ছবি: প্রতীকী।
শিব্রাম এক ঘোড়ার গল্প শুনিয়েছিলেন যে নিজের সৌভাগ্যের বহর দেখে হাসতে হাসতে পেট ফেটেই বোধহয় মারা পড়েছিল। ঘোড়া দেখলে চলতে না পারার গল্পটা তো সকলেই জানেন। কিন্তু ঘোড়া নিজেই যদি তা-ই করে? তা কি দুর্ভাগ্যকেই ডেকে আনে? জাতকমালার এই কাহিনীতেও বোধিসত্ত্ব রাজার ধীমান অমাত্য, অমাত্যকুলে জন্ম নিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যথাকালে ধর্মার্থানুশাসকের পদ লাভ করেছেন।
রাজার ঘোড়াশালে এক মঙ্গলাশ্ব ছিল, নাম তার পাণ্ডব। তার সহিস ছিল খঞ্জ। তার নাম গিরিদন্ত। স্বভাবতঃই তার চলত্শক্তি অবাধ ছিল না। কিন্তু অশ্বটির রজ্জু ধরে সহিস যখন চলাফেরা করত, তখন অশ্বটি ভাবতো তাকে বুঝি এভাবেই চলতে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। সে বুঝলে না, সহিসের এই প্রতিবন্ধকতা অনুকরণের বিষয় নয়, কিন্তু প্রভুর নির্দেশ আর অনুশাসন অনুসরণ করতে করতে অনুকরণের সঙ্গে তার পার্থক্যটুকু সে বুঝি বিস্মৃত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৩৮: অসমের কয়েকটি জনজাতি
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ
এ ভাবে চলতে চলতে অশ্বটিও খঞ্জ হল। রাজবৈদ্য এসে পরীক্ষা করলেন, কিন্তু দেহে কোনও রোগলক্ষণ আবিষ্কৃত হল না। রাজা তখন প্রাজ্ঞ ধীমান অমাত্যকে সেখানে প্রেরণ করলেন, তিনি উপলব্ধি করলেন, সংসর্গদোষেই অশ্বটির এমন দুর্গতি। তিনি রাজাকে জানালেন সেকথা। এর সমাধান কি? সুন্দর অশ্বের জন্য সুন্দর, অবিকলাঙ্গ অশ্বনিবন্ধিক নিয়োজিত হল, অচিরেই অশ্বটি তার এই আত্মবিস্মরণকে ভুলে নিজেকে ফিরে পেল, ফিরে পেল স্বাভাবিক গতি। অমাত্য রাজার কাছে মহাসম্মান লাভ করলেন।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান
দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম
এই কাহিনির অশ্বের খঞ্জত্ব মানুষের জাগতিক বিপন্নতার কথা বলে। মানসিক, কায়িক, বাচিক কিংবা আত্মিক নানা প্রতিকূলতার মূলে প্রতিবেশের প্রভাব থাকে। অনুসরণ জীবের আত্মধর্ম। প্রতিকূল প্রতিবন্ধক পরিবেশ জীবকে প্রকৃতিবিস্মৃত করে, নিজের শক্তি ও সত্তাকে ভুলে সে তখন অপরের ভ্রান্তির প্রতিরূপ হয়ে ওঠে। অনুসরণীয় আদর্শের স্থাপন জীবকে আত্মস্থ করে, তার বিস্মৃত সত্তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। এই কাহিনি সেই বোধেরই উদ্ঘোষণা করে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।