রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

দিনান্তের অন্ধকার নেমে আসছে। স্বতঃপ্রকাশ দৃশ্যমান জগৎ তার সকল চাঞ্চল্য নিয়ে প্রবেশ করছে রাত্রির গভীরে। সেই বৃক্ষশাখায় এসে বসেছে দুটি পাখি। চারপাশে বহু ফলবান বৃক্ষ, এই বৃক্ষের শাখায় শাখায় নবীন পল্লব, তার মধ্যে মধ্যে ফলভার। সুমিষ্ট বর্ণময় ফলের গন্ধে আকৃষ্ট ভ্রমরের পুঞ্জ ফল থেকে ফলে, ফুল থেকে ফুলে ভ্রমণ করে করে ক্লান্ত হয়ে প্রবেশ করেছে মুদিত কমলদলে। সেই পাখিদুটির একটি বৃক্ষশাখায় শোভমান ফলভারে, তার সুগন্ধে আমোদিত ও মোহিত হয়ে ফলভক্ষণে প্রবৃত্ত হল। খানিক পরেই সে বিস্মৃত হল পরিপার্শ্বকে। চারপাশের ঘোরা রজনীর রহস্যঘন অমানিশা, সেই বৃক্ষশাখা, চারপাশের পত্রপুঞ্জ এবং বিপরীতের পাখিটিকেও সে বিস্মৃত হল। অচেতন আকাঙ্ক্ষায় সে ভক্ষণ করতে থাকল পুঞ্জপুঞ্জ ফলভার থেকে… একটি… দুটি… তিনটি… অনেক।
রাত্রি ক্রমশ গভীর হয়, ঘনতর হয় তমিস্রা, মন্দ মন্দ বহমান সমীরণ দ্রুতগামী হয়। অযুত খদ্যোতের সংকেত, পার্বত্যপ্রদেশ থেকে বনতলের সকল নিশিপুষ্পের সুগন্ধ আহরণ করে ধাবমান সেই গতিমান বায়ু, বিশ্বতলের সকল পার্থিব সীমার অনেক অনেক ওপরের বিপুল অনন্ত নভোলোকের অস্তিত্ব সে বিস্মৃত হয়, ইন্দ্রিয়ের স্বাদ ও ঘ্রাণে বিমোহিত, প্রমুগ্ধ হয়ে একান্ত নিষ্ঠায় সেই ফলভারের ভোগে সে অবিচল থাকে। তার মনে ইচ্ছা জাগে, এই বৃক্ষের যাবতীয় ফল সে উদরসাত্ করবে, কুক্ষিগত করে রাখবে আগামী দিনের জন্য, আরও আরও নিবিষ্ট চিত্তে সে ফলগ্রহণে নিবেদিত প্রাণ হয়।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৮: নির্দোষ প্রাণীহত্যা কী সমর্থনযোগ্য?

অনন্তবায় বয়ে চলে, অগণ্য নক্ষত্রমালার ঘ্রাণ নিয়ে বিন্দু বিন্দু নিযুত স্নিগ্ধসজল আলোকধারা তার সকল শোভায় নগর-জনপদ-অরণ্যলোক-তপোবনকে বিধৌত করে করে পার্থিবলোককে অলৌকিক আনন্দমালায় মণ্ডিত করে। পক্ষী ভুলে যায় তার পক্ষ্মের মহিমা, বিস্মৃত হয় তার মুক্তির অনন্ত মেঘলোককে। সে নিবিষ্টতর হয়ে সেই ফলসম্ভারকেই তার জীবনের পরাকাষ্ঠা, তার পুরুষার্থ মনে করে। সে একেবারেই বিস্মৃত হয় তার অনুরূপ, সম্মুখস্থ অপর পাখিটিকে। সে নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখে আত্মবিস্মৃত সেই ফলভোক্তা পাখিটিকে। ডানাদুটি নিমীলিত করে প্রবল চঞ্চুসঞ্চালনে সে ভক্ষণ করে চলে একান্ত কাঙ্ক্ষিত ফলরাশি। তাতেই তার সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি বুঝি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

নিবিড় অনন্ত নিশীথিনীর নিঃশব্দ পদপাত, গন্ধবহের আকুল হাহাকার, অরণ্যভুমির বক্ষদেশে বিশীর্ণ পল্লবদলের জমে ওঠা ভার কিছুই তার ধ্যানভঙ্গ করতে পারে না যেন, দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষার মহাস্রোতে সে বিশুষ্ক তৃণখণ্ডের মতোই আন্দোলিত হতে হতে লক্ষ্যহীন ভোগাকাঙ্ক্ষায় মজ্জমান হতে থাকে। নিদাঘের তাপ, বর্ষণের বারিধারা, শিশিরের হিমে সন্তপ্ত, সিক্ত, পীড়িত হয়েও সে তার ভোগাকাঙ্ক্ষাকে মুহূর্তমাত্র-ও বিস্মৃত হয় না।

তার পক্ষ্মযুগল ক্রমে জরাভারাতুর মলিন, ক্লেদাক্ত হয়, তার বিষম আকাঙ্ক্ষা দুর্বহ, ভীষণ ও সতত উন্মার্গগামী হয়, তবুও নিমেষের জন্যও সে তার পরিপার্শ্বকে দেখে না, অনন্তের উদাত্ত আহ্বান তার ইন্দ্রিয়াসক্তির কাছে বাধিত হয় বারংবার, সে দেখে না তার বিপরীতের সেই অনিমেষ নয়নে চেয়ে থাকা পক্ষীটিকে, যদি সে একবারের জন্যও তার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতো, তার প্রাণসখা, অন্তরতম, আত্মার আত্মীয়, পরমবান্ধব, চিরসখাকে চিনতে পারতো, ধারণ করতো হৃদয়ে, তবে বুঝি নিমেষেই এই দুরপনেয় আকাঙ্ক্ষার ভারকে দুঃসহ, দুরন্ত জেনে তাকে প্রেয়ঃ জেনে নিবৃত্ত হতো।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

আসক্তি আর আকাঙ্কার সেই মহারণ্যভূমির বিপুল মলিন ছায়া সেদিন প্রলম্বিত হয়ে কুরুভূমির বুকে ত্যাগ করছিল তার বিষবাষ্পবাহী, উষ্ণ মহা দীর্ঘশ্বাস। সাগরের বিশাল তরঙ্গ যেমন আছড়ে পড়ে বেলাভূমিতে প্রবল আশ্লেষে, ভারতভূমি সেদিন দ্বিধান্বিত হয়ে আপতিত হয়েছিল ধর্মাধর্ম, ন্যায়-অন্যায়ের পদমূলে। মহাকালের চির নৃত্যচঞ্চল পদযুগল ঘিরে সেদিন জ্যোতির্ময় ভানুচন্দ্রের অমিতবিত্ত সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে কোন শাশ্বত সত্যের চরণধ্বনিতে, কোন সৃষ্টি-লয়ের নুপূরনিক্বণে, কোন্ অনির্জ্ঞাত মহাবেদনার শোকে, শোকোত্তর উপলব্ধিতে চরাচরকে আবিষ্ট করছিল তা কে বলতে পারে!
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

সেই মহাসাগরের মহাকল্লোল ভেদ করে কোনও এক মধুর নির্ঘোষ উদ্বেল করছিল এক মুহ্যমান হৃদয়। “যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি….”

হে ফলভোগী কর্মযোগী নিয়তিতাড়িত জীব, একবার নিবৃত্ত হয়ে দেখোই না! সত্যকর্মের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষার মহাস্রোতে আত্মাকে শুদ্ধ, বুদ্ধ করো; মহাকর্মপ্রেরণার অনুধাবন করে যে শুভাশুভ ফল, তার প্রতি ঔদাসীন্যের অভ্যাস করো। শোকে পরাভবে অনুদ্বিগ্ন অবিচল, অভ্যুত্থানে বিগতস্পৃহ হয়ে নিরন্তর কর্মের যাপন করো। ফলের আকাঙ্ক্ষা থেকে আসে আসক্তি, ফলনিষ্ঠ পরাভবের বোধ থেকে আসে গ্লানি আর দ্রোহ। প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, জয়, পরাজয়ের ঊর্ধ্বে শোকোত্তীর্ণ, ভয়োত্তীর্ণ, অহংমুক্ত মহত্তম যা কিছু, সেই হৃদয়ের নন্দনবনেই আমাকে পাবে, যুগে যুগে।
* গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে (A Special Write Up on Shrimad Bhagwat Gita): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content