ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
দমনকের যুক্তিগুলো শুনে পিঙ্গলক চঞ্চল হয়ে উঠল। দমনককে সে বললে, সঞ্জীবক আমার প্রাণাধিক প্রিয় একজন সেবক। আমার সঙ্গে কখনও কোনও বিষয়ে মতবৈপরিত্য হয়নি তার। তাহলে কেনই বা সে আমার বিরুদ্ধাচরণ করবে বা আমার প্রতি দ্রোহপূর্ণ মনোভাব পোষণ করবে? আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
চতুর দমনক বলল, হে রাজন! ভৃত্য যে চিরকাল ভৃত্যই হয়ে থাকবেন—এইরকম নিয়ম তো কোথাও নেই। জগতে এমন কোনও রাজপুরুষ নেই যে রাজৈশ্বর্য বা ক্ষমতা চান না; একমাত্র অসমর্থ লোকেরাই রাজার সেবা করে—রাজপদের আকাঙ্খা করে না। যেকোনও সমর্থ লোকই মনে মনে রাজা হওয়ার বাসনা রাখে। ক্ষমতার এমনই মোহ।
সিংহ পিঙ্গলক বললেন, ওহে দমনক! আপনার সমস্ত যুক্তিই আমি সমর্থন করছি, কিন্তু তত্সত্ত্বেও তার প্রতি আমার মনে কোনও রকম বিকৃতি জন্মাচ্ছে না। সে আমার কোনও ক্ষতি চায় এইটা আমি কিছুতেই কল্পনাতেও আনতে পারছি না। পণ্ডিতেরা বলেন—
অনেকদোষদুষ্টোঽপি কাযঃ কস্য ন বল্লভঃ।
কুর্বন্নপি ব্যলোকানি যঃ প্রিযঃ প্রিয এব সঃ।। (মিত্রভেদ, ২৬৫)
মানুষের স্বভাব হয়তো এমনই বিচিত্র। পছন্দের মানুষের মধ্যে অনেক দোষও থাকলেও, মানুষ তার খারপটা কখনই দেখতে পায় না। যেমন নিজের শরীরের মধ্যে অনেক দোষ থাকলেও সেই দোষদুষ্ট শরীরকেই মানুষ ভালোবাসে—তাকে ত্যাগ করার চিন্তা কেউ করেন না। তাই সেই বিপরীতবুদ্ধি মানুষটি যদি প্রিয় হন তবে সে অনেক অন্যায় করলেও সে সর্বদা নিজের শরীরের মতনই প্রিয় হয়।
সঞ্জীবকের প্রতি পিঙ্গলকের দুর্বলতাকে বুঝতে পেরে দমনক বললে, হে রাজন! এইটাই আপনাদের দোষ। লোকে বলে—
যস্মিন্নেবাধিকং চক্ষুরারোপযতি পার্থিবঃ।
অকুলীনঃ কুলীনো বা স শ্রিযো ভাজনং নরঃ।। (ঐ, ২৬৬)
চতুর দমনক বলল, হে রাজন! ভৃত্য যে চিরকাল ভৃত্যই হয়ে থাকবেন—এইরকম নিয়ম তো কোথাও নেই। জগতে এমন কোনও রাজপুরুষ নেই যে রাজৈশ্বর্য বা ক্ষমতা চান না; একমাত্র অসমর্থ লোকেরাই রাজার সেবা করে—রাজপদের আকাঙ্খা করে না। যেকোনও সমর্থ লোকই মনে মনে রাজা হওয়ার বাসনা রাখে। ক্ষমতার এমনই মোহ।
সিংহ পিঙ্গলক বললেন, ওহে দমনক! আপনার সমস্ত যুক্তিই আমি সমর্থন করছি, কিন্তু তত্সত্ত্বেও তার প্রতি আমার মনে কোনও রকম বিকৃতি জন্মাচ্ছে না। সে আমার কোনও ক্ষতি চায় এইটা আমি কিছুতেই কল্পনাতেও আনতে পারছি না। পণ্ডিতেরা বলেন—
কুর্বন্নপি ব্যলোকানি যঃ প্রিযঃ প্রিয এব সঃ।। (মিত্রভেদ, ২৬৫)
মানুষের স্বভাব হয়তো এমনই বিচিত্র। পছন্দের মানুষের মধ্যে অনেক দোষও থাকলেও, মানুষ তার খারপটা কখনই দেখতে পায় না। যেমন নিজের শরীরের মধ্যে অনেক দোষ থাকলেও সেই দোষদুষ্ট শরীরকেই মানুষ ভালোবাসে—তাকে ত্যাগ করার চিন্তা কেউ করেন না। তাই সেই বিপরীতবুদ্ধি মানুষটি যদি প্রিয় হন তবে সে অনেক অন্যায় করলেও সে সর্বদা নিজের শরীরের মতনই প্রিয় হয়।
সঞ্জীবকের প্রতি পিঙ্গলকের দুর্বলতাকে বুঝতে পেরে দমনক বললে, হে রাজন! এইটাই আপনাদের দোষ। লোকে বলে—
অকুলীনঃ কুলীনো বা স শ্রিযো ভাজনং নরঃ।। (ঐ, ২৬৬)
অর্থাৎ রাজা যে ব্যক্তির উপর বেশি পরিমাণে কৃপাবর্ষণ করেন, সে স্বভাবে ভালো হোক বা মন্দ- লক্ষ্মীলাভ তার নিশ্চিত। তা না হলে, হে রাজন! আপনি একটু চিন্তা করে বলুন ঠিক কোন গুণটা থাকবার কারণে এই বৃষ-সঞ্জীবকের প্রতি আপনি এতোটা স্নেহভাব পোষণ করেন বা তাকে আপনার এতটা কাছের জন করে সব সময় সঙ্গে সঙ্গে রেখেছেন। আপনি যদি ভেবে থাকেন তার বিশাল শরীর বলে সে আপনার শত্রুদমন করতে পারবে তাহলে আপনি নিতান্তই ভুল ভাবছেন; কারণ সে একটি সামান্য তৃণভোজী প্রাণী মাত্র আর আপনার শত্রুরা সকলে মাংসাশী। তাই বিশালকায় হলেও আপনার শত্রুদের পরাজিত করতে এই সঞ্জীবক একেবারেই সমর্থ নয়। “তস্মাদেনং দূষযিত্বা হন্যতাম্”-এর উপর মিথ্যা দোষ আরোপ করে একে হত্যা করুন। কারণ আপনার প্রতি দ্রোহভাব পোষণ করে যে আপনাকে ক্ষমতাচ্যূত করতে চায় তার প্রতি কৃপাবর্ষণ করাটা উচিত নয়।
পিঙ্গলক বললেন, যদি কোনও ব্যক্তি, কাউকে সভামধ্যে সকলের সামনে প্রথমে একবার গুণীজন বলে ঘোষণা করে থাকেন, তাহলে পরে আবার সেই ব্যক্তিকেই দোষী বলাটা সঙ্গত হবে না। এতে সেই ব্যক্তির নিজের কথার কোনও দাম থাকবে না।
পিঙ্গলক তাই কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেই বলল, ওহে দমনক! সবচেয়ে বড় কথাটা যেটা, সেটা হল, তোমার কথা শুনেই আমি তাকে অভয় প্রদান করেছিলাম। তাই কি করে আমি নিজেই তাকে হত্যা করি? রাজা হিসেবে আমার কথার দাম বলে তো আর কিছুই থাকবে না। তাছাড়া সব দিক দিয়ে বিচার করে দেখলে এই সঞ্জীবক সত্যিই আমার একজন উত্তম সুহৃদ। তার প্রতি আমার এখনও পর্যন্ত কোনও ক্রোধের কারণ উপস্থিত হয়নি। পুরাণের তারকাসুরের কাহিনীকে স্মরণ একবার স্মরণ করে দেকতে বলবো। ব্রহ্মার বরদানে সে অজেয় হয়েছিল। কিন্তু সে যখন স্বর্গ থেকে ইন্দ্রকে বিতারণ করে নিজেই ইন্দ্রপদে অধিষ্ঠিত হন তখন পিতামহ ব্রহ্মার কাছে সকল দেবতারা একত্রিত হয়ে তাকে তারকাসুরকে বধ করবার প্রার্থনা জানান। পিতামহ ব্রহ্মা তখন বলেছিলেন—
ইতঃ স দৈত্যঃ প্রাপ্তশ্রীর্নৈত এবার্হতি ক্ষযম্।
বিষবৃক্ষোঽপি সংবর্ধ্য স্বযং ছেত্তুমসাম্প্রতম্।। (ঐ, ২৬৮)
পিঙ্গলক বললেন, যদি কোনও ব্যক্তি, কাউকে সভামধ্যে সকলের সামনে প্রথমে একবার গুণীজন বলে ঘোষণা করে থাকেন, তাহলে পরে আবার সেই ব্যক্তিকেই দোষী বলাটা সঙ্গত হবে না। এতে সেই ব্যক্তির নিজের কথার কোনও দাম থাকবে না।
পিঙ্গলক তাই কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেই বলল, ওহে দমনক! সবচেয়ে বড় কথাটা যেটা, সেটা হল, তোমার কথা শুনেই আমি তাকে অভয় প্রদান করেছিলাম। তাই কি করে আমি নিজেই তাকে হত্যা করি? রাজা হিসেবে আমার কথার দাম বলে তো আর কিছুই থাকবে না। তাছাড়া সব দিক দিয়ে বিচার করে দেখলে এই সঞ্জীবক সত্যিই আমার একজন উত্তম সুহৃদ। তার প্রতি আমার এখনও পর্যন্ত কোনও ক্রোধের কারণ উপস্থিত হয়নি। পুরাণের তারকাসুরের কাহিনীকে স্মরণ একবার স্মরণ করে দেকতে বলবো। ব্রহ্মার বরদানে সে অজেয় হয়েছিল। কিন্তু সে যখন স্বর্গ থেকে ইন্দ্রকে বিতারণ করে নিজেই ইন্দ্রপদে অধিষ্ঠিত হন তখন পিতামহ ব্রহ্মার কাছে সকল দেবতারা একত্রিত হয়ে তাকে তারকাসুরকে বধ করবার প্রার্থনা জানান। পিতামহ ব্রহ্মা তখন বলেছিলেন—
বিষবৃক্ষোঽপি সংবর্ধ্য স্বযং ছেত্তুমসাম্প্রতম্।। (ঐ, ২৬৮)
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২৯: রাজ্য পরিচালনার ভার একজন মন্ত্রীর উপর ন্যস্ত হলে, তাঁর মনে অহঙ্কার জন্মায় যা রাজদ্রোহের পথকে প্রশস্ত করে
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২২: ঠাকুর ও মা সারদার সংসার
সকল দেবতাদেরকে পিতামহ ব্রহ্মা বলেছিলেন, এই তারকাসুর আমার বলেই বলীয়ান হয়েই আজ ত্রিভূবনের সম্পদকে ভোগ করছে। তাই আমার নিজের অন্তত তাকে বিনাশ করা উচিত নয়। কারণ, শাস্ত্র বলে নিজের হাতে পালন-পোষণ করে বড় করা বিষবৃক্ষকেও স্বয়ং ছেদ করা উচিত নয়। প্রথমত, প্রেমিকদের তো কারও সঙ্গে প্রেম করাই উচিত নয়। কিন্তু একবার প্রেম নিবেদন করবার পর নিরন্তন তার সেই প্রেমকে পুষ্ট করতে হয়। কারণ কাউকে প্রেমে নিমজ্জিত করে পরে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা অত্যন্ত লজ্জাজনক। আসলে যিনি ভূমিতে অবস্থান করেন তার পতনের কোনও আশঙ্কা থাকে না, কিন্তু প্রেমে যিনি উড়তে থাকেন পতনের সম্ভাবনা তারই হয়। সঞ্জীবকের প্রতি যদি আমি আমার প্রেমভাব প্রদর্শিত না করতাম তাহলে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা আমার পক্ষে খুব একটা কঠিন ব্যাপার হতো না। কিন্তু তার প্রতি আমিও স্নেহাসক্ত, তাই এখন তাকে প্রত্যাখ্যান করলে তার পতনের আশঙ্কা আমারও আছে। শাস্ত্রে বলে—
উপকারিষু যঃ সাধুঃ সাধুত্বে তস্য কো গুণঃ।
অপকারিষু যঃ সাধুঃ স সাধুঃ সদ্ভিরুচ্যতে।। (ঐ, ২৭০)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি শুধু নিজের উপকারীর প্রতি সদ্ব্যবহার করে সেটা তার কোনও বিশেষ গুণও নয়। নীচ ব্যক্তিও নিজের উপকারীর প্রতি সুব্যবহার করে, যে যাঁর কাছ থেকে উপকার পায় সে তার প্রতি অনুগত হয় এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অপকারীর প্রতিও যিনি সজ্জন— তিনিই আসল সাধু ব্যক্তি। এইটাই বিশেষ গুণ।
সুতরাং, সংক্ষেপে পিঙ্গলকের বক্তব্যের সারটুকু হল, “তদ্দ্রোহবুদ্ধেরপি মযাস্য ন বিরুদ্ধমাচরণীযম্” —মিত্র সঞ্জীবক আমার প্রতি দ্রোহপূর্ণ মনোভাব পোষণ করলেও আমার অন্ততঃ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবার কোনও বাসনা নেই।
দমনক বিচক্ষণ মন্ত্রী। সঞ্জীবকের প্রতি রাজার স্নেহ যে অত্যন্ত গভীর এটা বুঝতে অসুবিধা হল না তার। সহজে যে পিঙ্গলকের সঙ্গে সঞ্জীবকের ভেদ সৃষ্টি করা যাবে না একথা সে বুঝতে পারলো।
অপকারিষু যঃ সাধুঃ স সাধুঃ সদ্ভিরুচ্যতে।। (ঐ, ২৭০)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি শুধু নিজের উপকারীর প্রতি সদ্ব্যবহার করে সেটা তার কোনও বিশেষ গুণও নয়। নীচ ব্যক্তিও নিজের উপকারীর প্রতি সুব্যবহার করে, যে যাঁর কাছ থেকে উপকার পায় সে তার প্রতি অনুগত হয় এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অপকারীর প্রতিও যিনি সজ্জন— তিনিই আসল সাধু ব্যক্তি। এইটাই বিশেষ গুণ।
সুতরাং, সংক্ষেপে পিঙ্গলকের বক্তব্যের সারটুকু হল, “তদ্দ্রোহবুদ্ধেরপি মযাস্য ন বিরুদ্ধমাচরণীযম্” —মিত্র সঞ্জীবক আমার প্রতি দ্রোহপূর্ণ মনোভাব পোষণ করলেও আমার অন্ততঃ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবার কোনও বাসনা নেই।
দমনক বিচক্ষণ মন্ত্রী। সঞ্জীবকের প্রতি রাজার স্নেহ যে অত্যন্ত গভীর এটা বুঝতে অসুবিধা হল না তার। সহজে যে পিঙ্গলকের সঙ্গে সঞ্জীবকের ভেদ সৃষ্টি করা যাবে না একথা সে বুঝতে পারলো।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৪: সে যেন অন্য এক ‘পূনর্মিলন’
চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-৩: অবশেষে অভাবনীয় প্রাপ্তি ও স্বপ্নপূরণ
সিংহ পিঙ্গলককে সে বলল, হে রাজন! যাঁরা শত্রুভাবাপন্ন তাঁদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন কিন্তু রাজধর্ম নয়। আপনি তো ঋষিদের মতন ক্ষমাধর্মের কথা বলছেন। রাজনীতিশাস্ত্রের পণ্ডিতরা বলেন, যে রাজা রাজপদের অভিলাষী তাঁর তূল্য-বল, তূল্য-সামর্থ্য যুক্ত শত্রুকে হত্যা না করেন, যে শত্রু রাজার দুর্বলতাকে জানেন কিংবা রাজার অর্ধরাজ্য হরণ করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, সেই শত্রুই রাজার মৃত্যুর কারণ হয়। তাছাড়া সবচেয়ে বড়ো কথাটা যেটা সেটা হল এই সঞ্জীবকের সঙ্গে মিত্রতা হওয়ার পর থেকে রাজধর্ম পালনেও আপনার ঘাটতি পড়েছে—দণ্ড প্রদানের যোগ্য ব্যক্তি স্বাধীনভাবে নগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজদণ্ডের অভাবে আপনার সমস্ত সেবকেরাও এখন আপনার আদেশ যথাযথ পালন করছে না। কারণ তাঁরা জানেন যে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলেও দণ্ডের ভয় তাঁদের নেই।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দমনক বিনীতভাবে বললে, আপনি একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন মহারাজ! আপনার বন্ধু হলো তৃণভোজী—নির্জীব; আর আপনার অমাত্য বা সেবকেরা সকলেই মাংসাশী হিংস্র। আপনি স্বয়ং বন্ধুকৃত্য পালন করতে গিয়ে তৃণভোজীদের মতন আচরণ করলে আপনার অমাত্য বা হিংস্র সেবকদের মাংস ভোজন জুটবে কীভাবে? খাবারের জন্যই সেবক রাজাকে অনুসরণ করে, আর সে খাবার যদি তারা রাজার থেকে না পায় তবে তারাও আপনাকে একদিন ছেড়ে চলে যাবে। আর এর পরিমাণ কিন্তু একমাত্র আপনারই বিনাশ। এই বৃষ-সঞ্জীবকের সঙ্গে আপনি যত সময় অতিবাহিত করবেন, আপনার শিকার করার হিংস্র প্রবৃত্তি বা আপনার পরাক্রমশীলতা সবকিছুই লোপ পাবে। শাস্ত্রে বলে—
যাদৃশৈঃ সেব্যতে ভৃত্যৈর্যাদৃশাংশ্চোপসেবতে।
কদাচিন্নাত্র সন্দেহস্তাদৃগ্ ভবতি পুরুষঃ।। (ঐ, ২৭২)
অর্থাৎ যেরকম গুণসম্পন্ন সেবক রাজার সেবা করেন আর রাজাও যেরকমের গুণসম্পন্ন সেবককে নিজের আশ্রয়ে রাখেন, রাজাও সেইরকম গুণ সম্পন্নই হয়ে যান এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। দুষ্টলোকের সঙ্গে মেলামেশা করলে সজ্জন লোকেরও প্রকৃতি বিকৃত হয়ে যায়, তার মনেও সমান দুষ্টতা প্রকাশ পায়। মহাভারতের কথা স্মরণ করুন রাজন্! না হলে ভাবুন তো, গঙ্গাপুত্র ভীষ্মকেও দুর্যোধনের মতো দুষ্টের পাল্লায় পড়ে বিরাট রাজ্যে গোধন চুরির অপরাধে অপরাধী হতে হল। তাই সঙ্গদোষ হল এক মারাত্মক দোষ।
পাঠক-পাঠিকাদেরকে বলবো, দয়া করে আপনি প্রাচীন ভারতবর্ষের তত্কালীন জনমানসিকতাকে স্মরণ করবেন। পঞ্চতন্ত্র যদি আনুমানিক খ্রিষ্টিয় প্রথম শতাব্দীর সমসায়িক কালের গ্রন্থ হয়ে থাকে, তাহলে সে সময়ে উত্তরভারতের রাজনীতি মৌর্য পরবর্তী বৌদ্ধ প্রভাবিত কুষাণ রাজগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এছাড়াও সংসারের অসারতা প্রচারে নিমগ্ন অন্যান্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রচারে ভারতীয় জনমানস তখন বেদবিরোধী প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত। বৌদ্ধ প্রভাবিত মৌর্যসম্রাট অশোকের পরক্রমহীন ধর্মঘোষনীতি তখনও কিংবদন্তী না হলেও সমাজে পরিচিত। পরাক্রম ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, রাজার ধর্ম। রাজা যদি সদ্ধর্মী ঋষির সংস্পর্শে এসে তাঁর মতন ক্ষমাধর্মে বিশ্বাসী হয়ে যান তাহলে তিনি রাজর্ষি হয়ে হয়তো মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করলেও করতে পারেন, কিন্তু রাজ্যরক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তৃণভোজী এবং মাংসাশী রূপকের মাধ্যমে এই তত্ত্বটাকেই হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন পঞ্চতন্ত্রকার।—চলবে।
কদাচিন্নাত্র সন্দেহস্তাদৃগ্ ভবতি পুরুষঃ।। (ঐ, ২৭২)
অর্থাৎ যেরকম গুণসম্পন্ন সেবক রাজার সেবা করেন আর রাজাও যেরকমের গুণসম্পন্ন সেবককে নিজের আশ্রয়ে রাখেন, রাজাও সেইরকম গুণ সম্পন্নই হয়ে যান এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। দুষ্টলোকের সঙ্গে মেলামেশা করলে সজ্জন লোকেরও প্রকৃতি বিকৃত হয়ে যায়, তার মনেও সমান দুষ্টতা প্রকাশ পায়। মহাভারতের কথা স্মরণ করুন রাজন্! না হলে ভাবুন তো, গঙ্গাপুত্র ভীষ্মকেও দুর্যোধনের মতো দুষ্টের পাল্লায় পড়ে বিরাট রাজ্যে গোধন চুরির অপরাধে অপরাধী হতে হল। তাই সঙ্গদোষ হল এক মারাত্মক দোষ।
পাঠক-পাঠিকাদেরকে বলবো, দয়া করে আপনি প্রাচীন ভারতবর্ষের তত্কালীন জনমানসিকতাকে স্মরণ করবেন। পঞ্চতন্ত্র যদি আনুমানিক খ্রিষ্টিয় প্রথম শতাব্দীর সমসায়িক কালের গ্রন্থ হয়ে থাকে, তাহলে সে সময়ে উত্তরভারতের রাজনীতি মৌর্য পরবর্তী বৌদ্ধ প্রভাবিত কুষাণ রাজগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এছাড়াও সংসারের অসারতা প্রচারে নিমগ্ন অন্যান্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রচারে ভারতীয় জনমানস তখন বেদবিরোধী প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত। বৌদ্ধ প্রভাবিত মৌর্যসম্রাট অশোকের পরক্রমহীন ধর্মঘোষনীতি তখনও কিংবদন্তী না হলেও সমাজে পরিচিত। পরাক্রম ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, রাজার ধর্ম। রাজা যদি সদ্ধর্মী ঋষির সংস্পর্শে এসে তাঁর মতন ক্ষমাধর্মে বিশ্বাসী হয়ে যান তাহলে তিনি রাজর্ষি হয়ে হয়তো মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করলেও করতে পারেন, কিন্তু রাজ্যরক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তৃণভোজী এবং মাংসাশী রূপকের মাধ্যমে এই তত্ত্বটাকেই হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন পঞ্চতন্ত্রকার।—চলবে।