শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

দণ্ডকারণ্যে চলার পথ কি শেষ হয়? দেখা যায় কি পথের প্রান্ত? না কি পথের রমণীয়তায় মুগ্ধ হয় পথিক? পথের ভয়াল রূপে ত্রস্ত হয় তার মন? অদেখা, অচেনা পশু, পাখি, তরুলতা, নদী, সরোবর, পাহাড়পর্বত বিস্ময়াবিষ্ট করে চিত্তকে? রাম, লক্ষ্মণ, সীতা এভাবেই ভয়ে, বিস্ময়ে, পাড়ি দিলেন কত দীর্ঘ বনপথ। এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালেন তাঁরা। দিনের আলো তখন নিভে এসেছে প্রায়। তাঁদের সামনে এক যোজন ব্যাপী এক বিরাট সরোবর। তার টলটলে স্বচ্ছ জল থেকে উঠে আসছে আশ্চর্য গীত, বাদ্যধ্বনি। অথচ কোথাও কোনও জনমানব নেই। বিস্ময় তো জাগলই। বড় কৌতূহলও হল তাঁদের।
রামের সঙ্গে যাত্রী ছিলেন যে মুনিরা, তাঁদের মধ্যে ধর্মভৃত নামে মুনি বললেন, এ হল অতি প্রাচীন পঞ্চাপ্সর সরোবর। মন্দকর্ণি নামে এক মুনি এই স্থানে শিলাতলে বসে কেবলমাত্র বায়ু ভক্ষণ করে দশ সহস্র বছর উগ্র তপস্যা করেছিলেন। দেবতারা ভয় পেয়ে পাঁচ জন নৃত্যগীতপটিয়সী অপ্সরাকে পাঠিয়ে দেন তপস্যার বিঘ্ন ঘটানোর জন্য। এর পর এখানে এসে রূপবতী অপ্সরারা লাস্যে, বিভঙ্গে, সঙ্গীতে প্রলোভিত করতে থাকে মুনিবরকে। শেষে ধর্মজ্ঞানী মুনিরও মন পরিবর্তন হল। পাঁচ অপ্সরাকেই বিবাহ করলেন তিনি। এখন এই সরোবরের নিচে গুপ্তগৃহ তৈরি করে তাঁরা সেখানে সুখে শান্তিতে বাস করেন। সেই অপ্সরাদের গীত, বাদ্যের মনোমোহিনী ধ্বনিই ভেসে আসছে অপার জলরাশির তলদেশ থেকে। এ কাহিনি শুনে আশ্চর্য হলেন সকলে।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৩: সীতার মনে কি আশঙ্কার অশনি সংকেত?

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৭: কোরবা হয়ে সাতরেঙ্গা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৭: অর্থনীতির প্রান্তিকতায় নারী এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

এরপরই তাঁদের চোখে পড়ল কাছেই অনেক গাছপালার গায়ে শুকোতে দেওয়া হয়েছে চির, বল্কলবসন। বুঝতে অসুবিধা হল না তাঁরা চলে এসেছেন মুনিদের আশ্রমমণ্ডলে। বহু মুনি-ঋষির বাস সেখানে। আপাতত এই গন্তব্যেই পৌঁছতে চেয়েছিলেন রাম। বিভিন্ন আশ্রমে দিন কাটতে লাগল তাঁদের। কোথাও এক মাস, কোথাও চার মাস, ছয় মাস বা এক বছর। ইচ্ছে মতো অরণ্যদেশে ভ্রমণ করে, ঋষিদের সান্নিধ্যে সময় কাটিয়ে কেটে গেল দশ বছর। তারপর আবার তাঁরা ফিরে এলেন সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রমে। রাম এবার সাক্ষাৎ করতে চান মহাতপা, মহাতেজা অগস্ত্য মুনির সঙ্গে। সুতীক্ষ্ণ মুনি পথ নির্দেশ দিলেন তাঁকে। তাঁর আশ্রম থেকে দক্ষিণ দিকে চার যোজন পথ অতিক্রম করে তবে অগস্ত্য মুনির আশ্রম। সেই পথে সুরম্য বনপ্রদেশে পিপুল গাছে ঘেরা, পদ্মসরোবরের ধারে এক ছায়াশীতল আশ্রমে বাস করেন অগস্ত্যের প্রাণপ্রিয় অনুজ। সুতীক্ষ্ণ রামকে নির্দেশ দিলেন দীর্ঘ পথযাত্রায় সেখানে রাত্রিবাসের জন্য।

আবার শুরু হল যাত্রা। বহু পথ অতিক্রম করে ক্রমে এল অগস্ত্যের প্রিয় অনুজের আশ্রম। বিভিন্ন চিহ্ন দেখে তাঁরা নিশ্চিত হলেন এ স্থানটির কথাই সুতীক্ষ্ণ বলেছিলেন। স্থানটি আগে মানুষের বাসযোগ্য ছিল না। সেখানে এক ভয়াল পরিবেশ বিরাজ করত। কত যে মুনির প্রাণনাশ হয়েছে সেখানে, তার ঠিক নেই। কিন্তু মহাতেজস্বী অগস্ত্যের হস্তক্ষেপে এ স্থান এখন বাসযোগ্য। কীভাবে তা সম্ভব হল, সে কাহিনি রাম লক্ষ্ণণকে বললেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১: নাথানিয়্যাল গোবিন্দ সোরেনের গল্প

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২: এখানে দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, বাণিজ্যনীতি এবং বৈদেশিক নীতির চর্চা করা হয়েছে

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫২: প্রাকৃতিক উপায়ে মাছের ফলন বাড়াতে পুকুরে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণার ভারসাম্য ঠিক রাখা জরুরি

বাতাপি আর ইল্বল নামে দুই দুর্ধর্ষ পরাক্রমী অসুর বাস করত এই অরণ্যে। তারা যেমন শক্তিশালী, তেমনই নিষ্ঠুর ছিল। কত অসহায় ব্রাহ্মণের যে প্রাণ গিয়েছে তাদের হাতে, তার ইয়ত্তা নেই। ইল্বল ছলনা করে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করত, সংস্কৃত বাক্য বলত, শ্রাদ্ধকর্মে নিমন্ত্রণের ছলে ডেকে আনত ব্রাহ্মণদের। আর বাতাপি নিত মেষের রূপ। ইল্বল মেষটিকে শ্রাদ্ধোচিত কর্ম অনুসারে কেটে, রান্না করে মাংস খাওয়াত ব্রাহ্মণদের। আহারাদি শেষ হলে ইল্বল চিৎকার করে হাঁক দিত, ‘বাতাপি, বেরিয়ে আয়।’ তখন বাতাপি ভেড়ার মতো শব্দ করতে করতে ব্রাহ্মণদের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসত।

এ ভাবে দুই ভাই মাংসের লোভে প্রতিদিন নির্দয় ভাবে কত হাজার ব্রাহ্মণকে সংহার করেছে তার ঠিক নেই। একথা এক সময় মহাতেজস্বী অগস্ত্য মুনি জানতে পারলেন। শেষে একদিন দেবতাদের অনুরোধে তিনি পরিস্থিতি দেখতে গেলেন। উদ্দেশ্য, দুই ক্রূরকর্মা অসুরকে পরাস্ত করা। তাঁকে আসতে দেখে ইল্বল মনে মনে ভারি খুশি হল। সে বিনীতভাবে মুনিকে বলল, ‘ভগবন্, আপনি আজ এখানে আহার করবেন।’ মুনিও এতে সম্মতি প্রকাশ করলেন। তখন ইল্বল একটু হেসে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি একাই সম্পূর্ণ মেষটি আহার করবেন?’ অগস্ত্যও মনে মনে হেসে সম্মতি জানিয়ে বললেন— “হে দানশীল, আমি দীর্ঘকাল তপস্যা করে ভীষণ ক্ষুধার্ত। শ্রাদ্ধে একটি মেষ আমি একাই খেয়ে ফেলতে পারব। “ইল্বল আর কি করে। মুনিবাক্য শিরোধার্য করে গোটা মেষটিই আহারের জন্য অগস্ত্যের সামনে এনে দিল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৮: সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন পঞ্চম

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: ডাব ও নারকেলের ইতিকথা

এদিকে, ইল্বলের সামনেই অগস্ত্য মেষরূপী বাতাপিকে খাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। মনে মনে ভাগীরথী গঙ্গাকে আহ্বান করলেন তিনি। গঙ্গা এসে তাঁর কমণ্ডলুর মধ্যে প্রবেশ করলেন। সেই প্রচ্ছন্ন গঙ্গাজল গ্রহণ করে জপ ও আচমন সেরে তিনি সম্পূর্ণ মেষটি আহার করে ফেললেন। কিছুমাত্রও অবশিষ্ট থাকল না। ইল্বল জানেনা পরম তেজস্বী, কোপনস্বভাব অগস্ত্য মুনির শক্তি। সে নিয়ম মতো মুনির খাওয়ার পর হাঁক দিল, “বাতাপি বেরিয়ে আয়।” কিন্তু বহু ডাকাডাকির পরেও বাতাপি মুনির উদর ফুঁড়ে বেরিয়ে এল না। অগস্ত্য তখন হাসতে হাসতে বললেন, “তোমার ভাইয়ের তো আর বেরিয়ে আসার ক্ষমতা নেই। তাকে আর দেবতারাও ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তাকে আমি হজম করে ফেলেছি।”

এ কথা শুনে ক্রুদ্ধ ইল্বল মুনিকে বধ করার জন্য ছুটে এল। কিন্তু অগস্ত্যের অগ্নিসম দীপ্ত তীব্র দৃষ্টিপাতে নিমেষে সে ভস্ম হয়ে গেল। সেই থেকে রাক্ষস, নিশাচরেরা অগস্ত্যের ভয়ে এই অরণ্যদেশ এড়িয়ে চলে। অগস্ত্য মুনি তখন এই বন প্রদেশে গড়ে তুললেন এক রম্য আশ্রম। তাঁর স্নেহের অনুজ দায়িত্ব নিলেন সে আশ্রমের। লোক জগতের মঙ্গল কামনায় অগস্ত্যমুনির এই প্রয়াসকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করে রাম লক্ষ্মণ ও সীতাকে নিয়ে সন্ধ্যাকালে প্রবেশ করলেন সেই আশ্রমে।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content