অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।
সত্যব্রত বললেন, “দেখুন, আমি যা বলতে যাচ্ছি, তা শুনে আপনারা কী করবেন, তা একান্তভাবেই আপনাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমার মতে, যদি কালাদেও নামক সমস্যার শিকড়ে পৌঁছতে চান, তাহলে আগে এই ছোট ছোট পার্টসগুলিকে আপনাদের কালেক্ট করতেই হবে। আমার মনে হয়, এই সব সূত্র একজায়গায় জুড়তে পারলেই এই রহস্য আর রহস্য থাকবে না, জলের মতো সহজ হয়ে যাবে।”
শাক্য তাঁকে সমর্থন করে বলল, “ঠিক এই কথাটিই আমি সুদীপ্তকে একটু আগে বলছিলুম। তবে আপনার মশাই পুলিশবিভাগে জয়েন করা উচিত। আপনি তো গুরুদেব লোক মশাই, একদিকে ডাক্তার, অন্যদিকে গোয়েন্দাও। আমাদের ভাতে মারবেন দেখা যাচ্ছে! তা-না-হলে লোকাল পুলিশ যা পারল না, আপনি নিজের উদ্যোগে সেই শেকড়ের একটা অংশকে খুঁজে পেলেন, এ-তো আনবিলিভেবল্ মশাই!”
শাক্য ইচ্ছে করেই লোকাল পুলিশের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেছিল। সুদীপ্তর ভিতর প্রতিক্রিয়া হবে জেনেই। হল-ও। সুদীপ্ত মৃদু স্বরে বলল, “আমরা কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম স্যার! কিন্তু এঁরা সকলে যদি ক্ল্যুগুলিকে নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখেন, তাহলে আমরা কী করতে পারি?”
শাক্য তাঁকে সমর্থন করে বলল, “ঠিক এই কথাটিই আমি সুদীপ্তকে একটু আগে বলছিলুম। তবে আপনার মশাই পুলিশবিভাগে জয়েন করা উচিত। আপনি তো গুরুদেব লোক মশাই, একদিকে ডাক্তার, অন্যদিকে গোয়েন্দাও। আমাদের ভাতে মারবেন দেখা যাচ্ছে! তা-না-হলে লোকাল পুলিশ যা পারল না, আপনি নিজের উদ্যোগে সেই শেকড়ের একটা অংশকে খুঁজে পেলেন, এ-তো আনবিলিভেবল্ মশাই!”
শাক্য ইচ্ছে করেই লোকাল পুলিশের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেছিল। সুদীপ্তর ভিতর প্রতিক্রিয়া হবে জেনেই। হল-ও। সুদীপ্ত মৃদু স্বরে বলল, “আমরা কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম স্যার! কিন্তু এঁরা সকলে যদি ক্ল্যুগুলিকে নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখেন, তাহলে আমরা কী করতে পারি?”
শাক্য বলল, “আপনি হয়তো ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মালাকরবাবু? আমার তো মনে হয় তাঁর শিথিলতার জন্যই বিষয়টা এতদূর গড়াতে পেরেছে। আমি গত দু’বছরে হঠাৎ করে কালাদেওর পুনরাবির্ভাব সম্পর্কিত তথ্য বিশদে জেনেছি। মানে যতদূর জানা সম্ভব। প্রথম থেকেই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি, গত বছর যখন কালাদেওর বলি হিসাবে প্রথম মার্ডারটিকে চিহ্নিত করা হল, হ্যাঁ, আমি জেনেশুনেই মার্ডার বলছি, তখনই যদি ওইসব পেটি বিলিফকে বিশ্বাস না করে আপনারা একটু উদ্যোগী হতেন, তাহলে হয়ত পরের ঘটনাগুলি ঘটত না এবং সেই সুযোগ নিয়ে অন্যান্য দুষ্কৃতকারীরাও আসরে নেমে পড়ত না। এটা অভিযোগ করছি বলে ভাববেন না, আক্ষেপ আমার। এই কেসে এখানে এসে একমাত্র আপনাকেই দেখেছি মাথা ঘামাতে, এটাও মনে থাকবে আমার। যাক, এখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, ডক্টরের কথা শোনা যাক্। বলুন, ডক্টর !”
সত্যব্রত বিভাগের দ্বৈরথ শুনছিলেন, তবে তা নিয়ে সঙ্গত কারণেই কোন মন্তব্য করলেন না। সরাসরি নিজের পয়েন্টে চলে গেলেন। বললেন, “দেখুন, আমি গোয়েন্দা নই, গোয়েন্দাগিরির কিছুই জানি নে বলতে গেলে। তবে হ্যাঁ, আমাদের বয়সী সব বাঙালি ছেলেই যেমন ব্যোমকেশ, কিরীটী, ফেলুদা ইত্যাদি পড়ে বড় হয়, তেমন আমিও হয়েছি। গয়েন্দার সঙ্গে বলতে গেলে সেই আমার একমাত্র ঘনিষ্ঠ পরিচয়। বাস্তবে এই মেডিক্যাল লাইনে এসেও যে খুব বেশি গোয়েন্দা-পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে, তা নয়। সে-দিক থেকে দেখতে গেলে, শাক্যবাবুই বইয়ের বাইরে প্রথম দেখা পুলিশ গোয়েন্দা।”
সত্যব্রত বিভাগের দ্বৈরথ শুনছিলেন, তবে তা নিয়ে সঙ্গত কারণেই কোন মন্তব্য করলেন না। সরাসরি নিজের পয়েন্টে চলে গেলেন। বললেন, “দেখুন, আমি গোয়েন্দা নই, গোয়েন্দাগিরির কিছুই জানি নে বলতে গেলে। তবে হ্যাঁ, আমাদের বয়সী সব বাঙালি ছেলেই যেমন ব্যোমকেশ, কিরীটী, ফেলুদা ইত্যাদি পড়ে বড় হয়, তেমন আমিও হয়েছি। গয়েন্দার সঙ্গে বলতে গেলে সেই আমার একমাত্র ঘনিষ্ঠ পরিচয়। বাস্তবে এই মেডিক্যাল লাইনে এসেও যে খুব বেশি গোয়েন্দা-পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে, তা নয়। সে-দিক থেকে দেখতে গেলে, শাক্যবাবুই বইয়ের বাইরে প্রথম দেখা পুলিশ গোয়েন্দা।”
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৮: পালাবার কোনও পথ নেই
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন
শাক্য বলল, “নেহাৎ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করি, তা-না-হলে আমার নিজের কিন্তু শ্রদ্ধেয় ব্যোমকেশ বক্সীর ‘সত্যান্বেষী’ টার্মটাই বেশি পছন্দ। যাক গে। ক্যারি অন… !”
সত্যব্রত বলল, “আগেই বলেছি, বুধনের কেসটা অ্যাজ এ ডক্টর, আমার কাছে একটা প্রহেলিকাভরা চ্যালেঞ্জ ছিল। যতক্ষণ না সেই প্রহেলিকার সমাধান করতে পারছিলাম, আমার নিজেরই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। পুলিশি তদন্ত যখন ঝিমিয়ে পড়ল, বুঝলাম, কালাদেও-মিথকে সত্য বলে বিশ্বাস করে পুলিশ সেটিকেও আনন্যাচারাল ডেথ বলে এবার হয়তো ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেবে। অথচ, আগেই বলেছি যে, বুধনের লাশ দেখে আমার কেন মনে হয়েছিল যে, এটা কোন অপ্রাকৃত ঘটনার ফল নয়, অপারেশন টেবিলে করা কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। কেন সেই মার্ডার হল, তা তদন্তসাপেক্ষ এবং আমার আওতার বাইরে, কিন্তু মেডিক্যাল কেস হিসাবে যে ছেলেটি নকল বুধন সেজে প্রকৃত বুধনের মৃত্যুর পরে এসে কাটিয়ে গেল তারই বাড়িতে, তাকে খোঁজাটা আমার জরুরি বলে মনে হয়েছিল, কারণ তাকে খুঁজে পেলে হয়তো আমি কান টানলে মাথা আসের মতো প্রকৃত মাথা না-হোক, মাথার একতা আভাস পেতে পারবো। এই কারণেই আমি সেই নকল বুধনের তত্ত্বতালাশ করতে থাকি! আপনারা জানেন না, আমার এখানে একজন শ্তাফ আছেন, ন্যাথানিয়েল গোবিন্দ সোরেন, লোকটি হচ্ছে লোক্যাল গেজেট। প্রায় সব মানুষের নাড়িনক্ষত্র তার কন্ঠস্থ। গসিপের খনি, আর কী-দারুণ নেটওয়ার্ক! আশে-পাশের দশটা জায়গায় কী ঘটছে না-ঘটছে, সব গড়গড় করে বলে দিতে পারে। তবে হ্যাঁ, উস্কে দিতে হবে, নিজের থেকে মুখ খুলবে না। বলতে দ্বিধা নেই, আমি গোবিন্দের উপরেই ভরসা করলাম বেশি এবং শেষ পর্যন্ত যে নকল বুধনের খোঁজ পেলাম, তার প্রধান কৃতিত্ব ন্যাথানিয়েল গোবিন সোরেনেরই।”
শুনে সুদীপ্ত চেয়ার থেকে প্রায় উঠেই পড়ে! “আপনি নকল বুধনের খোঁজ পেয়েছেন? বলুন, সে কে? এক্ষুনি তাকে অ্যারেস্ট করবো! ভারতীয় ন্যায়সংহিতায় প্রতারণার ধারায় তাকে কোর্টে তুলতে বিন্দুমাত্র দেরি হবে না!”
শাক্য বলল, “ধৈর্য্যং রহু। আগে ডক্টরের সম্পূর্ণ কথাটা শুনে নিন, তারপরে অ্যাকশন নেবেন না-হয়! এতদিন দেরি হয়েছে, আর আধ ঘন্টা দেরি হলেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না!”
সুদীপ্ত কোনওক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে কৌতূহলী হয়ে সত্যব্রতর দিকে মনোযোগ দিল।
সত্যব্রত বলল, “আগেই বলেছি, বুধনের কেসটা অ্যাজ এ ডক্টর, আমার কাছে একটা প্রহেলিকাভরা চ্যালেঞ্জ ছিল। যতক্ষণ না সেই প্রহেলিকার সমাধান করতে পারছিলাম, আমার নিজেরই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। পুলিশি তদন্ত যখন ঝিমিয়ে পড়ল, বুঝলাম, কালাদেও-মিথকে সত্য বলে বিশ্বাস করে পুলিশ সেটিকেও আনন্যাচারাল ডেথ বলে এবার হয়তো ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেবে। অথচ, আগেই বলেছি যে, বুধনের লাশ দেখে আমার কেন মনে হয়েছিল যে, এটা কোন অপ্রাকৃত ঘটনার ফল নয়, অপারেশন টেবিলে করা কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। কেন সেই মার্ডার হল, তা তদন্তসাপেক্ষ এবং আমার আওতার বাইরে, কিন্তু মেডিক্যাল কেস হিসাবে যে ছেলেটি নকল বুধন সেজে প্রকৃত বুধনের মৃত্যুর পরে এসে কাটিয়ে গেল তারই বাড়িতে, তাকে খোঁজাটা আমার জরুরি বলে মনে হয়েছিল, কারণ তাকে খুঁজে পেলে হয়তো আমি কান টানলে মাথা আসের মতো প্রকৃত মাথা না-হোক, মাথার একতা আভাস পেতে পারবো। এই কারণেই আমি সেই নকল বুধনের তত্ত্বতালাশ করতে থাকি! আপনারা জানেন না, আমার এখানে একজন শ্তাফ আছেন, ন্যাথানিয়েল গোবিন্দ সোরেন, লোকটি হচ্ছে লোক্যাল গেজেট। প্রায় সব মানুষের নাড়িনক্ষত্র তার কন্ঠস্থ। গসিপের খনি, আর কী-দারুণ নেটওয়ার্ক! আশে-পাশের দশটা জায়গায় কী ঘটছে না-ঘটছে, সব গড়গড় করে বলে দিতে পারে। তবে হ্যাঁ, উস্কে দিতে হবে, নিজের থেকে মুখ খুলবে না। বলতে দ্বিধা নেই, আমি গোবিন্দের উপরেই ভরসা করলাম বেশি এবং শেষ পর্যন্ত যে নকল বুধনের খোঁজ পেলাম, তার প্রধান কৃতিত্ব ন্যাথানিয়েল গোবিন সোরেনেরই।”
শুনে সুদীপ্ত চেয়ার থেকে প্রায় উঠেই পড়ে! “আপনি নকল বুধনের খোঁজ পেয়েছেন? বলুন, সে কে? এক্ষুনি তাকে অ্যারেস্ট করবো! ভারতীয় ন্যায়সংহিতায় প্রতারণার ধারায় তাকে কোর্টে তুলতে বিন্দুমাত্র দেরি হবে না!”
শাক্য বলল, “ধৈর্য্যং রহু। আগে ডক্টরের সম্পূর্ণ কথাটা শুনে নিন, তারপরে অ্যাকশন নেবেন না-হয়! এতদিন দেরি হয়েছে, আর আধ ঘন্টা দেরি হলেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না!”
সুদীপ্ত কোনওক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে কৌতূহলী হয়ে সত্যব্রতর দিকে মনোযোগ দিল।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৪: আততায়ী এক, নাকি দুই?
সত্যব্রত শাক্যর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার জানার কথা নয়, তবে সুদীপ্তবাবু নিশ্চয়ই শুনেছেন, যদিও এই থানার ব্যাপার নয়, পলাশতলি থানার জুরিশডিকশনে পড়ে। বুধনের কেসটি ঘটার মাস দুয়েক আগে, পলাশতলিতে একদল বেদে এসে ডেরা বাঁধে। বেদেরা এ-অঞ্চলে প্রায় ফি-বছরই আসে। ফলে তাদের আসাটা কোন নতুন ব্যাপার নয়। হাত দেখা, নানা রকম খেলা দেখানো, জীবনের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য নানারকম শেকড়বাকড় দেওয়া—এইসবই করে তারা। এ বারের এই দলটি কিন্তু সে-সবের অতিরিক্ত আর-একটি অভিনব ব্যাপার করেছিল, ফলে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
সার্কাসে যেমন তাঁবু খাটিয়ে নানারকম খেলা দেখায়, ট্যাপিজের খেলা থেকে জোকার, এরাও মিনি সার্কাস নাম দিয়ে একখানা সার্কাস খুলেছিল, তাতে পশুপাখির বদলে নানারকম অদ্ভুত মানুষ এবং অদ্ভুত সব খেলা ইন্ট্রোডিউস করেছিল। ওদের মূল তাঁবুগুলির পাশে, কিছুটা বড় মাঝারিগোছের একখানা তাঁবু, সেখানে বড়জর ষাট-সত্তর জন মানূষ একসঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারে।
চারদিকে গোল হয়ে বসার ব্যবস্থা, মাঝখানে খেলা দেখানো হয়। বড় জোর ঘণ্টা খানেকের শো এক-একেকটা। টিকিটের দাম খুব কম, সামনের সারি—পঁচিশ টাকা, মাঝখানের সারি কুড়ি আর পিছনের সারিতে বসলে পনেরো টাকা। সাধারণ কিছু খেলা আছে, এক চাকার সাইকেল, মাথায় পরপর কলসী বসিয়ে সরু দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলি আসল অ্যাট্রাকশন নয়। এগুলির পাশাপাশি, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী কিংবা অন্য কোন সমস্যা আছে, এমন মানুষদের দিয়ে যে-সব খেলা দেখানো হত, সেগুলিই ছিল মূল আকর্ষণ। যেমন—একজন অন্ধ মানুষ এসে উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে থেকে যে-কাউকেই দেখানো হত, তাঁর পোশাক-আশাক থেকে মুখমন্ডল ইত্যাদি সম্পর্কে সব ঠিকঠাক বলে দেওয়া। এটি অবশ্য খুব কমন ট্রিকস্। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সেই অন্ধ খেলোয়াড়টির ছিল মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। কানটান ঢেকে এবার কাঁধে এসে পড়বে যেন। এমনটি হওয়াই সঙ্গত। তাহলে আজকের এই প্রযুক্তির যুগে কানে আঁটা এয়ার-বাড্সে যেমন-যেমন নির্দেশ আসছে, তেমনটি শুনে নিখুঁতভাবে সব বলে দেওয়া কোন ব্যাপারই না। বেদে বলে তারা আজকের প্রযুক্তি ব্যবহার করবে না, এমনটি তো তারা মাথার দিব্যি দেয়নি? তেমনই হাঁটুর নীচ থেকে পা নেই, এমন বাচ্চার সাইকেল চালানো আসলে আধুনিক রিমোট কন্ট্রোল প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়।
সার্কাসে যেমন তাঁবু খাটিয়ে নানারকম খেলা দেখায়, ট্যাপিজের খেলা থেকে জোকার, এরাও মিনি সার্কাস নাম দিয়ে একখানা সার্কাস খুলেছিল, তাতে পশুপাখির বদলে নানারকম অদ্ভুত মানুষ এবং অদ্ভুত সব খেলা ইন্ট্রোডিউস করেছিল। ওদের মূল তাঁবুগুলির পাশে, কিছুটা বড় মাঝারিগোছের একখানা তাঁবু, সেখানে বড়জর ষাট-সত্তর জন মানূষ একসঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারে।
চারদিকে গোল হয়ে বসার ব্যবস্থা, মাঝখানে খেলা দেখানো হয়। বড় জোর ঘণ্টা খানেকের শো এক-একেকটা। টিকিটের দাম খুব কম, সামনের সারি—পঁচিশ টাকা, মাঝখানের সারি কুড়ি আর পিছনের সারিতে বসলে পনেরো টাকা। সাধারণ কিছু খেলা আছে, এক চাকার সাইকেল, মাথায় পরপর কলসী বসিয়ে সরু দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলি আসল অ্যাট্রাকশন নয়। এগুলির পাশাপাশি, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী কিংবা অন্য কোন সমস্যা আছে, এমন মানুষদের দিয়ে যে-সব খেলা দেখানো হত, সেগুলিই ছিল মূল আকর্ষণ। যেমন—একজন অন্ধ মানুষ এসে উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে থেকে যে-কাউকেই দেখানো হত, তাঁর পোশাক-আশাক থেকে মুখমন্ডল ইত্যাদি সম্পর্কে সব ঠিকঠাক বলে দেওয়া। এটি অবশ্য খুব কমন ট্রিকস্। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সেই অন্ধ খেলোয়াড়টির ছিল মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। কানটান ঢেকে এবার কাঁধে এসে পড়বে যেন। এমনটি হওয়াই সঙ্গত। তাহলে আজকের এই প্রযুক্তির যুগে কানে আঁটা এয়ার-বাড্সে যেমন-যেমন নির্দেশ আসছে, তেমনটি শুনে নিখুঁতভাবে সব বলে দেওয়া কোন ব্যাপারই না। বেদে বলে তারা আজকের প্রযুক্তি ব্যবহার করবে না, এমনটি তো তারা মাথার দিব্যি দেয়নি? তেমনই হাঁটুর নীচ থেকে পা নেই, এমন বাচ্চার সাইকেল চালানো আসলে আধুনিক রিমোট কন্ট্রোল প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
বাচ্চাদের এ-জাতীয় খেলনার বড় সংস্করণ আর-কী! যাই হোক, এই রকমই একটি খেলা দেখানো হত এই মিনি সার্কাসে— গর্ভবান ছেলের দড়ির উপর দিয়ে ব্যালেন্সস্টিক নিয়ে খেলা! একটি ছেলে, মুখে রঙচঙে মুখোশ পরে, হাতে ব্যালেন্সস্টিক নিয়ে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটছে, এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল না, কিন্তু লোক ভেঙে পড়েছিল এটা দেখতেই যে, ছেলে হয়েও সে প্রেগন্যান্ট, এই আশ্চর্য ব্যাপার প্রত্যক্ষ করার জন্য। আসল বুধনের হাইট আমি যা জেনেছি, খুব লম্বাচওড়া ছিল না, তবে শক্তপোক্ত ছিল। বেদেদের দলের এই ছেলেটিরও হাইট বেশি নয়, কিন্তু ওই রকম ব্যালেন্সের খেলা দেখাতে গেলে যে-ধরনের শক্তিসামর্থ্যের দরকার, তার উপযুক্ত ছিল ছেলেটির শরীর। মুখে রঙচঙে মুখোশ পরে থাকায় তার প্রকৃত চেহারা কারুর পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না। কেউ আলাদা করে কৌতূহলী হলে তাকে বলা হত, ছেলেটি যেহেতু প্রেগন্যান্ট, অসুস্থ, ফলে তার সঙ্গে কাউকে আলাদা করে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। এটা আমি খোঁজখবর করে জেনেছি। ওরা অবশ্য বিশেষ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে এবং মিনি সার্কাসে খেলা দেখায়, এমন কারুর সঙ্গেই আলাদাভাবে বাইরের কাউকেই দেখা করতে দিচ্ছিল না।
তবে নতুন খেলার কথা মুখে-মুখে চাউর হয়ে যাওয়ায় হোক, কিংবা অন্যান্য বারের তুলনায় কিছুটা অভিনব বলেই হোক, যে-ক’দিন বেদের দলটি ছিল, লোক একেবারে ভেঙে পড়েছিল। আমাদের এই পিশাচপাহাড় থেকেও অনেকে সেই মিনি সার্কাস দেখতে গিয়েছিল। এই সমস্ত রিমোট জায়গায় অ্যামিউজমেন্টের ব্যবস্থা তেমন নেই। শহুরে মানুষ দু’দিনের জন্য যে টিলা, শাল-পলাশের গাছ দেখে আনন্দে অধীর হয়ে ওঠে, জন্মাবধি সে-সব দেখার ফলে স্থানীয় মানুষদের সে-সব দেখে আর কোন আনন্দ-স্ফূর্তি হয় না। ফলে বেদের দলের এই খেলা যে-স্থানীয় মানুষদের কৌতূহলী করে তুলবে, তাতে আর সন্দেহ কি?”
সত্যব্রত একটানা বলে একটু থামলেন। শাক্য এবং সুদীপ্ত দুজনেই নীরবে শুনছিল। কেউই কোন প্রশ্ন বা কিছু প্রতিক্রিয়া জানাল না। বোঝাই যাচ্ছিল যে, সত্যব্রতর বক্তব্য এখনও শেষ হয় নি। অতএব তারা দুজনেই সত্যব্রতর কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল।
তবে নতুন খেলার কথা মুখে-মুখে চাউর হয়ে যাওয়ায় হোক, কিংবা অন্যান্য বারের তুলনায় কিছুটা অভিনব বলেই হোক, যে-ক’দিন বেদের দলটি ছিল, লোক একেবারে ভেঙে পড়েছিল। আমাদের এই পিশাচপাহাড় থেকেও অনেকে সেই মিনি সার্কাস দেখতে গিয়েছিল। এই সমস্ত রিমোট জায়গায় অ্যামিউজমেন্টের ব্যবস্থা তেমন নেই। শহুরে মানুষ দু’দিনের জন্য যে টিলা, শাল-পলাশের গাছ দেখে আনন্দে অধীর হয়ে ওঠে, জন্মাবধি সে-সব দেখার ফলে স্থানীয় মানুষদের সে-সব দেখে আর কোন আনন্দ-স্ফূর্তি হয় না। ফলে বেদের দলের এই খেলা যে-স্থানীয় মানুষদের কৌতূহলী করে তুলবে, তাতে আর সন্দেহ কি?”
সত্যব্রত একটানা বলে একটু থামলেন। শাক্য এবং সুদীপ্ত দুজনেই নীরবে শুনছিল। কেউই কোন প্রশ্ন বা কিছু প্রতিক্রিয়া জানাল না। বোঝাই যাচ্ছিল যে, সত্যব্রতর বক্তব্য এখনও শেষ হয় নি। অতএব তারা দুজনেই সত্যব্রতর কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত
সত্যব্রত সামনে ঢাকা দেওয়া গ্লাস থেকে সামান্য জল খেলেন, খেয়ে বললেন, “দেখুন, ম্যাজিক মানেই ট্রিকস্, তাকে সার্কাস বা অন্য যা-খুশি নাম দেওয়াই হোক না কেন, আসল কথা হল লোকের চোখে ধোঁকা দিয়ে আশ্চর্যজনক বলে মনে হবে এমন কিছু করার নামই ম্যাজিক। অতএব বেদেরা নানারকম কৌশল অবলম্বন করে ম্যাজিক-ট্যাজিক দেখাবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমিও হইনি। আমার মূল লক্ষ্য ছিল সেই ছেলেটি, যে কি-না পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও প্রেগন্যান্ট, এবং প্রেগন্যান্সি নিয়েই দড়ির খেলা দেখাচ্ছে। প্রথম কথা হল, এই অবস্থায় তাকে খেলায় নামানো কিছুটা অদ্ভুত, যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নিই যে, প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে সে প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছে। এখন প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছে মানে, তার নিশ্চয়ই কোন সক্ষম পার্টনার ছিল।
আজকের দিনে এই সমস্ত ঘটনা আর অদ্ভুত বা অস্পৃশ্য নয়। গোবিন্দ আমাকে খবর এনে দেয় যে, মিনি সার্কাসের রিং-মাস্টারের সে খাস লোক। রিং-মাস্টারও বেদের দলেরই একজন। বেদেরা সচরাচর বাইরের কাউকে তাদের মূল দলভুক্ত করে না। তাদের বিবাহাদিও হয় দলের মধ্যেই। যাই হোক, এই রিং-মাস্টারটি যদি সেই নকল বুধনের পার্টনার কাম গাইড হয়, তাহলে যারা ছেলেটিকে ভাড়া করেছিল, তাদের সে চিনবে। কারণ, আমার মনে হয় না যে, নকল বুধনকে আসল বলে পুনর্জীবিত করার কোন পরিকল্পনা বেদের দলটি আসবার আগে ছিল। সম্ভবত মিনি সার্কাসে ওই খেলাটি দেখেই এই পরিকল্পনার কথা তাদের মাথায় আসে। সেক্ষেত্রে নকল বুধনের সঙ্গে আসল বুধনের কিছুটা সাদৃশ্য থাকা দরকার, তা-না-হলে ধরা পড়ার চান্স প্রবল। এই কারণেই আমি যখন গোবিন্দকে নিয়ে পলাশতলি যাই, তখন বুধনের একটা ফোটো জোগাড় করি। আমি মনে করি কিছুটা হলেও সাদৃশ্য ছিল দুজনের মধ্যে।
যারা মিনি সার্কাস দেখেছিল, তাদের অবশ্য বুধনের ছবি দেখিয়ে লাভ নেই, কারণ, নকল বুধন খেলা দেখানর সময় রংচঙে মুখোশ পরত। আমি যদিও আসল বুধনের বাড়ি থেকে তার মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ডে থাকা ছবির একটা স্ন্যাপ তুলে নিয়েছিলাম আমার মোবাইলে, কিন্তু সেটা দেখে নকল বুধনকে চিহ্নিত করা অসম্ভব ছিল, যেহেতু কেউই তার মুখ দেখেনি। কিন্তু এখানেই একটা মির্যা কেল ঘটল! আমরা ভাবিনি যে, আমাদের অনুসন্ধানের ফলে সেই চমকপ্রদ তথ্যটি আমরা পেয়ে যাবো, যার ফলে আমাদের প্রমাণ করা সহজ হয়ে যাবে যে, নকল বুধন আর কেউ নয়, ওই সার্কাসের ফলস্ প্রেগন্যান্সি নিয়ে খেলা দেখানো ছেলেটিই!”
শাক্য এবং সুদীপ্ত দুজনেই প্রায় একইসঙ্গে বলে উঠল, “মির্যাাকেলটা কী?”
সত্যব্রত তাদের দুজনের কৌতূহল দেখে মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন, “বলছি…” —চলবে।
আজকের দিনে এই সমস্ত ঘটনা আর অদ্ভুত বা অস্পৃশ্য নয়। গোবিন্দ আমাকে খবর এনে দেয় যে, মিনি সার্কাসের রিং-মাস্টারের সে খাস লোক। রিং-মাস্টারও বেদের দলেরই একজন। বেদেরা সচরাচর বাইরের কাউকে তাদের মূল দলভুক্ত করে না। তাদের বিবাহাদিও হয় দলের মধ্যেই। যাই হোক, এই রিং-মাস্টারটি যদি সেই নকল বুধনের পার্টনার কাম গাইড হয়, তাহলে যারা ছেলেটিকে ভাড়া করেছিল, তাদের সে চিনবে। কারণ, আমার মনে হয় না যে, নকল বুধনকে আসল বলে পুনর্জীবিত করার কোন পরিকল্পনা বেদের দলটি আসবার আগে ছিল। সম্ভবত মিনি সার্কাসে ওই খেলাটি দেখেই এই পরিকল্পনার কথা তাদের মাথায় আসে। সেক্ষেত্রে নকল বুধনের সঙ্গে আসল বুধনের কিছুটা সাদৃশ্য থাকা দরকার, তা-না-হলে ধরা পড়ার চান্স প্রবল। এই কারণেই আমি যখন গোবিন্দকে নিয়ে পলাশতলি যাই, তখন বুধনের একটা ফোটো জোগাড় করি। আমি মনে করি কিছুটা হলেও সাদৃশ্য ছিল দুজনের মধ্যে।
যারা মিনি সার্কাস দেখেছিল, তাদের অবশ্য বুধনের ছবি দেখিয়ে লাভ নেই, কারণ, নকল বুধন খেলা দেখানর সময় রংচঙে মুখোশ পরত। আমি যদিও আসল বুধনের বাড়ি থেকে তার মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ডে থাকা ছবির একটা স্ন্যাপ তুলে নিয়েছিলাম আমার মোবাইলে, কিন্তু সেটা দেখে নকল বুধনকে চিহ্নিত করা অসম্ভব ছিল, যেহেতু কেউই তার মুখ দেখেনি। কিন্তু এখানেই একটা মির্যা কেল ঘটল! আমরা ভাবিনি যে, আমাদের অনুসন্ধানের ফলে সেই চমকপ্রদ তথ্যটি আমরা পেয়ে যাবো, যার ফলে আমাদের প্রমাণ করা সহজ হয়ে যাবে যে, নকল বুধন আর কেউ নয়, ওই সার্কাসের ফলস্ প্রেগন্যান্সি নিয়ে খেলা দেখানো ছেলেটিই!”
শাক্য এবং সুদীপ্ত দুজনেই প্রায় একইসঙ্গে বলে উঠল, “মির্যাাকেলটা কী?”
সত্যব্রত তাদের দুজনের কৌতূহল দেখে মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন, “বলছি…” —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।