রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার

বাড়িতে মাসমাইনের ঠাকুরচাকর অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেকালের মাসমাইনের গৃহশিক্ষকও রাখা হত। তাঁর জন্য বাড়িতে একটি আলাদা ঘরও বরাদ্দ হত। ক্রমান্বয়ে বাড়ির সন্তান-সন্ততিরা সকলেই হত তাঁর ছাত্র। এসব না হয় মেনে নেওয়া গেল! কেউ মাইনে করা ডাক্তারবাবু রেখেছেন, না, একালে কি কল্পনা করা যায়! সেকালে ধনাঢ্য পরিবারেও সচরাচর তা দেখা যেত না। ঠাকুরবাড়িতে অবশ্যি ছিল। রীতিমতো মাইনে দিয়ে দু’জন ডাক্তারবাবু রাখা হয়েছিল, যাঁদের মাইনে মাসে মাসে দেওয়া হত না, দেওয়া হত বছরান্তে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘তখন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দুইজন করিয়া ডাক্তার বাৎসরিক বেতনে নিযুক্ত থাকিতেন।’

নিযুক্ত দু’জন ডাক্তারের একজন রীতিমতো সাহেব, অন্যজন অবশ্য বাঙালি। ডাঃ বেলি ও ডাঃ দ্বারকানাথ গুপ্ত। সাহেব-ডাক্তার সম্পর্কে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘অতি সদাশয় লোক’ ছিলেন তিনি। ন্যায়নিষ্ঠ ও কর্তব্যপরায়ণ। রাতে কেউ ঠাকুরবাড়ি থেকে ডাকতে গেলেও ডাঃ বেলি বিরক্ত হতেন না। ঠাকুরবাড়ির বাইরের অন্য কেউ ডাকতে গেলে অবশ্য তাঁর স্ত্রী ‘খড়গহস্ত’ হতেন। ঠাকুরবাড়ি থেকে ডাক এসেছে শুনলে শ্রীমতী আর ‘নিষেধ’ করতেন না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথই এসব জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বালক। তাঁকে দেখলেই ডাক্তার-সাহেব আদর করতেন।

সাহেব-ডাক্তারকে বছরে দেওয়া হত পাঁচশো টাকা। বাঙালি-ডাক্তারের জন্য বরাদ্দ ছিল অনেক কম, তিনশো টাকা। এই বাৎসরিক বরাদ্দের অর্ধেক দিতেন দেবেন্দ্রনাথ, বাকি অর্ধেক দিতেন গুণেন্দ্রনাথ। গুণেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর এ দায়িত্ব পালন করতেন গগনেন্দ্রনাথ।

ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়

অল্প বেতনের একজন হাতুড়ে ডাক্তারও ঠাকুরবাড়িতে ছিলেন। বাৎসরিক বেতনের চুক্তিতে নিযুক্ত ডাক্তারটিকে প্রয়োজনে ডাক দেওয়া হত। হাতুড়ে ডাক্তার ‘অষ্টপ্রহর’ জোড়াসাঁকো-বাড়িতেই‌ থাকতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কালে ছিলেন পীতাম্বর নামে এক হাতুড়ে ডাক্তার। কী ছিল তাঁর কাজ, তা জানিয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ‘তিনি বাড়িতে অষ্টপ্রহর হাজির থাকিতেন এবং বড়ো বড়ো ডাক্তারেরা যেসব ব্যবস্থা করিয়া যাইতেন এই হাতুড়ে ডাক্তারটি সেই অনুসারে নিজের হাতে ঔষধপত্রাদি দিতেন এবং ঠিক ঠিক সময়ে সেবন করাইতেন। ইনি অনেকটা শুশ্রূষাকারিণী নার্সের মতো।’

ছোটদের মহলে পীতাম্বর খুব প্রিয় ছিলেন। অফুরান তাঁর গল্পের ভাণ্ডার। বাড়ির ছেলেরা জড়ো হলেই শোনাতেন নানান গল্প। প্রায়শই তাঁর বগলে থাকত কাপড়ে মোড়া খোপকাটা একটা টিনের বাক্স। বাক্সের খোপে খোপে নানান রঙের রকমারি মলম। ছোটদের ফোঁড়া হলে, পাঁচড়া হলে লাগানো হত এইসব মলম।

সাহেব-ডাক্তারের পাশাপাশি যে বাঙালি-ডাক্তার ঠাকুরবাড়ি থেকে বছর-বছর ভাতা পেতেন, তিনি দ্বারিকানাথ গুপ্ত। কেমন ছিল দ্বারিকানাথের চিকিৎসা-পদ্ধতি, সে-বিবরণ আছে একাধিক স্মৃতিকথায়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘জ্বর হ’লেই ডাক্তার দ্বারি গুপ্ত আমাদের দেখতে আসতেন, কে জানে তাঁকে দেখলেই প্রাণ উড়ে যেত। তাঁর ব্যবস্থা ছিল— প্রথম দিন তেল (Castor oil) ও তেলের চেয়েও বিস্বাদ জলের সাগু; দ্বিতীয় দিন এলাচ দানার মতো সামান্য কিছু পথ্য; তৃতীয় দিন ফুলকো রুটি; চতুর্থ দিন ভাত –সেই জ্বরের এই ক্রম ছিল।’

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতাও ভিন্নতর নয়। একই রকম। দ্বারিকানাথ গুপ্তের চিকিৎসা-পদ্ধতি প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘আমাদের জ্বর হইলে দ্বারিবাবু প্রথম দিন আসিয়াই দীর্ঘচ্ছন্দে বলিতেন ‘তে‌-ল’ অর্থাৎ Castor Oil। এই তেলের নাম শুনিলেই আমাদের আতঙ্ক উপস্থিত হইত। তাঁহার চিকিৎসায় একটা ধরা-বাঁধা নিয়ম ছিল; ফলে এইরূপ চিকিৎসার নিয়মেই তিন দিন বড়ো‌ জোর সাত‌ দিনের মধ্যেই আমরা খাড়া হইয়া উঠিতাম। চিকিৎসার ঔষধ যেমন তিক্ত, পথ্যও ছিল, কিন্তু তেমন অরুচিকর…।’

‌শুধু চিকিৎসাই করতেন না দ্বারিকনাথ গুপ্ত, তিনি ওষুধ তৈরি করতেন। সেই ওষুধের ভালো বিপণনও হত। ‘ডি-গুপ্তর‌ মিকশ্চার’ সেকালে জনপ্রিয় হয়েছিল। ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরি করে‌ তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তাঁর এই ওষুধ তৈরির ব্যবসা যথেষ্ট লাভজনক হয়ে উঠেছিল।

ডাঃ নীলরতন সরকার

দ্বারিকানাথ থাকতেন জোড়াসাঁকোর অদূরে, পাথুরিয়াঘাটে। ব্যবসায়িক সাফল্যের পর ডানলপের অদূরে তিনি একটি বাগানবাড়ি কিনেছিলেন। সে বাগানবাড়িটির নাম ‘গুপ্তনিবাস’। অবনীন্দ্রনাথের শেষ-জীবন এই বাগানবাড়িতেই কেটেছে
দ্বারিকানাথের পর জোড়াসাঁকোয় পারিবারিক-চিকিৎসক হয়েছিলেন নীলমাধব হালদার। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় মূলত তিনিই চিকিৎসা করতেন। জ্বর হলে ‘জ্বর’ বলতেন না, বলতেন ‘গা গরম’। তাঁর ওষুধ ছিল অব্যর্থ। তিন দিনের দিনই মৌরলা মাছের ঝোল আর গলা ভাত খেতেন রবীন্দ্রনাথ। উপোসের পর তা ছিল ‘অমৃত’।

সাহেব-ডাক্তার এইচ. বেলি চিকিৎসক হিসেবে যথেষ্ট সুনামের অধিকারী ছিলেন। সেসময় এম.ডি ডাক্তার সুলভ ছিল না। ডাক্তার বেলি এম.ডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। দ্বারিকানাথের ওষুধ তৈরির ব্যবসায় সাফল্যের আড়ালে তাঁরও ভূমিকা ছিল। জ্বরের যে মিকশ্চার সমাদৃত হয়েছিল, তা বেলি-সাহেবের ব্যবস্থাপত্র অনুসারে তৈরি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে অন্তত এমনই সংবাদ ছিল!

পরবর্তীকালে ঠাকুরবাড়িতে সাহেব-ডাক্তার পরিবর্তিত হয়েছিল। বেলির পরিবর্তে ডাঃ ই. চার্লস। চার্লসও ছিলেন এম.ডি ডিগ্ৰির অধিকারী। কখনও কখনও ঠাকুরবাড়িতে চিকিৎসা করেছেন ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। কবিরাজি-হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও হয়েছে কারও কারও। বউবাজারের হোমিওপ্যাথি-ডাক্তার রাজেন্দ্র দত্ত ঠাকুরবাড়িতে চিকিৎসা করেছেন। তিনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

মেয়েদের প্রয়োজনে, বিশেষত প্রসবকালে‌ ডাক পড়ত মেডিকেল কলেজে নার্স মারপির। সব সময় যে তাঁকে দিয়ে সামাল দেওয়া গেছে, তা নয়। পরিস্থিতি হয়তো জটিল হয়ে উঠেছে, নিরুপায় হয়ে সেসময় সাহেব-ডাক্তারকেও তলব দিতে হয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই সাহেব-ডাক্তার ঠাকুরবাড়ির কন্যা ও বধূমাতাদের চিকিৎসা করেছেন।

শান্তিনিকেতনে কারও শরীর খারাপ হলে দেখতেন ডাঃ শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথেরও চিকিৎসা করেছেন তিনি। ডাঃ নীলরতন সরকার ও ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা করেছেন। দু’জনেই ছিলেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক। রবীন্দ্রনাথ তখন ইরিসিপ্লাসে কষ্ট পাচ্ছিলেন। সে-খবর জেনে তাঁরা শান্তিনিকেতনেও ছুটে গিয়েছিলেন।

হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর

অসুস্থ কবির চিকিৎসায়, অস্ত্রোপচারকালে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ডাঃ ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকাও কম নয়। অন্তিম-শয্যায় রবীন্দ্রনাথ খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। সামান্য ইনজেকশন নিতেই তিনি ভয় পেতেন। পৌত্রী নন্দিনী দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, শান্তিনিকেতনে ইনজেকশন নেওয়ার ভয়ে কবি একবার বাথরুমেও লুকিয়ে পড়েছিলেন। অস্ত্রোপচারকালে সেই রবীন্দ্রনাথকে শারীরিক ও মানসিক প্রভূত যন্ত্রণা পেতে হয়েছিল। ইনজেকশন নিতে অবনীন্দ্রনাথেরও ছিল ভীষণ ভয়। অবনীন্দ্রনাথের শেষের দিনগুলি কেটেছে গুপ্তনিবাসে। সেসময় আলমবাজারের ডাক্তার কানাই পাল নিয়মিত তাঁর চিকিৎসা করতেন।

ঠাকুরবাড়ির মানুষজনদের বিভিন্ন সময় কত না চিকিৎসক চিকিৎসা করেছেন! নানা ধরনের চিকিৎসা। কবিরাজি-হোমিওপ্যাথিও বাদ পড়েনি। আমরা কয়েকজন চিকিৎসকের কথাট উল্লেখ করলাম মাত্র। এর বাইরেও অনেক চিকিৎসক আছেন, যাঁরা ঠাকুরবাড়ির মানুষজনদের চিকিৎসা করেছেন। ঠাকুরবাড়ির হেমেন্দ্রনাথ মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ফাইনাল ইয়ারে পরীক্ষায় না বসলেও চিকিৎসাবিদ্যা তিনি ভালোই রপ্ত করেছিলেন। মা সারদাসুন্দরীর অস্ত্রোপচার হেমেন্দ্রনাথ নিজের হাতে করেছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানেও রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ কম ছিল না। তিনি যে হোমিওপ্যাথির চর্চা করতেন, ওষুধ দিতেন, তা আমাদের অজানা নয়। কবির ওষুধ খেয়ে অনেকে ভালোও থেকেছেন।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content