রবিবার ১৭ নভেম্বর, ২০২৪


ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “নাটক সাহিত্য হলেও, অতিরিক্ত আরও কিছু। ইহার সাথে দর্শকের রুচি চাহিদা, রঙ্গমঞ্চের ব্যবস্থাপনা ও অভিনয় কৌশল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।”

সাহিত্য, শিল্পের সব জায়গায় বক্তা এবং উপভোক্তার মধ্যে সম্পর্ক থাকে। কিন্তু লিখিত নাটকের ক্ষেত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই ‘থিয়েটার ভ্যালু’ বজায় তাকে। লিখিত নাটক যখন রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দর্শকের সামনে আসে তখন নির্দেশক, রঙ্গমঞ্চের নানা উপকরণ, অভিনেতা-অভিনেত্রী, মঞ্চব্যবস্থা, রূপসজ্জা, দৃশ্যের সজ্জাব্যবস্থা, আলোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, উইংস-এর ব্যবস্থা, অভিনয় দক্ষতা, পরিচালকের নির্মাণ, নিয়ন্ত্রণ, অর্থলগ্নী, বিনিয়গের মানসিকতা, তৎকালিন দর্শকের নাটক উপভোগের মানসিক অবস্থা সমস্ত দিয়েই গড়ে ওঠে একটি সম্পূর্ণ ‘থিয়েটার’। একজন মঞ্চাধক্যের কাছে তার সাফল্যের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল দর্শকাসনের প্রফুল্লতা।
এই প্রফুল্লতা হোক বা উৎফুল্লতা, সেদিন পরিপূর্ণ ছিল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের মঞ্চে ‘ভিট্টন’ নাটকটিতে। অর্পিতা ঘোয়ের রূপান্তর এবং নির্দেশনা। জার্মানি কবি, নাট্যকার, অভিনেতা বের্টল্ট ব্রেখট্-এর লেখা “The Resistible Rise of Arturo Ui” থেকেই রূপান্তর এই নাটকের। হিটলারের একনায়কত্বকে নেপথ্যে রেখেই এই নাটকের নির্মাণ।

নাট্যকাররা গিরিশযুগের মতো এখন পাঁচ ঘণ্টার নাটক লেখেন না। মানুষের ব্যস্ততার কারণেই এখন আড়াই ঘণ্টায় নাটক মঞ্চস্থ হয়, মাঝে থাকে বিরতি। নাট্যকারকে প্রথমেই খেয়াল রাখতে হয় বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি। দর্শকমনে বর্তমান পরিস্থিতির ছায়া এঁকে দিতে পারলেই সেই নাটক সফলতা পায়। সেই ক্ষেত্রে ‘ভিট্টন’একটি চূড়ান্ত সফল নাটক।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— রামবাণ ও পানি তাঙ্কি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৪: শ্রীমার সঙ্গে বেলুড়মঠে দুর্গোৎসব পালন

পশ্চিমবঙ্গে মাস খানিক আগে ওই রূপোলী পর্দার মতো এক পলিটিক্যাল থ্রিলার ঘটনার সাক্ষী সকলেই। এই ভয়াবহতায় প্রত্যেকের নিজের মতো করে লড়াই করছেন, বিচার চাইছেন নিজের আঙ্গিকে। এই ভারাক্রান্ত সময়েই পঞ্চমবৈদিকের আয়োজন ছিল ‘ভিট্টন’ নাট্যটি। ঠিক যেমনটি আমরা শুনি বা দেখি খবরের চ্যানেলগুলোতে বা সংবাদপত্রে পড়ি অনেক রাজনেতার উত্থান সংক্রান্ত বিষয়, তেমনটাই মিলে যায় এই থিয়েটারটিতে। তাই সমসাময়িক ঘটনার জেরেই হয়তো বা এই থিয়েটার কক্ষ সেদিন পূর্ণ ছিল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

উনিশ শতকের গোড়াতে বাঙালি থিয়েটারের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হয়। থিয়েটার যাঁরা করেন বা থিয়েটার যাঁরা দেখেন, তাঁদের সকলের কাছেই প্রসেনিয়াম থিয়েটার আদৃত। বিভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগে প্রসেনিয়াম থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করা হলেও তার নিজস্বরূপ অপরিবর্তিত রয়েছে। অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের প্রসেনিয়াম থিয়েটারকে ইংরেজরাই বাংলায় নিয়ে আসে। আর খোলা জায়গায় নাট্য অভিনয় থাকে না। শুরু হল প্রেক্ষাগৃহ বা রঙ্গালয় অথবা নাট্যশালা বা থিয়েটার হল। আলোর ব্যবহার, মঞ্চসজ্জা, সাউন্ডসিস্টেম, মিউজিক এবং একাধিক সঙ্গীত—সব কিছুই যথাযথ চিত্তাকর্ষক ছিল ‘ভিট্টন’ নাট্যটিতে। দর্শকের মনোরঞ্জনে এর প্রভাব ব্যাপকতর।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গল্পাকারে পড়তে ভীষণ আগ্রহ হলেও আজকের তারিখে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন আসে, রাজনীতি ‘মাফিয়া’দের জন্যই, নাকি ‘মাফিয়ারাজ’ই রাজনীতি? ভিট্টনের গল্পও এমন এক জেল ফেরত মাফিয়ার, যার স্বপ্ন ছিল তথাকথিত সমাজের উচ্চতর আসন। তার ভাবনায় ছিল, প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে চাই ‘মানি’, ‘মাসল্ পাওয়ার’ আর ‘পলিটিক্যাল পাওয়ার’। এই তিনটে থাকা মানেই সে রাজ করতে পারে দুনিয়ায়।

নাটকের মূল চরিত্র ছাতাওয়ালার ছেলে ভবেশ নাথের। যে কিনা ভিট্টন নামে খ্যাত গুন্ডা, লম্পট, মাফিয়া, নেতাদের ভাড়াটে রক্ষী ‘পোটেকসন’ দাতা এক বিন্দাস যুবক। আর ভিট্টনের দুই সাগরেদ তার কীর্তিকলাপে ‘গুরু তুমিই সেরা’ বলে সর্বদা তার ছায়াসঙ্গী। তোল্লা দিয়েই চলাই তাদের কাজ। আত্মবিশ্বাসী ভিট্টনের বক্তব্যই হল, “হয় তার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে হবে, নয় অশান্তি ভুগতেই হবে।” সন্ত্রাস সৃষ্টি করা, কারখানার মালিকদের পোষ্য ভাড়াটে গুন্ডা হয়ে হুমকি দেওয়া, দাদাগিরি করা, খুনোখুনি করে ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করাই ভিট্টনের দলবলের কাজ। সুতরাং, ‘মানি’ আর ‘মাসল পাওয়ার’ তার অধীনে এসে গিয়েছে। বাকি রয়েছে ‘পলিটিক্যাল পাওয়ার’ অর্জন করা।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

অসামাজিক কার্যকলাপে সিদ্ধহস্ত ভিট্টন এই বার চায় রাজনীতিতে যোগ দিতে। ‘নেতা’ হওয়ার সখ চাপে তার। কিন্তু জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠতে কিছুটা মার্জিতকরণেরও দরকার। না তার ভাষা, না তার নাম, না তার পোশাক, না চালচলন জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য। কিন্তু তাকে এখন নেতারূপী জনসেবক হতেই হবে। যেই না ভাবা অমনি কাজ শুরু। ভিট্টন নাম আড়ালে থাকে, আড়ালে থাকে ভিট্টনের কার্যবিধিও, ফিরে আসে সে ‘ভবেশ নাথ’ হয়ে। গ্রুমিং-এর জন্য প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে এক অভিনেত্রীর সান্নিধ্যে, পরের অধ্যায়ে। শিক্ষিকা অভিনেত্রীর ভূমিকায় অর্পিতাও মঞ্চে এসেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। তারপর তাঁর মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়, “কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ? এ জগৎ মহা হত্যাশালা”… সেই ‘বিসর্জন’-এর রঘুপতির সংলাপ ব্যবহার বিশেষ শ্লেষের সঞ্চার করে।
নাটকের নাম ভূমিকায় অর্ণ মুখোপাধ্যায় একাই একশ দশ। ভিট্টনের মাফিয়ারাজ কিম্বা রাজনেতা ভবেশ নাথের জনপ্রতিনিধিত্ব অর্ণ অতুলনীয় সব আধারেই। তাঁর অভিনীত থিয়েটারে মঞ্চসম্রাট বা একনায়কত্ব তাঁরই থাকে। বাকিদের অভিনয়েও ত্রুটি নেই এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু ওই গুন্ডারাজের সাবলীল খিস্তি-খেউর থেকে লাম্পট্য, নেশাখোর থেকে বন্দুকবাজ সব চরিত্রই বড্ড নিখুঁত। চোখের ইশারা, মুখভঙ্গী বা আঙ্গুল নাড়িয়ে বলা সংলাপে অদ্ভুত দাদাগিরির প্রকাশ। লাপট্য বা নারীনির্যাতনের ধরণ দেখলে রীতিমতো ক্ষোভ জন্মাতে পারে এতই নিখুঁত অভিনয়। পরিমার্জিত জননেতারূপেও সেই মাত্রাতেই অসাধারণ। সমস্ত শরীর দিয়েই তাঁর সফল অভিনয়।

নাচে-গানে ভরপুর, সিগারেটের ধোঁয়ায় ধোঁয়াশা হয়ে থাকা মঞ্চ একদম জমজমাট ছিল। শুধু রাজনীতি বা মাফিয়ারাজ নয়, এই নাটক একটি প্রহসনও বটে। হাস্যরসেও পরিপাটি। মজবুত নির্দেশনা, অভিনয়, আবহ, মঞ্চসজ্জা, আলোছায়ার খেলা সব মিলিয়ে দর্শকাসন হাস্যধ্বনিতে, হাততালিতে মুখরিত ছিল। নাটকটির বাহ্যিক রূপ যেমন মনোগ্রাহী, অভ্যন্তরেও ছিল এই দুর্বল সামাজিক পরিস্থিতির জন্য বার্তা। সব মিলিয়ে এক মজবুত অর্থবহ নাট্যশৈলীর প্রকাশ হল Vitton.

Skip to content