রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


বাবলি একটা অদ্ভুত দোটানায় ভুগছে। ছোটবেলায় মোটর দূর্ঘটনায় বাবার ভয়ঙ্কর মৃত্যু চোখের সামনে দেখেছে। দেখেছে জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহুর্ত পর্যন্ত অনেক চিকিৎসার পর সেই মানসিক ঝড় কাটিয়ে আবার পড়াশোনায় ফিরেছিল বটে কিন্তু দুঃস্বপ্নের দগদগে ক্ষত থেকে গিয়ে মনের গভীরে। নানান ভাবনা চিন্তা ব্যস্ততায়… সময়ের চাদরের তলায় চাপা পড়েছিল মাত্র। হাত-পায়ের গভীর ক্ষতচিহ্ন বা তার ব্যথা-বেদনা, ওষুধে ওষুধে একসময়ে মিলিয়ে যায়।

বহুবছর বাদে সে প্রসঙ্গ উঠলে একসময়ের সেই গভীর ক্ষতচিহ্ন শরীর হাতড়ে খুঁজতে হয়। অতীতের সে কাটাদাগের গভীর অসুখ তখন প্রায় হারিয়ে যাওয়া সামান্য চিহ্ন, কষ্ট নেই ক্ষত নেই পুঁজ রস রক্ত শুকিয়ে যাওয়া চামড়ার মিশমিশে অনুভূতি নেই। আছে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। মনের ক্ষত কিন্তু সে ভাবে মিলিয়ে যায় না। সেখানে যেমন রক্তপাত নেই তেমনই তার পরিচর্যায় তুলো ব্যান্ডেজ ব্যথা কমার ক্যাপসুল ট্যাবলেট বা ক্ষত শুশ্রূষার কোনও অয়েন্টমেন্ট নেই। তাই মনের ক্ষত সময়ে অসময়ে বেআব্রু হয়ে গিয়ে যন্ত্রণা দেয়, বাইরে থেকে কেউই বুঝতে পারে না জানতে পারে না।
বাবলি সেই চাপা দেওয়া লুকোনো মনোকষ্ট নিয়েই স্কুল পেরিয়ে কলেজ গিয়েছে। ক্লাস করেছে পরীক্ষা দিয়েছে মঞ্চনাটক করেছে স্ট্রিট থিয়েটার করেছে কলেজ ক্যাম্পাসে। তারপর দিল্লি থেকে প্রথমবার কলকাতায় বসুন্ধরা ভিলার পূজো দেখতে এসে ভেসে গেছে জীবনের প্রথম প্রেমের সুনামিতে। প্রণয়কান্তি দত্ত তাঁর জীবনের প্রথমপুরুষ যার জন্যে বাবলি ভালোবাসার মরশুমের খোঁজ পেয়েছিল। তাই সেই প্রথমবার ঠাকুরদালানে প্রণয়কে দেখার থেকে বিয়ে পর্যন্ত একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গিয়েছিল যেন। কিন্তু ফুলশয্যার রাত থেকেই স্বপ্নে যেন বাস্তবের ঝাঁকুনি এলো। গল্পে উপন্যাসে সিনেমায় স্বপ্নে দেখা সেই চরম রোমান্টিক রাত কল্পনার সঙ্গে মিলল না!
আরও পড়ুন:

বসুন্ধরা এবং…, ৩য় খণ্ড, পর্ব-৩৭: মিরাক্যাল

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

বিছানায় বসে অপেক্ষা করছিল নবপরিণীতা সলজ্জ বাবলি। প্রণয় এসে সিনেমার মতো ঘরের দরজার ডোরলক বন্ধ করেছিল। কয়েকমূহুর্তের চোখবোজা দম আটকানো প্রতীক্ষা। কিন্তু সে মূহুর্ত যেন অন্তহীন! খালি টুংটাং শব্দ। চোখ খুলে বাবলি দেখল তার স্বপ্নের পুরুষ ঘরের সুদৃশ্য ওয়াইন ক্যাবিনেট বা সেলারেট থেকে গ্লাস বোতল নিয়ে মদ্যপানের আয়োজন করছে।

বাবলি আগে দিল্লিতে তাঁর স্কুলের বান্ধবী নয়না চোপড়ার বাড়িতে সেলারেট দেখেছে – সুদৃশ্য কাচের আসবাবে নানান রং এবং বিচিত্র আকারের মদে গলাভর্তি বোতল। সোজা-বাঁকা-গোল-লম্বা-পেটমোটা-ছিপছিপে বোতলবোঝাই মদের শোরুম যেন । একটা তাকে সুদৃশ্য ঝলসে পড়া কাচের ছোট-বড়-মাঝারি অসংখ্য সুরাপাত্র।বাবলিদের প্রবাসী শিক্ষিত বাঙালি পরিবার।তারা মদ শুয়োর বা গোমাংস নিষেধের সামাজিক বিধি ও শৃঙ্খলা মেনে চলা সনাতনীধারায় বিশ্বাসী পুরোনোপন্থী।
আরও পড়ুন:

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

এই সব বাধা-নিষেধ থেকেই দিল্লিতে থাকা সত্ত্বেও বাবলির কলেজেও কোনও প্রেম হয়নি। অথচ স্কুলের ক্লাস সিক্স সেভেন থেকে তার বাঙালি-অবাঙালি বান্ধবীদের অনেকেরই মোটামুটি প্রাতঃকৃত্যের নিয়মে মাসঃকৃত্য প্রেম হতো। যদিও প্রাতঃকৃত্য শব্দার্থ্য কুইজে এলে শতকরা ষাটভাগ যে উত্তর দেবেন তা বেঠিক। প্রাতঃক্রিয়া বা প্রাতঃকৃত্য হল কর্মচতুষ্টয়, প্রাতঃকালীন শৌচধৌত স্নান উপাসনাদি বা নিত্যপুজো। অথচ আমরা অধিকাংশ এটি কেবলমাত্র শৌচের সমার্থক ভাবি। যাইহোক সেই উদ্ভ্রান্ত প্রেমিকাকূলের ক্ষণে ক্ষণে প্রেম পাওয়া আর প্রেম মিটে যাওয়া দেখতে দেখতে ক্লান্ত বাবলির স্কুলকলেজে প্রেমের ফুল ফোটেনি, যা ফুটেছে একবারই।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

প্রণয় চোখ নাচিয়ে জানতে চেয়েছিল—
—কী নেবে?
বাবলি ঘনঘন মাথা নেড়ে জানিয়ে দিয়েছিল। না, সে অভ্যস্ত নয়।
—খাওনি কক্ষনো?
—না।
—দেখেছো তো? সিনেমায়?
বাবলি মাথা নিচু করে সম্মতি জানিয়েছিল —
—টেস্ট করো?
না, বাবলি মাথা নাড়ায় —
—ওয়াইন নাও!
যাকে সত্যি ভালবাসা যায় তার সঙ্গে তো বিষও ভাগ করে খাওয়া যায়। বাবলি সেই প্রথম আর সেই শেষবার প্রণয়কে গরল চেখে দেখায় সঙ্গ দিয়েছিল। মদ খেতে যারা ভালবাসে তারা কী ভিতরে ভিতরে নিঃসঙ্গ? নাকি মদের নেশায় তারা নিঃসঙ্গতা অনুভব করে। তাই তারা নেশা করতে বসে সঙ্গী খোঁজে এক বা একাধিক! কিন্তু একাএকাও তো অনেকে মদ্যপান করেন – শুতে যাবার আগে ক্লান্তি দূর করতে নাকি আরও ক্লান্ত হয়ে নিশ্ছিদ্র নিদ্রার লোভে?
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

সে রাতে প্রণয়খানিকপরেই মদ খেতে খেতে ক্লান্ত পড়েছিল! প্রণয়কে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বাবলি সেদিন ভাবছিল এমন ফুলশয্যা হয়ত সিনেমা থিয়েটারে হয়। কিন্তু তার নিজের জীবনে এমন অঘটন ঘটল কেন? কিন্তু বাবলি তার মা বা কাকীমাদের এই দূর্ভাগ্যের কথা কখনও জানায়নি।—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content