেখলেই কিচকিচ করে দৌড়ে একবার গাছে ওঠে, আর একবার অন্য গাছে লাফ দিয়ে সার্কাসের ট্র্যাপিজের খেলা দেখায়।

একটা গিরগিটি তার দিকে খর চোখে দেখে যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে উদাসীন ভঙ্গিতে ঘাড় উঁচু করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে। নুনিয়া এদের ভাষা বোঝে যেন, শুনতে পায়। সন্ধ্যা নামার সময় পাখপাখালি যখন ঘরে ফেরে আর সারাদিনের কত কথা নিয়ে কথকতার আসর বসায়, তখন নুনিয়া হয়তো কোনও বুনো আম গাছের নীচু ডালে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। তারা তাকে ডাক দেয়, বলে, “ওঠ নুনিয়া ওঠ, ঘর যাবিক লাই? দেখ ক্যেনে, কুতো বেলা হঞইন গেল!” নুনিয়া অমনি উঠে পড়ে। দেখে, সত্যিই তো সানসেট হচ্ছে। লাল বলের মতো সূর্যটা ডিগবাজি খেয়েই নীল দিগন্তের সমুদ্রে ডুবসাঁতার দিয়ে কে জানে কোথায় গিয়ে উঠবে!
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৫: কালাদেওর ইতিহাস

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…

আজও নুনিয়া তার জামার কোঁচড়ে করে কুল পেড়ে এনে নুন দিয়ে সেই সব কাঁচা কুল তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিল। পাকা কুল সে খায় না। যেগুলি একেবারে কাঁচা, কষাটে সেগুলি খেতেই তার ভারি আনন্দ। জঙ্গলে অনেক জায়গায় কুলের গাছ আছে। আছে আতার গাছ। সেখানে রাশি রাশি কুল-আতা সব ভোক্তার অপেক্ষায় থাকে। জঙ্গলের নিরামিষাশী জীবজন্তু থেকে পাখিদের দল ওই খেয়ে দিন গুজরান করে। তবে তাদের আধিপত্য নিরঙ্কুশ নয়। আদিবাসীদের এক-একটা দল যখন জঙ্গল চষে কুল-আতা পেড়ে শহরে চালান দেয়, তখন ওই সব গাছ খালি হয়ে যায়। তবে তারা জঙ্গলের বেশি গভীরে ঢোকে না। নানা সংস্কার, নানা ভয়। জঙ্গলের মধ্যে ওত পেতে বসে আছে অজানা সব ভয়। আছে ভুলভুলাইয়া। বাগে পেলে চরকি পাক ঘুরিয়ে একেবারে নিংড়ে শুষে ছিবড়ে করে ফেলে দিয়ে যাবে। বেঘোরে প্রাণটি যাবে। সে কারণেই তারা মোটামুটি একটা এলাকা নির্দিষ্ট করে তার মধ্যেই তাদের অপারেশন চালায়।
আরও পড়ুন:

পাখি সব করে রব, পর্ব-১: সবুজ সুন্দরী মুনিয়া

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫: চন্দ্রমণির বধূবরণ

সরকারি জঙ্গলে অনেক সময় পুরাতন গাছ কাটার জন্য ইজারা দেওয়া হয়। সে বছর ওই জায়গার সমস্ত কুল-আতা-মহুয়া ইত্যাদি গাছের থেকে আর ফল পাড়ার উপায় থাকে না। আদিবাসী মহিলারা অনেক সময় গোপনে কুল-আতা-নরম শালপাতা পেড়ে চেনা রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তা ধরে জঙ্গলের বাইরে বের হয়। জঙ্গলকে যারা চেনে, তারা যে কত পথ জানে, তার ইয়ত্তা নেই। নুনিয়াও জানে। অন্যদের চেয়ে বরং বেশি জানে। এই জঙ্গলের গভীরে, আরও গভীরে যাওয়ার এবং সেখান থেকে বাইরে বেরোনোর যে কত বিচিত্র পথ আছে, নুনিয়ার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। তার উপর সে গাছ বাইতে জানে। জঙ্গলের জায়গায় জায়গায় বুনো লতার ঝাড় এ-গাছ থেকে ও-গাছ জড়িয়ে দীর্ঘকাল ধরে বসতি বানিয়ে আছে। তাদের লতাগুলি একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে বেশ শক্তপোক্ত রজ্জুর মতো হয়ে গিয়েছে। নুনিয়া চেনে কোন লতা ধরে ঝুলে এ-গাছ ও-গাছ সে বাইতে পারে। অনেক সময় ভুলও হয় তার, পড়ে হাতে-পায়ে, কোমরে লাগে। ধীরাজদা বকুনি দেয়। চার্চের হাসপাতাল থেকে নিজের কোমরে চোট লেগে ব্যথা বলে ওষুধ চেয়ে এনে দেয়। সেরেও ওঠে সে।

সাইকেল জন হেমব্রম তৃতীয় বারের জন্য দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে থুতু ছুঁড়বে বলে ভাবছে, তার আগেই নুনিয়া মৃদু স্বরে জবাব দিল, “কুল খাচ্চি বট্যে!”

“কুন গাছ থিক্যা খেলি বট্যে? জানিস লাই, ইবারে ইজারাদারই খানটা গাছ-কাটার ইজারা লিইনচে?”
“আমি তো হিথা থেকে লি নাই বট্যে! উ… উধারের গাছে হইনচিল, সিথ্যা থেক্যে এই ক’টা কুল লিইনচি!” বলে সে কোঁচড় খুলে কুলের পরিমাণ দেখিয়ে আস্বস্ত করে।

সাইকেল উসখুস করে। বলে, “কুন সময় থেকে ইখানে আছিস তুই? কাউরে দেকেচিস ইখানে?”

“কারে দেকব? আমি তো এই কিছু আগে এলাম বট্যে গো”, মিথ্যে বলল নুনিয়া, সে এখানে আছে সেই ভর-দুপুর থেকে। গাছের মাথায় পাতার আড়ালে বসে ছিল। অনেক কিছু দেখতে পাওয়া যায় তাতে, কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পায় না।

“হুঁ”, চিন্তিত মুখে সাইকেল হেমব্রম তার দিকে তাকায়, “ঝুট বাত বলচিস না তো? তাহলে কিন্তু তুর কপালে দুঃখ আচে!” সাইকেলের গলার স্বরে কী হুমকি?

“আমি ঝুট বাত ক্যানে বুলবো? ঈঁ দ্যাকো, কী বুলচ?” নুনিয়া বিস্ময়ের ভান করে। জীবন তাকে শিখিয়েছে অনেক কিছুই। সে জানে, সাইকেল হেমব্রম কেন এত চিন্তিত তার এখানে থাকার সময়কাল নিয়ে।

“আচ্ছা, ইখানে যখন এসেছিলি, কিচু কী দেকেচিলি?”

“কী দেখব?” নুনিয়া জিজ্ঞাসা করে অবাক গলায়।

“না, মানে”, ইতস্তত করে সাইকেল, “কিচু জিনিস ই-খানে পড়ে আচে কি না সেতাই জানতে চাইচি!”

“হ্যাঁ। কিন্তু কী জিনিস সিটা না বুললে আমি কী করে বুঝব!”

“ই ধর কোন সিগারেটের প্যাকেট, কিংবা ধর লুটবুক, অন্য কিছুও হতে পারে! দেখিস লাই?”

“না তো! কিচু দেকি লাই আমি। কারও কিচু কী পড়ে গিইঞচে? খুঁজবো?” নুনিয়া খোঁজবার জন্য ঝুঁকে পড়ে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১০: আমাদের কোনও শাখা নেই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৯: গাধা পিটিয়ে ঘোড়া

সাইকেল হঠাৎ তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। “তুকে খুঁজতে বুলেচি আমি?”

“না, তুমিই তো বুললে, ইখানে কিচু পড়েচে কি না তা…”

“ভাগ শালী! ইখানে বাবুরা পিকনিক করতে করতে এসেছিল, বাবুর একটা জিনিস পাচ্চে না, ইথেই হুটেল থেক্যে ম্যানেজার বাবু হামাকে বুলল কি না, যা সাইকেল যা, একবার দিখে আয়। তাইতে এসেচি। তুকে কুছ কাম করতে বলিনি, বুঝলি?”

নুনিয়া ঘাড় হেলিয়ে জানায়, সে বুঝেছে।

“যা ভাগ ইখান থেকে এখন। আর হ্যাঁ, ইখানে একদম বুসবি না তুই! যা পালা!” বলে তাকে তাড়িয়েই দিতে চায় সাইকেল।

নুনিয়া ভালো মানুষের মতো মুখ করে উঠে যায়। চলে যেতে যেতে কিছুদূর গিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। সাইকেল অনন্তলতার গাছের ভিড়ে নিচু হয়ে কিছু খুঁজে চলেছে আঁতিপাঁতি করে। তার যেন অন্য কোন হুঁশ নেই। ওই জিনিসটা তাকে পেতেই হবে। একবার অস্ফুট গলায় বলল, “কুথায় যে গেল ! ইখানেই তো ছিলাম, ইখানেই তো দিখেচি বট্যে। তাঞইলে ?”

নুনিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়। তার বিবর্ণ কামিজের মধ্যে থেকে বার করে আনে একখানা মোবাইল ফোন, সস্তা দরের। কিন্তু মূল্যবান। কোথায় যে লুকিয়ে রাখবে এটা সে! ভাবতে ভাবতে সে এগোয়, কুল খাওয়ার কথাও ভুলে যায়।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content