বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


রামকৃষ্ণ ও সারদা মা।

একবার এক অপ্রত্যাশিত কারণে শ্রীশ্রীমা পায়ে হেঁটে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে শ্যামপুকুরে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি না কি আমার সেবায় অসন্তুষ্ট, সেই জন্যই না কি তুমি শ্যামপুকুরে চলে এসেছো?” মায়ের কথা শুনে শ্রীরামকৃষ্ণ স্তম্ভিত হলেন বললেন, “এরকম কথা কে বলেছে?” শ্রীশ্রীমা বললেন, তিনি অমুকের কাছে শুনেছেন যে গোলাপ মা এরকম বলেছে। এই কথা শুনে রামকৃষ্ণ ভীষণ রেগে গেলেন বললেন, “সেই বামনি আসুক দেখি এখানে, আমি ওকে উচিত শিক্ষা দেব।” যখন শ্রীরামকৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হতেন কেউ তাঁর কাছে এগোতে পারত না।
এই ঘটনার পরদিনে গোলাপ মা ঠাকুরের কাছে গিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি এরকম কথা বলেছ? যাও ওঁর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাও। ও যদি তোমার উপর অসন্তুষ্ট থাকে, তাহলে আমার কাছেও তোমার ঠাঁই হবে না। তারপর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, “ও সারদা, সরস্বতী সাধারণ মানবের মতো দেখতে হলেও, ও আসলে জগৎ মাতা স্বয়ং। যাঁর কৃপা কটাক্ষে মানুষের জ্ঞান লাভ সম্ভব। ও অবতীর্ণ হয়েছে মানুষকে ঈশ্বর জ্ঞান দান করতে, জগতকে আলোর সন্ধান দিতে।”
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭১: হৃদয়ে প্রভুর দর্শন করলে যেমন মনে সংশয় থাকে না, তেমন অপ্রাপ্তিও থাকে না

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার

সেদিন ঠাকুরের কথা শুনে গোলাপ মা শ্যামপুকুর থেকে কাঁদতে কাঁদতে দক্ষিণেশ্বরে এসে শ্রীমায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন। ‘মা দয়া করে তুমি আমায় ক্ষমা কর, আমি অমুকের কাছে শুনে বলেছিলাম। এরকম বলা আমার উচিত হয়নি। ঠাকুর আমার উপর রাগ করেছেন। তুমি যদি ক্ষমা না করো, আর তাঁকে দর্শন করতে অনুমতি দেবেন না।’ শ্রীমা তার পিঠে মৃদু চাপড়ে দিয়ে বললেন, “তুমি ভুলে যাও, ভুলে যাও, তুমি তো আমার মেয়ে, মা কি কখনো মেয়ের উপর রাগ করতে পারে? ঠাকুরকে বল আমি তোমার উপর সম্পূর্ণ খুশি।’
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৫: বসু পরিবার-এ উত্তমকুমার দিনভর একটি শব্দই রিহার্সাল করেছিলেন, কোনটি?

শ্রীরামকৃষ্ণদেব গোলাপ মায়ের চোখ খুলে দিয়েছিলেন। যার ফলে শ্রীশ্রীমার অনুপম দৈবী মহিমা ও শক্তির তিনি কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। শ্রীমা দীক্ষা দান করে অনেক ভক্তকে বলতেন, “ঠাকুর-ই গুরু, আমি তোমার মা।” ‘মা’ এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। জগতজননী, মাটির ধরাধামে এসে ঘরের মা হয়ে গৃহস্থের সকল কাজ করছেন। সকলের মর্যাদা রক্ষা করছেন, নিজের কোনও কর্তব্য না থাকলেও সকল প্রকার দায়িত্ব সহকারে করছেন। আবার মা হয়ে আর্ত ও পীড়িতকে কোল দিচ্ছেন, এটা ভাবলেই সমস্ত মিথ্যা জ্ঞান সমাহিত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

স্বামীজি যেমন বলতেন, যে জ্ঞানে গুরু উড়ে যায়, সে জ্ঞান জ্ঞান নয়, অজ্ঞান। বিচার করে কূলকিনারা পাওয়া যায় না। তত্ত্ব জ্ঞান যে জগতে প্রতিটি জীবের উপর এমনভাবে প্রয়োগ করা যায়, মাকে না দেখলে বোঝা যায় না। সবার উপর সমান মাতৃত্ববোধ এমনকি, শ্রীরামকৃষ্ণের উপর। কি অকল্পনীয় শ্রীশ্রীমায়ের মাতৃত্ববোধ! দেবী, জ্ঞানদায়িনী, মহামায়া, এমন কি নিজের স্বরূপকে ছাড়িয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছিল মাতৃত্ববোধ।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি

শ্রীমায়ের ঈশ্বরত্ব এখানেই যে, মায়ের ভিতর আদৌ অহংকার নেই। আর তার কৃপা এই যে, তিনি সবাইকে, ‘মা’ এই জগতের সব থেকে প্রিয় মধুর নামে ডাকার অধিকার দিয়েছেন। মা ও সন্তান সম্পর্কে বেঁধে নিয়েছেন। তার কোনওদিন বিনাশ হবে না। যে মা বলে একবার ডাকবে। বিধির সাধ্য নেই তার সন্তানকে রসাতলে পাঠায়। শিবু দাদা বড়দা মহারাজকে বলছেন, “ভাই, মা সাক্ষাৎ কালী । উনিই সাক্ষাৎ কপালমোচন। ওঁর কৃপাতেই মুক্তি। বুঝলে?” (শ্রীমা সারদা দেবী পৃঃ ৩৩০) অনেক সময় ভক্তদের মনে প্রশ্ন জাগে, ঠাকুর ও মায়ের সম্বন্ধটা কি রূপ? বিশেষ ক্ষেত্রে, শ্রীমা নিজেই বলেছিলেন, তাঁহারা অভিন্ন। তার ও ঠাকুরের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। শুধু রূপের পার্থক্য। যিনি ঠাকুর তিনি শ্রীমার দেহের বর্তমান।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— গর্জন, ভোলা ও নোনা ঝাউ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৬: বিগ্রহে রামের প্রাণপ্রতিষ্ঠা, আদিকবির নবীন নায়ক রামের মানবিক মুখ

১৩২৩ সালে ৩০শে চৈত্রের পত্রে আছে, “যেই ঠাকুর সেই আমি।” প্রকৃতপক্ষে শ্রীশ্রীঠাকুর এবং শ্রীমায়ের মধ্যে কোনও ভেদ ছিল না। স্বামী প্রেমানন্দ আবেগ ভরে বলেছিলেন, “যাহারা ঠাকুর ও মাকে পৃথক করিয়া ভাববে তাদের কোনও কালে কিছু হইবে না। কারণ উভয়ই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।” (শ্রীমা সারদা দেবী পৃঃ ৩৪৯) আর এক স্থানে স্বামী প্রেমানন্দ বলছেন, “তোমরা দেখেই তো এলে, রাজরাজেশ্বরী মা কেমন সাধ করে কাঙ্গালিনী সেজে ঘর নিকুচ্ছেন, বাসন মাজছেন, চাল ঝাড়ছেন, ভক্তদের এঁটো পর্যন্ত পরিষ্কার করছেন। তিনি এত কষ্ট করছেন গৃহীদের গার্হস্থ্য ধর্ম শেখানোর জন্য। কি অসীম ধৈর্য, অপরিসীম করুণা, আর সম্পূর্ণ অভিমানরাহিত্য!…

মা! মা! জয় মা! মনে রেখো, সুখে, দৈন্যে, সম্পদে বিপদে, দুর্ভিক্ষে মহামারীতে, যুদ্ধ-বিগ্রহে-সর্বসময়ে মায়ের সেই করুণা, সেই অপার করুণা! জয় মা! জয় মা! (শ্রীমা সারদা দেবী পৃঃ ৩৫৫) আজ বিশ্বজনীন বাতাবরণে, পারিবারিক অশান্ত পটভূমিকায় প্রতিমুহূর্তে শ্রীশ্রীমায়ের অপূর্ব করুণা প্রতিফলিত হয়ে চলে তাঁর সন্তানদের অন্ধকারে পথ দেখানোর জন্য। শ্রীমা অবিরাম তৃষিত হৃদয়ে স্বর্গীয় আলো সঞ্চার করে চলেছেন। —চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content