শুক্রবার ২৮ মার্চ, ২০২৫


মা সারদা। সংগৃহীত।

সরযূদেবী রাধাষ্টমীর দিন মা সারদার সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখেন যে, তিনি স্নানে যাবেন বলে তেল মাখছেন। এই সময়ে প্রণাম করতে নেই বলে তিনিও করেননি। লৌকিক জীবনে জগজ্জননীও লৌকিক মর্যাদা রক্ষা করে চলেন। মা সারদা গঙ্গাস্নান করে আসার পর তিনি তাঁর শ্রীচরণের পুজো করেন ফুলচন্দনাদি দিয়ে। শ্রীমা তাঁর পায়ে তুলসীপাতা দিতে নিষেধ করেন। এবার শ্রীমা জলখাবার খেতে বসলেন। আর তাঁর পাশে বসে প্রত্যেক পদের প্রসাদ পেলেন সরযূ। শালপাতায় প্রসাদ খাবার সময় তার নাগ মহাশয়ের কথা মনে পড়ল। সে বলল, ‘মা, শালপাতায় প্রসাদ পেলেই নাগ মহাশয়ের কথা মনে পড়ে’।
শ্রীমা বলেন যে, তাঁর কি ভক্তিই ছিল। ‘এই তো দেখ শুকনো কটকটে শালপাতা। একি কেউ খেতে পারে? ভক্তির আতিশয্যে প্রসাদ ঠেকেছে বলে পাতা খানা পর্যন্ত খেয়ে ফেললে। আহা কি প্রেমচক্ষুই ছিল তার। লালচে চোখে সর্বদা জল ঝরছে। কঠোর তপস্যায় শরীরখানি শীর্ণ। আহা, আমার কাছে যখন আসত আবেগে থরথর করে কাঁপত। এখানে পা দিতে ওখানে পড়ত। তেমন ভক্তি আর কারও পেলাম না’। সরযূ বলল যে, বইয়ে পড়েছি, তিনি যখন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে রাতদিন ঠাকুরের ধ্যানে তন্ময় থাকতেন, তখন তাঁর বাবা বলেছিলেন, এখন আর কি করবি, উলঙ্গ হয়ে ফিরবি আর ব্যাঙ ধরে খাবি! উঠোনে একটা মরা ব্যাঙ পড়ে আছে দেখে নাগ মহাশয় পরনের কাপড়খানি ফেলে দিয়ে সেই ব্যাঙটা ধরে খেয়ে বাবাকে বলেছিলেন, ‘আপনার দুই আদেশই পালন করলুম, আপনি আমার খাওয়া-পরার চিন্তা ছেড়ে ইষ্টনাম করুন’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৭: মা সারদার লিঙ্গপুজো

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯o: ছাতারে

শ্রীমা বলেন যে, আহা কি গুরুভক্তি, কি শুচি অশুচিতে সমজ্ঞান। সরযূ বলল, অর্ধোদয় যোগের সময় কলকাতা ছেড়ে নাগ মহাশয় বাড়ি গিয়েছিলেন। তখন তাঁর বাবা তিরস্কার করে বলেছিলেন ‘গঙ্গাস্নান না করে গঙ্গার দেশ ছেড়ে বাড়ি এলি?’ তবে যোগের সময় সকলে দেখল, উঠোন ভেদ করে জল উঠে একেবারে ভেসে যাচ্ছে। আর নাগ মহাশয় “এসো মা গঙ্গে” বলে অঞ্জলি ভরে সেই জল মাথায় দিচ্ছেন। তাই দেখে পাড়ার সকলে সেই জলে স্নান করতে লাগল। শ্রীমা বললেন যে, ভক্তির জোরে এমন সব অদ্ভুতও সম্ভব হয়। তিনি নাগ মহাশয়কে একখানা কাপড় দিয়েছিলেন, সেটি নাগ মহাশয় মাথায় জড়িয়ে রাখতেন। তাঁর স্ত্রীও ভক্তিমতী ছিলেন। শ্রীমা বলেন, ‘সেবার আমের সময় এসেছিল। এখনো বেঁচে আছে’। এমন সময় সারদা মায়ের কাছে দুজন স্ত্রীভক্ত আসায় কথা আর বেশি এগোয়নি। শ্রীমা উঠে তাদের প্রণাম নিয়ে সরযূকে পান সাজতে বলেন। মহিলা ভক্তদুজনও সাহায্য করায় তাড়াতাড়ি পানসাজা হয়ে গেল।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৯: নাগজাতক— অকৃতজ্ঞ সেই লোকটা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৩: নির্বাসিত অর্জুনের দাম্পত্যজীবনে নতুন সম্পর্কের বিচিত্র সংযোজন

শ্রীমা ঠাকুরের পানগুলো আলাদা করে আগে তুলে দিয়ে আনন্দ করে বললেন, ‘মা লক্ষ্মীরা কত শিগগির পান সেজে ফেললে’। এবার তিনি রোদ পোহাতে ছাদে গেলেন। সঙ্গে ভক্তরাও গেল। সকলে গঙ্গাদর্শন করতে লাগল। এর কিছু আগে আরও দুজন মহিলা ভক্ত আসেন। তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধা সধবা যে ঠাকুরের সময় থেকে আসত। অন্যজন তার ছেলের বৌ। শ্রীমা নিচে নেমে ঠাকুরকে ভোগ দেওয়ার পর মেয়েদের খাওয়ার জায়গা করতে বললেন। সকলে প্রসাদ খেতে বসল। বৃদ্ধা মহিলাটি খেতে খেতে বললেন, ‘আহা, ঠাকুর আমাদের যেসব কথা বলে গেছেন, তা কি আমরা পালন করতে পেরেছি, তা হলে এত ভোগ ভুগবে কে মা? সংসার সংসার করেই মরছি, ওকাজ হল না, সেকাজ হল না, এই কেবল করছি’। একথায় শ্রীমা বললেন, ‘কাজ করা চাই বই কি, কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কেটে যায়। তবে নিষ্কাম ভাব আসে। একদণ্ডও কাজ ছাড়া থাকা উচিত নয়’।
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পর্ব-৬: আকাশ এখনও মেঘলা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৮: দুর্গম গিরি কান্তার ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’

আহার শেষে শ্রীমা খানিক বিশ্রাম করবেন তিনি সকলকেই বিশ্রাম নিতে বললেন। এখন সকলেই তাঁর একটু সেবা করতে চায়। খানিক পরে অন্য মহিলারা চলে গেলে সরযূ ঠাকুরের কথা শোনার আগ্রহে বৃদ্ধাকে বলল, ‘আপনি ঠাকুরকে দেখেছেন?’ বৃদ্ধা বলে, ‘ওমা, দেখেছি বই কি, তিনি যে আমাদের বাড়িতে আসতেন। মা তখন বৌটির মতন থাকতেন’। সরযূ ঠাকুরের কথা আরও জানতে চায় দেখে বৃদ্ধা বলে ‘আমি না না, মাকে বলতে বল’। কিছু পরে শ্রীমা নিজেই বললেন, ‘যে ব্যাকুল হয়ে ডাকবে সেই তাঁর দেখা পাবে। এই তো সেদিন ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত ছেলে তেজচন্দ্র মিত্র মারা গেল। আহা, কত ভাল ছিল, ঠাকুর তার বাড়ি যেতেন। একদিন পরের গচ্ছিত দুশো টাকা ট্রামে তার পকেট থেকে মারা যায়। বাড়ি এসে দেখে সে ব্যাকুল হয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে কাঁদছে আর বলছে, হায় ঠাকুর, কি করলে। তার অবস্থাও ভাল ছিল না যে শোধ দিতে পারবে। সে কাঁদতে কাঁদতে দেখে ঠাকুর সামনে এসে বলছেন, ‘কাঁদছিস কেন? ওই গঙ্গার ধারে ইট চাপা আছে দ্যাখ। সে শিগগির ইটখানা তুলে দেখে সত্যি তো একতাড়া নোট। শরতের কাছে এসে সব বলে। শরৎ শুনে বললে, তোরা তো এখনো দেখা পাস, আমরা কিন্তু আর পাই নে। ওরা পাবে কি? ওরা তো দেখে শুনে এখন গ্যাঁট হয়ে বসেছে। যারা ঠাকুরকে দেখেনি, এখন তাদেরই ব্যাকুলতা বেশি।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৫: সরজমিনে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৩: শরৎকুমারী স্নানাগারের সামনে বসে সারাক্ষণই সাজতেন

ঠাকুর যখন দক্ষিণেশ্বরে, রাখাল- টাখাল সব তখন ছোট। একদিন রাখালের বড় খিদে পেয়েছে, ঠাকুরকে বললে। তিনি তা শুনে গঙ্গার ধারে গিয়ে, ও গৌরদাসী, আয় না, আমার রাখালের যে বড় খিদে পেয়েছে, বলে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন। তখন দক্ষিণেশ্বরে খাবার পাওয়া যেত না। খানিক পরে গঙ্গায় একটি নৌকা দেখা গেল। নৌকাটি ঘাটে লাগতেই তার মধ্য হতে এক গামলা রসগোল্লা নিয়ে বলরামবাবু, গৌরদাসী প্রভৃতি নামলেন। তাই দেখে ঠাকুর তো আনন্দে রাখালকে ডেকে বললেন, ওরে, আয় না রে, রসগোল্লা এসেছে, খাবি আয়। খিদে পেয়েছে বললি যে। রাখাল তখন রাগ করে বলতে লাগল, আপনি অমন করে সকলের সামনে খিদে পেয়েছে বললেন কেন? তিনি বললেন, তাতে কি রে, খিদে পেয়েছে, খাবি, তা বলতে দোষ কি? শ্রীমা বলেন যে, তাঁর ওই রকম ভাব ছিল’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content