শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

শাক্য হতভম্ব হয়ে লোকাল থানার রিপোর্ট, স্থানীয় সরকারি হেলথ হোমের ডাক্তারের দেওয়া বয়ান, স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিউজ রিপোর্ট আর তার ফলোআপ দেখছিল।

একেজি গম্ভীর মুখে তাঁর মাথা ভর্তি সাদা চুলে অভ্যাসমতো হাত বুলাচ্ছেন। শাক্য অবশ্য একা নয়। তার পাশে বসে আছে তার অনুজ সহকর্মী পাভেল সরকার। পাভেল ছেলেটি চৌখস এবং অ্যাকশানে পটু। তবে একটু তাড়াহুড় করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায় বলেই অনেক সময় তীরে এসে তরী ডুবিয়ে ফেলে।

পাভেল তাকে দেখে মুচকি হেসেছিল, তারপর বলেছিল, “গুড ইভিনিং স্যার!”
“গুড ইভিনিং! কী ব্যাপার পাভেল, তুমি থাকতে একেজি স্যার এই অধমকে স্মরণ করলেন?”

“আসলে স্যার উত্তম নিশ্চিতে চলে অধমের সাথে, সেই কারণেই হয়ত আপনাকে ডেকেছেন!” বলে ফিচেল হাসি হাসল সে।

দু’জনের মধ্যে এমনি লেগ-পুলিং চলে, আবার দুজন দুজনকে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করে, ভরসা করে। দু’-একটা কেস দুজনে মিলেই সলভ্‌ করেছে।

একেজি বললেন, “তুমি আগে পাঁচ মাস আগের ‘অরণ্যবার্তা’ নামে লোকাল কাগজের খবরটা দেখো। এর আগে আর কোনো নিউজপেপারে কোনও খবর পাওয়া যায়নি। এরপরে কথা বলছি। পড়ো। হ্যাঁ, এই যে এই খবরটা।” তিনি ফাইল থেকে একটা চারপাতার স্থানীয় সংবাদপত্র বার করলেন। এখনও মফস্বলে এই জাতীয় সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, যেখানে স্থানীয় এমন অনেক খবর মেলে, যা বড় বড় হাউসগুলির সংবাদপত্রে পাওয়া যায় না। তাঁরা মনেই করেন না, এ-জাতীয় সংবাদের কোনও গুরুত্ব আছে। এটাও হয়তো তেমনই একটা খবর ছিল।
শাক্য এমনভাবে কাগজটা ধরল, যাতে পাভেলও পড়তে পারে। স্থানীয় সংবাদপত্রের তৃতীয় পাতায় খবরটি পাঁচ মাস আগে প্রকাশিত হয়েছিল—
 

কালাদেও কি ফিরে এল?

নিজস্ব সংবাদদাতা, ২১ মার্চ, ২০২২: সম্প্রতি পিশাচ-পাহাড় এলাকায় জাতীয় সড়কের ধারে একটি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। মৃতদেহের মাথা সম্পূর্ণরূপে থেঁতলানো। থাকায় চার দিন কেটে গেলেও এখনও তার পরিচয় জানা যায়নি। পুলিশের অনুমান, মৃত ব্যক্তির বয়স বছর তিরিশ থেকে বত্রিশের কোঠায়। পরনের পোশাক-আশাক দেখে অনুমান, মৃত ব্যক্তি স্বচ্ছল পরিবারের কেউ। হাতে দামি রিস্টওয়াচ ছিল। যদিও কোনও পার্স কিংবা মোবাইল পাওয়া যায়নি। স্থানীয় একদল মানুষ সকালবেলা ট্রেন ধরতে যাওয়ার পথে মৃতদেহটি দেখতে পেয়ে স্টেশনে কর্তব্যরত পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, পুলিশ ও ডাক্তারের অনুমান, আগের দিন রাত বারোটা থেকে তিনটের মধ্যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে। মাথায় একাধিকবার আঘাতের ফলে স্কাল একেবারে চুরমার হয়ে গিয়েছে বলে তাঁর অনুমান। বড় বড় কালো লোমও পাওয়া গিয়েছে, যা ভালুকের লোম নয়, তার চেয়েও বেশি দীর্ঘ। ফরেন্সিক টেস্টের জন্য সেগুলি কলকাতায় পাঠানো হবে বলে জানা গিয়েছে। কেউ কেউ এই হত্যাকাণ্ডকে কালাদেওর কীর্তি বলছেন। সম্প্রতি একদল শহুরে মানুষ পিশাচ-পাহাড়ে কালাদেওর গুহা বলে খ্যাত স্থানকে অপবিত্র করেছিলেন বলে স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। তাঁদের অনুমান, এতে কালাদেও রুষ্ট হয়েছেন এবং তার ফলেই এই হত্যাকাণ্ড। মৃত ব্যক্তি সেই শহুরে দলটির একজন হতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা। আশা করা হচ্ছে, পুলিশ অতি দ্রুত তাঁদের তদন্ত শেষ করবে এবং আমাদেরকে আশঙ্কা মুক্ত করবেন।

“পড়লে?” একেজি জিজ্ঞাসা করলেন দু’ জনকেই।

“হ্যাঁ। পড়লাম। এমনিতে সাধারণ ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। কারণ, কোনও দুর্ঘটনার ফলে মাথা থেঁতলে যাওয়া খুব কমন ব্যাপার। একমাত্র আশ্চর্য ঘটনা হল, হয়তো গুরুত্বপূর্ণ সূত্রও, দীর্ঘ কালো লোম, যা ভালুকের নয়, অন্য কোনও প্রাণির। এখন দেখতে হবে, স্থানীয় জঙ্গলে কী ধরণের জানোয়ার আছে!” শাক্য বলল।

আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৮: বুধন উধাও

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬০: গ্রাম বাংলায় আমুর কার্প মাছের বীজ উৎপাদন করে ভালো রোজগার করা সম্ভব

“দেখো, আমি সে-ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। স্থানীয় জঙ্গলে এককালে হাতি-ঘোড়া যাই থাকুক না কেন, এখন সাধারণ কিছু জানোয়ার আর বন-দপ্তরের ছাড়া হরিণ ছাড়া আর কিছু নেই। ভালুক থাকতে পারে, আগে ছিল, কিন্তু বহুকাল কোনও ভালুকের সঙ্গে কারও মুলাকাত হয়েছে বলে খবর নেই। মাঝেসাঝে দলমার রেঞ্জ থেকে হাতিদের পাল ঢুকে পড়ে ঠিকই, কিন্তু তাদের গায়ের লোম নয়। অন্য কোনও অজানা প্রাণির লোম। বনদপ্তরের বিশেষজ্ঞ লোকও চিনতে পারেননি।”

পাভেল বলল, “আচ্ছা স্যার, হাতিদের পায়ের চাপেও তো মাথা থেঁতলে যেতে পারে, কিংবা শুঁড়ে জড়িয়ে আঘাত করলে মাথার খুলি চুরমার হয়ে যাওয়া তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তারপর ধরুন আর কোনও প্রাণি এসে মুখ দিয়েছিল, সেই সময় তার লোম এসে পড়ে। এর মধ্যে কালাদেও-টেও কোথা থেকে আসলেন ?”

একেজি বললেন, “দেখ, বিষয়টা আমিও ভেবেছি। কিন্তু হাতির পায়ের চাপে উন্ডেড হলে, তার বডিতে আরও যেসব মার্ক থাকা উচিত, সেরকম কিছু মেলেনি। তার উপর হাতি শুঁড়ে তুলে আছাড় মারতেই পারে এবং সেই আঘাতে মাথার খুলি চুরমারও হতে পারে, কিন্তু তাতে কী শরীরের হাড়ও আস্ত থাকবে? অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার এই, বডির শরীরের বাকি সমস্ত কিছুই ইনট্যাক্ট আছে। নো ইনজুরি, নো স্ট্রেস!”

শাক্য বলল, “আচ্ছা, ওই লোমগুলি পুলিশ ফরেন্সিকে পাঠাবার কথা বলেছিল। সেটা নিশ্চয়ই পাঠিয়েছিল। তার রিপোর্ট কি পাওয়া গিয়েছে?”

“গিয়েছে। ফাইলেই আছে তার কপি। সেখানে একটা আশ্চর্য কথা বলা হয়েছে, লোমগুলি নাকি আসলে কোনও মানুষের মাথার চুল, যদিও খুব মোটা আর আনইউজুয়াল ফর ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট!”

“স্ট্রেঞ্জ!” শাক্য আপনমনে মন্তব্য করলো।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

পাভেল বলল, “কেস তো পুরো জন্ডিস মনে হচ্ছে! মানুষের মাথার চুল। তাহলে কী মানুষ রাক্ষস হয়ে মাছের মুড়ো ভেবে মানুষের মুড়ো চিবিয়ে খেয়েছে না কি?”

“এখানেই তো রহস্য!” একেজি বললেন, “এই কথা গোপন থাকেনি, খবরের কাগজওয়ালারাই ফরেন্সিক রিপোর্টের ব্যাপারে থানা থেকে জেনে ছাপিয়ে দিয়েছে। তার পর থেকেই কালাদেওর ব্যাপারটি আরও মজবুত হয়েছে। আর এই ঘটনা কেবল সূত্রপাত মাত্র। কালাদেওর বলি এই পাঁচ মাসে প্রায় তিন জন। তার মধ্যে দু’ জন মৃত, একজন কোনওভাবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে, কিন্তু তার মাথায় এমন আঘাত লেগেছিল যে, সারা শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছে। কোনওরকম কথা বলার অবস্থায় সে নেই। শরীরের অবস্থাও ভালো নয়। যে-কোনো মুহূর্তেই কোলাপ্স করতে পারে।”

“স্যার, বাকি কেসগুলি আর কালাদেও সম্পর্কে কোনও তথ্য যদি পাওয়া যায়…” শাক্য বলল।

একেজি বললেন, “যা যা আমি জোগাড় করতে পেরেছি, সব দুটি ফাইলে সাজিয়ে রেখেছি। বাকি কিছু দরকার হলে তোমাদের ছানবিন করে কালেক্ট করতে হবে। তবে হ্যাঁ, আমি কিন্তু ইতিমধ্যেই আমার এক সোর্সকে ওখানে নিযুক্ত করেছি। তার কাজ যতদুর সম্ভব খোঁজখবর নিয়ে ডেটা কালেক্ট করা।”

পাভেল জিজ্ঞাসা করল, “লোকাল লোক না কি স্যার? কিন্তু আপনি তো ওই জেলায় আগে কখনো কাজ করেননি বলেই জানি তাহলে? না কি এখান থেকে কাউকে পাঠিয়েছেন?”

একেজি গম্ভীর গলায় বললেন, “সেটা তোমার না-জানলেও চলবে পাভেল। আই মিন, তোমাদের দু’ জনের না জানলেও চলবে। যাকেই নিযুক্ত করি, সে তার কাজ করে আমার কাছে ফাইল পাঠিয়ে দেবে। আমি তোমাদের সেই ফাইল দেবো, যদি তোমরা এই কেসে ইন্টারেস্টেড হও। আমি এখনো ইনভেস্টিগেশন টিমে কারা কারা থাকবে, তা ফাইনাল করিনি। তবে কালকের মধ্যেই আমাকে ফাইনাল করে মন্ত্রীকে মেইল করে জানাতে হবে। অতএব তোমরা আগে যেটুকু এখন হাতে পেয়েছ, সেটা পড়ে দেখ। তারপর মনঃস্থির করো।”
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৫: পঞ্চমের অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে একটি কিশোরের গাওয়া জনপ্রিয় ‘নদিয়া সে দরিয়া’ গানটি

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: জাতির কল্যাণে ‘জাতীয় বৃক্ষ’

শাক্য বলল, “সে ক্ষেত্রে স্যার, আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে ফাইলগুলি আমি আর পাভেল নিয়ে যাই এখন, রাতের ভিতরেই আপনাকে ফিডব্যাক দিচ্ছি?”

“ইট’স্‌ ওকে। তবে আমি পজেটিভ আনসারটাই চাই!”

“জানি স্যার। তা না হলে ডিপার্টমেন্টের এত জন যোগ্য অফিসার থাকতে আমাদের মতো নভিশের দরকার পড়ত না। যদি আমি ভুল কিছু গেস না করে থাকি, তবে এই তদন্তে মগজের সঙ্গে সঙ্গে ফিজিক্যাল স্ট্রেংথ-ও থাকা দরকার। তাই তো স্যার?”

“মানে অ্যাকশানে নামতে হবে?” পাভেল উত্তেজিত হয়ে মুঠি বদ্ধ করে, “আই অ্যাম রেডি স্যার!”

“আগে কেস স্টাডি করো, তারপর বলো”, একেজি বললেন, “আমার অনুমান-শক্তি বলছে, কেসটা সাধারণ নয়। অনেক জট আছে, তার জন্য ইতিহাস-ভূগোলও ঘাঁটতে হতে পারে!”

“ইতিহাস-ভুগোল? সে-তো স্যার সেই কবে এইচএসে লাস্ট পড়েছি। আমার আর্টস ছিল কি না!”

“পাভেল!” চাপা গলায় ধমক দিল শাক্য, “এটা জোকস করার সময় নয়। বি সিরিয়াস। চল আমার কেবিনে, দুজনে বসে ঠান্ডা মাথায় ফাইলগুলি পড়ি। যুদ্ধে নামবো বললেই হয় না, আগে দেখতে হয়, আমি সেই যুদ্ধের উপযুক্ত কি না! এসো। আমরাও দেখি!”—চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content