বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা সৌদামিনী দেবী।

কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে বাঙালির ঘরে ঘরে যে লক্ষ্মীর আরাধনা হয়, সেই সব লক্ষ্মী মেয়ে তো পরিবারের মধ্যেই থাকে। ঠাকুর পরিবারেও ছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে সৌদামিনী দেবী। সারদা দেবীর মৃত্যুর পর বড় মেয়ে সৌদামিনীর হাতেই সংসারের সব ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। সৌদামিনীও জড়িয়ে পড়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে। ছোট থেকে জোড়াসাঁকোর বিবিধ ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা ‘পিতৃস্মৃতি’ থেকে সেই আমলের অনেক ঘটনার কথা জানাও যায়।
দেবেন্দ্রনাথ যখন কঠোরভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করছেন এবং অন্দরমহলেও উপাসনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন, তখনকার কথা জানা যায় সৌদামিনীর লেখা ‘পিতৃস্মৃতি’ থেকে। সহজাত দেবসংস্কার ভুলে যাওয়া কঠিন। কাজেই দেবেন্দ্রনাথের সামনে ব্রহ্ম উপাসনা অব্যাহত ছিল। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে গোপনে পুতুল পুজো করা হত। একসময় সৌদামিনী শিবপুজো, ইতুপুজো সব করেছেন। দুর্গাপুজোর সময় প্রতিমার সামনে অঞ্জলি না দিয়ে জলগ্রহণ করতেন না। পরে গোপনে নিজের ঘরের কৃষ্ণের ছবিতে ফুল দিয়ে পুজো করতেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি

বড় মেয়ে, তাই বাবা মা অনেক কথা ভাগ করে নিতেন তাঁর সঙ্গে। একবার সিপাহী বিদ্রোহের সময় গুজব উঠেছিল দেবেন্দ্রনাথকে হত্যা করা হয়েছে। সারদাদেবী সেইসময় আহার নিদ্রা ত্যাগ করেন। তারপর দেবেন্দ্রনাথের সুস্থতার খবর পেয়ে স্বস্তি। দেবেন্দ্রনাথ সৌদামিনীকে বলেছিলেন এক আশ্চর্য ঘটনা। দেবেন্দ্রনাথ তখন সিমলাতে। এইহময় তাঁর পুত্র পুণ্যেন্দ্রের অকাল মৃত্যু হয়। দেবেন্দ্রনাথ সেই মৃত্যুর সংবাদ পাননি। কিন্তু দিনের বেলা জাগ্রত অবস্থায় দেখেছিলেন পুণ্যেন্দ্র কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে আছে। এমন অনুভূতি দেবেন্দ্রনাথের আগেও হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৮: সুন্দরবনের পাখি—শামুকখোল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৫: ‘ছেলেদের জন্য আমার কোনও নিয়মকানুন থাকে না’

সৌদামিনীর ছোটবেলায় লেখাপড়ার চর্চা খুব একটা ছিল না। তাঁর প্রথম শিক্ষা হয়েছিল এক বৈষ্ণবীর কাছে। তাঁর কাছে শিশুপাঠ পড়তেন এবং কলাপাতায় লেখা অভ্যাস করতেন। ক্রমে তাঁর কাছে রামায়ণ লেখা অভ্যাস করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ সৌদামিনীর লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ মন দিয়েছিলেন। মিশনারি মেয়েরা নিয়ম করে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে এসে মেয়েদের পড়িয়ে যেত। এরপর একদিন দেবেন্দ্রনাথ মেয়ের কেমন পড়া হয়েছে , তা জানার জন্য এলেন ও সৌদামিনীকে লিখতে দিলেন। লেখা সন্তোষজনক না হওয়ায় মিশনারীদের কাছে পড়া বন্ধ হল এবং সৌদামিনীকে পাঠানো হল বেথুন স্কুলে। এছাড়াও সৌদামিনীর খুড়তুতো বোন, হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের দুই মেয়ে এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মেয়েদের নিয়ে শুরু হয়েছিল বেথুন স্কুলের নারীশিক্ষা।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৩: কালাদেওর কবলে

বিচিত্র সব শিল্পসাধনাতেও মগ্ন থাকতেন সৌদামিনী। বাড়ির যেকোনও অনুষ্ঠানে পিঁড়িতে আলপনা দেওয়ার ভার থাকত তাঁর উপর। ভালো করে ফুল ফুটিয়ে আলপনা না দিলে দেবেন্দ্রনাথের পছন্দ হত না। কেউ কোনও নিমন্ত্রণে গেলে চুল বাঁধার ভারও ছিল সৌদামিনীর উপর। দেবেন্দ্রনাথ স্বয়ং এসে দেখতেন সেই কাজ। অপছন্দ হলে আবার নতুন করে চুল বাঁধতে হত। সৌদামিনী বাবার বড় আদরের মেয়ে ছিলেন। পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে থাকার সময় প্রতিদিন একতোড়া করে ফুল রেখে দিতেন দেবেন্দ্রনাথের ঘরে। সৌদামিনী খাতা কলম নিয়ে বসতেন ও দেবেন্দ্রনাথের করা হাফেজের কবিতার তর্জমা লিখে রাখতেন। দেবেন্দ্রনাথের থেকে বাড়ির মেয়েরা একটি করে টাকা পেতেন। সেই টাকায় মাছ,সব্জি কিনে তাঁদের রান্না করতে হত। প্রতিদিন একটি করে পদ উপাসনা ঘর পরিস্কার করা, বাবার সঙ্গে বসে তত্ত্বকথা, গ্রহ নক্ষত্রের কথা শোনা, সেসব লিখে রাখা সৌদামিনীর নিত্য অভ্যাস ছিল। লেখার পাশে দেবেন্দ্রনাথ আবার উৎসাহবাক্য লিখে দিতেন। দেবেন্দ্রনাথের উৎসাহেই সেই আমলের অনেক নিন্দার ঝড়ের মধ্যেই সৌদামিনী সেমিজ, জুতো প্রভৃতি পরে বাইরে বেরোতেন। সৌদামিনীর জীবনের মধুর স্মৃতিভান্ডার তাঁর বাবাকে কেন্দ্র করে ছিল। তাঁর জীবনের সেরা আনন্দ অনুষ্ঠানেরমধ্যে একটি ছিল দেবেন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর

সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর দাম্পত্যজীবন ঠাকুরবাড়িতেই ছিল। সারদাপ্রসাদের আকস্মিক মৃত্যু হয় রবীন্দ্রনাথের বিয়ের দিন। সৌদামিনী অত বড় শোক সামলে ঠাকুরবাড়িকেও সামলে এবং আগলে রেখেছিলেন। সকলের মাথার উপর স্নিগ্ধ ছায়া হয়েই ছিলেন। তাঁর একমাত্র মেয়ের নাম ইন্দুমতী। সৌদামিনীর মৃত্যুর পর এক তারিখহীন চিঠিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন,‘ সৌদামিনী একাই ছিলেন আমাদের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। ’ সৌদামিনী সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তবে দ্বিজেন্দ্রনাথের এই কথা ঠাকুরবাড়িতে সৌদামিনীর অবস্থান বুঝতে সাহায্য করে।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content