শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

“ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পাথরের ঘাট গোমতী নদীতে গিয়া প্রবেশ করিয়াছে। ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য একদিন গ্রীষ্মকালীন প্রভাতে স্নান করিতে আসিয়াছেন, সঙ্গে তাঁহার ভাই নক্ষত্র রায়ও আসিয়াছেন। এমন সময়ে একটি ছোটো মেয়ে তাহার ছোটো ভাইকে সঙ্গে করিয়া সেই ঘাটে আসিল। রাজার কাপড় টানিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি কে?’
রাজা ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, ‘মা আমি তোমার সন্তান।’
মেয়েটি বলিলেন, ‘আমাকে পূজার ফুল পাড়িয়া দাও-না।’
রাজা বলিলেন, ‘আচ্ছা, চলো।’
অনুচরগণ অস্হির হইয়া উঠিল। তাহারা বলিল, ‘মহারাজ, আপনি কেন যাইবেন, আমরা পাড়িয়া দিতেছি।’
রাজা বলিলেন, ‘না,আমাকে যখন বলিয়াছে আমিই পড়িয়া দিব।’…
এই ভাবে শুরু হয়েছে ‘রাজর্ষি’। প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম কয়েকটি লাইনেই রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের মানবিক রূপটি যেন আমাদের অন্তরে নাড়া দিয়ে যায়। অখ্যাত প্রজার ঘরের একটি ছোট্ট মেয়েকে মা সম্বোধন করছেন রাজা। শুধু তাই নয়, এই মেয়ের অনুরোধে অনুচরদের বারণ সত্ত্বেও রাজা স্বয়ং তাকে পূজার ফুল পেড়ে দিতে যাচ্ছেন।
“এরপর হাত ধরিয়া রাজা স্নান করিতে আসিয়াছেন। একটি রক্তস্রোতের রেখা শ্বেত প্রস্তরের ঘাটের সোপান বাহিয়া জলে গিয়া শেষ হইয়াছে। কাল রাত্রে যে একশো-এক মহিষ বলি হইয়াছে তাহারই রক্ত। হাসি সেই রক্তের রেখা দেখিয়া সহসা এক প্রকার সংকোচে মরিয়া গিয়া রাজাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘এ কিসের দাগ, বাবা?’
রাজা বলিলেন, ‘রক্তের দাগ,মা।’
সে কহিল, ‘এত রক্ত কেন?’
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৭: মহারাজা বীরচন্দ্রের হাতে এসেছিল তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের ‘ভগ্ন হৃদয়’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৯: কী ছিল চিঠিতে, উত্তর লিখতে গিয়ে উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের হাত কেঁপেছিল

এমন এক প্রকার কাতর স্বরে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল ‘এত রক্ত কেন’ যে, রাজারও হৃদয়ের মধ্যে ক্রমাগত এই প্রশ্ন উঠিতে লাগিল ‘এত রক্ত কেন’। তিনি সহসা শিহরিয়া উঠিলেন।…
রাজবৈদ্য আসিয়া সন্দেহ প্রকাশ করিয়া গেল। রাজা সন্ধ্যাবেলায় আবার হাসিকে দেখিতে আসিলেন। তখন বালিকা প্রলাপ বকিতেছে। বলিতেছে, ‘মা গো, এত রক্ত কেন!’
রাজা কহিলেন, ‘মা রক্তস্রোত নিবারণ করিব।’
বালিকা বলিল, ‘আয় ভাই তাতা, আমরা দুজনে এ রক্ত মুছে ফেলি।’
রাজা কহিলেন, ‘আয় মা, আমিও মুছি।’…”
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

মূলত কাহিনির শুরু যেন এখান থেকেই। অনুতপ্ত রাজা এরপর তাঁর রাজ্যে বলি নিষিদ্ধ করে দিলেন। আবহমানকাল যাবৎ চলে আসা বলি বন্ধ হওয়ায় ভীষণ রুষ্ট হলেন পুরোহিত রঘুপতি। শুরু হল চক্রান্ত। রাজার ভাই নক্ষত্ররায়কে প্ররোচিত করলেন রঘুপতি। কালক্রমে রাজ্যচ্যুত হলেন গোবিন্দ মাণিক্য। এই ভাবেই এগিয়ে গেছে উপন্যাস।

মানবিক মূল্যবোধ ভিত্তিক হলেও কিছু কিছু ঐতিহাসিক উপাদান নিঃসন্দেহে পুষ্ট করেছে ‘রাজর্ষি’কে। প্রথম ‘বালক’ পত্রিকায় ১২৯২ বঙ্গাব্দে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় ‘রাজর্ষি’। আষাঢ় থেকে মাঘ পর্যন্ত এর ২৬টি অধ্যায় বের হয়। তারপর ১২৯৩ বঙ্গাব্দে বই আকারে প্রকাশিত হয় তা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলে গিয়েছেন—”এ আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প।”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৪: শিকারী ও ‘শিকার’

মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

‘রাজর্ষি’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন—”…দুই-এক সংখ্যা ‘বালক’ বাহির হইবার পর একবার দুই-একদিনের জন্য দেওঘরে রাজনারায়ণ বাবুকে দেখিতে যাই। কলিকাতায় ফিরিবার সময় রাত্রের গাড়িতে ভিড় ছিল, ভালো করিয়া ঘুম হইতেছিল না-ঠিক চোখের উপর আলো জ্বলিতেছিল। মনে করিলাম, ঘুম যখন হইবেই না তখন এই সুযোগে ‘বালকের’ জন্য একটা গল্প ভাবিয়া রাখি। গল্প ভাবিবার ব্যর্থ চেষ্টার টানে গল্প আসিল না,ঘুম আসিয়া পড়িল। স্বপ্ন দেখিলাম, কোন এক মন্দিরের সিঁড়ির উপর বলির রক্তচিহ্ণ দেখিয়া একটি বালিকা অত্যন্ত করুণ ব্যাকুলতার সঙ্গে তাহার বাপকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, ‘বাবা, এ কী! এ-যে রক্ত!’ বালিকার এই কাতরতায় তাহার বাপ অন্তরে ব্যথিত হইয়া অথচ বাহিরে রাগের ভান করিয়া কোনো মতে তার প্রশ্নটাকে চাপা দিতে চেষ্টা করিতেছে-জাগিয়া উঠিয়াই মনে হইল,এটি আমার স্বপ্ন-লব্ধ গল্প। এমন স্বপ্নে-পাওয়া গল্প এবং অন্য লেখা আমার আরো আছে।এই স্বপ্নটির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের পুরাবৃত্ত মিশাইয়া ‘রাজর্ষি’ গল্প মাসে মাসে লিখিতে ‘বালকে’ বাহির করিতে লাগিলাম।…”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৯: আলোকলতা তিলোত্তমারা যুগে যুগে পুরুষের উজ্জীবনী শক্তির আধার

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০০: চোর মাচায়ে শোর

একটি স্বপ্নলব্ধ গল্পের সঙ্গে ত্রিপুরার পুরাবৃত্ত সংমিশ্রণে আমরা যে ‘রাজর্ষি’ পেয়েছি তাই যেন ইতিহাসকে ছাপিয়েও হয়ে গেছে আসল ইতিহাস। ১৩৮ বছর আগে লেখা হয়েছিল ‘রাজর্ষি’। পটভূমি ছিল তারও প্রায় সোয়া দুশো বছর আগেকার। তবু এখনও যেন ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী উদয়পুর সাক্ষ্য দেয় সেইসব গৌরবময় রাজকাহিনির। বহমান গোমতীর অববাহিকা জুড়ে জনপদবাসীদের হৃদয়ে হৃদয়ে এখনও যেন অনুরণিত ভুবনেশ্বরী মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি! গোবিন্দ মাণিক্য সত্যিই ঋষিতুল্য রাজা ছিলেন কিনা, কিংবা গোমতীর তীরের সেই মন্দিরটি আদৌ ভুবনেশ্বরী মন্দির কিনা সেসব প্রশ্ন আজ অবান্তর। ‘রাজর্ষি’র গোবিন্দ মাণিক্যের রাজর্ষি রূপটি এবং তাঁর সেদিনকার রাজধানী উদয়পুর, ভুবনেশ্বরী মন্দির কিংবা দোর্দণ্ডপ্রতাপ চন্তাই রঘুপতি যেন আমাদের হৃদয়ে এক স্হায়ী আসন লাভ করে নিয়েছে। তাই সকলের হৃদয়ে আজ ‘রাজর্ষি’র গোবিন্দ মাণিক্যই উজ্জ্বল।—চলবে।
* * ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content