রামায়ণ আদিকাব্য, ঋষি বলছেন সে কাব্য, তাই তা আর্ষ, সাধারণ কবির কাব্য সে নয়। শব্দে, অর্থে, আখ্যানে-উপাখ্যানে সে কাব্য রত্নাকর সমুদ্র যেন। অসংখ্য উপাখ্যানের ছোট-বড় স্রোতধারা কবে কখন যে এসে মিশেছে তার আধারে; তাদের কোনটির স্রষ্টা আদিকবি স্বয়ং আর কোনটি বা প্রক্ষিপ্ত, তার গণনা করবে কে? এমনই এক উপাখ্যান ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির। রামায়ণী কথার বিপুল সাগরে মিলে-মিশে এক হয়ে গিয়েছে ছোট্ট কথানদীটি। পণ্ডিতেরা কেউ কেউ বলেন, এ বৃত্তান্ত বাল্মীকির রচনা নয়, উত্তরকবিদের জুড়ে দেওয়া উপাখ্যান এটি। তবে আজ থাক সে বিচার, বৈদগ্ধ্যের আতশকাচটি সরিয়ে রেখে আমরা বরং গল্প শুনি। সে গল্প শুনতে হলে যেতে হবে আমাদের ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রমে, যেতে হবে বৃষ্টিবিহীন, তৃষ্ণাকাতর অঙ্গরাজ্যে। কিন্তু আমরা যাবো কোশল দেশ হয়ে, অযোধ্যা নগরীকে ছুঁয়ে, একটু দীর্ঘপথে। গল্প শুরুরও তো গল্প থাকে কিছু।
সরযূ নদীর তীরে কোশল নামে এক দেশ। আয়তনে-বিস্তারে সে বেশ বড়সড়। বহু মানুষের সুখে শান্তিতে বাস ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ সে দেশে। তারই রাজধানী নগরী অযোধ্যা, লোকজগতে তার বড় সুখ্যাতি। নতুন নতুন বাড়িঘর, অট্টালিকা, প্রশস্ত ধূলোহীন রাজপথ, সাজানো-গোছানো বাগান রয়েছে সমস্ত নগরী জুড়ে। দুর্গ, প্রাসাদ, সভাগৃহ, দেবমন্দির, সুসজ্জিত দোকানপাট, জলসত্র, বড় বড় তোরণদ্বার— কী নেই সেই পরিখা-ঘেরা নগরীতে! রূপে-গুণে এ যেন দেবরাজের অমরাবতী। এ নগরীর ভার ইক্ষ্বাকুকুলপতি রাজর্ষি দশরথের হাতে। অজরাজার সুযোগ্য পুত্র তিনি- বিদ্যায়, বুদ্ধিমত্তায়, নীতিশাস্ত্রে, অস্ত্রবিদ্যায় একেবারে দেবতুল্য। শত্রুজয়ী ‘অতিরথ’ রাজা একাই দশ হাজার মহারথ বীরের সঙ্গে যুদ্ধে জয় লাভের শক্তি ধরেন। গ্রাম-শহর সর্বত্রই প্রজাদের প্রিয়জন তিনি। এমন সমৃদ্ধ রাজ্যের পরিচালনা তো সহজসাধ্য নয়। রাজকার্যে সহায় হলেন— ধৃষ্টি, জয়ন্ত, বিজয়, সুমন্ত্র প্রমুখ আটজন সুযোগ্য মন্ত্রী। যোগ্য রাজার যোগ্য মন্ত্রী তাঁরা— নির্লোভ, বিনীত, নীতিজ্ঞ, সমদর্শী। তাদের প্রখরদৃষ্টি এড়িয়ে কোনও অন্যায় কাজ হত না এ রাজ্যে। রাজার হিতে আর প্রজার কল্যাণে ন্যায়চক্ষুটি খোলা রাখতেন তাঁরা সবসময়। তাই সেখানে ছিল না চোর কিংবা দস্যুর ভয়, ছিল না নারীদের অসম্মানের ভয়। প্রজারা নিরুদ্বেগে দিন কাটাতে পারতেন। এঁদের সাহচর্যে যেন ইন্দ্রের পরাক্রমে আর সূর্যের দীপ্তিতে রাজ্য পালন করতে লাগলেন রাজা দশরথ। দুঃখ তাঁর একটিই— পুত্রহীনতার। বয়স বাড়ছে ক্রমাগত। কিন্তু কার হাতে দিয়ে যাবেন রাজ্যভার- এ চিন্তায় অস্থির হতে থাকেন তিনি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোয় এ চিন্তাই অবশ্য স্বাভাবিক। রাজা মনে মনে ভাবলেন, অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন পুত্রকামনায়। মন্ত্রিদের সঙ্গে মন্ত্রণায় বসলেন তিনি। মন্ত্রিশ্রেষ্ঠ সুমন্ত্র এই সংকল্পের কথা শুনে শুরু করলেন এক গল্প। সে হল গল্পচ্ছলে ভবিষ্যৎবাণী। পুরাণে শুনেছিলেন তিনি দশরথের পুত্রলাভের আখ্যান। সনৎকুমার বলেছিলেন সেই ভবিষ্যৎ আখ্যান। সে আখ্যানের ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। এভাবেই শুরু হল রামায়ণী কথার পরতের মধ্যে জড়িয়ে থাকা আর এক কাহিনি- বিভাণ্ডকমুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের।
কাশ্যপ মুনির পুত্র ছিলেন বিভাণ্ডক। তাঁর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ। কেন তার এমন নাম, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক ইতিবৃত্ত। ‘ঋষ্য’ শব্দের অর্থ হরিণ। ঋষ্যশৃঙ্গের মা এক হরিণী, আসলে তিনি ভগ নামক আদিত্যের শাপগ্রস্তা কন্যা স্বর্ণমুখী। হরিণী মায়ের ছেলে, তাই তাঁর মাথায় ছিল একটি শিং। আর নাম হয়েছিল, ঋষ্যশৃঙ্গ। বনেই তাঁর জন্ম, বনেই পিতা বিভাণ্ডকের স্নেহে- শাসনে তাঁর বেড়ে ওঠা। পিতার সান্নিধ্য ছাড়া আর কোনো মানুষের সংস্পর্শে আসেননি তিনি। অথবা বলা ভাল, আজন্মকাল কোনও নারী সান্নিধ্যে আসেননি তিনি। এভাবে তাঁর ব্রহ্মচর্য রইল অক্ষুণ্ণ, কালে কালে কঠিন তপশ্চর্যা করে তিনি হয়ে উঠলেন উগ্রতপা মুনি। অগ্নি উপাসনা আর পিতার সেবা— এই দুইয়ে কাটতে লাগল তাঁর দিন। তপস্যায় তিনি হলেন জগদ্বিখ্যাত।
এই সময় অঙ্গদেশে লোমপাদ বা রোমপাদ নামে এক মহাপ্রতাপশালী রাজা ছিলেন। কিন্তু একবার তাঁর অধর্মাচরণের ফলে হল ভয়াবহ অনাবৃষ্টি। বহু বছর ধরে সে রাজ্যে আর বৃষ্টি হয় না। নিদারুণ ক্ষতি হল ফসল আর প্রজাদের। সংকটে পড়ে গেলেন রাজা। এভাবে অনাবৃষ্টি চলতে থাকলে তো রাজ্য ছারখার হয়ে যাবে! রাজা তাঁর রাজ্যের সব জ্ঞানী, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের ডাকলেন উপায় বের করার জন্য। তাঁরা আদেশ করলেন, বিভাণ্ডকপুত্র ব্রহ্মজ্ঞ, মহাতপা ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে অঙ্গরাজ্যে নিয়ে আসার জন্য। তবে আনলেই শুধু হবে না, রাজকন্যা শান্তার সঙ্গে বেদসম্মত উপায়ে বিবাহ দিতে হবে। তবেই হবে প্রায়শ্চিত্ত, তবেই হবে বৃষ্টি। কিন্তু কীভাবে, কোন উপায়ে সেই বনবাসী, বিষয়সুখে অনভিজ্ঞ, আজন্মতপস্বীকে নিয়ে আসা যাবে – সে ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন রাজা। মন্ত্রী, পুরোহিত, অমাত্য— সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনায় দু-তিন দিন কেটে গেল। কিন্তু উপায় বের হল না। উগ্রতপা বিভাণ্ডকের ভয়ে যেতে চান না কেউই সে আশ্রমে। শেষে মন্ত্রিরাই বুদ্ধি বাতলালেন, ঋষিপুত্রকে আনতে যাবে মুনির মত সাজসজ্জা করে নগরগণিকারা। তাঁকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে কোনও না কোনও উপায়ে তারা নিয়ে আসবে অঙ্গরাজ্যে। গণিকারা রাজিও হল এ হেন দুঃসাধ্য কাজে।
একদিকে বিভাণ্ডকমুনির অভিশাপের ভয়, অন্যদিকে রাজ-আদেশ, রাজ্যের মঙ্গল। বারাঙ্গনারা সত্যিই সেদিন দুঃসাধ্য অভিযানে নেমেছিল নিজেদের জীবনের মায়া না করেই। ফলে-ফুলে ভরা গাছপালা, সুগন্ধি পানীয়, সুস্বাদু ফল দিয়ে বড় বড় নৌকা সাজিয়ে নদীপথে তারা এল ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রমের কাছে, নির্জন বনপ্রদেশে। বিভাণ্ডকমুনির ভয়ে লতাপাতাগুল্মে শরীর ঢেকে তারা আশ্রমের কাছে পৌঁছল। বিভাণ্ডক বেরিয়ে গেছেন, সে খবর জেনে নিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গের চলাচলের পথে দাঁড়িয়ে রইল সকলে। এবার শুরু হল তাদের নানারকম লীলা-খেলা। কেঊ গান গাইছে, কেউ আপন খেয়ালে নাচ করছে, কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে নানারকম খেলার সামগ্রী নিয়ে খেলতে শুরু করল। নূপুরের ধ্বনিতে, মধুর কলস্বরে, তাদের হাসি-গানে, হাবে-ভাবে, শৃঙ্গারবিলাসে আকাশ বাতাস মুখর হয়ে উঠল। ঋষ্যশৃঙ্গ এসব ঘটনা দেখে-শুনে যেমন অবাক হলেন, তেমন ভয়ও পেলেন। তপস্যায় তিনি মহাবল। কিন্তু আজন্মকাল পিতা ছাড়া অন্য কোন নারী-পুরুষ তিনি দেখেননি। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্যে ভারী কৌতূহলও হল তাঁর। এগিয়ে গেলেন তিনি বারাঙ্গনাদের মাঝে। তাঁকে কাছে পেয়ে ঘিরে ধরল প্রমত্তা গণিকার দল। বাকচাতুরীতে মিষ্টি কথায় জেনে নিল তাঁর পরিচয়। প্রাথমিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল তাদের।
ঋষ্যশৃঙ্গ শিশুর মতো সরল মনে নিজের আশ্রমে আসার অনুরোধ জানালেন এদের। তাঁর মধ্যে কিন্তু কোনও কামচেতনার উদ্রেক হয়নি এই সুন্দরীদের দেখে। বরং নারী-পুরুষের ভেদজ্ঞান ছিল না বলে, গণিকাদের প্রসঙ্গে বাক্য ব্যবহারে পুংলিঙ্গশব্দের প্রয়োগ করেছেন তিনি! মনে মনে ভেবে বসেছেন, এরা সুন্দর সব তাপসকুমার! গণিকারা আশ্রমে এলে ঋষ্যশৃঙ্গ তাদের যথোচিত সমাদর করে পা ধোওয়ার জল, বসার আসন, সুস্বাদু ফলমূল সবই দিলেন। বারাঙ্গনারা আগ্রহের সাথেই সেসব গ্রহণ করল, কিন্তু মনে মনে ভয়ের শেষ নেই তাদের — এই বুঝি এসে পড়েন বিভাণ্ডক! সে ভয় বুকে চেপে রেখে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির চেষ্টা করল এবার তারা। কামনা-বাসনায় আচ্ছন্ন হয়নি যাঁর মন, নারীসম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই যাঁর, তাঁকে ঘিরে কতই না শৃঙ্গারচেষ্টা শুরু হল তাদের। মনভোলানো মিষ্টি হাসি হেসে ঋষিপুত্রকে বললে তারা — আমাদের আশ্রমেও অনেক সুস্বাদু মধুর ফল আছে, সেগুলো যদি রোচে আপনার— এই বলে তারা নানারকম ফলের মতো দেখতে মোদক দিল, দিল নগর থেকে আনা অন্যান্য সুখাদ্য এবং পানীয় হিসেবে মধুর মদ্য। আর দিল গাঢ় আলিঙ্গন। এর আস্বাদও তো এর আগে কখনও পাননি ঋষিকুমার। রোমাঞ্চ লাগল শরীরে তাঁর। বারাঙ্গনারা চলে যেতে আর স্বস্তি নেই মুনির মনে। ঘুরে ফিরে আসছে সেই সুখস্পর্শের স্মৃতি। ঘুম এল না রাতে।
পরের দিন পিতা আশ্রম থেকে বেরিয়ে গেলেই যে জায়গায় দেখেছিলেন তিনি সেই ‘মনোজ্ঞরূপাঃ’ ‘চারুমধ্যমাঃ’ বারাঙ্গনাদের, অমোঘটানে চললেন সেখানে। তারা তো মহাখুশি। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল! সম্মান-সমাদর করে আরও সুস্বাদু ফলমূলের প্রলোভন দেখিয়ে তারা মুনিকে নিয়ে যেতে চাইল তাদের ‘আশ্রমে’। দ্বিধা করলেন না ঋষ্যশৃঙ্গ। আশ্রমজীবন পিছনে পড়ে রইল, পড়ে থাকল একলা পিতার স্নেহচ্ছায়া। অমন ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি কিন্তু শিশুর সরলতা আর অপার বিস্ময়বোধ তাঁর হৃদয় জুড়ে। কত সহজেই বিশ্বাস করে বারাঙ্গনাদের সঙ্গে তাদের আশ্রমে থুড়ি অঙ্গরাজ্যে প্রবেশ করলেন তিনি। আর অমনি কাজল কালো মেঘে ঢেকে গেল দশদিক। দেবতারা বর্ষা নামালেন অঝোরে। দেখা গেল, গণিকাদের সঙ্গ ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষির নির্মল ব্রহ্মচর্যবলে পাওয়া তপঃশক্তিকে নষ্ট করেনি। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাজধানীতে এসে পৌঁছলেন মুনিবর। অঙ্গরাজ তো মহাখুশি। আনত হয়ে প্রণাম করে নিজেই ঋষির পরিচর্যা করতে শুরু করলেন। এবার এঁর হাতে তুলে দিতে হবে আদরের কন্যা শান্তাকে। ঋষিকে অন্তঃপুরে নিয়ে এসে রোমপাদ শান্তমনে শান্তাকে সম্প্রদান করলেন ঋষির হাতে। আর বনবাসী, মহাতপা ঋষ্যশৃঙ্গ এতদিনে জানলেন কামনার আস্বাদ। স্ত্রী শান্তার সঙ্গে রাজ-আদরে দীর্ঘকালের জন্য তিনি রয়ে গেলেন অঙ্গরাজ্যে।
আর ওদিকে ফলমূলের বোঝা কাঁধে নিয়ে ক্লান্ত শরীরে আশ্রমে এসে বিভাণ্ডক দেখেন পুত্র কোথাও নেই। যে ছেলে আজ পর্যন্ত এই আশ্রমের গণ্ডী ছেড়ে কোথাও যায় নি, সে আজ কোথায় গেল? চিন্তায় আকুল ঋষি বনের চারদিকে ঘুরে ঘুরে ‘ঋষ্যশৃঙ্গ’ নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। সাড়া দিল না কেউ। বন থেকে বেরিয়ে পৌঁছলেন এক গ্রামে। বেশ সুন্দর সমৃদ্ধ গোপালকদের গ্রাম, রয়েছে অনেক গরু-গাভী। জানতে চাইলেন তাদের কাছে, কার এই গ্রাম? তারা জানাল, বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে সম্মানার্থে এই গ্রাম উৎসর্গ করেছেন অঙ্গরাজ রোমপাদ। তারা ঋষির কাছে ঋষ্যশৃঙ্গের অঙ্গরাজ্যে আসার ঘটনা সব খুলে বলল। এতক্ষণে বুঝি ঋষির সম্বিৎ ফিরল। ধ্যাননেত্রে পুত্রের ভবিতব্য জেনে শান্তমনে ফিরে এলেন তিনি পুত্রহীন আশ্রমে।—চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সরযূ নদীর তীরে কোশল নামে এক দেশ। আয়তনে-বিস্তারে সে বেশ বড়সড়। বহু মানুষের সুখে শান্তিতে বাস ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ সে দেশে। তারই রাজধানী নগরী অযোধ্যা, লোকজগতে তার বড় সুখ্যাতি। নতুন নতুন বাড়িঘর, অট্টালিকা, প্রশস্ত ধূলোহীন রাজপথ, সাজানো-গোছানো বাগান রয়েছে সমস্ত নগরী জুড়ে। দুর্গ, প্রাসাদ, সভাগৃহ, দেবমন্দির, সুসজ্জিত দোকানপাট, জলসত্র, বড় বড় তোরণদ্বার— কী নেই সেই পরিখা-ঘেরা নগরীতে! রূপে-গুণে এ যেন দেবরাজের অমরাবতী। এ নগরীর ভার ইক্ষ্বাকুকুলপতি রাজর্ষি দশরথের হাতে। অজরাজার সুযোগ্য পুত্র তিনি- বিদ্যায়, বুদ্ধিমত্তায়, নীতিশাস্ত্রে, অস্ত্রবিদ্যায় একেবারে দেবতুল্য। শত্রুজয়ী ‘অতিরথ’ রাজা একাই দশ হাজার মহারথ বীরের সঙ্গে যুদ্ধে জয় লাভের শক্তি ধরেন। গ্রাম-শহর সর্বত্রই প্রজাদের প্রিয়জন তিনি। এমন সমৃদ্ধ রাজ্যের পরিচালনা তো সহজসাধ্য নয়। রাজকার্যে সহায় হলেন— ধৃষ্টি, জয়ন্ত, বিজয়, সুমন্ত্র প্রমুখ আটজন সুযোগ্য মন্ত্রী। যোগ্য রাজার যোগ্য মন্ত্রী তাঁরা— নির্লোভ, বিনীত, নীতিজ্ঞ, সমদর্শী। তাদের প্রখরদৃষ্টি এড়িয়ে কোনও অন্যায় কাজ হত না এ রাজ্যে। রাজার হিতে আর প্রজার কল্যাণে ন্যায়চক্ষুটি খোলা রাখতেন তাঁরা সবসময়। তাই সেখানে ছিল না চোর কিংবা দস্যুর ভয়, ছিল না নারীদের অসম্মানের ভয়। প্রজারা নিরুদ্বেগে দিন কাটাতে পারতেন। এঁদের সাহচর্যে যেন ইন্দ্রের পরাক্রমে আর সূর্যের দীপ্তিতে রাজ্য পালন করতে লাগলেন রাজা দশরথ। দুঃখ তাঁর একটিই— পুত্রহীনতার। বয়স বাড়ছে ক্রমাগত। কিন্তু কার হাতে দিয়ে যাবেন রাজ্যভার- এ চিন্তায় অস্থির হতে থাকেন তিনি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোয় এ চিন্তাই অবশ্য স্বাভাবিক। রাজা মনে মনে ভাবলেন, অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন পুত্রকামনায়। মন্ত্রিদের সঙ্গে মন্ত্রণায় বসলেন তিনি। মন্ত্রিশ্রেষ্ঠ সুমন্ত্র এই সংকল্পের কথা শুনে শুরু করলেন এক গল্প। সে হল গল্পচ্ছলে ভবিষ্যৎবাণী। পুরাণে শুনেছিলেন তিনি দশরথের পুত্রলাভের আখ্যান। সনৎকুমার বলেছিলেন সেই ভবিষ্যৎ আখ্যান। সে আখ্যানের ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। এভাবেই শুরু হল রামায়ণী কথার পরতের মধ্যে জড়িয়ে থাকা আর এক কাহিনি- বিভাণ্ডকমুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের।
কাশ্যপ মুনির পুত্র ছিলেন বিভাণ্ডক। তাঁর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ। কেন তার এমন নাম, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক ইতিবৃত্ত। ‘ঋষ্য’ শব্দের অর্থ হরিণ। ঋষ্যশৃঙ্গের মা এক হরিণী, আসলে তিনি ভগ নামক আদিত্যের শাপগ্রস্তা কন্যা স্বর্ণমুখী। হরিণী মায়ের ছেলে, তাই তাঁর মাথায় ছিল একটি শিং। আর নাম হয়েছিল, ঋষ্যশৃঙ্গ। বনেই তাঁর জন্ম, বনেই পিতা বিভাণ্ডকের স্নেহে- শাসনে তাঁর বেড়ে ওঠা। পিতার সান্নিধ্য ছাড়া আর কোনো মানুষের সংস্পর্শে আসেননি তিনি। অথবা বলা ভাল, আজন্মকাল কোনও নারী সান্নিধ্যে আসেননি তিনি। এভাবে তাঁর ব্রহ্মচর্য রইল অক্ষুণ্ণ, কালে কালে কঠিন তপশ্চর্যা করে তিনি হয়ে উঠলেন উগ্রতপা মুনি। অগ্নি উপাসনা আর পিতার সেবা— এই দুইয়ে কাটতে লাগল তাঁর দিন। তপস্যায় তিনি হলেন জগদ্বিখ্যাত।
এই সময় অঙ্গদেশে লোমপাদ বা রোমপাদ নামে এক মহাপ্রতাপশালী রাজা ছিলেন। কিন্তু একবার তাঁর অধর্মাচরণের ফলে হল ভয়াবহ অনাবৃষ্টি। বহু বছর ধরে সে রাজ্যে আর বৃষ্টি হয় না। নিদারুণ ক্ষতি হল ফসল আর প্রজাদের। সংকটে পড়ে গেলেন রাজা। এভাবে অনাবৃষ্টি চলতে থাকলে তো রাজ্য ছারখার হয়ে যাবে! রাজা তাঁর রাজ্যের সব জ্ঞানী, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের ডাকলেন উপায় বের করার জন্য। তাঁরা আদেশ করলেন, বিভাণ্ডকপুত্র ব্রহ্মজ্ঞ, মহাতপা ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে অঙ্গরাজ্যে নিয়ে আসার জন্য। তবে আনলেই শুধু হবে না, রাজকন্যা শান্তার সঙ্গে বেদসম্মত উপায়ে বিবাহ দিতে হবে। তবেই হবে প্রায়শ্চিত্ত, তবেই হবে বৃষ্টি। কিন্তু কীভাবে, কোন উপায়ে সেই বনবাসী, বিষয়সুখে অনভিজ্ঞ, আজন্মতপস্বীকে নিয়ে আসা যাবে – সে ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন রাজা। মন্ত্রী, পুরোহিত, অমাত্য— সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনায় দু-তিন দিন কেটে গেল। কিন্তু উপায় বের হল না। উগ্রতপা বিভাণ্ডকের ভয়ে যেতে চান না কেউই সে আশ্রমে। শেষে মন্ত্রিরাই বুদ্ধি বাতলালেন, ঋষিপুত্রকে আনতে যাবে মুনির মত সাজসজ্জা করে নগরগণিকারা। তাঁকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে কোনও না কোনও উপায়ে তারা নিয়ে আসবে অঙ্গরাজ্যে। গণিকারা রাজিও হল এ হেন দুঃসাধ্য কাজে।
একদিকে বিভাণ্ডকমুনির অভিশাপের ভয়, অন্যদিকে রাজ-আদেশ, রাজ্যের মঙ্গল। বারাঙ্গনারা সত্যিই সেদিন দুঃসাধ্য অভিযানে নেমেছিল নিজেদের জীবনের মায়া না করেই। ফলে-ফুলে ভরা গাছপালা, সুগন্ধি পানীয়, সুস্বাদু ফল দিয়ে বড় বড় নৌকা সাজিয়ে নদীপথে তারা এল ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রমের কাছে, নির্জন বনপ্রদেশে। বিভাণ্ডকমুনির ভয়ে লতাপাতাগুল্মে শরীর ঢেকে তারা আশ্রমের কাছে পৌঁছল। বিভাণ্ডক বেরিয়ে গেছেন, সে খবর জেনে নিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গের চলাচলের পথে দাঁড়িয়ে রইল সকলে। এবার শুরু হল তাদের নানারকম লীলা-খেলা। কেঊ গান গাইছে, কেউ আপন খেয়ালে নাচ করছে, কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে নানারকম খেলার সামগ্রী নিয়ে খেলতে শুরু করল। নূপুরের ধ্বনিতে, মধুর কলস্বরে, তাদের হাসি-গানে, হাবে-ভাবে, শৃঙ্গারবিলাসে আকাশ বাতাস মুখর হয়ে উঠল। ঋষ্যশৃঙ্গ এসব ঘটনা দেখে-শুনে যেমন অবাক হলেন, তেমন ভয়ও পেলেন। তপস্যায় তিনি মহাবল। কিন্তু আজন্মকাল পিতা ছাড়া অন্য কোন নারী-পুরুষ তিনি দেখেননি। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্যে ভারী কৌতূহলও হল তাঁর। এগিয়ে গেলেন তিনি বারাঙ্গনাদের মাঝে। তাঁকে কাছে পেয়ে ঘিরে ধরল প্রমত্তা গণিকার দল। বাকচাতুরীতে মিষ্টি কথায় জেনে নিল তাঁর পরিচয়। প্রাথমিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল তাদের।
ঋষ্যশৃঙ্গ শিশুর মতো সরল মনে নিজের আশ্রমে আসার অনুরোধ জানালেন এদের। তাঁর মধ্যে কিন্তু কোনও কামচেতনার উদ্রেক হয়নি এই সুন্দরীদের দেখে। বরং নারী-পুরুষের ভেদজ্ঞান ছিল না বলে, গণিকাদের প্রসঙ্গে বাক্য ব্যবহারে পুংলিঙ্গশব্দের প্রয়োগ করেছেন তিনি! মনে মনে ভেবে বসেছেন, এরা সুন্দর সব তাপসকুমার! গণিকারা আশ্রমে এলে ঋষ্যশৃঙ্গ তাদের যথোচিত সমাদর করে পা ধোওয়ার জল, বসার আসন, সুস্বাদু ফলমূল সবই দিলেন। বারাঙ্গনারা আগ্রহের সাথেই সেসব গ্রহণ করল, কিন্তু মনে মনে ভয়ের শেষ নেই তাদের — এই বুঝি এসে পড়েন বিভাণ্ডক! সে ভয় বুকে চেপে রেখে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির চেষ্টা করল এবার তারা। কামনা-বাসনায় আচ্ছন্ন হয়নি যাঁর মন, নারীসম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই যাঁর, তাঁকে ঘিরে কতই না শৃঙ্গারচেষ্টা শুরু হল তাদের। মনভোলানো মিষ্টি হাসি হেসে ঋষিপুত্রকে বললে তারা — আমাদের আশ্রমেও অনেক সুস্বাদু মধুর ফল আছে, সেগুলো যদি রোচে আপনার— এই বলে তারা নানারকম ফলের মতো দেখতে মোদক দিল, দিল নগর থেকে আনা অন্যান্য সুখাদ্য এবং পানীয় হিসেবে মধুর মদ্য। আর দিল গাঢ় আলিঙ্গন। এর আস্বাদও তো এর আগে কখনও পাননি ঋষিকুমার। রোমাঞ্চ লাগল শরীরে তাঁর। বারাঙ্গনারা চলে যেতে আর স্বস্তি নেই মুনির মনে। ঘুরে ফিরে আসছে সেই সুখস্পর্শের স্মৃতি। ঘুম এল না রাতে।
পরের দিন পিতা আশ্রম থেকে বেরিয়ে গেলেই যে জায়গায় দেখেছিলেন তিনি সেই ‘মনোজ্ঞরূপাঃ’ ‘চারুমধ্যমাঃ’ বারাঙ্গনাদের, অমোঘটানে চললেন সেখানে। তারা তো মহাখুশি। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল! সম্মান-সমাদর করে আরও সুস্বাদু ফলমূলের প্রলোভন দেখিয়ে তারা মুনিকে নিয়ে যেতে চাইল তাদের ‘আশ্রমে’। দ্বিধা করলেন না ঋষ্যশৃঙ্গ। আশ্রমজীবন পিছনে পড়ে রইল, পড়ে থাকল একলা পিতার স্নেহচ্ছায়া। অমন ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি কিন্তু শিশুর সরলতা আর অপার বিস্ময়বোধ তাঁর হৃদয় জুড়ে। কত সহজেই বিশ্বাস করে বারাঙ্গনাদের সঙ্গে তাদের আশ্রমে থুড়ি অঙ্গরাজ্যে প্রবেশ করলেন তিনি। আর অমনি কাজল কালো মেঘে ঢেকে গেল দশদিক। দেবতারা বর্ষা নামালেন অঝোরে। দেখা গেল, গণিকাদের সঙ্গ ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষির নির্মল ব্রহ্মচর্যবলে পাওয়া তপঃশক্তিকে নষ্ট করেনি। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাজধানীতে এসে পৌঁছলেন মুনিবর। অঙ্গরাজ তো মহাখুশি। আনত হয়ে প্রণাম করে নিজেই ঋষির পরিচর্যা করতে শুরু করলেন। এবার এঁর হাতে তুলে দিতে হবে আদরের কন্যা শান্তাকে। ঋষিকে অন্তঃপুরে নিয়ে এসে রোমপাদ শান্তমনে শান্তাকে সম্প্রদান করলেন ঋষির হাতে। আর বনবাসী, মহাতপা ঋষ্যশৃঙ্গ এতদিনে জানলেন কামনার আস্বাদ। স্ত্রী শান্তার সঙ্গে রাজ-আদরে দীর্ঘকালের জন্য তিনি রয়ে গেলেন অঙ্গরাজ্যে।
আর ওদিকে ফলমূলের বোঝা কাঁধে নিয়ে ক্লান্ত শরীরে আশ্রমে এসে বিভাণ্ডক দেখেন পুত্র কোথাও নেই। যে ছেলে আজ পর্যন্ত এই আশ্রমের গণ্ডী ছেড়ে কোথাও যায় নি, সে আজ কোথায় গেল? চিন্তায় আকুল ঋষি বনের চারদিকে ঘুরে ঘুরে ‘ঋষ্যশৃঙ্গ’ নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। সাড়া দিল না কেউ। বন থেকে বেরিয়ে পৌঁছলেন এক গ্রামে। বেশ সুন্দর সমৃদ্ধ গোপালকদের গ্রাম, রয়েছে অনেক গরু-গাভী। জানতে চাইলেন তাদের কাছে, কার এই গ্রাম? তারা জানাল, বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে সম্মানার্থে এই গ্রাম উৎসর্গ করেছেন অঙ্গরাজ রোমপাদ। তারা ঋষির কাছে ঋষ্যশৃঙ্গের অঙ্গরাজ্যে আসার ঘটনা সব খুলে বলল। এতক্ষণে বুঝি ঋষির সম্বিৎ ফিরল। ধ্যাননেত্রে পুত্রের ভবিতব্য জেনে শান্তমনে ফিরে এলেন তিনি পুত্রহীন আশ্রমে।—চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।