
মা সারদা।
মা সারদার নতুন বাড়ি হওয়ায় সেখানে দুধের অভাব দূর করার জন্য জ্ঞানানন্দ মহারাজ দুটি ভালো গরু কিনে আনেন। সুরেন্দ্রনাথ গুপ্ত এই গরু কেনার খরচ বহন করেন। তবে শ্রীমা সংসারী হয়েও সন্ন্যাসিনী ছিলেন, নিজের জন্য কোনো ঝঞ্ঝাট বাড়াতে চাইতেন না। নিজের জন্য আলাদা বাড়ির ইচ্ছাও তাঁর ছিল না। যখন তাঁর ভাইরা আলাদা হয়ে নিজেদের বাড়ি করে তখন কালীকুমার তাঁর দিদি শ্রীমার সাহায্যে ভালো বাড়ি, বৈঠকখানা করেন। তখন থেকে জগদ্ধাত্রীপুজোও তাঁর বৈঠকখানাতেই হত। তার আগে শ্রীমা দেশে এলে বড়ভাই প্রসন্নের ঘরে থাকতেন। তাঁর বৈঠকখানাতেই পুজো হত। রাজা মহারাজ শ্রীমার কাছে এলে এই ঘরেই থাকেন। তিনি এখানেই পুজোতে আনন্দে নাচগানও করেছিলেন বলে শোনা যায়।
শ্রীমার ভক্তদের আসা-যাওয়া বেড়ে যাওয়ায় প্রসন্নের সংসারে তাঁর থাকার অসুবিধা হয়। সেই সময় সারদানন্দ মহারাজের সম্মতিতে ভক্তদের চেষ্টায় তাঁর ভাইদের দেওয়া একখণ্ড জমির উপর শ্রীমার আশীর্বাদ নিয়ে খড়ের চাল, মাটির দেওয়াল দিয়ে ছোট ছোট চারখানি ঘর নিয়ে শ্রীমার নতুন বাড়ি তৈরি হয়। তখন শ্রীমার জন্য কেনা গরুদুটি চরাবার জন্য অনাথ বালক গোবিন্দকে রাখাল নিযুক্ত করা হয়। এই বাড়ির জন্য মাস্টারমশাই বিশেষভাবে অর্থ সাহায্য করেন। বিভূতিবাবু বাঁকুড়ায় থাকেন, চাকরি করেন, তিনি শ্রীমার বাড়ি তৈরির কাজ দেখছিলেন। তবে সর্বদা উপস্থিত থাকতে পারেন না। তাই তদারকির অভাবে কাজ বেশিদূর এগোচ্ছিল না।
শ্রীমার ভক্তদের আসা-যাওয়া বেড়ে যাওয়ায় প্রসন্নের সংসারে তাঁর থাকার অসুবিধা হয়। সেই সময় সারদানন্দ মহারাজের সম্মতিতে ভক্তদের চেষ্টায় তাঁর ভাইদের দেওয়া একখণ্ড জমির উপর শ্রীমার আশীর্বাদ নিয়ে খড়ের চাল, মাটির দেওয়াল দিয়ে ছোট ছোট চারখানি ঘর নিয়ে শ্রীমার নতুন বাড়ি তৈরি হয়। তখন শ্রীমার জন্য কেনা গরুদুটি চরাবার জন্য অনাথ বালক গোবিন্দকে রাখাল নিযুক্ত করা হয়। এই বাড়ির জন্য মাস্টারমশাই বিশেষভাবে অর্থ সাহায্য করেন। বিভূতিবাবু বাঁকুড়ায় থাকেন, চাকরি করেন, তিনি শ্রীমার বাড়ি তৈরির কাজ দেখছিলেন। তবে সর্বদা উপস্থিত থাকতে পারেন না। তাই তদারকির অভাবে কাজ বেশিদূর এগোচ্ছিল না।
এরই মধ্যে মা সারদার জন্মতিথি উপলক্ষে কলকাতা থেকে জিনিস নিয়ে রাসবিহারী মহারাজ ও হেমেন্দ্র মহারাজ আসেন। আর তাঁদের প্রাণপাত পরিশ্রমে শ্রীমার নতুন বাড়ি তৈরি হয়। শ্রীমার বিশেষ ভক্ত কোয়ালপাড়া আশ্রমের কেদার নাথ এই বাড়ির নকসা তৈরি করেন। সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জোগাড় করে নতুন বাড়িতে শ্রীমায়ের স্বাচ্ছন্দ্যে অবস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খুব সমারোহের সঙ্গে নতুন বাড়িতে প্রবেশ করা হয়েছিল। তবে রাস্তার উপরে সাজানো গোছানো বাড়িতে সকলের সামনে শ্রীমা যেতে নারাজ ছিলেন। প্রসন্নমামার গলির ভেতরে আড়ালে অবস্থিত পুরোনো ঘুপসি ঘরটি ছাড়তে চাননি। কিছুদিন পর উৎসাহ ঠাণ্ডা হলে তিনি সন্তানদের আগ্রহে ও নানা কারণে নতুন বাড়িতে এসে থাকেন। তাও চুপিসারে যাতে কেউ টের না পায়।
এ বার রাসবিহারী মহারাজ কলকাতা ফিরে যাবেন। এখানে শ্রীমার নতুনবাড়ির রক্ষকরূপে কে থাকবে? নবাসন থেকে জিনিস নিয়ে জ্ঞানানন্দ মহারাজ শ্রীমার সেবার জন্য প্রায় যাওয়া আসা করেন। শ্রীমার প্রতি তাঁর ভক্তিভাব ও মা সারদার তাঁর প্রতি অনুকম্পা দেখে রাসবিহারী মহারাজ তাঁকেই রেখে গেলেন। জ্ঞানানন্দ মহারাজ পরিশ্রমী, তাই শ্রীমার বাড়ির উন্নতির চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁর উদ্যমেই পুণ্যিপুকুর কিনে সংস্কার করা হল। ভক্তদের থাকার জন্য বিছানাপত্র কেনা হল। যদিও শ্রীমা আড়ম্বর একদম পছন্দ করতেন না। কিন্তু কি আর করবেন, তাঁর ছেলেরা করতে চায়, প্রয়োজনও আছে আর লোকের উপকারও হচ্ছে। বর্ষায় নতুন বাড়ির উঠোনে কাদা হলে শ্রীমাকে পাকা করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি অমত করেন। কারণ, গ্রামে মাটির ঘরই ভাল, সবাই সেখানেই থাকে। আর জাঁকজমকে ঈর্ষা থেকে শত্রুতা বাড়ে। তবে দু-তিন বছর বাদে শ্রীমার মত না নিয়েই বাড়ির দাওয়া পাকা করা হল ও ঘরের মেঝে বাঁধানো হল।
এ বার রাসবিহারী মহারাজ কলকাতা ফিরে যাবেন। এখানে শ্রীমার নতুনবাড়ির রক্ষকরূপে কে থাকবে? নবাসন থেকে জিনিস নিয়ে জ্ঞানানন্দ মহারাজ শ্রীমার সেবার জন্য প্রায় যাওয়া আসা করেন। শ্রীমার প্রতি তাঁর ভক্তিভাব ও মা সারদার তাঁর প্রতি অনুকম্পা দেখে রাসবিহারী মহারাজ তাঁকেই রেখে গেলেন। জ্ঞানানন্দ মহারাজ পরিশ্রমী, তাই শ্রীমার বাড়ির উন্নতির চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁর উদ্যমেই পুণ্যিপুকুর কিনে সংস্কার করা হল। ভক্তদের থাকার জন্য বিছানাপত্র কেনা হল। যদিও শ্রীমা আড়ম্বর একদম পছন্দ করতেন না। কিন্তু কি আর করবেন, তাঁর ছেলেরা করতে চায়, প্রয়োজনও আছে আর লোকের উপকারও হচ্ছে। বর্ষায় নতুন বাড়ির উঠোনে কাদা হলে শ্রীমাকে পাকা করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি অমত করেন। কারণ, গ্রামে মাটির ঘরই ভাল, সবাই সেখানেই থাকে। আর জাঁকজমকে ঈর্ষা থেকে শত্রুতা বাড়ে। তবে দু-তিন বছর বাদে শ্রীমার মত না নিয়েই বাড়ির দাওয়া পাকা করা হল ও ঘরের মেঝে বাঁধানো হল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৭: কোয়ালপাড়া আশ্রমের রাজেন মহারাজ ও মা সারদার প্রসাদী

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন
শ্রীমা বলেন যে, তাঁর শোবার ঘরের মেঝে যেন বাঁধানো না হয়, পাকা মেঝেতে বসে আরাম নেই। কারণ, তা গরমে বেশি গরম হয় আর শীতে বেশি ঠান্ডা। মা সারদা পাড়াগেঁয়ে সেকেলে নারী। যখন তখন ঘরে বা বারান্দায় আসন না বিছিয়ে তিনি মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়তেন। ঘরের মেঝে বাঁধানো হলে সে ঘরে আর তিনি বাস করেননি। সুরেনবাবুর সাহায্যে জ্ঞানানন্দ মহারাজ যেমন গোশালা করেন, তেমনই ললিতবাবুর আর্থিক সহায়তায় ও আগ্রহে তিনি এখানে ঔষধালয় ও নৈশ পাঠশালাও স্থাপন করেন। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে খুব অসুস্থ হলে তিনি জয়রামবাটি ছাড়তে বাধ্য হন এবং কাটিহারে শ্রীমার ভক্ত ডাক্তার অঘোরবাবুর বাসায় চিকিৎসা ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গিয়েছিলেন। কিছুকাল পরেই তাঁর ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ইংরেজসরকারের পুলিশ তাঁকে বিপ্লবী সন্দেহে আটকে রাখে। তিনি যতদিন শ্রীমার কাছে ছিলেন, গরুর খুব যত্ন করতেন। তাই শ্রীমার ভাবনা ছিল না। এখান থেকে যাবার পরও তিনি সুরেনবাবুর সাহায্যে গরুর জন্য সব ব্যবস্থা করতেন, এমনকি গোয়ালঘরও কেনেন। তবে তাঁর অবর্তমানে শ্রীমার গরুর দেখাশোনার জন্য ভীষণ ভাবনা হত।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৩: বীরবিক্রম ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৪: আশ্রমের আনন্দময় পিকনিক
শ্রীমা বলেন যে, তাঁর শোবার ঘরের মেঝে যেন বাঁধানো না হয়, পাকা মেঝেতে বসে আরাম নেই। কারণ, তা গরমে বেশি গরম হয় আর শীতে বেশি ঠান্ডা। মা সারদা পাড়াগেঁয়ে সেকেলে নারী। যখন তখন ঘরে বা বারান্দায় আসন না বিছিয়ে তিনি মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়তেন। ঘরের মেঝে বাঁধানো হলে সে ঘরে আর তিনি বাস করেননি। সুরেনবাবুর সাহায্যে জ্ঞানানন্দ মহারাজ যেমন গোশালা করেন, তেমনই ললিতবাবুর আর্থিক সহায়তায় ও আগ্রহে তিনি এখানে ঔষধালয় ও নৈশ পাঠশালাও স্থাপন করেন। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে খুব অসুস্থ হলে তিনি জয়রামবাটি ছাড়তে বাধ্য হন এবং কাটিহারে শ্রীমার ভক্ত ডাক্তার অঘোরবাবুর বাসায় চিকিৎসা ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গিয়েছিলেন। কিছুকাল পরেই তাঁর ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ইংরেজসরকারের পুলিশ তাঁকে বিপ্লবী সন্দেহে আটকে রাখে। তিনি যতদিন শ্রীমার কাছে ছিলেন, গরুর খুব যত্ন করতেন। তাই শ্রীমার ভাবনা ছিল না। এখান থেকে যাবার পরও তিনি সুরেনবাবুর সাহায্যে গরুর জন্য সব ব্যবস্থা করতেন, এমনকি গোয়ালঘরও কেনেন। তবে তাঁর অবর্তমানে শ্রীমার গরুর দেখাশোনার জন্য ভীষণ ভাবনা হত।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
মাঝে মাঝে তিনি বলতেন, ‘গরু করে জ্ঞান আবার হাঙ্গামা বাড়িয়ে দিল’। সেই গোবিন্দকে বাগাল রাখার পর হাঙ্গামা কিছু কমে। অল্পবয়সে অনাথ হওয়ায় সে খুব দুঃখে মানুষ হয়েছে। যা তার চেহারা দেখে বোঝা যায়। ছেলেটির দুরসম্পর্কের এক আত্মীয় তাকে শ্রীমার গোয়ালে বাগালের কাজে নিযুক্ত করে দিলে। মাইনে সামান্য হলেও খাওয়াপরার স্বাচ্ছন্দ্য আছে। রাতে সে নৈশ পাঠশালায় লেখাপড়াও শিখতে পারবে। পাড়ার কৃষক পরিবারের ছেলেবুড়ো অনেকেই সেখানে পড়তে যায়। ন’দশ বছরের ছেলেটি নিজের কাজ ভালই করছিল। আর শ্রীমা ও সকলের আদরযত্নে তার ভালই দিন কাটছিল। তবে রাতে তাকে পড়তে বাধ্য করা হয়, যাতে তার একদম মনোযোগ নেই। ফলে মন বসে না। কিছুকাল পরে তার শরীরে খোসপ্যাঁচড়া দেখা দিল। চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল। তবে বিশেষ কিছু সারলো না। সে অসুখে ভুগেও তার কাজ ঠিক করে যেতে লাগল। যদিও অসুখ তেমন সাংঘাতিক নয়, খোসপ্যাঁচড়া আসে আর যায়। তাই কারও সেদিকে মনোযোগ নেই।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট
একদিন রাতে গোবিন্দের ভীষণ যন্ত্রণা হওয়ায় সে খুব কাঁদতে লাগল। কাপড়ের নিচে রোগ খুব বেড়েছে লজ্জায় দেখায়নি। রাতে সে ব্যথা আর সহ্য করতে পারছে না। তাকে সবাই সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল। পরদিন ভোরেই দেখা গেল যে মা সারদা তাকে বাড়ির ভেতর ডেকে নিয়ে যান আর নিজের হাতে শিলেনোড়াতে নিমপাতা হলুদসহ বেটে দিচ্ছেন তাঁর পাশে দাঁড়ানো গোবিন্দকে। শ্রীমা নিমহলুদ বেটে একটু করে তাকে দিতে লাগলেন। কীভাবে তা শরীরে লাগাতে হবে তাও দেখিয়ে দিচ্ছেন। আর ছেলেটি সেভাবে লাগাচ্ছে। শ্রীমায়ের অপার স্নেহে বালকটির মন ভরে উঠল। তার চোখে মুখে তখন আনন্দ। তার কান্নায় রাতে শ্রীমা ভালভাবে ঘুমোতে পারেননি। তাই পরদিন ভোর হতে না হতেই ওষুধের আয়োজন নিজেই করেছেন। মা সারদার আদরে মাতৃহীন বালকের রোগের যন্ত্রণার অনেকখানি লাঘব হয়েছে দেখে শ্রীমাও খুশি হলেন। দুজনের মুখে আনন্দ দেখে ও কথা শুনে কে বুঝবে যে সে মা সারদার নিজের ছেলে নয়! ‘আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং’ অর্থাৎ নিজসদৃশ সর্বত্র সমান দেখা, ‘পরকে আপন করা’ শেখানোর জন্যই তো জননী সারদা এসেছেন এ’ ধরায়।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।