রবিবার ২৩ মার্চ, ২০২৫


(বাঁদিকে) হলদে পলাশের মধুপায়ী পুরুষ দুর্গা টুনটুনি। ছবি: সংগৃহীত। (মাঝখানে) আমার আমগাছে দুর্গা টুনটুনির বাসা। ছবি: লেখক। (ডান দিকে) স্ত্রী দুর্গা টুনটুনি। ছবি: সংগৃহীত।

গত বছরের কথা। কন্যার চিকিৎসার কারণে ঘর গেরস্থালি ছেড়ে সপরিবারে প্রায় একমাস ছিলাম দক্ষিণ ভারতে। বাড়ি পাহারায় ছিলেন আমার শাশুড়ি ঠাকরুণ। তা বাড়ি ফিরে দেখি আমার উঠোনের আমগাছে মাটি থেকে নয় দশ ফুট ওপরে একটা শাখা থেকে ঝুলছে অদ্ভুত সুন্দর একটা বাসা। এই ধরনের বাসা আমার অপরিচিত নয়। ছোট থেকে এই বাসা অনেক দেখেছি। কিছুদিন আগে আমার ভাইয়ের বাড়ির জামরুল গাছেও দেখেছি। কোন পাখির বাসা, তাও আমি জানি। আর সেই পাখিকে আশৈশব গ্রামের বাড়িতে উঠোনে থাকা জবা আর রঙ্গন ফুলের গাছে ওড়াউড়ি করতে দেখেছি। আর এখন আমার শহরের বাড়ির উঠোনে থাকা জবা ফুলের গাছেও সেই একই পাখিকে মিষ্টি সুরে ডাকতে ডাকতে উড়তে দেখি প্রায় প্রতিদিন। সেই কারণে আম গাছে ওই বাসা দেখে আদৌ অবাক হইনি।
কিন্তু বাসার ভিতরে ডিম বা বাচ্চারা নেই তো? কয়েকদিন নিবিড়ভাবে লক্ষ্য রাখলাম বাসাটির উপর। না, বাসার মুখ দিয়ে কোনও পাখিকে ভেতরে বা বাইরে যাতায়াত করতে দেখলাম না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোল্ডিং সিঁড়িটা আম গাছের তলায় নিয়ে গিয়ে উঠে পড়লাম। বাসার কাছে গিয়ে চোখ রাখলাম গর্ত দিয়ে ভেতরের দিকে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে আলো জ্বালিয়ে দেখলাম ভেতরটা। নাহ্, ডিম বা বাচ্চা কিছুই নেই। তার মানে আমাদের অনুপস্থিতির সময়ে ওই পাখিরা বাসা বানিয়ে তাতে ডিম পেড়ে নিশ্চিন্তে বাচ্চাদের বড় করে নিয়ে উড়ে গেছে। সুন্দরবন অঞ্চলে যেখানেই মধুযুক্ত ফুলের গাছ আছে বিশেষ করে জবা ফুলের গাছ সেখানে এই পাখিদের আনাগোনা যথেষ্ট বেশি। আকারে খুব ছোট, খুব দ্রুতগতিতে ওড়ে এবং ভীষণ ছটফটে বলে হয়তো অনেকের নজর এড়িয়ে যায়। কিন্তু এই পাখির সংখ্যা আগেও যেমন দেখেছি এখনও তেমনই দেখি। পাখি জগতের এই অতি ক্ষুদ্র কিন্তু বাহারি সদস্য হল দুর্গা টুনটুনি। ইংরেজিতে বলে সানবার্ড (Sun bird)। বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Cinnyris asiaticus’।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯১: গো-শালিক

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৩: ‘বালক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথ ‘মুকুট’ লিখতে শুরু করেন

দুর্গা টুনটুনিদের সম্বন্ধে বলতে গেলে কথা যেন ফুরাবেই না। তাহলে বাসা থেকেই শুরু করি। ওদের বাসা ছোট থেকে অনেক দেখেছি। সব বাসার গড়ন এবং উপাদান একই। পাঁচ-ছয় ইঞ্চি লম্বা বাসা গাছের কোনও শাখা থেকে নিচের দিকে ঝুলে থাকে। বাসার উপরের দিকটা নলাকার হলেও নিচের দিক সরু হতে হতে সূচালো। বাসার ওপরের দিকে থাকে একটা গোলাকার প্রবেশপথ। ওখান দিয়েই স্ত্রী দুর্গা টুনটুনি বাসার মধ্যে ঢোকে ও বেরোয়। প্রবেশপথের ঠিক ওপরেই রয়েছে অদ্ভুত এক গঠন, ঠিক যেন আমাদের বাড়ির জানালায় সানসেডের মতো। বৃষ্টির জল যাতে বাসার মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য এই অসাধারণ নির্মাণ। রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে জানালায় সানসেডের ব্যবস্থা মানুষের আগে দুর্গা টুনটুনিরা যে কবে থেকে শুরু করেছে তার ইতিহাস মনে হয় জানা নেই।

(বাঁদিকে) রূপহীন পুরুষ দুর্গা টুনটুনি। (ডান দিকে) মধু সংগ্রহরত পুরুষ দুর্গা টুনটুনি। ছবি: সংগৃহীত।

প্রকৃতিতে জীবরা স্বউদ্ভাবিত নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে যুগ যুগ ধরে। আমরা উন্নত মানুষরা সেই সব প্রযুক্তি নকল করি মাত্র। দুর্গা টুনটুনির বাসার মূল উপাদান শুকনো পাতা, সুতো, দড়ি, উল, কাগজের টুকরো, ফুলের শুকনো পাপড়ি, গাছের শুকনো বাকল, শুকনো কাঠি, ঘাস ও বাকলের তন্তু। এইসব জিনিসকে মাকড়সার জাল দিয়ে জড়িয়ে থলের মতো বাসা তৈরি করে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে খুবই অপরিচ্ছন্ন এই বাসা। বাসার গা থেকে অগোছালোভাবে কাগজের টুকরো, শুকনো বাকল, সুতো, পাতা, ছেঁড়া ন্যাকড়া, পালক ইত্যাদি ঝোলানো থাকে। সম্ভবত জোরালো বাতাসে বাসা যাতে খুব বেশি দোল না খায় সেজন্য ভারসাম্য বজায় রাখতে এই ব্যবস্থা। আবার অনেকের মতে এই ধরনের বাসা দেখলে শিকারি পাখিরা ভয় পেতে পারে। তাই ডিম ও সন্তানকে রক্ষা করতে নিরীহ দুর্গা টুনটুনিরা এই ধরনের বাসা বানায়। বাসার ভেতরে অবশ্য নরম ঘাস, তুলো ইত্যাদি দিয়ে মোলায়েম গদি তৈরি করে। স্ত্রী দুর্গা টুনটুনি তার ওপর ডিম পাড়ে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫০: রোজই দেখি আলাস্কা পর্বতশৃঙ্গের বাঁ দিকের চূড়া থেকে সূর্য উঠতে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৯: উদ্বোধনের ঠাকুরঘরে মা সারদার সঙ্গে স্বামী অরূপানন্দের কথোপকথন

দুর্গা টুনটুনিরা তাদের ছেড়ে যাওয়া বাসা দ্বিতীয়বার ব্যবহার করে না। দুর্গা টুনটুনিদের ক্ষেত্রে বাসা বানায় কেবল স্ত্রী পাখি। তার সঙ্গী পুরুষটি মাঝে মাঝে এসে বাতেলাবাজ স্বামীদের মতো বাসা বানানোর ব্যাপারে জ্ঞান দিয়ে যায়। অবশ্য সেই জ্ঞান স্ত্রী টুনটুনি আদৌ গ্রহণ করে কিনা তা আমার জানা নেই। বাসা বাঁধা শেষ হলে স্ত্রী দুর্গা টুনটুনি ধূসর বা হালকা সবুজ রঙের দু’তিনটি ডিম পাড়ে। ডিমের ওপর বাদামি ও বেগুনি ছোপ থাকে। স্ত্রী দুর্গা টুনটুনি যখন ডিমে তা দেয় তখন বাসার প্রবেশপথের কাছে তার মুখ রেখে দেয় যাতে বাইরের পরিবেশ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকে। আমি অনেকবার দুর্গা টুনটুনির চঞ্চু বেরিয়ে থাকতে দেখেছি বাসার প্রবেশ পথ দিয়ে। পুরুষ দুর্গা টুনটুনির অধিকার নেই বাসার মধ্যে প্রবেশ করার। সে এই সময় বাসার আশেপাশে ঘুরঘুর করে নানা রকম শব্দ করতে থাকে। হয়তো স্ত্রী দুর্গা টুনটুনির শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেয়! ১৪-১৫ দিন তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরিয়ে আসে। তখন অবশ্য মা-বাবা মিলে বাচ্চাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয়। ১৬ থেকে ১৭ দিনের মধ্যে বাচ্চারা উড়তে শিখে স্থায়ীভাবে বাসা ত্যাগ করে। বাসা ছাড়ার পরও বাচ্চারা তার বাবা-মায়ের সাথে প্রায় সাত দিন ঘোরাঘুরি করে। তারপর সঙ্গী বা সঙ্গিনী খুঁজে নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।

(বাঁদিকে) বাবা দুর্গা টুনটুনির সন্তান পরিচর্যা। (মাঝখানে) পুরুষ দুর্গা টুনটুনি। (ডান দিকে) প্রজনন ঋতুর আগে পুরুষ দুর্গা টুনটুনি। ছবি: সংগৃহীত।

দুর্গা টুনটুনিদের রূপের কথা না বললে এই লেখার আসল কথাই বলা হবে না। ছোট থেকে ভাবতাম ফুলের মধু খাওয়া দুর্গা টুনটুনিগুলো তিন ধরনের জাতের হয়। এক ধরনের দুর্গা টুনটুনি গাঢ় নীল বা বেগুনি রঙের হয়। বেগুনি রং থাকে পিঠ ও ডানার বেশিরভাগ অংশ এবং গাল ও গলা জুড়ে। মাথার চাঁদি, ঘাড় আর পিঠের সামনের দিকে রঙ হয় নীলচে তুঁতে রঙের। গলার কাছে তুঁতে রঙের একটা বন্ধনী দেখা যায়। তবে পালকগুলোর রঙ ও বিন্যাস এতটাই অদ্ভুত যে এদের রূপলাবণ্য দৃষ্টিআকর্ষক শুধু নয়, নিখুঁত বর্ণনা করাও মুশকিল। এতটাই চকচকে ওদের পালক যে সূর্যের আলো পড়লে মনে হয় আয়নার মতো প্রতিফলিত হচ্ছে। যেন মেটালিক রং। আর তাই এদের ইংরেজি নাম সানবার্ড হওয়া সার্থক। তবে এদের চঞ্চু, চোখ ও পায়ের রঙ কালো। পেট এবং পায়ুর কাছের অংশও কালো। এই ধরনের দুর্গা টুনটুনির বুকের পাশে অনেক সময় একগুচ্ছ কমলা রঙের পালক দেখা যায়। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে ডানার আড়ালে তা চাপা পড়ে থাকে। এরা যখন ফুলের গাছে মধু সংগ্রহের জন্য গলাটাকে লম্বা করে কিংবা শরীরটাকে নিচের দিকে ঝুলিয়ে ফুলের মধ্যে লম্বা, সূচালো ও আগার দিকে বাঁকা চঞ্চু ঢুকিয়ে দিয়ে মধু সংগ্রহ করে সে দৃশ্য চোখের পক্ষে খুবই আরামদায়ক।

দ্বিতীয় প্রকার দুর্গা টুনটুনিদের দেখেছি কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে রঙের হয়। মাথার চাঁদি ও গাল জুড়ে নীল রঙের পালকের মাঝে মাঝে ছোট ছোট হলুদ ছোপ। আর পেট জুড়ে বেশ বড় বড় হলুদ ছোপ। দেখে মনে হয় মানুষের যেমন শ্বেতি রোগ হয় এদেরও তেমন কিছু হয়েছে। কারও কারও তো আবার মাথা ও পিঠের নীল রঙ উধাও হয়ে ছাই বা তামারঙা হয়ে যায়। ডানার ওপরের নীল রঙ হয়ে যায় ফিকে। আবার গলা থেকে পেট পর্যন্ত কালো রঙের একটা লম্বা ডোরা দাগও দেখা যায়। তবে এই রকম দুর্গা টুনটুনির রং ও দাগে সামান্য রকমফের একাধিকবার আমি দেখেছি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৫: বনবাসে অর্জুনের অসংযত জীবন, আশ্রয়দাতার বিশ্বাসভঙ্গ কি অনুসরণযোগ্য আচরণ?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৮: দুর্গম গিরি কান্তার ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’

তৃতীয় প্রকারের দুর্গা টুনটুনির পিঠের দিকের রং তামাটে ধূসর। মাথা, ঘাড় ও চোখের পাশের রঙ ফিকে তামাটে বা ধূসর। তবে থুতনি, গলা ও পেটের রং হয় হলুদ। পায়ের পেছন থেকে লেজ পর্যন্ত নিচের দিকের রঙ ফ্যাকাশে সাদা। এদের চঞ্চুর রঙ হয় ফ্যাকাশে কালচে। লেজ হয় কালচে ধূসর রঙের, আর লেজের পালকের আগার কোণের দিকে সাদা রঙ দেখা যায়। অথচ এদের স্বভাব চরিত্র একই রকম। এই ধন্ধ কাটতে আমার সময় লাগল অনেকদিন। পক্ষীবিদ অজয় হোমের “বাংলার পাখি” বইটি পড়ে জানলাম প্রথম প্রকারের দুর্গা টুনটুনি হল পুরুষ পাখি। প্রজনন ঋতুতে ওর এই অসাধারণ রূপ হয়। দ্বিতীয় প্রকারের দুর্গা টুনটুনিও পুরুষ পাখি, তবে এটি তার প্রজনন ঋতু নয়। আর তাই এর রঙ এত ম্যাড়মেড়ে। তৃতীয় প্রকারের পাখি হল স্ত্রী দুর্গা টুনটুনি। রূপের ব্যাপারে পাখি জগতে পুরুষরা সবসময়ই স্ত্রীদের থেকে যে এগিয়ে তা দুর্গা টুনটুনির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

দুর্গা টুনটুনি স্ত্রী ও পুরুষ লম্বায় হয় প্রায় ৪ ইঞ্চি। ফুলের সামনে এদের ওড়ার ধরণ অনেকটা আমাদের ছবিতে দেখা হামিংবার্ডের মত। তাই অনেককে ভুল করে হামিংবার্ড বলতে শোনা যায় যদিও হামিংবার্ড ভারতে পাওয়া যায় না। আগেই বলেছি এদের তীক্ষ্ণ, লম্বা ও আগার দিকে বাঁকানো চঞ্চুর কথা। চঞ্চু কিন্তু করাতের মতো সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম খাঁজ কাটা। বাঁকানো চঞ্চু দিয়ে ফুলের মধুভাণ্ড ছিদ্র করে জিভ দিয়ে মধু টেনে নিতে এরা ওস্তাদ। মধু সংগ্রহের জন্য এদের জিভ হয় সরু, লম্বা ও নলাকার। এত ছোট পাখি বলে এদের শরীরও হয় খুব হালকা। আর তাই দিব্যি ফুলের ওপর বসে মধু পান করতে পারে। ফুল থেকে মধু সংগ্রহের সময় এরা নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে দেখে মনে হয় পাকা জিমন্যাস্ট। হামিং বার্ডের মতো উড়ন্ত অবস্থাতেও এরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে পারে। আর ঠিক এই সময় এরা ফুলের পরাগমিলন ঘটিয়ে দেয়। যদিও এদের প্রধান খাদ্য ফুলের মধু তবে ছোটখাটো পোকামাকড়, মশা, মাছি, শুয়োপোকা ইত্যাদি এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে। যেখানেই ফুলের বাগান সেখানেই দুর্গা টুনটুনিদের অবাধ আনাগোনা দেখা যাবে। তাই শুধু সুন্দরবন নয়, প্রায় সারা ভারতবর্ষ জুড়েই এদের বিস্তার।

(বাঁদিকে) প্রজনন ঋতুর পরে পুরুষ দুর্গা টুনটুনি। (মাঝখানে) অপরিণত পুরুষ দুর্গা টুনটুনি। (ডান দিকে) উড়ন্ত পুরুষ দুর্গা টুনটুনি। ছবি: সংগৃহীত।

আমার বাড়ির সামনে এখন কয়েকটি জবা ফুলের গাছ রয়েছে। সারা বছর সেখানে ফুল ফোটে। আর তাই দুর্গা টুনটুনিরা সারা বছরই সেই গাছে ঘোরাঘুরি করে। ছোট্ট পাখি হয় বলে তাদের দেখতে পাওয়া অত সহজ নয়, কিন্তু আওয়াজ শুনেই বোঝা যায় তাদের উপস্থিতি। “চিইইই উইট, চিইইই উইট” কিংবা “উইচ উইচ” করে তীব্র কিন্তু মিষ্টি সুরে যখন ডাকতে থাকে তখন মন ভালো হতে বাধ্য। শব্দ করার সময় ডানা দুটোকে ওরা ওঠায় আর নামায়। আর সেই সময় ডানার তলায় উজ্জ্বল হলুদ আর গাঢ় লাল রঙের পালক উঁকি দেয়। তবে দুর্গা টুনটুনিদের মধ্যে সংগীতশিল্পী হল পুরুষ। স্ত্রীদের কখনোই গান গাইতে দেখিনি। আমার স্কুলে এক সময় একটা বিরাট বটল ব্রাশ গাছ ছিল। সারা বছর প্রচুর ফুল ফুটত সেই গাছে। স্কুলের স্টাফরুমের ঠিক সামনেই ছিল গাছটি। বারান্দা থেকে হাত বাড়ালে গাছের শাখা ছোঁয়া যেত। ফলে দুর্গা টুনটুনিদের সংগীতসাধনা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নিয়মিত শুনতাম। তখন ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছি স্ত্রীদুর্গা টুনটুনিরা মাঝে মাঝে আওয়াজ করে, তবে সে ডাকে মোটেই মিষ্টতা নেই। আমফান ঝড়ে সেই গাছটি উপড়ে যায় আর তার সাথে স্কুলের স্টাফ রুমের সামনে থেকে হারিয়ে যায় দুর্গা টুনটুনিদের সংগীত মূর্ছনা।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৬: নীল রাত্রি, নীল অন্ধকার

দুর্গা টুনটুনিদের প্রজনন ঋতু হল মার্চ থেকে মে মাস। অবশ্য দুই-এক মাস আগে পিছেও হতে পারে। স্ত্রী দুর্গা টুনটুনি বছরে সাধারণত দুবার ডিম পাড়ে। প্রতিবার ডিম পাড়ে দুই থেকে তিনটি। সাদার উপর সবুজ বা হালকা খয়েরি আভাযুক্ত ছোট্ট ডিম। প্রতিটি ডিম লম্বায় প্রায় ০.৬৪ ইঞ্চি ও চওড়ায় প্রায় ০.৪৬ ইঞ্চি হয়। এরা বাঁচে প্রায় ৮ থেকে ১২ বছর। সুন্দরবন অঞ্চলে যে পরিমাণে আমি এদের আজও দেখতে পাই তাতে এরা বিপন্ন প্রজাতি বলে মনে হয় না। তবে এ নিয়ে আমাদের উল্লসিত হওয়ারও কিছু নেই। ফুলের বাগান কমলে, ফুল গাছ কমলে দুর্গা টুনটুনিরা যে বিপন্ন হবে তা বলা বাহুল্য। নগর সভ্যতা যেভাবে গ্রাম গ্রাস করে নিচ্ছে তাতে দুর্গা টুনটুনিরা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে কি?—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content