রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।।

সত্যব্রত অপেক্ষা করছিলেন। অভিষেক মালকর এটা-ওটা বলছিলেন, আর হাতে-ধরা মোবাইলে সময় দেখছিলেন। সুদীপ্ত ছেলেটা যে কেন এত দেরি করছে? তিনি সত্যব্রতকে বললেন, “চা খাবেন?”
“নাহ্! থানায় আসবার আগেই খেয়েছি। এখন আর খাবো না!” সত্যব্রত সবিনয়ে বললেন।
“এ-বাবা! থানায় আসবেন যখন ঠিকই করে নিয়েছিলেন, তখন চা খেয়ে এলেন কেন? আমাদের এখানকার ক্যান্টিনের চা কিন্তু বেশ ভালো। আমরা আপনাকে চা খাওয়াতে পারলে খুশি হতাম। সময়ে-অসময়ে বিরক্ত করি আপনাদেরকে। আপনারা আছেন বলে এই পৃথিবীর মানূষেরা নিশ্চিন্তে থাকে!”
সত্যব্রত এই-সব কথার কোনও প্রতিক্রিয়া দিলেন না। তিনি মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন, কীভাবে বলবেন সব। অভিষেকের সম্বন্ধে যা শুনেছেন, তাতে তাঁকে ভরসা করতে পারা যায় না। একে তো তিনি মাথা ঘামান না, তার উপর এই কেসে সন্দেহভাজন বলে মনে হয়েছে, এমন দু’-চারজনের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরমের সম্পর্কের কথা এলাকার সকলেই জানে। অভিষেক-সকাশে কিছু বলাটা কতটা সঙ্গত হবে, সেটাই ভাবার বিষয়।
সাত-পাঁচ ভাবছেন, এমন সময় সুদীপ্ত ঢুকল।
ওয়েট করে আছেন। তাঁকেও তো হেলথ-সেন্টারে ফিরতে হবে। জানোই তো, একমাত্র ডাক্তার তিনি। ওখানে না-থাকাকালীন কোনও রোগী এলে, তারা কী করবে?”
সুদীপ্ত কিছু বলার আগেই সত্যব্রত বললেন, “সে-জন্য আপনাকে চিন্তিত হতে হবে না মিস্টার মালাকর। এখানে রোগীদের চার্চের হসপিটাল ফিরিয়ে দিলে তবেই তারা হেলথ-সেন্টারে আসে। আসলে কী জানেন, ফ্রি-তে টাকা পাওয়া ছাড়া অন্য জিনিষ ফ্রি-তে দিলে, তার আর সম্মান থাকে না। লোকে ধরেই নেয়, জিনিসটা খারাপ, সে-কারণেই ফ্রি-তে দিচ্ছে! অতএব হেলথ-সেন্টারে চাপ তেমন থাকে না এখানে! চার্চের হসপিটাল বন্ধ হয়ে গেলে আলাদা ব্যাপার!”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৪: কথায়-কথায়

সুদীপ্ত তাঁকে নমস্কার জানিয়ে মালাকরকে বলল, “স্যার, আগেই বলি, একটা দারুণ খবর আছে। আপনি সেটা শুনলে চমকে যাবেন!”
মালাকর বললেন, “তাই না কি? তা আগে বলনি কেন?”
‘‘আগে তো জানতাম না। এখানে আসবার জন্য বেরুচ্ছি, তখনই একটা ফোন এল। তার থেকেই জানতে পারলাম!”
“ব্যাপারটা কী?”
“আর্য বাবু ফিরে এসেছেন!”
“আর্য! সে-আবার কে?”
“পিশাচ-পাহাড় রিসর্টের যে-লোকটি অঞ্জনিবাবুর দামী বাইক নিয়ে ফ্রিল্যান্স করতে কাছেপিঠে কোথাও গিয়েছিলেন, তিনি।”
“অ্যা! বল কী? তাহলে ওই বাইকটা, যেটা আমরা উদ্ধার করেছি জঙ্গলের ধার থেকে, সেটা কার?”
“সেটা সম্ভবত অঞ্জনবাবুরই। ওনারা আজকেই আসতেন। কিন্তু আর্যবাবু ফিরে আসাতে সকলেই এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন যে, আসতে পারেন নি বলছেন। কাল সকালে থানায় অবশ্যই দেখা করতে বলেছি উইথ আর্যবাবু!”
মালাকর খুশি হয়ে বললেন, “তবে তো ঠিক আছে। নিশ্চিন্ত!”
“নিশ্চিন্ত নয় স্যার। দুশ্চিন্তা বাড়ল!”
“মানে? দুশ্চিন্তা আবার কোথা থাকে দেখলে হে?”
“স্যার, ভেবে দেখেছেন কী, যদি আর্যবাবু ফিরে আসে, তাহলে মর্গে যে কাটাছেঁড়ার পর চিরঘুমে শুয়ে আছে, সে কে?”
মালাকর চমকে উঠে বললেন, “আরে ঠিক বলেছ তো? কে সে?”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

“সেটাই তো বার করতে হবে স্যার! আমি বলি কী, আমি সত্যব্রতবাবুর কথা শুনছি, আপনি বরং একবার মর্গে ফোন করুন। চলে গেলেই ভালো। সরাসরি কথা বলুন ডাক্তারের সঙ্গে। লাশের হোয়্যারঅ্যাবাউট্স্ নিতে হবে। তারপর প্রোফাইল রেডি করে থানায় থানায় মেইল পাঠাতে হবে। যদি কোথাও কেউ মিসিং থেকে থাকে। কিংবা আর কেউ!”
“এটা ঠিক বলেছ। তবে তুমি ডাক্তারবাবুর কথা শোন। আমি ওদিকটা দেখি। উফ্, এই থানায় এতদিন শান্তিতে ছিলাম। কিন্তু এত সুখ কপালে সইবে কেন? প্রথমে এল কি-না কালাদেও, তারপর এই একের এক রহস্যজনক হত্যা! আমি এবার-না পাগল হয়ে যাই!” বলে সত্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি সুদীপ্তকে যা-বলতে চান খুলে বলুন। ওকে ভরসা করতে পারেন। আমি মর্গটা ঘুরে আসি।”
সত্যব্রত বললেন, “বেশ, আপনি ডক্টর সরখেলকে আমার নমস্কার জানিয়ে দেবেন!”
ডক্টর সরখেল মর্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার। পুলিশের পরম মিত্র। তবে আজ বোধহয় প্রাইমারি রিপোর্ট পাওয়া যাবে। ফরেন্সিক রিপোর্টের জন্য আর ক-দিন অপেক্ষা করতে হবে। সদরে গিয়েছে। সেখান থেকে রিপোর্ট এলেই বোঝা যাবে, এই ক’দিনে এতগুলি মৃত্যুর কারণ।
মালাকর বেরিয়ে যেতেই সুদীপ্ত বলল, “ডক্টর, আপনি যা বলতে এসেছেন, নির্দ্বিধায় আমাকে বলুন। কোনওরকম সংকোচ করবেন না!”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

“নাহ্, এটা সংকোচের সময় নয়। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন না, ‘সংকোচের বিহ্ববলতা নিজেরই অপমান।’ যাই হোক, যা-বলবো তা আমার অনুমান, যদিও এই অনুমান আমি অনেক যুক্তি ঘেঁটে এবং সরজমিনে তদন্ত করে পেয়েছি !”
“যেমন?” সামান্য কৌতূক মিশিয়ে বলল সুদীপ্ত। মনে মনে সে ভাবল, আজকাল ওয়েবসিরিজ আর যত্ত সব ট্র্যাস সিরিয়াল দেখে সকলেই নিজেকে এক-একজন ফেলুদা কিংবা এরকুল পোয়ারোঁ ভেবে নেয়। তার উপর এখন পাল্প-ফিকশনের যুগ। কত রকম রহস্য, কত রকম মনগড়া কাহিনি, যে-দেশে প্রাইভেট ডিটেকটিভের অস্তিত্ব বইয়ের পাতায়, সে-দেশে এত কাগুজে গোয়েন্দার ছড়াছড়ি যে মনে হয়, এখানে কেউ পুলিশের কাছে যায়ই না। তার নিজের ব্যোমকেশ বক্সী ছাড়া আর কাউকেই বাঙালি গোয়েন্দাদের মধ্যে জাতের বলে মনে হয় না। ছোটবেলায় ফেলুদা গ্রোগ্রাসে গিলত, বড় বেলায় পড়তে গিয়ে হাই উঠেছে কেবল। ফেলুদা ছোটদের জন্যই। বড়দের গোয়েন্দা হিসাবে তাঁর কোন সার্থকতা আছে বলে মনে হয় না।
সত্যব্রত বললেন, “কথাগুলি বলতে গেলে অনেকটা সময় লাগবে। তার আগে একটা প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, আপাতত আপনাদের তদন্তের স্বার্থে কথাটা যত কন জন জানবে, ততই মঙ্গল।”
“আপনি বলতে চান যে, আপনি বুধনের মৃত্যুরহস্য সমাধান করেছেন?” নড়েচড়ে বসে সুদীপ্ত জিজ্ঞাসা করল।
“আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র আবিষ্কার করেছি। সমাধান করা আপনাদের কাজ, অবশ্য যদি না আগেই সমাধান করে বসে থাকেন!” সত্যব্রত নিরুত্তাপ গলায় বললেন।
সুদীপ্ত কাষ্ঠহাসি হাসল, “এত তাড়াতাড়ি সমধান করা সম্ভব? বিশেষ করে, যেখানে বুধনের একটা রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে! আমরা চেষ্টায় আছি। কিন্তু আপনিও যে এ-সব বিষয়ে উৎসাহিত, তা জানতাম না!”
“ডাক্তারদের নানা কেস স্টাডি করতে হয়। কখন কোন্ পেশেন্টের জন্য দরকার পড়ে, তা কী বলা যায়? যাই হোক, যা বলতে এসেছি শুনুন—”
“বেশ, বলুন!”
সত্যব্রত বলতে যাবেন, এমনসময় সুদীপ্তর ফোনটা বেজে উঠল। সে দেখল, স্ক্রিনে মালাকরের নাম্বার। বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে গেল তার। মর্গে গিয়েও লোকটা তাকে ফোন করছে? এবার কী বলবেন, এখানের কাজ শেষ হলে ওখানে একটু যেতে? হোপলেস! বলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করল সে।
ওপাশ থেকে মালাকরের উত্তেজিত গলা শোনা গেল, “শোন, তোমার কি ডাক্তারের কথা শোনা হয়ে গিয়েছে?”
“এখনও শুরুই হয়নি!”
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৯: ফেরেন্তস পুসকাস: দুটি দেশের হয়েই বিশ্বকাপ খেলেছেন

“তাহলে পরে শুনো। এখনি আমাদের বেরুতে হবে। পরশুর ক্রাইমস্পটে গিয়ে লালাবাজারের গোয়েন্দা অফিসার দু’জন যখন তদন্ত করছেন, তখন জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেউ তাঁদের ওয়াচ করছিল। একজন অফিসার, আমার মনে হয় শাক্য সিংহ তাকে চেজ করে জঙ্গলের মধ্যে ঢোকেন, তার পিছন-পিছন অন্য অফিসারটি। ড্রাইভারকে দ্বিতীয় অফিসারটি মানা করেছিলেন বোধহয়। সে গাড়ির কাছেই অপেক্ষা করছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, তাঁদের কারওই কোনও পাত্তা নেই। বুঝতে পারছি না, কোন মিসহ্যাপ হয়ে গেল কি না। ড্রাইভার বলায় আমি বার-বার ফোন করছি, কিন্তু বলছে সার্ভিস এরিয়ার বাইরে আছে। সম্ভবত জঙ্গলের মধ্যে টাওয়ারের প্রবলেম আছে। কিন্তু সেটা না-গেলে বোঝা যাবে না। তুমি ডাক্তারকে বল, অন্যদিন আসতে। আর থানায় দু-জনকে রেখে কয়েকজনকে সঙ্গে করে তাড়াতাড়ি চলে যাও। আমিও যাচ্ছি। মর্গের ব্যাপারটা পরে দেখা যাবে। যদি কিছু হয়ে যায়, চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে, মনে রেখো!” —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content