বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


ঊষা মেহতা।

তখন কণ্ঠরোধের ভারতবর্ষ, চিন্তাচেতনা রোধের ভারতবর্ষ, আর সেই পরাধীনতার আগুনে পোড়া এই দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হন একদল অগ্নিপুত্র, অগ্নিকন্যারা। তবে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া যে একমাত্র পথ নয় বুঝতে পেরে শুরু হয় লিফলেট বিলি, দেওয়ালে পোস্টার সাঁটানো, গণ আন্দোলনে যোগদান, দেশজ জিনিসের ব্যবহার থেকে ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ মাথায় তুলে নেওয়ার প্রত্যয়, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে কলম ধরতে না পারার হতাশা থেকে সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্ব বোঝাতে, তাঁদের সংগঠিত করতে বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ও বিপ্লবীদের কণ্ঠস্বর এবং নানাবিধ অসহযোগের খবর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে মাত্র ২২ বছরের ঊষা মেহতা ও তাঁর সহযোগী বিটঠল ভাই জাভেরি, চন্দ্রকান্ত জাভেরি, বাবুভাই ঠক্কর, শিকাগো রেডিয়োর কর্ণধার নঙ্কা মোতয়ানির সহায়তায় ‘সিক্রেট কংগ্রেস রেডিয়ো’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এই রেডিয়ো স্টেশন ব্রিটিশ সরকার নিয়ন্ত্রিত, নিষিদ্ধ, সেন্সর বিহীন সংবাদ এবং তথ্য প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রাত সাড়ে সাতটায় সব কাজের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ উদগ্রীব অপেক্ষায় থাকতেন এই রেডিয়ো স্টেশনের বার্তা শোনার জন্য। অনুপ্রেরণা এসেছিল স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীর থেকে। সাল ১৯৪২ এর ৮ আগস্ট গান্ধীজির ‘করো ইয়া মরো’ যেমন উদ্বুদ্ধ করেছিল বহু ভারতবাসীকে তেমনই ঊষাকেও। এই বক্তৃতা দানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গান্ধীজি সহ অন্যান্য নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয় যাতে ভারতছাড়ো আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়। এই আন্দোলনের সূচনা লগ্নে গান্ধীজির কথায় উদ্বুদ্ধ ঊষা সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট গোপনে কংগ্রেস রেডিয়ো স্টেশন শুরু করেন। ওই বছরের ২৭ আগস্ট থেকে সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। শুরুতেই সেই অগ্নিকন্যা নিজেই ঘোষণা করতেন, “এটি কংগ্রেস রেডিয়ো, ৪২.৩৪ মিটারে, ভারতবর্ষের কোথাও থেকে, কোথাও থেকে ভারতবর্ষে”।
আরও পড়ুন:

যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে…/১

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরার সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম

ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ঊষার বিরোধ সেই প্রথম নয়, যখন তাঁর বয়স মাত্র পাঁচ, তখন তিনি প্রথম মহাত্মা গান্ধীকে আহমেদাবাদে তাঁর আশ্রমে দেখেন। সেই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই গান্ধীজি ঊষাদের গ্রাম সরসের কাছে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য ক্যাম্প করেন। ছোট্ট ঊষা বাড়ির বড়দের সঙ্গে সেই আলোচনা মালায় যোগ দিতে শুরু করেন। যত তাঁর বয়স বাড়তে থাকে ততই তিনি মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে উঠতে থাকেন। ত্যাগ করেন সমস্ত সাংসারিক সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, ধারণ করেন খাদি। প্রতিরোধ ঊষার কাছে নতুন কিছু ছিল না। প্রথম জীবনে পুলিশের তাড়া ছিল তাঁর সবসময়ের সঙ্গী। গুজরাতের সরসে যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেখান থেকে ১৯৩০ সালে ইতিহাসখ্যাত লবণ আন্দোলনের শুরু হয়। ছোট মেয়ের ভয় বলে কিছু ছিল না কোনওদিন, শিশুদের দলের (বানর সেনার) সঙ্গে হাজতবাস থেকে শুরু করে ‘সাইমন গো ব্যাক’ শ্লোগান দিতে কখনও পিছুপা হননি। ভারতীয়রা নিজেদের দেশ নিজেরা শাসন করবে, বিদেশিরা নয়, এই ছিল সবসময়ের যুক্তি।

যৌবনে।

অগ্নিকন্যা ঊষা মেহতার বয়স যখন মাত্র দশ (১৯৩০) তখন তিনি গান্ধীজির ডাকে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন। অনেক পরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, “অত ছোট বয়সে আমি দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছিলাম, আমার জন্য সেটা খুবই শান্তির বিষয় ছিল”। লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মাধ্যমে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। তাতেও ঊষার সক্রিয় যোগদান দেখা গিয়েছিল। পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রসঙ্গ উঠলে তিনি বলতেন, “সেইসময় কোনও অনুপ্রেরণার প্রয়োজন পড়তো না কারণ সমগ্র পরিবেশ এত উজ্জীবিত হয়ে থাকতো যে সবাই ব্রিটিশ সরকার বিরোধী আন্দোলনে সহায়তা করতেন।” ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ রাজের অধীনে বিচারক হিসেবে কর্মরত তাঁর বাবা অবসর গ্রহণ করলে ঊষা স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িয়ে পড়েন। পুরো পরিবার গুজরাত থেকে বম্বাই এসে বসবাস করতে শুরু করে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪১: সুন্দরবনে বাঘে-মানুষে সংঘাত

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’

জনসংযোগের বিশেষ মাধ্যম হয়ে ওঠে সেই সিক্রেট রেডিয়ো। যে বিশিষ্ট নেতাদের সহযোগিতা ঊষা ও তাঁর সহযোগীরা পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ড. রাম মনোহর লোহিয়া, অচ্যুতরাও পটবর্ধন এবং পুরুষোত্তম টিকারামদাস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। প্রথমে দিনে দুবার করে হিন্দি এবং ইংরেজিতে সম্প্রচার ও পরে তা কমিয়ে দিনে একবার সন্ধ্যা ৭.৩০ থেকে ৮.৩০ হয়। আন্দোলনের এই পথ সহজ ছিল না। তিন মাসের সম্প্রচারে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য তাঁরা ছয় থেকে সাতবার স্থান পরিবর্তন করেন। সারা দেশে তাঁদের বার্তাবাহকরা ছড়িয়ে ছিলেন। এমনকি অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির বম্বাই অফিস থেকে তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ খবর আসত। দেশের তৎকালীন বহু সংবাদপত্র যা ছাপতে ভয় পেতো কংগ্রেস রেডিও সেই বিষয়গুলি সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরতো। পুলিশ ভ্যান সব সময় তাদের ধাওয়া করতো, ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে পুলিশ বম্বাইয়ের সমস্ত রেডিওর দোকানে এমনকি শিকাগো রেডিও স্টেশনে অভিযান চালায়। সেদিন জনৈক নরিমান প্রিন্টারকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ কংগ্রেস রেডিও সম্পর্কে সঠিক হদিশ পায়।

কিশোরী ঊষা।

১২ নভেম্বর সন্ধ্যায় পুলিশ ঊষা মেহতা সহ তাঁর চারজন সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করে, বাজেয়াপ্ত করে কংগ্রেস পার্টি সেশনের বাইশটি কেস ভর্তি ছবি এবং সাউন্ড রেকর্ডার সহ নানা প্লেট। সকলের কারাবাস ধার্য হয়। সিআইডি প্রায় ছয় মাস ধরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। অনেক পরে সেই সব জিজ্ঞাসাবাদের ধরনকে তিনি ‘সত্যিকারের মানসিক অত্যাচার’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর জন্য ধার্য হয় নির্জন কারাবাস। আন্দোলনের পথ থেকে সরিয়ে আনার জন্য তাঁকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন ঊষা মেহতা, হাইকোর্টে বিচার চলাকালীন আগাগোড়া চুপ করে থাকতেন। নিজেকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টাই তিনি করতেন না ফলে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ এই চার বছরের জন্য তাঁর স্থান হয় পুণের ইয়ারাব্দা জেল। ১৯৪৬ সালে বম্বাইতে মুক্তি পাওয়া প্রথম রাজনৈতিক বন্দি ছিলেন ঊষা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা

মুক্তির পর মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারায় তিনি পিএইচডি করেন। ১৯৮০ সালে বম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত তিনি অধ্যাপক এবং রাষ্ট্রনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করে গিয়েছিলেন। ইংরেজি ও গুজরাতি ভাষায় লিখেছিলেন অসংখ্য প্রবন্ধ এবং বই। দীর্ঘকাল তিনি বম্বাইয়ের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে গান্ধীবাদী নীতি ও দর্শন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। নারী শিক্ষার পক্ষে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শ্রীমতী নাথিবাই দামোদর থাকরে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমৃত্যু জড়িত ছিলেন। জীবনের শেষ কুড়ি বছর তিনি গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন এবং মণি ভবন গান্ধী সংগ্রহালয়ের প্রেসিডেন্ট পদে কাজ করে গিয়েছেন।

লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন।

জীবনসায়াহ্নে এসে ঊষা মেহতা সামাজিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীন ভারত যে দিকে যাচ্ছিল সেই সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “নিশ্চিতভাবে এমন স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়াই করিনি”। তবে তিনি স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশের অগ্রগতির প্রয়োজনীয়তাকেও অস্বীকার করেননি। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ঊষা মেহতা সারা জীবন দেশের উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকার কথা তুলে ধরে ১৯৯৮ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন। ২০০০ সালের ১১ আগস্ট বিনা রোগভোগে তিনি চলে গেলেও রেখে যান ‘অনেক নৃপতির শাসনে না রহি শঙ্কিত আসনে’র তুল্য দৃপ্ত প্রতিবাদের ভাষা।
* ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

Skip to content