শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


শ্রীমা।

মা সারদার নতুন বাড়ির অর্পণনামা যখন কোয়ালপাড়াতে রেজিস্ট্রি করা হয়, তখন একটি ঘটনা ঘটে। সেইসময় শরৎ মহারাজও উপস্থিত ছিলেন। কোতলপুর থেকে রেজিস্ট্রির জন্য একজন মুসলমান সাব-রেজিস্ট্রার আসেন। তাঁকে কোয়ালপাড়া মঠের ঠাকুরঘরের বারান্দায় বসানো হয়। শ্রীমা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়েছিলেন। সাব-রেজিষ্ট্রার তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার নাম কি’? শুনে সারদা মা ধীরে ধীরে বিভূতিবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিভূতি, আমার নাম কি’? তিনি জানান, ‘মা, আপনার নাম সারদামণি’। তখন শ্রীমাও বললেন, ‘নাম, সারদামণি’।

পল্লিবাংলায় ভালোনামে কাউকেই ডাকা হয় না। আর বাড়ির বড়দের কাছে তিনি তো ‘সারু’। মার সখীরাও তাঁকে ‘সারদা’ বলেই ডাকতেন। কামারপুকুরে তিনি চন্দ্রমণি ও গ্রামবাসীদের কাছে তাদের ‘গদাইয়ের বৌ’ নয়তো বৌমা। তিনি গৃহেই শিক্ষালাভ করেছেন। তাঁর ভাইদের মতো পাঠশালায় গিয়ে নয়। তাই শ্রীমার নিজের পুরো নাম জানা ছিল না। এই কারণেই বিভূতিবাবুর কাছে জানতে চান। রেজিস্ট্রিকৃত এই নতুন বাড়িতে মা সারদা তাঁর ভাইপো, ভাইজিদের নিয়ে থাকতেন।
শ্রীমার সেজভাই বরদাপ্রসাদের স্ত্রী ইন্দুমতীর কথা থেকে জানা যায় যে, তার বড়ছেলে খুদিরামকে মা সারদা খুদির বদলে ‘ফুদি’ ডাকতেন। সে ফল খেতে খুব ভালোবাসত। তার জন্য শ্রীমা কলকাতা থেকে কখনও বা পার্সেল করে ফল পাঠাতেন। নিজের খাওয়া শেষে দুধভাত মেখে ভাইপোকে মনে করতেন, আর খুদিও ‘পিসিমা’ বলে গিয়ে হাজির হত। সারদা মা বলতেন, ‘এস বাবা, আমি তোমাকেই ডাকছিলুম’। ইন্দুমতী কখনও মা সারদাকে বলতেন, ‘আপনি ওকে ভালোমন্দ এত করে খাওয়াচ্চেন, ও কি বরাবরই এমনি খেতে পাবে? পাড়াগেঁয়ের ছেলে’। শ্রীমা অমনি বলতেন, ‘তোরা বুঝিসনি গো, যে খায় চিনি যোগায় তাকে চিন্তামণি’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪১: মা সারদার অন্তরঙ্গ সেবক শরৎ মহারাজ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ

মা সারদার কলকাতায় যাবার সময়ও খুদি মায়ের সঙ্গ কিছুতেই ছাড়ল না। শ্রীমা খুদির হাতে শম্ভূবাবুর স্ত্রীর দেওয়া একটা সোনার আংটি পরিয়ে দেন। আর একটি মিছরির ঢেলা দিয়ে বলেন, ‘যখনই আমার কথা মনে পড়বে, এই মিছরি খাবে, তাহলেই আমাকে ভুলে যাবে’। এরপর ইন্দুমতী যখন খুদিরামকে নিয়ে কলকাতা যান, তখন শ্রীমা খুদিকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাবা, তুমি কি মল নেবে’? সে বলে, ‘আমি দেতুরে (অর্থাৎ নূপুরে) মল লুব’। শ্রীমা ভাইপোর আধো বুলি শুনে বলেন, ‘বেশ তো বাবা, গোপালের নূপুর আছে, তোমারও পায়ের নূপুরে মল থাকবে’। তখন শ্রীমা গোলাপমাকে দিয়ে তাকে পায়ের মল গড়িয়ে দেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

সেদিন ‘খণ্ডরে’র পুনঃপ্রদর্শন আনন্দ দিয়েছিল বিশ্বের তাবড় সিনেমাপ্রেমী থেকে বরেণ্য সেই পরিচালককে

একদিন শ্রীমা খুদিকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কি দিয়ে ভাত খেলে, বাবা’? খুদি অমনি বলল, ‘আমার মা এত বড় একটা মাগুরমাছ কিনেচে’ এই বলে সে দু’হাত তুলে বোঝাল। সারদা মা বললেন, ‘কতবড় বাবা? এত বড়, তোমাকে দিয়েছিল’? সে বলে, ‘একখানি মোটে দিয়েছিল, পিসিমা। সবাইকে দিয়ে দিল। বিকেলবেলা ইন্দুমতী শ্রীমার কাছে যেতেই তিনি বললেন, ‘শুনেছিস? এত বড় মাগুরমাছ কিনে রান্না করেছিস, আর ফুদিকে মোটে একখানা দিয়েচিস? আর দিসনি’? ইন্দুমতী বললেন, ‘না, মাছ তো নেওয়া হয়নি’। শ্রীমা তখন হেসে বলেন, ‘ওলো, আমার মেজভাই উমেশ অমনি বলত। সেকথাই আজ ফুদি বললো’। আসলে শ্রীমায়ের হাতেই তাঁর ভাইরাও মানুষ হয়েছে। তাই তিনি ভাইপো-ভাইজিদের মধ্যে ভাইদের ছোটবেলাটা দেখতে পেতেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৮: যুগান্তরেও রামচন্দ্র, পুরুষোত্তমরূপে প্রসিদ্ধ কেন?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪০: দুর্বল বা অসহায়রা একত্র হলে তাঁরাই অজেয় হয়ে ওঠেন

খুদির যখন আড়াই বছর বয়স, তখন ইন্দুমতীর অম্বলের রোগ হয়। শ্রীমা তাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে শ্যামাদাস কবিরাজকে দিয়ে চিকিৎসা করাতে থাকেন। কিন্তু চিকিৎসায় কোনও ফল না হওয়ায় শ্রীমা তাকে নানা টোটকার ওষুধ খাওয়াতে লাগলেন এবং রোজ গঙ্গাস্নানে নিয়ে যেতেন। এই অম্লরোগ সারতে প্রায় দেড়বছর লেগেছিল। মা সারদা তাকে বলেন যে, তার অসুখের জন্য মা ছাদে উঠে গঙ্গার বাগে চেয়ে কাঁদতেন। পাছে ইন্দুমতী মারা যান আর তিনি ইন্দুর ছেলেকে মানুষ করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইন্দুমতীর ছোট ছেলে বিজয় হবার সময়ও তার কঠিন অসুখ হয়। তখন শ্রীমা তিনজন ডাক্তার অনিয়েছিলেন। একজন হলেন দেশড়ার যথার্থ ঘোষ, অন্যজন চন্দ্রকোণার নলিন সরকার আর তৃতীয়জন বাঁকুড়ার বৈকুণ্ঠ।
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র: হে নূতন…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

ইন্দুমতীর অসুখ নিয়ে শ্রীমা এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়েন যে, তিনি নিজেও অসুস্থ হন। অসুখ সারলে তিনি ভাজকে বলেন, ‘তোর যখন ছেলে হয়, তখন আমি বড় কষ্ট পাই। তোর যত না কষ্ট হয়, আমার তার চেয়ে বেশি হয়। তুই যদি মরে যাস, আমাকেই তো দেখতে হবে। আমি তো ফেলতে পারবনি। আমি আশীর্বাদ করি, আর যেন না তোর ছেলে হয়’। সেই ছেলের জন্ম থেকেই ইন্দুমতী অনেক কষ্ট পাওয়ায় শ্রীমা তার নাম রাখেন দুখীরাম। তাই দেখে যোগীনমা আর গোলাপমা সারদা মাকে বলেন, ‘আপনি যা নাম রাখবেন, তাই তো হবে’। শুনে শ্রীমা বলেন, ‘তবে ওর নাম বিজয়কৃষ্ণ থাক’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content