বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

রাতে হাসপাতাল এবং চার্চের ভিতরের অংশের আলো ছাড়া আর কোনও আলো জ্বলে না কোথাও, বিশেষ করে আবাসিকদের হোস্টেল যেখানে আছে, সেই অংশে কয়েকটি বাল্ব ছাড়া আর কিছুই জ্বলে না রাতে। তাও গাছপালার অন্ধকারে বাল্বের আলো পর্যাপ্ত বলে মনে হয় না। আবাসিকদের বিল্ডিংয়ের গায়েই খেলাধুলার জায়গা, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, তার ওপাশে তিন তলা স্কুলবাড়ি। সেখানেও একতলায় সামান্য কয়েকটি বাল্ব ছাড়া আর কিছু জ্বলছে না। জ্বলার নিয়মও নেই। এখানকার আবাসিকদের বয়েস-গার্লস দু’টি ব্লক। দুটির মাঝখানে অনেকটা দূরত্ব নেই যদিও, তবে পাশাপাশিও নয়।

ছেলেদের হোস্টেলের থেকে কিছুদূর গিয়ে রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, তার বাঁকের মুখে একখানা বেশ বড় পুকুর, তার পাশেই বড় বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা মেয়েদের হোস্টেল। এর ঠিক পিছনে ফুল-ফলের একখানা বাগান, তার ওপাশে চার্চের সীমানা-প্রাচীর। তার ওপারে কিছুটা চাষের জমি, তারও পরে জঙ্গল-এরিয়া শুরু। চাষের জমিগুলি চার্চে যাঁরা দৈহিক শ্রম দেন, তাঁদেরকে দেওয়া হয়েছে। এঁরা সকলেই স্থানীয় আদিবাসী। এর বিনিময়ে তাঁরা চার্চে নানা কাজ করে থাকেন এবং দু’বেলা খাবার পান। মাইনে কিছু দেওয়া হয় না। তবে হাতখরচ হিসেবে সামান্য হপ্তার ব্যবস্থা আছে।

এখানে উভয় হোস্টেলের আবাসিকদের সন্ধ্যে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে ডিনার করে নিতে হয়। তার পরে কেউ খেতে চাইলেও খেতে পাবে না—এমনই নিয়ম। রাত ন’টায় সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। গরমের দিনে ভোর চারটে, আর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ভোর পাঁচটায় উঠে পড়তে হয় সবাইকে। সকাল এবং সন্ধ্যের প্রার্থনায় মোটামুটিভাবে সকলকেই উপস্থিত থাকতে হয়, যদি না শারীরিক বা অন্য কোন অসুবিধা থাকে। ফাদার আন্তোনিও বিশেষ কয়েকটি দিন ছাড়া সকালের প্রার্থনার সময় কখনই উপস্থিত থাকেন না। তাঁকে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। তার উপর বাইবেলের কাহিনিকে অলচিকি ভাষায় সহজবোধ্য করে একখানি বই লিখছেন তিনি, সে-কাজেও অনেক রাত অবধি পড়াশুনা করতে হয়; ফলে তাঁর বিছানায় যেতে অনেক দেরি হয়। ফলে সকালের প্রার্থনায় তাঁর পক্ষে উপস্থিত থাকা খুব কষ্টকর। তিনি উপস্থিত থাকেনও না।
তবে সন্ধ্যের প্রার্থনার সময় চার্চে থাকলে তিনি উপস্থিত থাকেন। এবং আগাগোড়া সমস্ত সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন, সকলের প্রার্থনাকালীন মুখচোখের ভাব দেখেন, কারা-কারা অনুপস্থিত নিজের চোখে তার হিসেব নেন এবং পরে অবস্থা বুঝে অনুপস্থিত ছাত্রছাত্রীর নামে শো-কজ লেটার পাঠান। উত্তর সন্তোষজনক না হলে না-কি শাস্তির ব্যবস্থা আছে। অন্ধকার ঘরে খাবার-জল ছাড়া টানা তিন দিন আটক্‌ থাকা, খাদ্য-পানীয় কিছুই না মেলা, চাবুকের শাসন—সব কিছুর মধ্যেই ফাদার আন্তোনিও মধ্যযুগের আবহ ধরে রেখেছেন। কেবল মানুষগুলি একালের এই যা।
আগে যিনি ফাদার ছিলেন, সেই ফাদার রডরিগ কিন্তু ছিলেন দয়ার অবতার। গুরুতর অপরাধ করলেও শাসন করতেন না, কাছে ডেকে বোঝাতেন। তাঁর শাস্তি ছিল অভিনব। একদিন সারারাত জেগে বাইবেলের নির্দিষ্ট অংশ কপি করে তার ব্যাখ্যা শোনাতে হবে ফাদারকে। ফাদার রডরিগ নিজেও সেই দিন জাগতেন। দণ্ডিতের সঙ্গে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে—তাকে তিনিও প্রকৃত বিচার বলে মনে করতেন। তাঁর সময়ে শাস্তিও ছিল সুখের। কেক, চকোলেট, হট কোকো সহযোগে বাইবেল পাঠ করতে কার না ভালো লাগে? ছেলেপিলেরা ইচ্ছে করে ছোটখাট অপরাধ করত, অনেকে আবার অপরাধ করে নিজেই বলতে যেত, ‘ফাদার আমি অমুক অপরাধ করেছি। আমায় শাস্তি দিন!’ মেয়েদের অবশ্য শাস্তির বালাই ছিল না।

এই চার্চে কিছু নান আছেন, যদিও সংখ্যায় কম। তাঁদের উপর রডরিগের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, মেয়েরা হল মাতা মেরির অংশ। তারা যদি কোনও ভুল কিংবা আপাত বিচারে অপরাধও করে, তাহলে তাকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে হবে। বিশেষ করে বাইরের সমাজ যেহেতু তাদের প্রতি হৃদয়হীন আচরণ করে থাকে, চার্চ কখনই তা করবে না। বরং তারা যাতে ভালোবাসার স্পর্শ পায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ভালোবাসাই যে এক এবং একমাত্র উপায় অপরাধীকে পাপের পঙ্কিল পথ থেকে উদ্ধার করার, সে-ব্যাপারে তাঁর মনে কোন সংশয় ছিল না। নুনিয়াকে তিনি আরও অতিরিক্ত স্নেহ করতেন।

শোনা যায়, নুনিয়ার মা নুনিয়ার জন্মের আগে থেকেই চুক্তিভিত্তিক স্বেচ্ছাশ্রম দিতেন ফাদারের কাছে। সেই থেকে ফাদারের সঙ্গে তাঁর স্নেহ-প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে, কালধর্মে যা নুনিয়ার অধিকারে দাঁড়িয়েছে। ফাদার রডরিগের বিশেষ স্নেহের পাত্রী বলেই তার আচরণে বিরক্ত হলেও ফাদার আন্তোনিও নুনিয়ার বিরুদ্ধে কোন বড় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা এখনও পর্যন্ত ভাবেননি। তাছাড়া ফাদার রডরিগ সারাদিনের শেষে একবার নুনিয়াকে না-দেখতে পেলে এখন বিরক্ত হন। ফলে সকালে কিংবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্ধায় নুনিয়ার দেখা না-পেলে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন। তাঁর ধারণা, নুনিয়াকে কেউ কিডন্যাপ এবং পরে মার্ডার করবে। ওই বুধন মাহাতোর মতো ! ফলে তিনি ভয়ে ভয়ে থাকেন। নুনিয়াকে একবার দেখতে না-পেলে অস্থির বোধ করেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

এই কারণেই আন্তোনিও এতদিন চুপ করে এসেছেন। না হলে কবেই অন্যত্র তাঁদের যে শাখা-মিশনগুলি আছে, সেখানে নুনিয়াকে পাঠিয়ে দিতেন!

রাত গভীর হয়েছে। চার্চের এই অংশে বিশেষ কোন সাড়াশব্দ নেই। ফাদার আন্তোনিও থাকেন চার্চের পিছনের দিকে গার্লস্‌ হোস্টেল ছাড়িয়ে একখানা নতুন বাড়িতে। রাত্রে এখানেই তিনি বিশ্রাম নিতে আসেন। দোতলা ছিমছাম বাড়ি। নীচে তিনটি ঘর, উপরে দুটি। ফাদারের শয়নকক্ষ উপরের দুটির মধ্যে একটিতে। অন্যটিতে তিনি লেখাপড়া করেন, অফিসের কাজ থাকলে তাও করেন, তারপর ঘুম পেলে চলে আসেন নিজের শয়নকক্ষে। দোতলায় তাঁর কাজের ঘরের জানালা দিয়ে গার্লস্‌ হোস্টেলের সামনের দিকটি দেখা যায়। অন্ধকারে সারারাত হোস্টেলের সিঁড়ির আলোগুলি জ্বলে, কিংবা সদ্য লাগানো এলইডি ল্যাম্পগুলি ম্যাড়মেড়ে আলো ছড়ায়। তাতে রহস্যময় বলে মনে হয় দূর থেকে। ফাদার দোতলার ছোট টেরেসে বেরিয়ে আসেন। পায়চারি করেন। মোবাইলে আলো জ্বেলে দেখে নেন, তাঁর কোয়াটার্সের গা-ঘেঁষে বেড়ে ওঠা রাধাচূড়ার গাছে পাখিদের যে-বাসা আছে, সেখানে ভাম আক্রমণ করছে কি-না।

আগে আরও অনেক পাখির বাসা ছিল, কিন্তু ইদানিং কোনও জায়গা থেকে এক বুড়া ভাম এসে নির্বিচারে পাখির ছানাদের, পাখিদের মেরে খেয়ে প্রায় উজাড় করে দিয়েছে। যে-টুকু অবশিষ্ট আছে, তা যাতে ভাম না খেয়ে যায়, সে-জন্য অনেক রাত পর্যন্ত মোবাইলের টর্চ ব্যবহার করে যেন সতর্ক করে দিতে চান পাখি এবং ভাম উভয়পক্ষকেই যে, তিনি জেগে আছেন! দূর থেকে চার্চের গার্ডেরা সেই আলো দেখে ভাবে, আন্তোনিও সাহেব রাত জেগে লেখাপড়া করার ফাঁকে ফাঁকে ভাম তাড়াচ্ছেন। হেসেই কুটিপাটি হয় তারা। ও-ভাবে কি আর ভাম তাড়ানো যায়?
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৩: তুরুপের তাস

রাতের দিকে চার্চে অনেকসময় মালপত্র আসে। খাবারদাবার, ওষুধ-বিসুধ, ফার্নিচার ইত্যাদি। সেই সমস্ত দিনে ফাদার জেগেই থাকেন প্রায়। সাইকেল মাহাতো আসে। ফাদারের খাস লোক সে, মাল ওঠা-নামার গোটা কাজটা সে বুঝে নেয়। চার্চের আরও কয়েকজন থাকে। তবে মাল খালাস হয়ে না-যাওয়া পর্যন্ত ফাদারের সোয়াস্তি নেই। কেবল খালাস নয়, কোন মেশিন বা কিছু খারাপ হয়েছে, তা পাঠানো হয় একই গাড়িতে নির্দিষ্ট জায়গায়। অনেকসময় হোস্টেলের ছেলেমেয়েদের টিম নিয়ে চার্চের বিশেষ বাস ছাড়ে রাতের দিকে। যারা এখানে অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না কিংবা চার্চের কর্মপদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষ আছে, তাদের অন্য ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যদি তারা পরবর্তীকালে এই চার্চে ফিরে আসার মতো মানসিক সুস্থিতি অর্জন করে, তাহলে তাদের আবার ফিরিয়ে আনার নিয়ম আছে। এই নিয়ম অনেককাল থেকেই প্রচলিত আছে। চার্চ তো কেবল এইটুকু নিয়ে নয়। বেশ কয়েকটি জায়গায় চার্চের ব্রাঞ্চ আছে।

পার্শ্ববর্তী রাজ্যেই দুটি, আর অন্য রাজ্যে আরও দুটি। মোট পাঁচটি ব্রাঞ্চ এ-দেশে। বিদেশেও বেশ কয়েকটি জায়গায় চার্চের শাখা রয়েছে। চার্চের মেইন সেন্টার বিদেশে। সেখান থেকেই এর কর্মপদ্ধতি ঠিক হয়। ফাদারেরাও এক ব্রাঞ্চ থেকে অন্য ব্রাঞ্চে ট্র্যান্সফার হন। অনেকে এ-দেশ থেকে মেইন সেন্টারে ফিরেও যান। ইদানীং যদিও ট্র্যান্সফারের ব্যাপারটি বন্ধ আছে। বিশেষ করে ফাদার রডরিগ এখান থেকে যেতে চান নি। ভারত বিশেষ করে এই পিশাচপাহাড় তাঁর কাছে খুব প্রিয় একটি স্থান। এর আগে এ-দেশে আরও একটি ব্রাঞ্চে ছিলেন, সেটি ঝাঝার কাছে। সেখানে যদিও চার্চের পরিধি আরও বড়, কিন্তু পিশাচপাহাড়ের মতো এত সুন্দর নয় সেখানকার ব্যবস্থাপনা। এখানে আসা ইস্তক রডরিগ যেন হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন। বার্ধক্য তাঁকে পেড়ে না-ফেললে, আন্তোনিও এখানে আসার সুযোগই পেতেন না। আর আন্তোনিও এখানে এসেছেন সরাসরি।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

এর আগে তিনি মধ্য-প্রাচ্যে চার্চের একটি ছোট্ট ব্রাঞ্চে সার্ভিস দিয়েছেন। সেখান থেকে তাঁকে এখানে পাঠানো হয় রডরিগকে সাহায্য করার জন্য। পরে রডরিগ অসুস্থ হলে তাঁরই জায়গায় আন্তোনিকে বলবৎ করা হয়। রডরিগের আমলেও ছেলেমেয়েদের এক ব্রাঞ্চ থেকে অন্য ব্রাঞ্চে স্থানান্তরিত করা হত। চার্চের বক্তব্য এই যে, অনেক সময়েই দেখা গিয়েছে স্থানান্তরিত হলে পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাব সরাসরি ছেলেমেয়েদের উপর পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা বদলে যায়। বেশিরভাগই এখানে আর ফিরে আসতে চায় না। কেউ কেউ বড় হয়ে চার্চের সঙ্গেই থেকে যায়, তবে বেশিরভাগই নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করে।

অনেকে চার্চের সহায়তায় বিদেশেও প্রতিষ্ঠিত হয়। আগে যেদিন-যেদিন এই স্থানান্তরিকরণের কাজটি হত, সেদিন ফাদার রডরিগ জেগে থাকতেন। যারা চলে যেত এই ব্রাঞ্চ ছেড়ে, তাদের জড়িয়ে ধরে দু-ফোঁটা হলেও চোখের জল ফেলতেন তিনি। আন্তোনিও অবশ্য চোখের জল ফেলেন না, তাঁর মুখ এমন ভাবলেশহীন যে, মনের ভাব মুখে ফুটে ওঠে না। তবে দিনকতক খুব চুপচাপ থাকেন তিনি, কারুর সঙ্গে দরকারি বিষয় ছাড়া তেমন কথাবার্তা বলেন না। সকলেই বুঝতে পারে, ফাদার মনঃকষ্টে আছেন। দুঃখ কতটা পান ফাদার আন্তোনিও তা বলা যায় না, তবে মনে মনে ভারি স্বস্তি বোধ করেন তিনি। আর কে না-জানে, সুখের চেয়ে সোয়াস্তি ভালো?

আজ একটি গাড়ি আসবার কথা। হাসপাতালের প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ-বিসুধ আসবে সে-গাড়িতে। একই সঙ্গে কিছু মেশিন খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন, সেগুলি নিয়েও ঢুকবে গাড়ি। সাইকেল মাহাতো আছে। মাল খালাস করে এখানকার মাল লোড করার পর গাড়ি রওনা হলে সে চার্চেই কোথাও একটা থেকে যাবে।বেশি রাতে জঙ্গলের রাস্তায় কেউ যাওয়ার চেষ্টাও করে না। সাইকেলও না। আর এখন তো কালাদেওর ভয়ে কেউ সন্ধ্যের পরে জঙ্গলের রাস্তা মাড়ায় না খুব প্রয়োজন না হলে।

আন্তোনিওর টর্চের আলো খানিক আগেও গার্ডেরা দূর থেকে দেখেছে। তার শয়নকক্ষে আলোও জ্বলছিল। এখন অবশ্য আলো নিভে গিয়েছে। ফাদার শুয়ে পড়েছেন বোঝাই যায় কারণ আর কোন আলোর ইশারা তাঁর কোয়াটার্সের দিক থেকে দৃশ্যমান হচ্ছে না। আজ অমাবস্যা। ফলে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। বাতাসে ঠাণ্ডার আমেজ ক্রমেই বাড়ছে, যত রাত বাড়ছে। পাখিদের মধ্যে কেউ-কেউ হঠাৎ ডানা ঝাপটে ডেকে উঠল। তারপর আবার সব নিস্তব্ধ। আন্তোনিওর কোয়াটার্সের থেকে কিছু দূরে একটি ঝুপসি গাছের আড়ালে একজন কেউ দাঁড়িয়ে ছিল।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

আপাদমস্তক ডার্ক শেডের পোশাকে ঢাকা শরীর। লোকটি অস্থির হয়ে উঠছিল এবং বার-বার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। সেকেলে ঘড়ি নয়, স্মার্ট ওয়াচ। লোকটি যেন কারও আসার অপেক্ষায় আছে। গার্ডেরা এই দিকে আসে না তেমন। গাছপালা-ঝোপঝাড়-শিয়ালকাঁটার জঙ্গল আছে বলে এই দিকে অন্ধকারে আসাটা খুব সুখকর নয়। সেই কারণেই এই জায়গাটায় সাধারণভাবে নিরাপদ হলেও সাবধানের মার নেই। লোকটি হয়তো সে-কারণেই অস্থির হচ্ছিল। এমনস্ময় পিছনে পায়ের শব্দ হল। খুব মৃদু কিন্তু এই নির্জন অন্ধকারে তা ভারি শোনালো। মুহূর্তে অপেক্ষমান আগন্তুক ঘুরে তাকাল।
“কে?”
“শূন্য ছয় নয় আট জিরো ফোর!” আগুন্তক উত্তর দিল।
“সব ঠিকঠাক?”
“ইয়েস স্যার। আজ রাতেই নির্দিষ্ট জায়গায় মাল পৌঁছে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না।”
“চিন্তা করব না বললেই কি হয়? সামান্য ভুলচুক হলে তার খেসারৎ কে দেবে?”
“এতদিন কী হয়েছে যে আজ হবে?”
“এতদিন পরিস্থিতি শান্ত ছিল। এখন আর তা নয়!”
“মেশিনগুলি সারিয়ে-সুরিয়ে ঠিক কাজ চালানর মতো করে ফেলবে ওরা। ওয়ার্কশপে কাজের জন্য লোকে মুখিয়ে আছে সব!”
“হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি ওগুলি ব্যবহারের উপযুক্ত করে দিয়ে যাও। এদিকে সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে!”
“কী সব বলছেন? আপনার মুখে ও-শব্দটি মানায় না ! আপনার সাহসিকতা যদি আমাদের সকলের মধ্যে থাকত, তাহলে আর চিন্তা ছিল না!”
“বেশ! ও-সব কথা বাদ দাও। যা কাজের ভার নিয়েছ করে ফেলো। আর কিছুদিন গেলেই আমি দেশে ফিরে যাবো। যথেষ্ট হয়েছে। আর এখানে নয়!”
“তাহলে আমাকেও সঙ্গে নেবেন!”
“সে দেখা যাবে। আপাতত আজকের কাজটা মিটিয়ে ফেল! চারপাশে হায়েনারা হাঁ করে আছে। খুব সাবধান। ওরা ছিঁড়ে খেতে ওস্তাদ!”
“কত হায়েনা দেখলাম! ভালো কাজে কেউ বাধা দিলে আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়, সে-তো জানেন। আমাদের মধ্যে যদি কেউ বেইমানি করে তার উচিত শিক্ষা আপনাকে দিতে হবে না। আমিই দেবো। আপনি কেবল বাধা দেবেন না!”
“আগে কখনও দিয়েছি?”
“তা দেন নি, কিন্তু দিতে কতক্ষণ? আপনাকেও তো নিজের ইমেজ ধরে রাখতে হবে? নাহলে আপনারই সমস্যা। আর আপনি সমস্যায় পড়লে আমরা বাকি থাকি কী করে?”
“বেশি কথা বলতে হবে না। যে-পথে এসেছ, সে-পথে ফিরে যাও। সাবধান কেউ যেন দেখে না ফেলে!”
“হুম! জানি! আচ্ছা, আসি। ও হ্যাঁ। প্যাকেটটা তো দিতে ভুলেই গিয়েছি!” বলে কোমরের গেঁজ থেকে আগন্তুক একটা প্যাকেট বার করে অপেক্ষমান ব্যক্তির হাতে দিল। সে সেটা নিল। মুখে কিছু বলল না।
“তাহলে আসি?”
“এসো!”
“কাজ হয়ে গেলে এসএমএস করে দেবো!”
“হুম! এখন যাও!”
আগন্তুক একবার বক্তার মুখের দিকে ভালো করে দেখল, মনে মনে একটা কাঁচা খিস্তি মারল। তারপর যে-পথে এসেছিল, সেই পথেই হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
রাত আবার নির্জন নিঝুম। হায়েনারা ঝোপেঝাড়ে অপেক্ষা করছে কি-না পূর্ববর্তী ব্যক্তিটি জানে না। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে। ওদের দাঁত-নখ ধারালো কম নয়। অসতর্ক হলেই বিপদ! —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content