শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

রুমটি প্রায়ান্ধকার। জানালার ভারি পর্দাগুলি সব ভালো করে টানা। পড়ন্ত বিকেলের রোদের আভা যে তাতে সম্পূর্ণ আটকানো গেছে, এমনটা নয়। সারা ঘরময় একটা মিহিন কুয়াশার মতো আলো ছড়িয়ে আছে। ঘরের মধ্যে কুলার চলছে, ফলে রুমের ভিতরের আবহাওয়া খুব মনোরম। বাইরের তপ্ত চাটুর মতো গনগনে হাওয়া রুমের ভিতরে একরত্তিও নেই।

এই মুহূর্তে হোটেলের এই রুমের বাসিন্দাটি বিছানার উপর বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। তার একাগ্র দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। এই মুহূর্তে সে একটা ফিচার লিখে পাঠাচ্ছিল। সে কেবল কবিতা লেখে না, ফিচারও লেখে। তবে নিজের নামে নয়, ছদ্মনামে। কবিতাই কেবল লেখে নিজের নামে। তার কবিতা কলকাতার সমস্ত নামি-দামি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। সব পত্রিকা যে টাকাপয়সা দেয়, তা নয়। তবে কেউ কেউ দেয়। পূজাসংখ্যায় কবিতা লিখে সে আটশো টাকা পর্যন্ত পেয়েছে। কিন্তু ছদ্মনামে ফিচার লিখলে সে হাজার-দু’ হাজার পর্যন্ত পায়। আবার অনেক পত্রপত্রিকায় লিখে শ’ তিনেকও পায়। তবে কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় অতি সাধারণ মানের কবিতা পড়ে “আহা, উহু’ করে, কিন্তু তার বাইরে ভালো কবিতার কদর করে সামান্য কয়েক জন। এরা মোবাইলে যতটা স্বচ্ছন্দ, পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে ততটা নয়। এমনিতেই প্যানডেমিকের পরে অনেক পত্র-পত্রিকা বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে চিরতরে, তার উপর ক্রমাগত যে-ভাবে পাঠকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তাতে মনে হয়, আগামী দশ বছরে পত্রপত্রিকা বলতে আর কিছু থাকবে না, সকলেই তখন শর্ট ফিল্মের ক্রিয়েটর বনে যাবে। কেউ আর কবিতা পড়বে না। এই কথা ভেবেই সে গদ্যে হাত পাকানর জন্য ফিচার লেখা শুরু করে। প্রথম-প্রথম লজ্জাবশত ফিচার লিখত ছদ্মনামে, পরে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তার আর-একটা নাম। যদিও এই নামের আড়ালে যে কবি মানুষটি লুকিয়ে আছে, তার কথা এখনও কেউ জানে না। কারণ, সে এই পরিচয়টা বাইরে প্রকাশ করে না।
এখন সে লিখছিল স্থানীয় মিথ, কিংবদন্তীনির্ভর একটি ধারাবাহিক রচনার গুরুত্বপূর্ণ এপিসোডের পরের কিস্তি। এই লেখাটি সে খুব মনোযোগের সঙ্গে লিখছিল, কারণ লেখাটির আগের এপিসোডগুলি পাঠকের খুব পছন্দ হয়েছে, ফলে সম্পাদক তাকে আরও পর্ব লিখে জমা দিতে বলেছেন। দরকার হলে এরপর পর্ব পিছু আটশোর জায়গায় হাজার করে দেবেন ঠিক করেছেন। টাকা হিসেবে এক হাজার নিতান্ত মামুলি ব্যাপার নয়, আবার খুব বেশিও নয়। তবুও স্রষ্টা যখন উপহারস্বরূপ কিছু পান, তা সে পাঠকের ভালোবাসাই হোক, সে-সব তাঁদের আপ্লুতই করে। বর্তমান লেখকও আপ্লুতই হচ্ছিল। কয়েকটা পত্রিকা থেকে লেখার অফার এসেছে। আমন্ত্রিত লেখক বলে টাকাও পাওয়া যাবে। সেটাই আনন্দের কারণ। টাকা ছাড়া যে জীবন অচল, সে-কথা কবি-মানুষটি আজ হাড়ে-হাড়ে জানে। বচ্‌পনে সে-কথা বুঝত না, কত নাদান্‌ ছিল সে। তখন রোম্যান্টিকতার ভূত ঘাড়ে চেপেছিল। চাঁদ-ফুল-জোছনার কথা মনে-মনে গাথা হয়ে উঠত, জন্ম দিত এক-একটা নার্সিসাস ফুলের। নিজের সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে নিজেকে মনে হত প্রজাপতি ব্রহ্মার সমান। কিন্তু তখন পেট ভরত না। অথচ নিজেই বিশ্বাস করত যে, সপ্তাহান্তে একবার বারে গিয়ে পানাহার না করলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় হওয়া যায় না! কিংবা কমলকুমার মজুমদার! বন্ধুরা এইসব কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ত, যেন সে জোকার। সে চিৎকার করে বলতে চাইত, “না আমি জোকার নই। স্টপ্‌ ইট্!” কিন্তু কে-কার কথা শোনে? বাকিরা হাসত। হেসে গড়িয়ে পড়ত। তারপরেই এক অদ্ভুত উপায়ে বন্ধ হয়ে যেত সেই হাসি!
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৭: নকল বুধন মাহাতো

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ

এখন সে লিখছিল স্থানীয় মিথ, কিংবদন্তীনির্ভর একটি ধারাবাহিক রচনার গুরুত্বপূর্ণ এপিসোডের পরের কিস্তি। এই লেখাটি সে খুব মনোযোগের সঙ্গে লিখছিল, কারণ লেখাটির আগের এপিসোডগুলি পাঠকের খুব পছন্দ হয়েছে, ফলে সম্পাদক তাকে আরও পর্ব লিখে জমা দিতে বলেছেন। দরকার হলে এরপর পর্ব পিছু আটশোর জায়গায় হাজার করে দেবেন ঠিক করেছেন। টাকা হিসেবে এক হাজার নিতান্ত মামুলি ব্যাপার নয়, আবার খুব বেশিও নয়। তবুও স্রষ্টা যখন উপহারস্বরূপ কিছু পান, তা সে পাঠকের ভালোবাসাই হোক, সে-সব তাঁদের আপ্লুতই করে। বর্তমান লেখকও আপ্লুতই হচ্ছিল। কয়েকটা পত্রিকা থেকে লেখার অফার এসেছে। আমন্ত্রিত লেখক বলে টাকাও পাওয়া যাবে। সেটাই আনন্দের কারণ। টাকা ছাড়া যে জীবন অচল, সে-কথা কবি-মানুষটি আজ হাড়ে-হাড়ে জানে। বচ্‌পনে সে-কথা বুঝত না, কত নাদান্‌ ছিল সে। তখন রোম্যান্টিকতার ভূত ঘাড়ে চেপেছিল। চাঁদ-ফুল-জোছনার কথা মনে-মনে গাথা হয়ে উঠত, জন্ম দিত এক-একটা নার্সিসাস ফুলের। নিজের সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে নিজেকে মনে হত প্রজাপতি ব্রহ্মার সমান। কিন্তু তখন পেট ভরত না। অথচ নিজেই বিশ্বাস করত যে, সপ্তাহান্তে একবার বারে গিয়ে পানাহার না করলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় হওয়া যায় না! কিংবা কমলকুমার মজুমদার! বন্ধুরা এইসব কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ত, যেন সে জোকার। সে চিৎকার করে বলতে চাইত, “না আমি জোকার নই। স্টপ্‌ ইট্!” কিন্তু কে-কার কথা শোনে? বাকিরা হাসত। হেসে গড়িয়ে পড়ত। তারপরেই এক অদ্ভুত উপায়ে বন্ধ হয়ে যেত সেই হাসি!
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ

সবে আবার লেখায় মন দিয়েছে, এমনসময় মৃদু আওয়াজ করে মোবাইল সক্রিয় হয়ে উঠে জানান দিল। হাতে নিয়ে দেখল সে, চেনা মানুষের ফোন। সামান্য ভেবে সে ফোন হাতে তুলে নিল। তারপর রিসিভ করে চাপা গলায় বলল, “এখন ফোন করেছ কেন?”
“লেখা শেষ?”
“নাহ্‌, লিখছি। কোনো দরকার আছে? এনি প্রবলেম?”
“কেন? তুমি কি পীর-গাজি না-কি? সব মুশকিল আসান করে দেবে?”
“ইয়ার্কি রাখো। এখন ফোন করো না। কে জানে, কে আবার কোথায় শুনে ফেলবে?”
“পাগল না-কি আমি ? ওয়াশরুমের ভিতরে ঢুকে ফোন করছি।”
“কী দরকার তাড়াতাড়ি বলো। তুমি তো জানো আজকের ভিতর লেখাটা পাঠাতে হবে!” বিরক্ত হল লেখক।
“এমন ভাব দেখাচ্ছ যেন তুমি রবীন্দ্রনাথ কিংবা সুনীল-শীর্ষেন্দু! তোমার লেখার জন্য সম্পাদক হা-পিত্যেশ করে বসে আছেন। নাহ্‌, বসে নেই। কারণ, তুমি না-লিখলেও পত্রিকা দিব্যি চলে যাবে, যেমন যাচ্ছে।”
“এইসব কথা বলবার জন্য ফোন করেছ?”
“না!”
“তবে?”
“জরুরি কথা আছে। নাহলে তোমায় আমি কখনও এই সময় ফোন করি? তোমার লেখার সময়ে আমি কোনোদিন কোনো ডিসটার্ব করেছি এর আগে?”
মাথা নেড়ে লেখককে অগত্যা সায় দিতে হল ও-পারের কথককে। তারপর চাপা গলায় বলল লেখক, “জরুরি কথাটা বলে ফেলো!”
“আচ্ছা, অনিলের খুনী কে বলে তোমার মনে হয়?”
“আমি কি গোয়েন্দা, না-কি স্নিফার ডগ্‌ যে বলে দেবো কে অনিলকে খুন করেছে? অনিলকে যখন মারা হয়, তখন আমি এখানে ছিলাম?”
“কেন ছিলে না, এটাই তো সকলের প্রশ্ন। তুমি কি জানতে যে অনিল খুন হবে ওই সময়, সেই কারণেই কি ওই সময়টুকু পার করে তুমি এসেছিলে?”
“না, না! কী বোকার মতো কথা বলছ তুমি? আমি জ্যোতিষশাস্ত্র জানি না, বিশ্বাসও করি না, অতএব অনিলের মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি পুলিশকেও তো একই কথা বলেছি।”
“বলেছ, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারোনি!”
“মানে ?”
“ওরা কিন্তু সকলের সঙ্গে তোমাকেও সন্দেহ করছে!”
“কোন্‌ ব্যাপারে?”
“অনিলের হত্যা!”
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

“রাবিশ্! তদন্তের গোড়ার দিকে সক্কলকে সন্দেহ করাটাই কাজ! তারপর তদন্ত-প্রক্রিয়া যত এগুবে, ততই সন্দেহভাজন এবং নিরপরাধ সবাইকে তারা বাদ দেবে আস্তে-আস্তে। তাছাড়া আমার অ্যালিবি পাকা। আমি তো বলেছি যে, আমি কোথায় ছিলাম! দরকার হলে তারা সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে নেবে! আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে?”
“আজ বেশ মুডে আছো দেখছি। যাক্‌, এটা যদি তোমার জরুরি কথা হয়, তা-হলে আমার বক্তব্যও শুনে নিয়েছ আশা করি। এখন রাখলাম।”
“আরে রাখি রাখি করো না। শোনো, কথাটা তোমাকে ফোনে বলতে চাই না। তোমার কাছে যাবো?”
“এখন? এ-সময়ে? তোমাকে বললাম তো আমি লিখছিলাম। এখন এলেও তোমার মনোরঞ্জন করার জন্য আমার হাতে সময় নেই !” একটু রাগত স্বরে বলল লেখক!”
“তা বললে চলে? সময় তোমাকেই বার করে নিতে হবে! নাহলে তুমি তো জানো… ভিডিওটা সরাসরি পুলিশের হাতে চলে গেলে, তুমিই বিপদে পড়বে!” এবার আর ও-পারের বক্তব্যে গলায় বন্ধুত্বের সুর নেই, কেমন যেন চাপা শাসানি আছে।
“তুমি তাহলে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছ আমাকে?”
“একেবারেই নয়। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ করলাম। সিগারেট প্যাকেটে লেখা থাকে দেখনি?”
“তুমি কী চাও?”
“আপাতত তোমার সময়!”
“এইভাবে আর কতদিন? তুমি ভিডিওটি ডিসক্লোজ করলে কেবল আমি ফাঁসবো না, তোমরা সকলেই কম-বেশি ফেঁসে যাবে। ফলে আমি জানি, ওটা তুমি পাবলিক করবে না।”
“নতুন প্রযুক্তির কিছুই জানো না তুমি। আজকাল কত কিছুকে চোখের পলকে ‘নেই’ করে দেওয়া যায়, আবার বিপরীত দিক থেকে যুক্তও করা যায়, তা জানলে এমন নিশ্চিন্তভাবে কথাটা বলতে পারতে না!”
আরও পড়ুন:

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

“আমার কথা আমি তো বলেই দিয়েছি, তুমি কী করতে পারো, না-পারো—সব আমার জানা আছে। যাই হোক, তুমি যা বলছ, তা পাবে। কিন্তু এই শেষবার। আর পাবে না! আমি হাঁফিয়ে উঠেছি। কী কুক্ষণে আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলাম! নাহলে আজ…”
“পালিয়ে যেতে চাইছ?”
“ধরে নাও তা-ই!”
“পালাবার পথ নেই। তোমার-আমার কুটো সব এক জায়গায় বাঁধা। লেখাটা শেষ করে ফেলো। আমি রাতে যাবো। তখনই বলব জরুরি কথা। অনেকক্ষণ ওয়াসরুমে আছি। ও সন্দেহ করলে বিপদ হতে পারে। আর একটা কথা মনে রাখবে, তুমি আমাকে দয়া করছ না, আমি তোমাকে করছি। দয়া না করলে এখন শ্রীঘরে দিন কাটত তোমার। কথাটা মনে রেখো। রাখছি”, বলে ও-প্রান্তের ব্যক্তি ফোন কেটে দিল।
অন্ধকার ঘরে খোলা ল্যাপটপের আলোয় লেখকের মুখ যতটুকু দেখা যাচ্ছিল, তাতে জিঘাংসা, হতাশা আর ক্রুরতা খেলা করে বেড়াচ্ছিল। খুব মৃদু গলায় লেখক একটা কথাই বার-বার আওড়াচ্ছিল, “পালাবার পথ নেই! পালাবার পথ নেই!”—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content