বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেব এবং নৃপেন চক্রবর্তী।

১৯৯৩ সালের ১০ এপ্রিল প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা দশরথ দেবের নেতৃত্বে শপথ গ্রহণ করল তৃতীয় বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা। এই সরকারের চলার পথ মোটামুটি নিষ্কন্টক থাকলেও এর কার্যকালের শুরুতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছিল রাজনৈতিক বিতর্ক। নৃপেনবাবুকে রাজ্য যোজনা পর্ষদের চেয়ারম্যান করে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সাধারণত পদাধিকার বলে যোজনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হয়ে থাকেন রাজ্য মুখ্যমন্ত্রীই। কিন্তু নৃপেনবাবুর ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটে।

সম্ভবত দশ বছরের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের অবিসংবাদিত সিপিএম নেতা নৃপেনবাবুকে মুখ্যমন্ত্রীর মর্যাদার সমতুল্য পদে রাখতে চেয়েছিলেন দলীয় নেতৃত্ব। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা যে সুখের হয়নি। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে। তিনি সরকারি কাজে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ করতে থাকেন। এমনকি, মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেবের বাড়িতে আর্দালি নিয়োগের মতো ঘটনা নিয়েও অভিযোগ জানান তিনি।

স্বাভাবিক ভাবেই যোজনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নৃপেনবাবুর কিছু অভিযোগ সংবাদমাধ্যমেরও রসদ হয়। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, তখন পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, দশরথবাবুর পক্ষে সরকার পরিচালনাটাই কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত যোজনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে নৃপেনবাবুকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অবশ্য তাতে যে সমস্যার পরিসমাপ্তি ঘটল এমন নয়, বরং সিপিএম’র মধ্যে নৃপেন ইস্যুজনিত অস্বস্তি দিন দিন বাড়তেই থাকল।
যোজনা পর্ষদের চেয়ারম্যান না থাকলেও তিনি তো নৃপেন চক্রবর্তী! তাই তাঁর বক্তব্য যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই কাগজে কাগজে ছাপা হতে থাকল। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে নৃপেনবাবুকে সিপিএম পলিটব্যুরো থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। বলাই বাহুল্য তাতে তাঁর ক্ষোভ, অসহিষ্ণুতা যেন আরও বেড়ে গেল। তৃতীয়বারের মতো রাজ্যে সিপিএম তথা বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় আনার প্রধান কারিগর নৃপেন চক্রবর্তী তখন রাজধানীর দু’ নম্বর আবাসে বসে খবরের কাগজের জন্য লিখে চলেছেন পাতার পর পাতা-যাতে সমালোচনার বর্শামুখ ছিল সিপিএম নেতৃত্বের দিকে।

১৯৯৫ সালের এপ্রিলে নৃপেনবাবুকে সিপিএম দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত করায় তাঁর বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একে ইতিহাসের এক নির্মম পরিণতি হিসেবেই অভিহিত করা যায়। অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল যাবৎ যিনি পার্টির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, নানা সময়ে পার্টির গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন, ত্রিপুরায় পার্টিকে মূলত ক্ষমতায় এনেছেন যিনি, শেষপর্যন্ত তাকেই কিনা বহিষ্কৃত হতে হল! সিপিএম নেতৃত্ব দলীয় অনুশাসনের দোহাই দিয়ে এ রকম কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও রাজ্যের আপামর দলীয় কর্মী সমর্থকদের মধ্যে এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয় এই সিদ্ধান্তে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৬: কংগ্রেসের নেতৃত্বে দুটি জোট সরকার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

ত্রিপুরার ডান-বাম সকল অংশের মানুষ এটা জানেন যে, এ রাজ্যে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের বিস্তার সহ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠান-সব কিছুর পিছনেই অন্যতম চালিকা শক্তি এই মানুষটি। এমনকি, ১৯৮৮ সালে ক্ষমতাচ্যুতির পর সাংগঠনিক তৎপরতাকে সামগ্ৰিক ভাবে জোট সরকারের বিরুদ্ধে সুসংহত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা-সহ দিল্লিতে একের পর এক পত্র বোমা নিক্ষেপ— সব মিলিয়ে ক্ষমতার তখ্তে বামেদের ফিরে আসার ক্ষেত্রে নৃপেনবাবুর অবদান কে অস্বীকার করবে! কিন্তু সেই মানুষটিকেই কিনা দল থেকে বহিষ্কার করা হল! ত্রিপুরার মানুষ যেন এটা মন থেকে মানতে চায়নি। নৃপেনবাবু সেদিন বলেছিলেন—”আমি কমিউনিস্ট। কমিউনিস্টই থাকব। আমার সভ্যপদ কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

নৃপেনবাবুর বহিষ্কার ইস্যু তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকারকে পরোক্ষ ভাবে কিছুটা চাপের মধ্যে ফেলে দেয়। একদিকে দলীয় অনুশাসন নির্ভর পার্টির বাধ্যবাধকতা, অপরদিকে পার্টি কর্মী-সহ সর্বস্তরের মানুষের আবেগ। দু’ নম্বর বিধায়ক আবাসের নৃপেনবাবুর কক্ষ তখন মিডিয়ারও লক্ষ্য। বিশিষ্ট সাংবাদিক-সহ দেশের বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারাও আসছেন নৃপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে।

একদিন কলকাতা থেকে উড়ে এলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা তখন বাম শাসিত বঙ্গের প্রধান বিরোধী মুখ। সব মিলিয়ে তখন যেন বামেদের বিরুদ্ধেই প্রবাহিত ঘটনার ঘনঘটা। এরই মধ্যে আবার ত্রিপুরার কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সমীর রঞ্জন বর্মণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বামফ্রন্ট সরকারকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন নৃপেনবাবু। দশরথবাবুর নেতৃত্বে তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই নৃপেনবাবুর সমালোচনার বাণ তাঁকে বিদ্ধ করছিল। পরবর্তী সময়ে তা আরও বাড়তেই থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে সরকারের অস্বস্তিও।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতাও বাড়তে থাকে। গ্রাম-পাহাড়ে অপহরণ, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, খুন,চাঁদা আদায় ইত্যাদি চলতে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, সন্ত্রাসবাদীদের খুন সন্ত্রাসের ফলে শিক্ষক কর্মচারীরা প্রত্যন্ত এলাকায় কাজে যেতে ভয় পান। স্কুল বন্ধ হয়ে পড়ে। উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে যায়।

এ অবস্থায় সন্ত্রাসবাদীদের দমনে রাজ্যের বেশ কিছু থানা এলাকাকে উপদ্রুত ঘোষণা করে সেনা নামানো হয়। পাশাপাশি শান্তি-সম্প্রীতির লড়াই জারি রেখে বিপথগামী যুবকদের স্বাভাবিক জীবন স্রোতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ত্রিপুরায় পৃথক উপজাতি রাজ্য গঠনের দাবিও উঠেছিল। মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেব এই দাবির বিরোধিতা করে বলেছিলেন, পৃথক রাজ্য গঠনের মধ্য দিয়ে পশ্চাদপদ উপজাতি জনগণের সমস্যার সমাধান হবে না।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৬: প্রথমে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির বিজ্ঞাপনে উত্তম কুমারকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি

যাইহোক, দশরথবাবুর নেতৃত্বাধীন তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে নানা সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে ত্রিপুরাকে। একদিকে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা এবং অপরদিকে সৃষ্টি হয়েছিল জাতি-উপজাতি সংঘাতের এক বাতাবরণ। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে, জনগণের সচেতন আন্দোলনই জাতি-উপজাতি ঐক্যের গ্যারান্টি সৃষ্টি করতে পারে।

তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে ত্রিপুরায় সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় বহু নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সরকার সন্ত্রাসবাদ সমস্যার সমাধানে নিরলস ভাবে কাজ করে গেলেও মানুষের মৃত্যু, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ ইত্যাদি ঠেকানো যায়নি। তবে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তখন রাজ্যে কিছু কিছু উন্নয়ন কর্মসূচি রূপায়িত হয়। উদ্যোগ নেওয়া হয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের। ১৯৯৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়ে বামফ্রন্ট আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে। —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content